আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। দুর্লভ পাপ

writerrazu.com

অধ্যায় ১ চৈত্রের দুপুরের রোদ। রোদ নয় যেন আকাশ থেকে আগুন ঝরছে। বেশিক্ষণ কোথাও তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখের পাতা প্রায় বন্ধ করে চোখের অ্যার্পাচার কমিয়ে চোখের ভিতর যাওয়া আলো ও তার সহযোগী তাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। তা না হলে “চোখের কাবাব” হয়ে যাওয়ার চান্স আছে।

গরমের কারণে রাস্তার পিচ কিছুটা গলে গেছে। কিছু দূরে মরীচিকা দেখা যায়। গলা পিচের উপর দিয়ে ভ্যান চলছে। তাতে চর চর করে শব্দ হচ্ছে। টাউন পিছনে ফেলে ভ্যান চলছে গ্রাম অভিমুখে।

আর তা প্রমানিত হচ্ছে রাস্তার দুপাশের দোকান ঘর তৈরির উপকরণে এবং ঘরের ঘনত্বে। ভ্যানের উপর আধো শোয়া বল্টু। চোখ বন্ধ করে শরীরটা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে ভ্যানের উপর। সে কি ধ্যান করছে? সে কি কোন প্রেরিত পুরুষ? সে কি হেরা পর্বতের গুহায় জায়গা পায়নি? তুর পাহাড়ে উঠতে পারেনি? বোধি গাছের তলায় কি বসতে পারেনি কাকের বিষ্ঠার ভয়ে? তার উদ্দেশ্য কী? জীবনের নির্বাণ লাভ? নাকি সে কোয়ান্টাম মেডিটেশন করছে? ডান নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ে বাম নাক দিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ছে? মনের বাড়িতে পৌঁছে গেছে? মহাজাতক? আহারে! এই কাকের বিষ্ঠার উৎপাতে না-জানি কত অসংখ্য অজানা হবু বুদ্ধ ধ্যান গুটিয়ে সংসারী হয়েছে যশোধারাদের উদ্ধার করেছে। কাউয়াদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক! শান্তি! ভ্যানের উপর চলছে ধ্যান।

ভ্যানের দুলুনিতে কি তার ধ্যান ভঙ্গ হচ্ছে? নাকি আরাম আরাম লাগছে? ধ্যানকারী কাঁপছে, থুরথুরে পান চাবানো বুড়ির নিচের থুতনির মতোÑরিকটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের মতোÑ এনগেজমেন্ট পার্টিতে আংটি পরাতে যাওয়া ভীতু বরের মতোÑ এক পায়া হালকা ছোট টেবিলের মত কাঁপছে ধ্যানকারী। ভ্যানের উপর মোটা পাটের রশি দিয়ে বাঁধা ধ্যানকারী। সে-কি তাহলে দড়ি পীর? ধ্যানকারীর ভ্যানের পিছন পিছন সাইকেল চালিয়ে আসছে মোহাম্মদ আলী, ধ্যানকারীর মালিক, স্রষ্টা নয়। রাস্তার পথচারী, রাস্তার পাশের মুদির দোকানের দোকানি, কেউই কোনো কথা বলছে না। গরমের কারণে সবাই বোধ হয় চুপ।

শুধু পিচের রাস্তায় ভ্যান চলার চরচর শব্দÑএলোমেলো পাখির ডাকÑবড় গাছের ডালে পাতার শব্দ। বাকি পৃথিবী নীরব। বোবা। এখন থেকে ঘণ্টা চারেক আগে ধ্যানকারীকে যখন ভ্যানে তোলা হয়েছিল তখন সে বুঝতেই পারেনি পরবর্তী তিন ঘণ্টায় তার জীবনে কী ঘটতে যাচ্ছে। পৃথিবীতে আমরা পরিকল্পনা করিÑস্বপ্ন দেখি সময় নিয়ে।

কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় হুট করে। চোখের পলকে পাল্টে যায় জীবনের পথ। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। আবার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন ঘরের ধুলাবালির মত; যতই পরিস্কার করা হোক আবার কোথা থেকে যেন এসে হাজির হয়।

দেবতা জিউস একবার মানুষের সব গুণ একটি ডানো দুধের টিনের কৌটায় ভরে পৃথিবীতে এক লোকের হাতে দিয়ে বললÑ এটা রেখে দাও, পৃথিবীতে তোমাদের আর কোনো কিছুর অভাব হবে না। কিন্তু সেই লোক ছিল খুব কৌতূহলী। জিউস তাকে কী দিল তা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়ল। ডানো দুধের কৌটার মুখ খুলল। সাথে সাথে কর্পুরের মতো মানুষের সব গুণ উড়ে চলে গেল।

