আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি আরবি গল্পের অনুবাদ

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

গল্পের নাম: কিভাবে আমি এক রাতের জন্য পিশাচ হয়ে ছিলাম লেখক:ইব্রাহিম আবদ আল -কাদির আল-মাজিনি বাংলা অনুবাদ করেছেন: সুমন সোহরাব ইব্রাহিম‘ আবদ আল-কাদির আল-মাজিনি(১৮৯০-১৯৪৯) মিসরিয় সমালোচক, কল্পকাহিনী লেখক, কবি, প্রবন্ধকার ইব্রাহিম ‘আবদ আল-কাদির আল-মাজিনি ছিলেন বিখ্যাত দিওয়ান দলের এক জন সদস্য। তার সাথের অন্যান্যরা হলেন ‘আব্বাস এম. আল-‘কুয়াদ এবং ‘আবদ আল-রাহমান শুকুরি। অন্য আরো অনেক নামকরা সাহিত্যিকের মত তিনিও বিভিন্ন ধারার সাহিত্য রচনা করেছেন।

প্রচন্ড রোমান্টিক ধরনের কাব্য রচনার মধ্যদিয়ে তার সাহিত্য জগতে তার আতœপ্রকাশ ঘটে। ১৯২০ এর দিকে তিনি গদ্য রচনার দিকে ঝুঁকে পরেন। রসাত্মক আঙ্গিক এবং পারিপার্শি¦ক অবস্থা অনুসারে মানব চরিত্র চিত্রনের মুন্সিয়ানার কারনে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তার কল্প কাহিনী গুলোর মধ্যে পুরোমাত্রায় আত্মচরিতের ধাচে রচিত ইব্রাহিম আল-খতিব ১৯৩০ এর দিকে পুরো আরবে জুড়ে তাকে খ্যাতি এনে দেয়। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে মাগদি ওহাবা ইব্রাহিম দ্যা রাইটার নামে এর ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করেন।

তার অন্যান্য কল্পকাহিনী গুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যাজিক বক্স অব দ্যা ওয়াল্ড(১৯২৯), কবওয়েবস(১৯৩৫), থার্টি ম্যান এন্ড এ ওমেন(১৯৪৩), এবং ইব্রাহিম দ্যা রাইটার এর পরের অংশ ইব্রাহিমওও (১৯৪৩) , এটি অশিংক আত্মচরিতের ধাচে রচিত। কিভাবে আমি এক রাতের জন্য পিশাচ হয়ে ছিলাম যখন আমি ছোট ছিলাম, বয়স ষোল কি সতের, তখন থেকে আমি হাতের কাছে পাওয়া কম বেশী সব সুযোগই কাজে লাগাবার আপ্রান চেষ্টা করতাম। সেই সময় আমি কেবল যে সময়টা পার করছিলাম তার কথাই মাথায় রাখতাম। আমি নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য আকুল ছিলাম। পরিপূর্ণতা পাওয়ার জন্য আমি ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড এক যাতনায় ভুগছিলাম।

সুরা পান আর গানটান শুনে সারাটা রাত বন্ধুদের সাথে কাটাবার পর একদিন অবাক করা এক গ্রীষ্মের রাতে বাড়ি ফিরি। ভোর হয় হয় অবস্থা। এমন সময় ঘরের দরজার কাছে চলে আসা মাত্র মনে পরে, নব্বই বছর বয়স্কা দাদি ছাড়া এখন বাড়িতে আর কেউই নেই। এ অবস্থায় ভেতরে ঢোকার চাবিটা পর্যন্ত নেই আমার কাছে। আপন মনে ভাবতে ভাবতে নিজেকে আমি নিজেই প্রশ্ন করলাম “এখন কি দাদিকে আমার বিরক্ত করা ঠিক হবে? হঠাৎ করে পড়িমড়ি করে উঠতে গিয়ে সে হয়তো বড় ধরনের কোন আঘাত পেতে পারে।

