আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভস্মীভূত স্বজনের ধ্বংসস্তুপ আর মায়ের লাশের উপর শকুনের নৃত্য!!



মা এমনই একজন, যাঁর সাথে সম্পর্ক এই পৃথিবীর আলো দেখার অনেক আগে থেকেই। মার শরীরের নির্যাস তিল তিল করে শুষে আমাদের এই রক্ত মাংশের শরীর, এই অস্তিত্বের সৃষ্টি। ছোট বড় সকলের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব, অনুভূতি আর ভালোবাসার নাম মা। যে মায়ের কাছ থেকে শুধু বছর নয়, বরং সপ্তাহ বা মাস কালের বিচ্ছেদও দুঃসহ কষ্টের মনে হয়, তাঁর মৃত্যু কতোখানি যন্ত্রণার হতে পারে তা মানুষ মাত্রই বুঝতে পারে। যে মেয়েটি বধুর সাজ নিয়ে ফিরে দেখে হাতের মেহেদীর রং কে ম্লান করে জ্বাজল্যমান অগ্নিকুন্ড গ্রাস করেছে তার পরিবার, সজন এমনকি জন্মদাত্রী মাকেও.. সেই বধুর সাজ তার জন্য কতোখানি কষ্টের তা অনুধাবনের জন্য কোন অসাধারণ বা সুক্ষবোধের প্রয়োজন পড়েনা।

যে ছেলেটির ঘর সাজাবার স্বপ্ন চোখে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে তার মা অঙ্গার হয়ে ফিরে, সেই ছেলেটির কি তখন বিয়ের সাজে সাজার মতো মানসিকতা থাকে? ভাগ্নের বিয়ের আয়োজনে প্রথম অনুষ্ঠানে গিয়ে ভস্ম হয়ে ফিরে খালা, ফুপু আর তাঁদের ছোট শিশু সন্তান! সজন হারানোর কষ্ট, মাকে হারানোর কষ্টের কাছে ম্লান হয়ে যায় পৃথিবীর আর যতো উৎসব, আয়োজন। ঘৃনা প্রকাশের যে সীমা থাকে তা আজ যেভাবে বুঝতে পারছি, এমন করে আর কখনও হয়নি.. মানুষ লোভ, নোংরামী আর স্বস্তা প্রচারের কারনে কতো নীচে নামতে পারে, এক ভয়াল রাতের অগ্নিকুন্ড ১২২ টি নীরিহ প্রাণ কেড়ে আর ৩৭ জনকে অগ্নিদগ্ধের তীব্রযন্ত্রণায় আক্রান্ত করে আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। সেই অগ্নিকুন্ড আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে সে যতো না পোড়ায় তার চেয়ে ঢের বেশি দগ্ধ করে, ছারখার করে আমাদের নর্দমার কীট রাজনীতিবিদেরা... হতদরিদ্র দেশে এক আবেগ কে সম্বল করেই আমাদের অধিকাংশের বেঁচে থাকা, আমরা নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য ও সচেতনতা থেকে পলায়নপর মনোভাবের কারণেই যেন বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে এই আবেগে ডুবিয়ে চোখ বুজে থাকি! সাধারণ মনুষত্ববোধও যে আমরা হারিয়ে ফেলছি তা অনুধাবনের বোধটুকু আজ আমাদের নেই। বিয়ে মানে নতুন জীবনের শুরু, চোখ ভরা স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনার আনন্দময় উদযাপন...বিয়ে তথা, নতুন জীবন গড়ার সময়টি মানুষ শুধু আনন্দ আর সুন্দর স্বপ্ন দিয়ে উপভোগ করতে চায়, দুঃস্বপ্নের চেয়ে ভয়াল বাস্তবতা আর শোকের মাতমের মাঝে নয়। দীর্ঘদিন পূর্বে কারো বিয়ের দিনধার্য থাকা সত্ত্বেও সেই সময়ের কিছু আাগে কারো বাবা মা, এমনকি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মৃত্যু হলেও সেই শোকেরে মাঝে উদযাপন না করে পূর্বনির্ধারিত দিনটি পিছিয়ে দেয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে।