কৌটার মধ্যে উঁকি দিয়ে কিছু না দেখে ঐ কৌতূহলী লোক তাড়াতাড়ি কৌটার মুখ আটকে দিল। আটকা পড়ল শুধু স্বপ্ন। সেদিন থেকে পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হল স্বপ্ন। আমাদের “আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ” সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। গুলিস্তানের মোড়ে-ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে তিনি বলেলÑ খুইট্টা লন, বাইচ্ছা লন, দশ টাকা, দশ টাকা।

ছোট স্বপ্ন, বড় স্বপ্ন, দশ টাকা, দশ টাকা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ওলি লাল্টু-বল্টুর জন্যে নিয়ে এল শুকনা খড়, আমন ধানের কুড়া এবং ভাতের ফ্যানের স্যুপ। পূর্ণ তৃপ্তিতে পেট ভরে স্যুপ খেলো লাল্টু-বল্টু। তারপর যখন লাল্টু-বল্টুকে নিয়ে ওলি বের হবে বাড়ি থেকে তখন বারান্দায় বসে আলী হাক দিলÑ আইড়া বাছুর ডারে রাইখা যা। ক্যান? কাম আছে।

বাধ্য হয়ে ওলি শুধু লাল্টুকে নিয়ে রওনা হল তালতলার উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণপর বাড়িতে একটা ভ্যান এল। বল্টুকে তোলা হল ভ্যানে। মোটা রশি দিয়ে তাকে বাঁধা হল। বল্টু অবাক হয়।

কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে? টিকা দিতে? বেচে দিতে? না, এত তাড়াতাড়ি বেচে দেওয়ার কথা না। কোরবানির ঈদের এখনও অনেক দেরি আছে। ভ্যান চলতে শুরু করেছে টাউন অভিমুখে। বল্টুর মাথায় রাজ্যের চিন্তা। কেন যেন তার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

কিন্তু কী? এক সময় বিরক্ত হয় বল্টু। ধুর! এত ভেবে কী হবে, যা হবার তা তো হবেই। এই জন্মে তারা মানুষের হাতে পরাধীন। পরজন্মে এর প্রতিশোধ নেবে বল্টু। কিন্তু শত চেষ্টা করেও বেয়াদব চিন্তাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছে না বল্টু।

তার মাথা এখন আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই। অশুভ একটা ভবিষ্যত দখল করে নিয়েছে। শুধু মাথা নয়, হার্টবিট-রক্তপ্রবাহ-স্নায়ুতন্ত্র সবকিছু দখল করে নিয়েছে সেই অশুভ ভবিষ্যত। সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বল্টু প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। চুপ করে শুয়ে আছে ভ্যানের উপর।

নিস্তেজ-নিঃসার। রাস্তার পাশের মাঠে কলাই ডাল বতি হয়েছে। কয়েকদিন পরই কৃষক কেটে নেবে। তার আগে গ্রামের ছেলেমেয়েরা কলাই ক্ষেতেই খড়কুটা জড়ো করে কয়েক গাছা কলাই লতা সহ আগুন ধরিয়ে দেয়। লতা পুড়ে ছাই হয়, কলাই সিম আগুনে পোড়ে।

সিম খুলে পোড়া কলাই খায় ছেলেমেয়েরা। কালিতে ভেসে যায় তাদের হাত-মুখ-শরীর। মুক্ত আনন্দে আত্মহারা তারা। রাস্তার পাশে কলাই ক্ষেতে কলাই পোড়ানো ৪/৫ জন কিশোরকে দেখে বল্টুর চোখে পানি আসে। জীবনটাকে উপভোগ করার জন্যে মানুষের কী অসীম স্বাধীনতা।

তারপরও তারা কত নিষ্ঠুর। বল্টু ভাবে, স্বাধীনতাই মানুষকে নিষ্ঠুর করেছে। মানুষের মধ্যে যারা পরাধীন তারা আবার এত নিষ্ঠুর নয়। প্রাণিজগৎ পরাধীন বলে তারা নিষ্ঠুর নয়। তাহলে তো পরাধীনতাই ভালো।