দেয়ালে ধাক্কা খেয়েও পড়ে যেতে পারে। বরং তাকে খানিকটা বিশ্রাম দিয়ে মা আর ভাইয়ের কাছেইবা যাইনা কেন। আর যাই হোক আকাশটা আজ খুব পরিষ্কার। হেটে হেটে নিজেকে একটু তরতাজাও করে নেয়া যাবে। এত সব সাত পাঁচ ভেবে আমি দরজা ছেড়ে ঘুরে দাড়ালাম, বাড়ি ছেড়ে চলে আসলাম।

তখনো ইমাম সাফি মসজিদে যাবার পথটি বাধানো হয়নি। রাস্তায় তখন কোন ট্রাম বা বাতি পর্যন্ত ছিলনা। সব রাস্তার অবস্থা একই রকমের ছিল। মূল সড়ক ছেড়ে তাই আমি সাইদা নাফিসা মসজিদের পাসদিয়ে সোজা সাপ্টা পথ বেছে নিলাম। পথটি একটা কবর স্থানের মাঝ দিয়ে গিয়ে অন্য প্রান্ত আবার বড় রাস্তার সাথে মিশেছে।

যেতে যেতে প্রায়ই আমি এটা সেটার সাথে ধাক্কা খেয়ে ব্যাথা পাচ্ছিলাম। চারপাসে ছড়ানো ছিটানো অসংখ্য কবরের ভির ছিল বলে এমন হচ্ছিলো। এক সময় অন্ধকারে পথ খুজে নেয়াই আমার জন্য কষ্টকর হয়ে দাড়ালো। তার পরও আমি এসব নিয়ে কিছু ভাবছিলাম না। নিজের দুটি পায়ের ওপর অঘাত বিশ্বাসে আমি এগিয়ে যাচ্ছি।

প্রতি দিনের মতই তারা হোচট খাচ্ছিলো। এখনো আমার মনে আছে, শেষ রাতে শোনা সেই গানের সুর তখনো আমার কানে বাজছে। আমার মন প্রান পুরোটা সত্তা তখন সেই সুরে আচ্ছন্ন। হাটতে হাটতে আমি তা অনুভব করছি। কিন্তু তারপরও কেন যেন মনে হচ্ছিলো এর মাঝ থেকে কোন একটা সুর যেন আমার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

এক সময় আমি সেই সুরটা ধরতে পারি। তাই কবরের একটা পাথরে হেলান দিয়ে থেমে সেটা ভালো মতো গাইতে চেষ্টা করি। আজো আমার মনে সেদিন কার সেই ছবি স্পষ্ট করে আঁকা আছে। নাটকিয় কোন ঘটনার মত এটি আমাকে অভিভুত করে না। কবরের কথা ভাবার বদলে কেন যে আমি সুর আর সুরার নেষায় বুদ হয়ে ছিলাম, এমন কি ছিল এর ভেতর? জীবনের উন্মাতাল এ সময়টাতে মরনের মুখোমুখি হলেও বুঝি মানুষ একবারের জন্য পরপারের কথা ভাবেনা? এর থেকেতো আমাদের কারুরি নিস্তার নেই।

কোন ভাবেই মরন থেকে পার পাওয়া যায় না। তার পরও কাঁচা বয়সের লোকেরা মরন নিয়ে একদমই ভাবেনা। হঠাৎ যখন তাদের কারো ভাগ্যে এটি ঘটে যায় তখন না বুঝেই ধরে নেয়া হয় পাহারের আড়ালে নিশ্চয় কিছু একটা লুকানো ছিল। ধরা ছোয়ার বাইরে অজানা একটা কিছু। মনোযোগ তখন পাহারের চুড়ায় আরহনে ব্যস্ত থাকে।

আর মজাদার অবাক করা সব ঘটনা ঘটে পাহারের ঢালে! আরো দূরে চূড়ার কাছাকাছি এসে ঘটনার সঙ্কটকাল চলতে থাকে। এর পরে কি আছে মাথার ভেতর কেবল এমন বিষ্ময় ঘুরপাক খায়। সে মৃত্যুর মানে খুজতে থাকে। ধীরে ধীরে এর আকর্ষনের নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ফলে এর পর থেকে তার মন-মানসিকতা পুরোপুরি এধরনের চিন্তা-ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকে।

