আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শীতলক্ষ্যা মরে গেছে, নারায়ণগঞ্জ কি বেঁচে আছে ?

জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই
শীতলক্ষ্যা বাঁচাও, নারায়ণগঞ্জ বাঁচাও - শ্লোগানটি শুনে মনে হয় শীতলক্ষ্যা এখনও বেঁচে আছে। আসলে শীতলক্ষ্যা মারা গেছে বহু আগেই। আজ শীতলক্ষ্যার পানি ব্যবহারের অনুপযুক্ত - কোন কাজেই ব্যবহার করার উপযুক্ত নেই এই নোংরা কালো পানি। যেই নদীর পানি ব্যবহারের উপযোগী নয়, সেই নদীকে মৃত নদী ছাড়া আর কি বলা যায় ? এই নদীকে গলা টিপে মেরেছে আমাদের সীমাহীন লোভ - মুনাফা ও সম্পদের লোভ। দূষণ ও দখলে এই নদী আর নদী নাই, একটা নোংরা ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

যে পেরেছে সেই এই নদীকে দূষিত করেছে - পৌরসভার নর্দমা, ডাইং কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল, সার কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য। আইন-কানুন অনুসারে নদীতে শিল্প বর্জ্য বা বিষাক্ত কেমিক্যাল ফেলার আগে পরিশোধন করার নিয়ম। এই নিয়ম কেউ মানে না - কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানই এই নিয়মের তোয়াক্কা করে না। বেশির ভাগ ডাইং কারখানার কোন পরিশোধন প্লান্ট নাই। পরিশোধন প্লাট বসানোর খরচ এই কারখানার মালিকগুলোর কাছে একটা বাহুল্য খরচ।

মুনাফায় নিজের ব্যাংক একাউন্ট ফুলে ফেপে উঠবে, বাড়ি গাড়ি হবে, টাকার পাহাড় হবে, কিন্তু তার খেসারত দিতে হবে আশেপাশের পরিবেশকে - এই অনাচার কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। একটা সহজ নিয়ম হল, পরিবেশের যেই উপাদান আপনি সৃষ্টি করতে পারবেন না, সেই উপাদান ধ্বংস করার কোন অধিকার আপনার নাই। পানি, মাটি, বায়ু - এই তিনটি উপাদান তেমন উপাদান। আমরা কেউ পানি, মাটি বা বায়ু সৃষ্টি করতে পারি না। সুতরাং পরিবেশের সদা ব্যবহার্য এই তিনটি উপাদানকে দূষিত করার অধিকার আমাদের কারও নাই।

পরিবেশের এই তিনটি উপাদানে পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীর সমান অধিকার। কোন শিল্প কারখানার মালিকের কাছে পরিবেশকে ইজারা দেয়া হয় নি। তাদের মুনাফার স্বার্থে পরিবেশের কোন উপাদানকে দূষিত করার অধিকার তাদের নাই। শীতলক্ষ্যা নদী আমাদের পানির উৎস। এই পানির উপর অধিকার আমাদের নারায়ণগঞ্জবাসী সবার।

এই পানি পান থেকে শুরু করে সকল কাজে ব্যবহার করার অধিকার আমাদের আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের তথা জনগণের এই সার্বজনীন সম্পদকে দূষণ করে নষ্ট করার অধিকার কারও নাই। যারা এই কাজ করছেন, তারা কঠিন অপরাধ করছেন। একজন মানুষকে খুন করলে কেবল একজনই মারা যায়, কিন্তু পরিবেশ দূষণ করলে সেই পরিবেশে বসবাসকারী প্রতি মানুষ তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। যিনি দূষণ করেন, তিনিও এই দূষণের শিকার হন, তার সন্তান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এই দূষণের কুফল থেকে রেহাই পান না।

এই সব বিষাক্ত কেমিক্যালের কুফল দীর্ঘ দিন ভোগ করতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। সুতরাং পরিবেশ দূষণ করা কোন সাধারণ অপরাধ নয়, কঠিন অপরাধ। কঠিন অপরাধের জন্য কঠিন শাস্তিই কাম্য। জেল-জরিমানাসহ কঠোর শাস্তি দিতে হবে এই সব অপরাধীর। পরিবেশ দূষণ করে মুনাফা, আসলে কোন মুনাফা নয়।