বল্টুকে আনা হল থানা পশু হাসপাতালে। হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ঢুকতেই বল্টু বুঝল খারাপ কিছু একটা হতে যাচ্ছে। একটু দূরেই এক গরুর আর্তচিৎকার শোনা গেল। হাম্বা-বা-বা-বা... কিন্তু বল্টুর কিছু করার নেই। কারণ তার শরীর শক্ত রশি দিয়ে ভ্যানের সঙ্গে বাধা।

চার জন জোয়ান লোক এসে তাকে ভ্যান থেকে নামাল। পেছনের দুই পায়ের মাঝখানে লেজ নিয়ে হ্যাচকা টান দিতেই মাটিতে পড়ে গেল বল্টু। তার চারপা চারটা পিলারের সাথে বাধা হল। মুখে পড়িয়ে দেওয়া হল লোহার খাঁচা। ্ বল্টুর দুচোখ দিয়ে পানি পড়ল।

কিন্তু সেই পানি উপস্থিত কারো দৃষ্টি গোচর হল না। মানুষ খেয়াল করে গরুর রান বা সিনার গোস্ত। আর গাই বিয়ালে তার ওলান। ওলান বড় হলে মালিক খুশি। রান-সিনার মাংস বেশি হলে মালিক খুশি।

কিন্তু গরুর চোখ বা অশ্র“র দিকে মানুষের কোনো খেয়াল থাকে না। সবাই প্রোডাক্ট চেনে। সবাই-কি এমবিএ করা? ছোট বেলায় বল্টু যেসব গল্প শুনেছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল কোরবানির ঈদের গল্প। সেদিন গরুদেরকে এইভাবেই কাত করে শোয়ানো হয়। রক্তে ভেজা লম্বা-বড় ছোড়া।

পাঞ্জাবি-টুপি পড়া ৪/৫ জন। তাদের হাতে-পাঞ্জাবিতে-পায়ে রক্তের দাগ। চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা। তারপর...। উহ্, বল্টু আর ভাবতে পারছে না।

চোখ বন্ধ করল সে। আবার খুলল। চারপাশটা দেখার চেষ্টা করল। নাহ্, কোনো রক্তে ভেজা-লম্বা-বড় ছোড়া দেখা যাচ্ছে না। রক্ত মাখানো কোনো পাঞ্জাবিও না।

তাহলে? তাহলে কী হচ্ছে। ঠিক এই সময়ে তার টেস্টিসটা কামড়ে ধরল ধাতব কিছু একটা। বল্টু জানে না কিন্তু এই যন্ত্রটার নাম “ইম্যাসকুলেটর”। ইম্যাসকুলেটর এক ধরনের কেচি টাইপের যন্ত্র যা দিয়ে প্রাণীর টেস্টিস কেটে ক্যাস্ট্রেট করা হয়। উহ্ প্রচণ্ড ব্যথা।

ব্যথায় কুকড়ে যাচ্ছে বল্টু। আ... । জ্ঞান হারাবার আগে ভয়ংকর এক চিৎকার আটকে গেল তার চোয়াল-জিহ্ববা-দাত জড়িয়ে। অনেক দিনের অব্যবহৃত-পুরাতন কুয়ার মত অর্ধ উন্মুক্ত দুই চোয়াল। না-কি “গারে সওর”? কুরাইশদের ধাওয়া খেয়ে জল-জ্যান্ত দুই জন মানুষ ঢুকল পাহাড়ের গুহায়, আর সঙ্গে সঙ্গে মাকড়সা এসে জাল বুনে বহু দিনের “অব্যবহৃত”-“পুরাতন” করে দিল।

আর কিছু মনে নেই। বাকি যৌনাঙ্গ থেকে টেস্টিস বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সেখানে সেলাই করে দিল ভ্যাটেরেনারী সার্জন। তারপর একটা ইনজেকশান দেওয়া হল যাতে ক্ষতস্থান তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। তারপর আবারও ভ্যানে তুলে বল্টুকে নিয়ে আসা হল বাড়িতে। সন্ধ্যায় যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন দেখল লাল্টু তার গলার উপর গলা রেখে অঝোরে কাঁদছে।

কিন্তু এতটুকু নড়াচড়ার শক্তি তার নেই। দুই বার চোখ টিপটিপ করে আবারও চোখ বন্ধ করল। লাল্টুÑবল্টু গোয়ালঘরে শোয়া। অদুরে বাড়ির বারান্দায় বসে সেদিকে তাকিয়ে আছে ওলি। কিন্তু তার মনও লাল্টু বল্টুর কাছে পড়ে আছে।