মনে হয় পাহাড়ে আরোহনের অসম্ভব ক্লান্তি পেয়ে বসে তাকে। তাই বুঝি শরীর অবসন্ন হয়ে যায়। একারনেই জীবনের চূড়ায় উঠতে উঠতে যে কেউ বোকা বনে যায়। মৃত্যুর কথা চিন্তা করে বড় বেশী অসহায় বোধ করে। সব কিছু ভুলতে থাকে, ব্যক্তিগত কোন হিতাহিত জ্ঞান তখন আর তার মাঝে কাজ করে না।

যাই হোক কিছু ক্ষন এভাবে দাড়িয়ে ছিলাম, কবরের উপর দাড়িয়ে আপন মনে গান গাইছি। আঁধারের মাঝে আমার গলার স্বর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আসপাসে থাকা কবর বা এর নিচে চাপা পড়ে থাকা দেহাবশেষের প্রতি কোন বোধ কাজ করেনি সে সময়। এক সময় এসব লোক জন আমারি মত সজীব প্রানবন্ত যৌবন অতিক্রম করেছে। আনন্দে আহলাদে মাতোয়ারা থেকে আপন যৌবন কে অবহেলা করেছে।

তারা ভাবেনি সব জীবকে এক সময় বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে হবে, ভাগ্যের চুড়ান্ত মূহুর্তটিকে জড়িয়ে ধরতে হবে। আমি নিজেও অবাক হই কি করে মৃত্যু পুরির মত স্থির এ সাগরের মাঝে দাড়িয়ে থেকে মৃত্যুকে অস্বীকার করতে পারছি! আচ্ছা জীবন আসলে কেমন হওয়া উচিত? সত্যিই কি যুবকেরা করুনার পাত্র। ঠিক যেমন করে এতশত কবর দেখার পর মনটা মৃত্যুচিন্তায় কানায় কানায় ভরে ওঠে, তেমন? এমন পরিস্থিতিতে সব কিছুই কেমন যেন বিষাদ ঠেকে। মানুষের সব কৃতিত্ব আর চেষ্টা হঠাৎ কেমন এখানে এসে মিইয়ে যায়। এমন চিন্তা পুরো মানব জাতীকে দিন রাত কুঁড়ে কুঁড়ে খেলেইবা জীবনের জন্য কি এমন মঙ্গল হবে? আসলে মৃত্যু এক চুড়ান্ত হতাশা।

অন্যদিকে জীবনকে যথেষ্ঠ শক্তি দেবার জন্য স্রষ্টা আমাদের অবিরাম করুনা করে আসছেন। তাই বোধ হয় মানুষের অনুভুতি খুবই দৃঢ়। নিজের ওপর তার অনেক বেশী নিয়ন্ত্রন রয়েছে। তারুণ্য বিস্ফোরন উন্মুখ এক শক্তি; তারুণ্যে জীবন অপার এক যাদুকরি মহিমার অধীকারি হয়। এর পর মধ্য বয়সে এসে জীবনকে কেমন যেন পরিচিত ঠেকে, নিজেকে কেমন যেন অভ্যস্থ মনে হয়; এসময়, কোন এক দিন কেউ একজন জীবনটা কেড়ে নেবে, এর পরিচিত সব স্বাদ অর্ন্তহিত হবে, সে ব্যপারে মনুষকে উদাসিন বলে মনে হয়।

কেউ কেউ এর চলমান স্বাদেও সন্তষ্ঠ থাকে না! যদিও পৃথীবির আর সব কিছুর সাথে জীবনকে মেলানো যায়না; আমাদের চারপাসের মানুষ-জন অতি সাচ্ছন্দ্যে বেঁচে বর্তে আছে, শ্বাস নিচ্ছে, তারা একে বোঝা মনে করে মরে যেতে চাইছে না। পরিচিত এই বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে যেতেও সায় নেই তাদের মনে। সবাই এখানে নিজ নিজ কল্পনা অনুসারে জীবনে অভ্যস্থ। এখানে যার যার অনুভুতি তার তার, যা মৃত্যুকে করে তোলে কষ্টকর, আয়ুষ্মান বিশ্ব চিন্তা মানুষকে তাই বিষাদময় করে তোলে। শিশু বা পশুদের কাছে এই বোধ পুরোপুরি বিপরিত ঠেকতে পারে।

