আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ(তৃতীয় পর্ব)

সবাইকে সাথে নিয়ে এগুতে চাই।

ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস ধর্মনিরপেক্ষতা মূলত আধুনিক বিশ্বে মানুষের চিন্তাপ্রসুত মতবাদ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে এ মতবাদরে জন্ম হয়। আর আঠারো শতাব্দীর প্রথমার্ধে তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইউরোপীয়রা যখন জ্ঞান চর্চায় বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছিল ঠিক তখন তারা ধর্মীয় চেতনা থেকে ক্রমেই দূরে সরে গিয়ে জন্ম দেয় ধর্মবিবর্জিত প্রগতিশীল চিন্তাধারার।

ইউরোপে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান বেশ বিকশিত হয় তখন খ্রিষ্টান পাদ্রীদের মনগড়া গবেষণাহীন মতামত জ্ঞান গবেষকদের নিকট ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের রহস্য যতই উদঘাটিত হতে থাকে, পাদ্রীদের সাথে বিজ্ঞানীদের মত-বৈষম্য ততই প্রকট আকার ধারণ করে। বিজ্ঞানীদের প্রত্যেক নতুন নতুন তথ্য ও আবিষ্কার সমকালীন পাদ্রীদের ভ্রান্তি প্রমাণ করলে পাদ্রীরা গণ ধর্মের দোহাই দিতে আরম্ভ করে এবং শাসন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে গবেষকদের শাস্তি দিতে উদ্যত হয়। এমন কি এক পর্যায়ে তারা বিজ্ঞানীদেরকে বেত্রাঘাত থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কার্যকর করে। এ নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাদ্রীদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনতা ও চিন্তাশীলদের মাঝে চরম বিদ্রোহ দানা বেধে উঠলো।

এক পর্যায়ে বিদ্রোহীরা আত্মবিশ্বাসের সাথে বেপরোয়াভাবে পাদ্রীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সংগ্রাম ঘোষণা করে। পাদ্রীরা ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং ধর্মান্ধ নেতার সহায়তায় রাজশক্তির মাধ্যমে নিয়ে দৃঢ়ভাবে এ বিদ্রোহ প্রতিরোধ দমন করতে বদ্ধপরিকর হয়। অপরদিকে বিদ্রোহীরা জীবনের সকল বিভাগ থেকে পাদ্রীদেরকে উৎখাত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্বক্রীয় আন্দোলন গড়ে তুললো। সূদীর্ঘ দু‘শ বছর ধরে এ ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলতে থাকে। এটি ইতিহাসে গীর্জা বনাম রাষ্ট্রের লড়াই নামে পরিচিত।

দীর্ঘ দু‘শ বছর অবিরাম সংগ্রামের ফলে উভয় পক্ষই বিব্রতকর অবস্থায় পতিত হয়। অবশেষে সংস্কারপন্থীদের নেতৃত্বে দু‘পক্ষের মধ্যে আপোষের প্রবণতা জোরদার হয়ে ওঠে। মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে পরিচালিত এ আন্দোলন আপোষ আন্দোলন নামে খ্যাতি লাভ করে। এ আন্দোলনর প্রস্তাব ছিলো ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং মানুষের ধর্মীয় বিষয় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চার্চের উপর অর্পিত থাকবে। কিন্তু পার্থিব জীবনের সকল দিকের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যাস্ত থাকবে এবং পার্থিব কোন বিষয়েই চার্চের কোন প্রাধান্য থাকবে না।

অবশ্য রাষ্ট্রের নেতৃ-বৃন্দকে চার্চের নিকটই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করার সময় শপথ গ্রহণ করতে হবে। সকল অবস্থা বিবেচনা করে উভয় পক্ষ এ প্রস্তাব মেনে নেয়ার ফলে বিদ্রোহের দাবানল নির্বাপিত হয়। এভাবে ধর্মীয় ভাবধারাকে সমাজ ও রাষ্ট্র জীবন থেকে নির্বাাসিত করে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার উন্মেষ ঘটে। এ মতবাদের সূচনার পর থেকে এটি ধীরে ধীরে আমেরিকায় বিস্তার লাভ করে। এবং আমেরিকার সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য মূলধারা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

