আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘জনাব বিএনপি’, হরতালের পর কী?

সবুজের বুকে লাল, থাকবে চিরকাল

আগামীকালের হরতাল নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি। নেতারা বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত। এক পক্ষ বলছে, হরতালের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে কঠোর হাতে তা দমন করা হবে। অন্য পক্ষ আওয়াজ তুলেছে, হরতালে বাধা দিলে প্রতিহত করা হবে। দুই দশক ধরেই দেশে দমন আর প্রতিহত করার গণতন্ত্র চলছে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বীকার করেছেন, হরতালে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে এবং দেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু সরকার যেহেতু আরও বেশি ক্ষতি করছে, তার প্রতিবাদে তাদের হরতাল ডাকতে হয়েছে। কী সর্বনাশা যুক্তি! সরকার গণবিরোধী কাজ করে দেশের ক্ষতি করছে। অতএব বিরোধী দলও চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। তারাও জনগণের দুর্ভোগ বাড়াতে একটি হরতাল পালন করছে।

এই হরতালে বাধা দিলে বিরোধী দল আবার হরতাল দেবে। সরকারও কঠোর হতে সেই হরতাল দমন করতে চাইবে। জনগণের ক্ষতি বাড়বে। মনে হচ্ছে, দুই পক্ষই দেশ ও জনগণের সর্বনাশ করতে আঁটসাঁট বেঁধে মাঠে নেমেছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, হরতাল করা তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার।

কিন্তু সরকার অগণতান্ত্রিকভাবে তাঁদের শান্তিপূর্ণ প্রচারে বাধা দিচ্ছে। অশান্তিপূর্ণ হরতালের পক্ষে শান্তিপূর্ণ প্রচার! অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের দাবি, দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য বিরোধী দল হরতাল ডেকেছে। যদি তারা জোর করে দোকানপাট বন্ধ করে, রাস্তায় যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তাঁরা বিরোধী দলকে হরতাল প্রত্যাহার করে সংসদে এসে তাদের বক্তব্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব জবাবে বলেছেন, ‘সংসদে আমরা যেতে চাই।

কিন্তু সরকারি দল সংসদে যাওয়ার পরিবেশ রাখেনি। সারা দেশে তাঁদের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। ’ বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের (কতটা গণতান্ত্রিক, তা নিয়ে বিতর্ক আছে) অভিজ্ঞতা হলো, যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরা সংসদকে না-জায়েজ মনে করেন, যাঁরা সরকারে থাকেন, তাঁরা বিরোধী দলকে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৯৯১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালা করে দেশ শাসন করছে, কখনো আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও বামদের সঙ্গে নিয়েছে, আবার কখনো বিএনপি জামায়াতে ইসলামীকে পক্ষভুক্ত করেছে। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ফল বলে দেয়, এককভাবে তারা ক্ষমতায় যেতে অপারগ।

কিন্তু ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দুটি দলই বিশাল ব্যবধানে জয়ী এবং পরবর্তী নির্বাচনে তার চেয়েও বেশি ব্যবধানে পরাজিত। এই অস্বাভাবিক জয়-পরাজয় কেন ঘটেছে, তা একবারও কোনো দলের নেতৃত্ব পর্যালোচনা করে দেখেননি। করলে বুঝতে পারতেন, এতে বিজয়ী দলের কৃতিত্ব নেই। ১৯৯৬—২০০১ সালে আওয়ামী লীগ যদি দুর্নীতি-সন্ত্রাস-দলীয়করণের জন্য পরাজিত হয়ে থাকে, ২০০১—২০০৬ সালের বিএনপির পরাজয়ের পেছনে সেসব উপাদানের সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছিল মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ তোষণ, দেশব্যাপী বোমাবাজি, সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রভৃতি। বিএনপি দাবি করছে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সরকারের দেশবিরোধী চুক্তি সইয়ের প্রতিবাদে ২৭ জুনের হরতাল ডাকা হয়েছে।

হরতাল করে কি জিনিসপত্রের দাম কমানো যায়? হরতাল করলে বন্দরে পণ্য খালাস হবে না, ট্রাক-লরি বন্ধ থাকবে। এতে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে। হরতাল করে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করা যায়, তা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। বরং হরতালে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার আশঙ্কা থাকে। হরতাল ডাকা মানে সংঘাত-সংঘর্ষকে উসকে দেওয়া।