সেখানেই ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে থেকে আপন মনে গান গাইছিলাম, এমন সময় একটা অবয়ব দেখতে পেলামÑআমি এক প্রকার নিশ্চিত ছিলাম এটা কোন পুরুষ লোক হবে, কারন কোন মেয়ে লোক এত রাতে বিশেষ কোন কারন ছাড়া এখানে আসার সাহস করবে নাÑসারাটা কবর স্থান জুড়ে অবয়বটি হাটাহাটি করছে। হঠাৎ ভয়পেয়ে আমি গান থামালাম। মনে হলো কোন চোর হবে হয়তো। আর যদি তা না হয়, তাহলে এমন বিরান জনহীন প্রন্তরে কোন ডাকাতই কেবল আসতে পারে। এমন কথা ভাবতে ভাবতে একটু স্থির হলাম, ভাবলাম “কিসের জন্য আমি দুঃশ্চিন্তা করছি? আমার কাছে খোয়া যাবার মতো কিছুইতো নেই; আমার কাছে সামান্য কিছু পিয়্যাসট রয়েছে, এগুলো নিয়েতো লোকটির পক্ষে ধনী হওয়া সম্ভব নয়, সামান্য এ মুদ্রা গুলো হরিয়ে আমিও একেবারে পথে বোসবোনা।

সে যাইহোক, গড়ন গাড়নে আমি যেমন হালকা পাতলা ছিলাম তেমনি খুব জোড়ে দৌড়াতেও পারতাম। আর কবর স্থানে ঢোকা ও বের হবার সব পথও আমার জানা ছিল; দু’পায়ে ঝেড়ে দৌড় দিলে মনে হয়নি সে আমার সাথে পেরে উঠবে। তাই লোকটি যেই হোক না কেন তাকে ভয়ের তেমন কিছুই ছিলনা। ” আসলেই আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারন ছিলনা; আমার নড়াচড়া ও চলাফেরাতে সেটি ফুটে উঠেছিল। অশুভ কোন লোক হলে নিশ্চই এতে উৎসাহ পেতো।

তারপরও সতর্ক থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে এই ভেবে নির্জন একটি কবরের পেছনে লুকিয়ে পড়লাম, এমনভাবে যেন নিজেকে সম্পূর্ন আড়াল করে কেবল আমিই তাকে দেখতে পাই। তাতে অন্তত বুঝে উঠতে পারবো লোকটা কি ধরনের, আর সামনা সামনি থেকেও গোপনে তার এগিয়ে আসা দেখার জন্য শক্তিশালি একটা অবস্থান বলে মনে হচ্ছিলো জায়গাটিকে। মনে হচ্ছিলো সাদা দাড়ি ওয়ালা কোন বৃদ্ধ শেখ এগিয়ে আসছে; হাতে জপ মালা, মুখে স্রষ্টার নাম, সাথে কোরান বা অন্য কিছু থেকে পাঠ করছে, যদিও বাস্তবে এর কিছুই আমি শুনতে পারছিলাম না। ভাবতে আমার যেন খারাপ লাগছিল কি করে এই বৃদ্ধ শেখ আমাকে ভয়ে চমকে দিয়েছে, এবার লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখার জন্য নিজে থেকে তার পানে এগিয়ে যাবার জন্য ভেতর থেকে কেমন যেন একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম। লোকটাকে খানিক এদিকে এগিয়ে আসার সুজোগ দিলাম, তারপর হঠাৎ আড়াল ছেড়ে একটা কবরের পেছনে দু’জনে সামনা সামনি দাড়িয়ে গেলাম।

অসহায় লোকটির ভয়ে পড়ে যাবার মত অবস্থা। আবার আমি তড়িঘড়ি করে দু’ এক কদম পিছিয়ে কবরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। চারদিকে তাকিয়ে সে কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারলোনা। ডানে বামে থুতু ছিটিয়ে একটু ধাতস্থ হবার পর গলা চড়িয়ে অভিশপ্ত সব শয়তানের হাত থেকে বাঁচতে স্রষ্টার কাছে মিনতি জানাতে লাগলো। তারপর সুরা পড়তে পড়তে জোর কদম হাটতে শুরু করে দিল।