১৯০৫ সালে ফ্রান্সকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর রাশিয়া ও চীনে এ মতবাদ দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করে। যদিও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কোন আধুনিক সৃষ্টি নয়, তবুও একটি আদর্শ হিসেবে বর্তমানকালে এর প্রচার চলছে। একটি মতাদর্শ হিসেবে আধুনিক ও প্রগতিশীল বলেই এক শ্রেণীর নিকট এর সুনাম। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এ আধুনিক সংস্করণ প্রায় আড়াই শত বছর সংগ্রামের পর আঠার শতাব্দীর প্রথমার্ধে তা বিজয়ী মতাদর্শ হিসেবে কায়েম হলেও এ মতাদর্শের ইতিহাস পাঠ করে কারো এ ধারণা করা উচিত নয় যে, পনের শতাব্দীর পূর্বে কোন কালেই এ মতবাদ দুনিয়ায় প্রচলিত ছিল না।

প্রকৃতপক্ষে পূর্ণাঙ্গ ধর্মের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের লড়াই চিরন্তন। যখনই আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান মানব সমাজে কায়েম করার উদ্দেশ্যে নবী ও রাসূলগণ চেষ্টা করেছেন তখনই শয়তান ও তার বাহিনীর পক্ষ থেকে নানা অজুহাতে প্রবল বিরোধিতা হয়েছে এবং কিয়ামতের আগপর্যন্ত হতে থাকবে। আল্লাহর বাণী, وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلآئِكَةِ اسْجُدُواْ لآدَمَ فَسَجَدُواْ إَلاَّ إِبْلِيسَ قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا قَالَ أَرَأَيْتَكَ هَـذَا الَّذِي كَرَّمْتَ عَلَيَّ لَئِنْ أَخَّرْتَنِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لأَحْتَنِكَنَّ ذُرِّيَّتَهُ إَلاَّ قَلِيلاً قَالَ اذْهَبْ فَمَن تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزَآؤُكُمْ جَزَاء مَّوْفُورًا وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِم بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الأَمْوَالِ وَالأَوْلادِ وَعِدْهُمْ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلاَّ غُرُورًا إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ وَكَفَى بِرَبِّكَ وَكِيلاً “স্মরণ করো, যখন আমি ফেরেশতাদের বললামঃ আদমকে সিজদা করো, তখন সবাই সিজদা করলো কিন্তু ইবলীস করলো না। সে বললো, আমি কি তাকে সিজদা করবো যাকে তুমি বানিয়েছো মাটি দিয়ে? তারপর সে বললো, দেখোতো ভাল করে তুমি যে একে আমার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছো, এ কি এর যোগ্য ছিলো? যদি তুমি আমাকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত অবকাশ দাও তাহলে আমি অল্প কয়েকজন ছাড়া তার বংশধরদের সমূলে নষ্ট করে ফেলবো। আল্লাহ্ বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও, এদের মধ্য থেকে যারাই তোমার অনুসরণ করবে তুমিসহ তাদের সবার জন্য জাহান্নামই হবে পূর্ণ প্রতিদান।

তুমি যাকে যাকে পারো তোমার দাওয়াতের মাধ্যমে পদস্খলিত করো,তাদের ওপর অশ্বরোহী ও পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ চালাও,ধন-সম্পদে ও সন্তান-সন্ততিতে তাদের সাথে শরীক হয়ে যা এবং তাদেরকে প্রতিশ্র“তি দে;শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্র“তি দেয় তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়-নিশ্চিতভাবেই আমার বান্দাদের ওপর তোর কোন কর্তৃত্ব অর্জিত হবে না। এবং ভরসা করার জন্য তোমার রবই যথেষ্ট। (বানী ইসরাঈল,৬১-৬৫)। শয়তানের বাহিনী বলতে এমনসব জিন ও মানুষকে বুঝানো হয়েছে, যারা বিভিন্ন আকৃতিতে ও বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইবলীসের মানব বিধ্বংসী অভিযানে সহযোগিতা করছে। মানুষের মধ্য থেকে যারা ইবলীসের বাহিনী হিসেবে কাজ করে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- আল্লাহদ্রোহী রাষ্ট্রশক্তি, রাজনৈতিক মতাদর্শ, অর্থনৈতিক ময়দানে শোষক গোষ্ঠী,এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ ইত্যাদি।

সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই ইবলীস আদম সন্তানদের পেছনে লেগেছে। সে তাদেরকে আশার ছলনা দিয়ে ও মিথ্যা প্রতিশ্র“তির জালে জড়িয়ে সঠিক পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে একথা প্রমাণ করতে চায় যে, আল্লাহ তাদেরকে যে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তারা তার যোগ্য নয়। ইবলিসী শক্তি বহুরূপী। এক এক যুগে এক এক রকমের বেশ পরিবর্তন করে,পোষাক পরিবর্তন করে তার আবির্ভাব ঘটে। এর আধুনিক রূপ হচ্ছে, পুঁজিবাদ,সমাজবাদ,ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি।

এ মতবাদ সমূহ মানব জাতিকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে ইবলিসী শক্তির ক্রীড়াণকে পরিণত করে চলেছে। এ বিপদ থেকে যদি কোন জিনিস মানুষকে বাঁচাতে পারে তাহলে তা হচ্ছে কেবল এই যে, মানুষকে তার রবের ইবাদতের ওপর অবিচল থেকে তাঁরই পথনির্দেশনা ও সাহায্য লাভের জন্য একমাত্র তাঁরই দিকে রুজু করতে হবে এবং একমাত্র তাঁরই প্রতি নির্ভরশীল হতে হবে। এ ছাড়া দ্বিতীয় যে কোন পথই মানুষ অবলম্বন করবে তার সাহায্যে সে শয়তানের জাল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারবে না। ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের প্রকার ভেদ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদেরকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। এক শ্রেণীর পরিচয় খুব স্পষ্ট।

তারা ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে প্রচার করে বটে, কিন্তু তাদের অনেকেরই ব্যক্তি জীবনে ধর্মের কোন গন্ধও পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে তারা ধর্মকে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় জিনিস বলে মনে করে, কিন্তু সামাজিক মর্যাদা, রাজনৈতিক সুবিধা ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনের তাকিদে ধর্মকে মৌখিক স্বীকৃতি দান করে মাত্র। দ্বিতীয় প্রকার তারা নামায, রোযা, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ, যিকির ইত্যাদি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে আদায় করে, কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামী বিধানকে মেনে চলার কোন তাকিদই অনুভব করে না। কুরায়শ কাফিররা মহানবী (স কে বলেছিল “তুমি এক বছর আমাদের ইলাহ্ ইবাদত কর আমরাও এক বছর তোমার ইলাহ্ ইবাদত করব। ’তদ্রƒপ বর্তমান যুগের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা বলে আমরা মসজিদে আল্লাহর ইবাদত করবো বাইরে তথা রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে অন্যের আনুগত্য করবো।

অথচ আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরিভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। ’ আল্লাহর কিতাবকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ না করে যারা শুধু ইসলামের কতিপয় অনুষ্ঠান নিয়েই সন্তুষ্ট, তাদের প্রতি কুরআন যে কঠোর সতর্ক বাণী উচ্ছারণ করেছে, তা যে কোন সত্যিকার মুসলমানের অন্তরকেই কাঁপিয়ে তুলবার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ পাক বলেন, ْ أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاء مَن يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنكُمْ إِلاَّ خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ “তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর ও কিছু অংশ অবিশ্বাস কর ? অতএব তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের পার্থিব জীবনে লাঞ্চনা ও অপমান ব্যতীত কিছুই নেই। আর পরকালে তাদেরকে ভয়ংকর শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে এবং তোমরা যা করছো আল্লাহ্ সে বিষয়ে অমনোযোগী নন। ” (বাকারাহ্-৮৫)।

وَيقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُواْ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلاً أُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا “আর যারা বলে আমরা কিছু বিশ্বাস করি আর কিছু প্রত্যাখ্যান করি এবং তারা এ মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করতে ইচ্ছা করে, প্রকৃতপক্ষে ওরাই অবিশ্বাসী, এবং আমি এ ধরনের অবিশ্বাসীদের জন্যে অবমাননাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। ” (নিসা-১৫০,১৫১)। ফলাফল যদি এই হয় তাহলে, কোন মুসলমানের পক্ষে কি ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ গ্রহণ করা উচিত?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.