আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চোরাবালি জীবনের চোরাই গল্প

পরাঞ্জয়ী...

সকাল থেকেই গা টা শির শির করছে নোমান সাহেবের। শীত শীত ভাব একটা। বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চাইছে না। জানলা দিয়ে রোদটা পড়ছে মুখের ওপর। এক কাপ চায়ের তেষ্টায় বুকটা কেমন কেমন করছে।

রাহেলা নেই। থাকলে না বলতেই হাজির কোরতো হয়ত। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি। মেহগনি গাছটিতে ফল দেখা দিয়েছে। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে।

মাঝে মাঝে মেহগনি ফল গুলোকে নোমান সাহেবের কাছে বড় সড় সাইজের কাঠবাদাম মনে হয়। একটা ছোট্ট পাখি এ ডাল থেকে ও ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। চাদর টা গা থেকে ফেলে দিয়ে উঠে জানলায় গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। রাস্তায় একটা রিকশা দাঁড়িয়ে। রিকশাওয়ালা ভ্যানের উপর ফেরী করা চায়ের স্টল থেকে চা খাচ্ছে।

ডান হাতে চায়ের কাপ, বাম হাতে একটা বন রুটি। নোমান সাহেবের মনে হল তারও ক্ষুধা পেয়েছে। হাতঘড়িটার দিকে তাকালেন। পৌনে এগারটা। এত বেলা হল কেউ ওনাকে নাস্তা খেতে ডাকেনি।

রাহেলা কে খুব মনে পড়ছে। কতবেলা সকাল আট টায় ঠেলে ঠুলে ওঠাতো নাস্তার জন্য। কতদিন রাগ করেছেন নোমান সাহেব। তবুও শুনতো না সে! বৌমা হয়ত তার ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত। কত কাজ! স্বামীর অফিস, ছেলের স্কুল।

সময় কোথায় শ্বশুরের খোঁজ রাখবার। বেচারী একা মানুষ! নিজের মনকে বোঝান তিনি। গোসল টা সেরে নেয়া দরকার। গরম পানি হলে ভালই হত। কিন্তু কোমরের ব্যাথায় ভারি কিছু উঠাতেই পারেন না তিনি।

চুলা টা আবার উঁচুতে। অগত্যা ঠান্ডা পানিতেই গোসলটা সারতে হবে ভেবে বাথরুমে ঢুকলেন তিনি। গামছা নিয়ে গোসলে ঢুকতে প্রায়ই ভুলে যান তিনি। রাহেলা থাকতে বাথরুম থেকেই ডেকে বলতেন "এ্যাই গামছা টা দিয়ে যাও তো"। আধা-ভেজা শরীরে আবার বের হলেন তিনি।

বালতি ভরতে দিয়ে তিনি বাথরুমের মেঝেতেই বসে পড়লেন । ভীষণ মনে পড়ছে রাহেলার কথা। রাহেলা প্রায়উ বলতো "আমি যখন থাকব না তখন বুঝবে তুমি, তখন তোমার এই ভাই বোন কেউ কাজে লাগবে না"। নোমান সাহেব ভাবতে থাকেন "খুব বেশি কষ্ট দিয়েছিলাম রাহেলা কে। ভাই, ভাবী, বোনদের কথা শুনে রাহেলাকে কষ্ট দিতাম, রাগারাগি করতাম, রাহেল কাঁদত আর বলতো "একদিন কেউ থাকবেনা, তখন আমাকেই পাবা পাশে"!! রাহেলার সেই চোখের জলের শোক কি অভিশাপ হল আজ? সত্যি তো আজ রাহেলাকে বড্ড দরকার নোমান সাহেবের।

রাহেলার মত করে তাঁর রয়োজন টা আড় কে বোঝে!! পানি ভরে বালতি উপচে পড়ে। ঠান্ডা পানিতে হাত দিয়ে শিউরে উঠেন তিনি। সাবান মাখতে চিরদিনই বড্ড অলস তিনি। আর ঠান্ডায় তো নয়ই। কোনমতে গায়ে পানি ঢেলে বের হলেন তিনি।

বারান্দার রোদে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। নাহ ক্ষুধায় পেট টা চোঁ চোঁ করছে। ডাইনীং রুমে গিয়ে দেখলেন বৌমা মনে করে তাঁর নাস্তাটা ঢেকে রেখে গেছে। মনে মনে খুশিই হলেন। ঢাকনা উঠিয়ে দেখলেন তেলে ভাঁজা পরোটা আর আলু ভাজি।

বৌমা প্রায় প্রতিদিনই ভুলে যায় যে শ্বশুরের তেলে ভাঁজা পরোটা খাওয়া নিষেধ। "বেচারী কত আর মনে রাখবে!" ভাবেন নোমান সাহেব। "কত কাজ তার, ছেলেকে স্কুলে দেয়া, পুরোনো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গল্প করা মাঝে মাঝে, নিজের বুড়ো মা-বাপ কে দেখতে যাওয়া, মাঝে মধ্যে শপিং"। ডিম পোজ করে খেয়ে নিবেন ভেবে উঠে ফ্রীজ খুলে ডিম বের করতে গিয়ে দেখলেন, ফ্রীজ লক করা। " দাদু ভাইটার জ্বালায় ফ্রীজটা খোলা রাখাই যায়না, ঠান্ডার মধ্যে আইসক্রীম খেয়ে সাবাড় করে" মুচকি হাসলেন তিনি! আলু ভাঁজি টা বৌমা একেবারে খারাপ করেনা।