বিকাল বেলায় বাড়িতে ফিরে ওলি জানল বল্টুর ক্যাস্ট্রেট করানো হয়েছে। গ্রামের ভাষায় ওরা বলে ‘তোলানো’। ‘আইড়া গরুডারে তোলায় দেছে’। তোলায় দিয়ে বলদ বানানো হয়েছে। সুযোগ বুঝে ওলি সব কথা বলল লাল্টুকে।

লাল্টু শুনেছে আর কেঁদেছে। ওলিও কেঁদেছে কিন্তু সে নিরুপায়। সে জানত না আজ বল্টুর এই সর্বনাশ হবে। অবশ্য জানলেও কিছু করার ছিল না। মোহাম্মদ আলীর মুখের উপর কথা বলার সাহস এই বাড়িতে কারো নেই।

সরি, ভুল বললাম, একজনের আছে। সে প্রায়ই মোহাম্মদ আলীকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে। সে হল এই বাড়ির এক চোখ কানা কুকুরটা। এই এক চোখ আলী নিজেই কানা করে দিয়েছে। এক চোখ কানা কুকুর নাকি বেশি হিংস্র হয়।

সহজে চোর ধরতে পারে। আলীর এই বিদ্যা ডিবির ডগ স্কোয়াডের কর্তাব্যক্তিরা এখনও জানেনি বলেই রক্ষা। তা-না-হলে আমরা টিভিতে দেখতাম, প্রধানমন্ত্রী কোন মঞ্চে ওঠার আগে তা পরীক্ষা করে দেখছে এক চোখ কানা একদল কুত্তা। ও! সরি, কুকুরকে কুত্তা বললে তো আবার মাইন্ড করে। মাইন্ড কইরো না প্লিজ! তিনদিন পর বল্টু উঠে দাঁড়াতে পারল।

এর মধ্যে ডাক্তার এসে একদিন দেখে গেল। আরও একটা ইনজেকশান দিল। সাতদিন পর মাঠে গেল বল্টু, সাথে লাল্টু আর ওলি। কিন্তু এই সাতদিনে একেবারে পাল্টে গেছে বল্টু। আর সেই পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি যে অনুধাবন করছে তার নাম লাল্টু।

এতদিনের প্রেম, কত সুখ, কত ঝগড়া, কত ভালোবাসা, সেই সব কোথায় গেল? নিতান্ত বাধ্য না হলে বল্টু কথা বলছে না। খাওয়া-জাবর কাটা-ঘুম, এই নিয়ে বল্টুর নতুন জীবন। আগামী বৈশাখ থেকে অবশ্য তার নতুন কাজ শুরু হবে। আলীর সাথে মাঠে গিয়ে জমি চাষ করতে হবে। কিন্তু এ-কী হল বল্টুর? এত নিস্পৃহ কেন? লাল্টু ভাবে আর কাঁদে।

কাঁদতে কাঁদতে অদক্ষ দুটি চোখ ফুলিয়ে ফেলে। লাল্টুর এই দুর্দিনে তাকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিচ্ছে ওলি। নানা ভাবে তাকে বোঝাচ্ছে এবং বেঁচে থাকার জন্যেÑনতুন করে ভাবার জন্যে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। অবশ্য সাপোর্ট দেওয়ার কি-ই-বা আছে? বল্টু আর কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না। এটা ওলি যেমন জানে তেমনি লাল্টুও।

জীবন ওয়ান ওয়ে রাস্তার মতো, উল্টা পথে চলতে গেলে ট্রাফিক সার্জেন্ট ধরবে। আটকে দেবে। বল্টুর ক্যাস্ট্রেশনের ১১/১২ দিন পরের ঘটনা। তালতলা মাঠে লাল্টু-বল্টুকে রেখে ওলি পাশের একটা জঙ্গলে ঢুকেছে প্রাকৃতিক কাজ সারতে। লাল্টু ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছে আর বল্টু বসে জাবর কাটছে।

হঠাৎ করে আজরাইলের মত হাজির হল ডাম্বা। লাফ দিয়ে এসে প্রায় লাল্টুর শরীরের উপর উঠেই গিয়েছিল আজরাইল। চমকে লাফ দিল লাল্টু, তাতেই রক্ষা। একটুর জন্যে তাকে ধরতে পারল না আজরাইল। কিন্তু এত সহজেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আজরাইল নয়।