বিএনপির তৃতীয় দাবি, দেশবিরোধী চুক্তি। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দিয়েছে, তা স্পষ্ট করে বলছে না। আওয়ামী লীগ সরকার এখন পর্যন্ত এমন কিছু করেনি, যার সূচনা বিএনপি করে যায়নি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারতে গ্যাস রপ্তানি করতে চেয়েছিল। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেছিলেন, ‘গ্যাস মাটির নিচে রেখে লাভ কী?’ আজ ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে এত কথা উঠেছে, তাও শুরু করেছিল বিএনপি।

সড়ক ও নৌপথে পণ্য আনা-নেওয়া কি তখন বন্ধ ছিল? চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার নিয়ে এখনো ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর যুক্ত ইশতেহারে মতৈক্য হয়েছে মাত্র। চুক্তি আর যুক্ত ইশতেহার যে এক নয়, সে কথাাট নিশ্চয়ই বিএনপির নেতাদের জানা আছে। সরকার দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করেছে, তার অকাট্য তথ্যপ্রমাণ বিএনপির হাতে থাকলে তাদের উচিত জনগণকে জানানো। বিএনপি এশিয়ান হাইওয়ের বিরোধিতা করছে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতীয় যান চলাচল করবে এই যুক্তিতে। কিন্তু চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ ঘটাতে চাইছে।

সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর দিয়ে বাংলাদেশি বা চীনা যানবাহনে পণ্য পরিবহন করতে হবে। মিয়ানমার কি তখন করিডর বলে পথ আটকে দেবে? পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এ ধরনের স্ববিরোধিতা কেবল নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার শামিল। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত বিএনপিই বেশি সময় দেশ শাসন করেছে। ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে তারা দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করেছে, তেমন নজির নেই। বরং তাদের আমলেই ভারতের জন্য বাংলাদেশের বাজার খুলে দেওয়া হয়েছিল।

নির্বাচনী ইশতেহারে দুটি দলই জাতীয় সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। আমরা হলফ করে বলতে পারি, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগের প্রতি একইভাবে সংসদে যাওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাত এবং হরতালের বিপক্ষে হাজারটা যুক্তি দাঁড় করাত। তাহলে সংসদ কি শুধু ক্ষমতাসীনদের এবং বিরোধীদের জন্য রাজপথ? বিএনপি বলেছে, তারা ৯৬টি মুলতবি প্রস্তাব জমা দিয়েছে। কোনোটি নিয়ে আলোচনা হয়নি। এ কথা তারা সংসদে গিয়েই বলুক।

৯৬টি মুলতবি প্রস্তাবের বিষয়বস্তু দেশবাসীকে জানাক। সেসব না করে হরতাল ডেকে দেশের সর্বনাশ করা কেন? বিএনপির নেতারা যখন সংসদ বর্জনের পক্ষে নানা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছিলেন, তখন দূরদর্শনে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতার সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। তিনি রাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের কঠোর সমালোচনা করে বলেছিলেন, আসন্ন বিধানসভার অধিবেশনে মন্ত্রীদের গরহাজির থাকলে চলবে না। বিধায়কদের প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। আর আমাদের বিরোধী দল সংসদে না গিয়ে সরকারকে, মন্ত্রীদের ছাড় দিচ্ছেন।

কিন্তু তাঁদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বিরোধী দল সংসদে বর্জন করলে সরকারেরই লাভ। তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না। তখন সরকারি দলের সাংসদদের একমাত্র কাজ হয় বিল পাসে হাত তুলে সমর্থন জানানো এবং সংসদ নেত্রী ও মন্ত্রীদের বক্তৃতায় টেবিল চাপড়ে বাহবা দেওয়া।

এই রীতি চলে আসছে দুই দশক ধরে। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে যতই ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, লাঠালাঠি থাকুক না কেন, তাদের মধ্যে এক অলিখিত চুক্তি আছে, আছে সমঝোতা; সেটি হলো সরকারি দল সংসদে থাকবে আর বিরোধী দল রাজপথ কাঁপাবে, প্রতিবাদ জানাবে। হরতাল ডাকবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করে পূর্বসূরির পথ অনুসরণ করবে। তখন আবার সরকারি দল হরতালের বিরুদ্ধে বুুলন্দ আওয়াজ তুলবে। বিরোধী দলও তখন সরকারকে আগের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।