আলু ভাঁজি দিয়ে একটা পরোটা খেয়ে উঠে যান তিনি। ইদানীং চোখ দিয়ে অকারনেই পানি ঝরে!!!!!! বয়স হয়েছে কিনা!!!! আবার বারান্দায় গিয়ে বসেন তিনি। তাদের ২ ছেলে ১ মেয়ে। রাহেলার খুব ছেলের সখ ছিল, আর নোমান সাহেবের মেয়ের। নোমান সাহেব মেয়ের নাম রেখেছিলেন "নোরা"।

নোমান এর "নো" আর রাহেলার "রা"। ২ছেলে রাকিব আর রাহাত। তিনজনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নোমান সাহেব। নিজের জন্য বলতে গেলে কিছুই রাখেননি। মেয়েটি ভীষণ মেধাবী।

স্কলারশীপ নিয়ে দেশের বাইরে গেল, বিয়ে করলো তারপর সেখানেই সেটেল হল। নোমান সাহেব যৎসামান্য পেনশন পেয়েছিলেন তা তিনি ২ ছেলের শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। বাবা-মা কে খাওয়ানোর জন্য তো তারা আছেই!!! কিন্তু গোল বাঁধলো তখন যখন যোগ্য ছেলেরা জানালো দুর্মূল্যের বাজারে দুইজন মানুষকে একসাথে টানা ভীষণ কঠিন। তাছাড়া ২কক্ষের ফ্ল্যাটে রুম শেয়ার করে থাকতে হবে! রাহেলাই স্বিদ্ধান্ত নিল দু'জন দুই ছেলের কাছে থাকবেন। প্রথম প্রথম চিৎকার চেচামেচি করলেন নোমান সাহেব, অতঃপর অনুরোধ উপরোধ! কাজ হল না।

শেষ মেশ রাগ করে রাহেলা কেই বললেন "আমার উপর বুড়ো বয়সে শোধ নিতে চাও? নাও! তুমি পারলে আমিও পারব"। রাহেলা আড়ালে চোখ মুছেন। তারপর চলে যান ছোট ছেলের কাছে! সেই থেকে মাত্র ২ বার দু'জনের দেখা হয়েছে গত ৮ মাসে! বুকটা খচ খচ করে উঠে নোমান সাহেবের। নোমান সাহেবকে ছেড়ে রাহেলা কোথাও যেত না। এমনকি বাপের বাড়ি গিয়েও না।

বাপের বাড়ি রেখে আসতে চাইলে হাত পা ছড়িয়ে কেঁদে বুক ভাসাত সে। অফিস ছুটি নিয়ে বউয়ের আঁচল ধরেই থাকতে হত তাঁর। কত আহ্লাদ যে করতো। রাকিবের যখন জন্ম হল তখনও সে তাকে মাঝখানে নিয়ে ঘুমাতে দিত না। নিজে নোমান সাহেবকে জড়িয়ে ঘুমাত আর রাকিব থাকত এক পাশে।

এমনি করে একদিন রাকিব খাঁট থেকে পড়ে যায়! ব্যাথাও পেয়েছিল ভীষণ। তবু শিক্ষা হয়নি রাহেলার। সেই রাহেলা কিনা নিজেই আলাদা হয়ে গেল!! বুকটা চিনচিন করে ওঠে আবারও। মাথাটা ঘুরছে ভীষণ। উঠে বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি।

কোথায় যেন তার খুব প্রিয় মোহাম্মদ রফির " ক্ষ্যোয়া ক্ষ্যোয়া চাঁণদ , খোলা আসমা...." গানটা বাজছে। বাজছে নাকি তিনি ভুল শুনছেন কে জানে! রাহেলা কে ফোন করার জন্য উঠে গেলেন আবার। ফোনের কাছে গিয়ে আবারও মাথাটা চককর দিল। পড়ে গেলেন তিনি। রিং হওয়ার আওয়াজ শুনলেন।

রাহেলা কথা বলছে বোধ হয়। নাকি ভুল শুনছেন! না, তিনি তো ডায়াল করেন নি। রাকিবের কন্ঠ শুনতে পেলেন "গত কয়েকমাস ফোনের বিল এত বেশি কেন আসছে?", রাকিব আবার বলছে "বাবা অপ্রয়োজনে বেশি ফোন কোরনা!" আবার শুনলেন ছোট্ট রাকিব বলছে "বাবা, বাবা আমাকে একটা হ্যালো হ্যালো কিনে দিবা?"। রাহেলা ছেলেকে বকছে, নোরার চুল এলোমেলো তাই চুলের মুঠি ধরে মেয়েটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অস্ফুটে নোমান সাহেব বললেন "আমার মেয়েটাকে মারবেনা বললাম!" (( একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ, উত্তর কমলাপুর নিবাসী রাকিব আহমেদের পিতা নোমান আহমেদ আজ দুপূর ২ ঘটিকায় মৃত্যুবরণ করেছেন, ইন্নালিল্লাহী....................রাজেউন" তার নামাজে জানযা অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল বাদ মাগরীব, তার কন্যা আমেরিক থেকে এসে পৌঁছানোর পর")))


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।