যেখানে সজনের লাশের পোড়া গন্ধে এখনও বাতাসে ভেসে বেড়ায়, ঘড়ের দেয়ালে আজও চক চক করে এঁটে আছে মৃত মায়ের বিচ্ছিন্ন মাংশপিন্ড, বাঁচার আকুতি নিয়ে অসহায় ভাবে গগনবিদারী আর্তনাদ করেছিলো কিছু আগেও আনন্দে মুখর এক ঝাঁক মানুষ, একটু কান পেতে শুনলে তার প্রতিধ্বনিটি হয়তো এখনও কানে বাজে- এমন সময় উৎসবের ভাবনা শুধু মানসিক বিকারগ্রস্থ উন্মাদের পক্ষেই সম্ভব। সজনহারা পরিজন বিশেষ করে মাতৃহারা সন্তানের জন্য এসময়টা বিভীষিকাময়। পৃথিবীর কোন সুন্দর এসময় দৃষ্টিনন্দন নয়, কোন আনন্দ এসময় হাসি ফোটাতে পারেনা, উৎসবের আয়োজন এসময় নরক যন্ত্রণার মতো মনে হয়... অথচ.. এমন দূর্ভাগ্য আমাদের! সদ্য সজনহারা দুটি এতীম মেয়ে নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনীতির নোংরা খেলা! এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা! নিজেকে মহৎ বা মহতী প্রমাণের এই মোক্ষম সুযোগটি হাত ছাড়া করত চাইছেনা নষ্ট নেতৃবৃন্দ, দেশের ভাগ্য চাকা হাতে নিয়ে জনগনকে বানিয়েছে ক্রীড়ানক বানিয়ে খেলছে এরা! এই সুযোগ লাভের আনন্দে এরা এতোটাই আত্মহারা যে এটা কতোখানি বিভৎস ভাবনা ও বিকৃত রুচীর প্রকাশ তা অনুধাবনের বোধটুকু এদের নেই। আর বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে দিনে দিনে মানসিক ভাবে শিখন্ডী হয়ে উঠা আমরা এই উৎসব দেখে যাই বোবা জড় পদার্থের মতো! অগ্নকিান্ডে এতীম হয়ে যাওয়া ছোট্ট শিশুদের মাথার উপর আশ্রয়ের ছায়া নয়, অগ্বিদগ্ধ হয়ে স্ত্রী, সন্তান, ভাতৃবধু আর ভাইয়ের সন্তান হারা, আবাস আর জীবিকা হারানো অসহায় মানুষটির পাশে নয়, শরীরে অঙ্গার ধারন করে মরণযন্ত্রণায় ছটফট করা রুগীটির পাশে নয়.... ভয়াবহ এক অগ্নিকান্ডে সদ্য মাতৃহারা, সজন হারানো ছেলেমেয়েদের বিয়ের বাদ্য বাজিয়ে সেই তালে বোধশক্তিহীন জাতিকে নাচানোর এক বিকৃত খেলায় মত্ত তারা। শোকাতুর পুত্র কন্যাদের কাছে এই মুহুর্তে বিয়ের সানাই যে মৃত্যুর ডংকার মতোই ভয়ংকর, তা বোঝার মতো বোধটুকু এদের নেই! শ্যাওলাপড়া বিবেকের অধিকারী এসব ক্রীড়াবিদদের ঘিরে থাকে জেলীফিশের পাল, এসব মেরুদন্ডহীনেরা তাদের তোষামোদের গান গেয়ে প্রচার করছে এ কতো মহতী উদ্যোগ, এসব বিকৃত খেলার দুর্গন্ধকে মহত্ত্বের সুবাতাস হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে এই নরাধমের দল।

ক্ষমতা আর প্রভাবের নগ্ন প্রকাশের কাছে শোকাতুর তিনটি প্রাণের অসহায় আত্মসমর্পন। আমার জানা নেই আজ তাঁরা তাঁদের এই বেঁচে যাওয়াকে অভিসম্পাৎ করছেন কিনা! এভাবে ক্ষমতার হাতের পুতুল হয়ে সজন হারানোর শোক পালনের অধিকারটুকু তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে, এর চেয়ে হয়তো পরিবার পরিজনদের সাথে ভস্মীভূত হলেও কষ্ট কম হতো.. এমন ভাবনা তাঁদের কাতর করে কিনা তা কখনও জানা হবেনা!! অক্ষম মেরুদন্ডহীন নপুংসক জাতির হয়ে এই তিনটি প্রাণের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাই.... তাঁদের এমন দূর্ভাগ্য, অসহায়ত্বের জন্য নীরব দর্শক আমরা দায়ী। এই অমানবিকতা আর বিভৎস ভাবনার প্রচারলোভী মানুষ রূপী হায়নাদের প্রতি ঘৃনা জানাতেও কুন্ঠা হয় কারণ ঘৃণা প্রকাশেরও সীমা আছে! এদের এধরনের নির্মমতা ও বিকৃত আনন্দের প্রতি ঘৃনা জানাবার ভাষা জানা নেই.. শুধু অভিসম্পাৎ করতে ইচ্ছে করে এই কুলাঙ্গারদের যারা মানুষের শোকের মাতম, মানুষের সর্বনাশ নিয়ে রাজনীতির হোলী খেলা খেলে!! শৈশবে বড়দের কেউ মজা করে আকাশে ছুটে যাওয়া রকেট বা চাঁদের বুড়ি দেখানোর ছলে বলতেন, “দেখো ‌ঐইই..........ই যে দূরে দেখা যায়!!” কেউ যেন বোকা মনে না করে তাই খেলার সাথীদের কেউ কেউ তাতে সন্মতি দিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সায় দিতো; “ ঐ যে.. দেখছি” তাদের কেউ শুধু চাঁদের বুড়ি নয়, তার হাতের চড়কা এমনকি ফোকলা দাঁতের হাসিটিও স্পষ্ট দেখতে পেতো.. আমি শুধু বোকা মেয়েটির মতো অসহায় ভাবে প্রশ্ন করে যেতাম; “কোথায় রকেট? কোথায় চাঁদের বুড়ি?” কয়েক দশক পেড়িয়ে আজও নিজেকে সেই অসহায় বোকা মেয়েটির স্থানে খুঁজে পাই! এই আয়োজনে মানবতাকে খুঁজে ফিরি, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার সন্ধান মিলেনা! আজও কেউ কেউ বলে উঠে; "ঐ যে দেখা যায় মানবতা!" আমি দেখি, শুধু মায়ের পোড়া লাশ, সজনের ভস্মীভূত ধ্বংশ স্তুপে শকুনের নৃত্য, সেখানে শোনা যায় হায়নার পালের বিকৃত উল্লাস!! ধিক!! শত সহস্র ধিক এই হায়নার পালের প্রতি!! ইতিহাস একদিন এই বিভৎস উৎসবের প্রতিশোধ নিবে!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.