হরতালের রাজনীতিতে দেশবাসী বরাবরই অসহায়। বিদ্যুৎ-সমস্যার সমাধানে হরতাল ডেকেছে বিএনপি। তারা ক্ষমতায় থাকতে হাজার হাজার খাম্বা পুঁতলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ায়নি। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বিএনপির এই কর্মসূচি কি সমর্থন করছেন? এফবিসিসিআইয়ের নতুন সভাপতি হরতাল প্রত্যাহার করে আন্দোলনের বিকল্প ভাষা খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন।

কয়েক দিন আগে তৈরি পোশাকশিল্পে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছিল মজুরি-বিরোধ নিয়ে। ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর তার আপাত সমাধান হলেও ফের হরতালের মুখোমুখি হতে হবে। গরিব শ্রমিকদের এক দিনের বেতন কাটা যাবে। তাতে কী? বিরোধী দলের জেদ তো বজায় থাকবে। মহাজোটের আমলে বিএনপির প্রথম হরতালটি কেমন হবে? বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের হরতাল থেকে ভিন্ন কিছু হবে না।

বিরোধীদলীয় নেত্রী গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে হরতালের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। এ কথাগুলো তিনি সংসদে গিয়ে বলতে পারতেন। সরকারি দল তাতে বাধা দিলে তাও দেশবাসীকে জানাতে পারতেন। বিরোধী দলের নেতারা হরতালের পক্ষে পাড়ায়-পাড়ায় প্রচার চালিয়েছেন। জনগণকে হরতালের দিন গাড়ি বের না করতে ও দোকান না খুলতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

তাঁদের প্রতি জনগণের আস্থা যদি এতই প্রবল হয়, তাহলে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেবে। রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর কিংবা জোর করে দোকান বন্ধ করা কিংবা পুলিশের সঙ্গে মারপিট করার প্রয়োজন নেই। একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, সরকারি দল হরতালে বাধা দেবে না, রাজপথ দখল করবে না। তাদের এ অভয়বাণী বাস্তবায়িত হলে সেটি দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গল। সরকারি দল বাধা না দিলে বিরোধী দল এক দিন হরতাল পালন করে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে ঘরে ফিরে যাবে।

কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ আমলের মতো রাজপথ দখল করে কথিত শান্তিমিছিল করলে তার পরিণাম ভালো হবে না। সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়বে। জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত হবে। ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি হরতালের দিন গাড়ি বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দোকান মালিকেরা দোকান বন্ধ করবে কি না এখনো জানাননি।

তবে সব পরিবহন ও দোকান মালিক যে সমিতির আহ্বানে সাড়া দেবে তার নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশে এমন কোনো পেশাজীবী নেই, যাঁরা আওয়ামী ও বিএনপিতে বিভক্ত নন। আইনজীবীরা বিভক্ত। সাংবাদিকেরা বিভক্ত। চিকিৎসকেরা বিভক্ত।

শিক্ষকেরা বিভক্ত। ব্যবসায়ীরা বিভক্ত। সরকারি কর্মচারীরা বিভক্ত। আইনজীবীদের দুই অংশ আলাদা বৈঠক করে হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যে নাগরিক সমাজ সরকার ও বিরোধী দলকে পথ দেখাবে, তারা নিজেরাই পথ হারিয়ে ফেলেছে অথবা দালালির খাতায় নাম লিখিয়েছে।

জনসমর্থন পেতে হরতাল করার প্রয়োজন নেই। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে জয়লাভ করতে বিএনপিকে বিরাট জনসমাবেশ করতে হয়নি, হরতাল ডেকে শহর ও বন্দর অচলও করতে হয়নি। এমনকি তাদের প্রার্থী পরীক্ষিত ‘জিয়ার সৈনিক’ও ছিলেন না। তার পরও চট্টগ্রামবাসী তাঁকে বিজয়ী করেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে। অতএব হরতাল, অবরোধের পথ পরিহার করে প্রতিবাদের শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজে বের করুন।

মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিন। মহাজোট সরকার মাত্র ১৮ মাস পার না হতেই বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তুলেছে। সামনে আরও ৪২ মাস বাকি। অপেক্ষা করুন। এখনই অস্থির হবেন না।

আপনারা মেয়াদের এক দিন আগেও ক্ষমতা ছাড়েননি। প্রতিপক্ষের কাছে সেটি আশা করেন কীভাবে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।