কেননা, আমরা যদি সুস্থ ও নিরোগ জীবনযাপন না করতে পারি, তবে সেই মুনাফা আমাদের কোন কাজে আসবে না। দূষণের ফলে আমাদের দেশে পেটের পীড়া ভীষণ বেড়েছে। বেড়েছে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার। আমরা যে পানি পান করছি, সেটা আসছে শীতল্যা থেকে, সেই পানি বিশুদ্ধকরণের পরেও বিষাক্ত কেমিক্যালের প্রতিক্রিয়া থেকে যাচ্ছে। শীতল্যার পানি এতটাই দূষিত হয়েছে যে, শোধিত পানিও আজ আর শোধিত নয়, ভয়াবহ সব কেমিক্যাল মিশে আছে এই পানিতে।

ফলে ক্যান্সারসহ নানারকম নতুন নতুন জটিল রোগের ঝুঁকির মধ্যে বাস করছি আমরা। আরেকটা ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে চলেছে। এই সব শিল্পবর্জ্য কেবল নদীর পানিতে নষ্ট করেছে তা-ই নয়। এই বিষাক্ত কেমিক্যাল থেকে সেচ দেয়া হচ্ছে, সেই সেচের পানি থেকে এই সব কেমিক্যাল ঢুকে পড়ছে বিভিন্ন ফসলের দেহে। নষ্ট হচ্ছে না এই এই কেমিক্যালের কার্যকারিতা।

ফলে আমরা যখন সেই ফসল খাচ্ছি, তখনও আমরা স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়েই চলেছি। মাটি, পানি, বায়ু - আমাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার নেয়ামত। আমাদের সবার জীবনযাপনের জন্য এই পরিবেশের উপাদানগুলো সার্বণিক দরকার হয় আমাদের। পানি আমরা পান করি, ময়লা ধুয়ে পরিষ্কার করি পানি দিয়ে। আমাদের দেহের এবং চারপাশের ময়লা পরিষ্কার করি পানি দিয়ে।

যা দিয়ে আমরা ময়লা ধুই, পবিত্র হই, সেটাকে ময়লা করার চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছু হতে পারে না। তাই সকল শিল্প কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। যারা এই নিয়ম মানবেন না, তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। অন্য দিকে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে শীতলক্ষ্যার পাড় দখল চলছে দীর্ঘদিন থেকে। যারা নদীর পাড় দখলমুক্ত রাখার দায়িত্বে তাদের দায়িত্বহীনতা, পরিকল্পনার অভাব, পরিচর্যার অভাবের ফলে আজ নদীর দু’ধারে কেবল দখলদারের সংখ্যা বেড়েছে ।

রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে যে যেদিক দিয়ে সুযোগ পেয়েছে, নদীর জায়গা দখল করে শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ঘর-বাড়ি নির্মাণ করেছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের তরফ থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের লক্ষ্যে অভিযান চালানো হলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে মাঝ পথে অভিযান থেমে যায়। তারপর আবারও দখল হয়ে গেছে উচ্ছেদকৃত এলাকা। ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য দখলদাররা নবউদ্যমে দখল করা শুরু করেছে। এই দখলমুক্তকরণ ও দখল করার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

যারা দখল করেছে, তাদের কেবল উচ্ছেদ করলেই হবে না, তারা এই দখলের মাধ্যমে যে মুনাফা করেছে তা বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং তাদের জেল জরিমানা দিতে হবে। পাশাপাশি দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালনে কেন বার বার ব্যর্থ হচ্ছে সেটাও দেখা দরকার। সর্ষের ভুত না তাড়ালে কোন দিনও আসল ভুত তাড়ানো যায় না। তাই দায়িত্বে অবহেলাকারী এই সব লোকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠোরভাবে দখল বন্ধ না করলে শীতলক্ষ্যা নদী কোন দিনও নাব্যতা ফিরে পাবে না।

ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য সরকারের নির্দেশ ও পরিকল্পনা বারবারই অসার বলে প্রমাণিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেষে রাস্তা নির্মাণের কথা আমরা দীর্ঘকাল ধরে শুনে আসছি। আদৌ সেটা হবে কি না আমরা জানি না। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ধীর গতি আমাদের একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে শত শত পরিকল্পনা করলেও বাস্তবে তার সুফল আমরা কোন দিনও পাব না।

আজ সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর। মুনাফার লোভে যারা আজ পরিবেশের শত্রু, শীতলক্ষ্যার শত্রু , তাদের রুখতে হবে। তাদের কোন অধিকার নাই পরিবেশকে ধ্বংস করে মুনাফার পাহাড় গড়ার। আজ সচেতন মানুষকে একত্রিত হতে হবে এই দূষণ ও দখলের বিরুদ্ধে। কেননা, সম্মিলিত জনমত ছাড়া কোন পরিবর্তন স্থায়ী হয় না।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।