এক সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির নামে বাণিজ্য বেশ জমে উঠেছিল। সারাদেশ থেকে মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার প্রধানশিক্ষক, অধ্যক্ষ এবং সুপার ঢাকার বিভিন্ন হোটেল ও আত্মীয়-স্বজনের বাসায় উঠে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তিকরণে মরিয়া হয়ে সংশ্লিষ্টদের পেছনে ছুটোছুটি করেছেন। তবে শুধু খালি হাতে নয়। সংশ্লিষ্টদের চাহিদা মোতাবেক লাখ লাখ টাকা নিয়ে তারা এসেছিলেন। কারণ তারা জানেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এমপিওভুক্তির জন্য কোনও টাকা প্রদানের ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করলেও এছাড়া তাদের উপায় নেই।
টাকা তাদের দিতেই হবে। মফস্বল থেকে আসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের কেউ কেউ সংশ্লিষ্টদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে না পারায় তাদের অনেকে আবার মফস্বলে ফিরে গিয়ে টাকার সংস্থান করে রাজধানীতে ফিরে আসেন।
শিক্ষামন্ত্রী এক প্রেসব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘এমপিওভুক্তির জন্য দয়া করে কেউ টাকার লেনদেন করবেন না। টাকা কিংবা ঘুষের বিনিময়ে এমপিওভুক্তির কোনও সুযোগ নেই। যারা টাকা দেবেন তারা প্রতারিত হবেন।
' মন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের সদিচ্ছার কোনও কমতি আছে বলে আমরা মনে করি না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নরকম। এমপিওভুক্তির নামে এখন চলছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে দেবার কথা বলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে এ টাকা খরচ করে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা স্কুল, কলেজ, মাদরাসাকে এমপিওভুক্ত করে দেবেন বলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, এমপিওভুক্তির আবেদন চাওয়ার পর এবার ৭ হাজার ৫৩৩টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে বৈধ আবেদনের সংখ্যা ৭ হাজার বলে শিক্ষামন্ত্রী প্রেসব্রিফিংয়ে জানান। ৭ হাজারের মধ্যে অনেকেই নীতিমালার শর্ত পূরণ করতে পারেনি। বিগত ২০০৪ সাল থেকে এমপিওভুক্তিকরণ স্থগিত ছিল। এ দীর্ঘ সময়ে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় দিন গুণেছে।
তাই এ ব্যাপারে এবার যেমন চাপ বেশি, তেমনি সকলের প্রত্যাশাও অনেক। মন্ত্রী জানান, এ ক্ষেত্রে তারা স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে চান। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করে কাজ করছেন তারা।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক মাদরাসার জনৈক অধ্যক্ষ রাজধানীতে অবস্থানকালে জানান, সংশ্লিষ্ট অফিসে ঢোকা যাচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু বাইরে থেকে যোগাযোগ রয়েছে।
তিনি টাকা লেনদেনের ব্যাপারে দুটো চ্যানেলের কথা বললেন। তিনি তার মাদরাসার এমপিওভুক্তির জন্য চ্যানেল দুটোকে ইতোমধ্যে পৌনে ৩ লাখ টাকা প্রদান করেছেন বলে জানান। তারা এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়েছে। এমপিওভুক্তিকরণে সহায়তাকারীদের চাহিদা পূরণ প্রথম দফায় হয়নি বিধায় তাকে আবারও মফস্বলে গিয়ে টাকা জোগাড় করে আনতে হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের সতর্ক করে দেবার ব্যাপারটি তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, এছাড়া কোনও উপায় নেই।
টাকা ছাড়া এমপিওভুক্তির কাজ কখনও হয়নি। এখনও হবে না। মন্ত্রী সাহেবরা তাদের কথা বলেছেন। আমাদের কাজ আমাদেরই করতে হবে। তবে এ মাদরাসা প্রধান যেমন তদবিরকারীদের দেয়া শতভাগ নিশ্চয়তার কথা বললেন, তেমনি খানিকটা হতাশাও প্রকাশ করলেন।
শিক্ষামন্ত্রীর সতর্কবাণী সম্পর্কে তার মধ্যে কিছুটা আশঙ্কাও রয়েছে বলে মনে হয়।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে এমপিওভুক্তির জন্য ১১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বর্তমানে এমপিওভুক্ত মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৬ হাজার ৩৪০টি। এর মধ্যে কলেজ ২ হাজার ৩৮৬টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৫ হাজার ৫১৫টি, মাদরাসা ৭ হাজার ৩৪৪টি এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৯৫টি। বর্তমানে সরকার অনুমোদিত অথচ এমপিওভুক্ত নয় এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৯৩টি।
এছাড়া এমপিওভুক্তির জন্য আরও প্রায় ৭ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। ১৯৯৭ সালে এমপিওভুক্তির সর্বশেষ নীতিমালা প্রণীত হয়েছিল।
গত বছর ১১ জুন এ সম্পর্কিত একটি নীতিমালার সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ১২ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়। ১৯৯৭ সালের নীতিমালার আলোকেই কমিটি নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নতুন নীতিমালায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও শিক্ষকনিয়োগসহ বেশকিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার দিন বদলের শ্লোগান দিয়ে জনগণকে মোহাচ্ছন্ন করে ক্ষমতায় এসেছে। বিশেষ একটি সংস্থার নির্বাচনী সহযোগিতার কথা দেশবাসী না ভুললেও এটা অন্তত আশা করে যে, অতীতের সরকারগুলো জনগণকে যেভাবে ভুগিয়েছে সেটা যেন বর্তমান সরকার না করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিকরণ নিয়ে অর্থ লেনদেন সম্পর্কে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রির হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও এ নিয়ে যেভাবে বাণিজ্য চললো তা শিক্ষকসমাজসহ সমগ্র দেশবাসীকে হতবাক ও বিস্মিত করে তুলেছে। ইতোমধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা কোটি কোটি টাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন। এরপরও সকলের প্রত্যাশা পূরণ কিন্তু হলো না।
এবার প্রায় ১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। তবে এবার যেসব প্রতিষ্ঠান বাদ পড়েছে সেগুলোকে আগামী ডিসেম্বরের আগে এমপিওভুক্ত করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এমপিওভুক্তির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে গত দু'তিন দিনে সারাদেশের ৫৪ জন এমপি নিজনিজ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির জন্য তদবির করতে শিক্ষামন্ত্রণালয়ে এসেছিলেন বলে জানা গেছে। শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে তাদের জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও অর্থমন্ত্রণালয়ের শর্তানুসারেই এমপিওভুক্তির কাজ সম্পন্ন হয়। অন্য কোনও উপায়ে এমপিওভুক্তি সম্ভব নয়।
বাছাই কমিটি জানায়, অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে কাজ হয়। তালিকা তৈরি করতে কমিটি হিমসিম খায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো নির্দেশ মোতাবেক মোট ১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার কথা। এর মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্কুল ৪শ' স্কুল ও কলেজ ১০টি, কলেজ ৭৫টি, ভোকেশনাল স্কুল ও কলেজ ৩শ'টি মাদরাসা ১শ'টি এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ ১১৫টি। তবে কোনও কোনও এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে শুধু শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করার নির্দেশ ছিল বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ খবর হচ্ছে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এমপিওভুক্তির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।