প্রাণপণে চিৎকার করছে আর দিগি¦দিক ছুটছে লাল্টু, আর তাকে তাড়া করছে গরু জগতের “রক” (ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ চ্যাম্পিয়ন) ডাম্বা। লাল্টুর চিৎকার শুনে জঙ্গল থেকে বের হয়ে এল ওলি, হা রা ম জা দা - কু ত্তা র বা চ্চা - খা ন কি র পো... খোলা মাঠে বাতাস কেটে তীর ছুটে চলেছে। তীরবেগে ধাবমান ওলির ‘প্রায়ইস্পাত’ শরীরে বাতাসের সংঘর্ষে পতপত করে শব্দ হচ্ছে। এই তীরের জন্যে ডাম্বার মত বাতাস নিজেও তৈরি ছিল না। দৌড়ে এসে হাতের লাঠি দিয়ে রকের মাথায় কষে দিল এক ঘা।

সাঁই... হটাৎ করে সময় স্থির হয়ে গেল। সময়টা স্থির হওয়া দরকার ছিল। দরকার ছিল বাতাসের চমক ভাঙ্গার জন্যে, রকের পরবর্তী করনীয় ঠিক করে নেওয়ার জন্যে এবং ওলির লাল্টুর চোখে চোখ রেখে তাকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে। সবাই তৈরি হয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময় আবার চলতে শুরু কলল। টিক-টিক-টিক... রক আরও ক্ষেপে গেল।

এখন সে ওলির পিছু নিয়েছে। ওলি দৌড়ে গিয়ে এক তালগাছের গোড়ায় গিয়ে দিল এক ডিগবাজী। আর তাতেই কুপকাত ডাম্বা। তালগাছ আর ডাম্বার মাথায় বিরাট সংঘর্ষ হল। এবার আর সময় স্থির হওয়ার সুযোগ পেল-না।

অবস্থার আকস্মিকতায় সে ভড়কে গেছে। সে আরও দ্রুত চলতে শুরু করল। টিকটিক-টিকটিক-টিকটিক... রাগে গজ গজ করতে করতে তালতলা ছাড়ল ডাম্বা। ডাম্বা ওলিদের এক প্রতিবেশীর ষাড়। এই পুরো ঘটনাই ঘটেছে বল্টুর চোখের সামনে।

সে আগেও বসে বসে জাবর কাটছিল, এখনও কাটছে। অবাক হয়ে তাকে দেখছে ওলি এবং লাল্টু। কত পরিবর্তন! অথচ এমনও দিন ছিল যখন ডাম্বার সাথে একটু কথা বলার অভিযোগে লাল্টুর সাথে সারাদিন কথা বলেনি বল্টু। ডাম্বা অনেকদিন ধরে লেগে আছে লাল্টুর পিছে। লাল্টু অত্র এলাকার গাভীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী।

মানুষ হলে নিশ্চিত লাক্সÑচ্যানেল আই সুপার স্টার হতো। হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে তৌকির আহমেদের পরিচালিত সিনেমার নায়িকা হত। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য সে মানুষ হয়ে জন্মাতে পারেনি। আর তাতেই ভাগ্য খুলে গেল মুনমুনÑবিন্দুদের। লাল্টু কম্পিটিশনে অ্যাটেন না-করায় তারা হয়ে গেল সুপারস্টারÑ সেলিব্রেটি।

একেই বলে কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ! হা হা হা ... প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আজরাইল প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করেছিল। সিরাজগঞ্জ থেকে এসিড কিনে এনেছিল লাল্টুর মুখে মারার জন্য। এলাকার এমপি’র ডান হাত, মোস্তাকের একটা রিভলবার বেশ কিছুদিন সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছিল। কিন্তু বল্টুর কারণে সে লাল্টুর ধারে কাছেও যেতে পারেনি। এমনকি কোনদিনও তালতলার মাঠে যাওয়ার সাহস পর্যন্ত করেনি আজরাইল।

অথচ আজ! কত পরিবর্তন। অথচ সেই বল্টু আজ লাল্টুর চরম বিপদেও নিশ্চুপ, নির্বাক, নিস্পৃহ। লাল্টু-ওলি দুজনেই অবাক হয়। কিছুক্ষণ পর তিন জনেই চুপচাপ বাড়ির দিকে রওনা দেয়। পথে যশোরে লতার সঙ্গে দেখা হয়।

ওদের দেখে দাত বের করে হেসে দেয় যশোরে লতা। ওরা কেউই সে হাসির উত্তর দেয় না। চুপশে যায় যশোরে লতা। একটা রক্তচোষা দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হল। ওরা কেউই ব্যস্ত হয়ে বুকে থু থু দিল না।

নিরবে বাড়ি চলে এল। বাকি দিনটা কেউই কারো সঙ্গে কথা বলল না। হতভম্ব।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।