আমিও চুপিসারে পেছন দিকের কবরের সারি ধরে তার পিছু পিছু আগাতে লাগলাম। তার পা ফেলার গতি ক্রমেই বাড়ছিলো, তাতে করে বুঝতে পারছিলাম লোকটির ভয় তখনো কাটেনি। মাথা সামনের দিকে বাড়িয়ে আবার আমি হঠাৎ তাকে দেখা দিলাম, আর তার দাড়িতে টানদিয়ে বসলাম। লোকটি এবার চিৎকার দিয়ে উঠলো, আমি দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। কবরের আড়ালে লুকিয়ে আবার তার সামনে পড়লাম।

চাপা দেওয়া প্রচন্ড আমোদে আমার ফেঁটে পড়ার মতো অবস্থা। পাশদিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম, তারপর আমি তার কোমর বরাবর মাথা বের করে সুড়সুড়ি দিয়ে বোসলাম। হলফ করে বলতে পারি, তরবারি অথবা সাদা রঙের গরম করা লোহার শিক পেটের মধ্যে ধরলে লোকটা একদম চিৎপটাং হয়ে মাটিতে গড়াতো। বুঝতে পারছিলাম লোকটা চড়ম ভয় পেয়েছে, আওড়ানো সুরা গুলো জড়িয়ে যাচ্ছে, মনে করতে না পারলে সবার যেমন হয়, মনে মনে ভালাম এটাই সময়। ভয়ে লোকটা চিৎকার জুড়ে দিলো, “আমি শয়তানের থেকে পানা........”এবার ঠিক পেছনে এসে দাড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে দেখিয়ে দিলাম কতটা জোরে আমি শব্দ করতে পারি।

অসহায় লোকটা এবার পড়িমড়ি করে দৌড়। এভাবে লোকটা এক সময় চোখের সামনে থেকে দূর হলো। একটানা এমন আজব খেলায় আমি নিজেও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই পেছনে ধাওয়া করার চিন্তা বাদ দিলাম। জামা কাপড়ে লেগে থাকা ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে আস্তে ধীরে এগোচ্ছি, ঘটনাক্রমে এক সময় প্রকাশ্য রাজ পথে উঠে এলাম।

তারো মিনিট পনেরো বা খানিক বাদে আমি ইমাম সুফি মসজিদের কাছে আসি। সে সময় মুয়াজ্জিন সবেমাত্র তার সুললিত সুরে আজান দিতে শুরু করেছে। লোক জন জড়ো হয়ে ফজরের নামাজ পড়ার প্রস্ততি নিচ্ছে। এমন সময় আমার সেই হতভাগ্য শেখ বন্ধুটিকে সেখানে দেখলাম, পুরো এক দল লোক তাকে ঘিরে আছে। সাবাই কে সে বলছিলো, “ কালো বিড়ালের মত দেখতে একটা জন্তু আমার ঘাড়ে উঠে পড়েছিলো, গালদুটি চেটেপুটে শেষে দু’পায়ের মাঝদিয়ে গিয়ে কাফতানের ভেতর সেধিয়ে যায় সেটি! চিৎকার করে আমি আল্লার কাছে সাহায্য চেয়েছি, তার পর মাটি ফুঁড়ে আজব সেই চিড়িয়াটি একটা গার্তের মধ্যে সেধিয়ে যায়।

কিন্তু কিছু সময় পর তা আবার ভাল্লুকের বেশে ফিরে আসে, খানিক বাদে আবারো কবরের পাথরের নিচ থেকে কাফন পরে হাজির হয়; এসময় কাফনের কাপড় চিরে মুখ বেরিয়ে ছিলো জানোয়ারটির, যেন চোখ দুটো রাগি হাঙ্গরের মতো জ্বল জ্বল করে জ্বলছিলো। কোরানের যা কিছু আমার মনে ছিলো তার সবটুকুন পড়েছি। তারপরই সে ছেড়া কাফনে মুখ ঢেকে নিজ কবরে ডুব দেয়। আমি সারা জিবনেও এর লম্বা দাঁত গুলোর কথা ভুলবো না.......জ্বলন্ত কয়লার মতো লালচে দাঁত গুলো সারা মুখ জুড়ে তারার মতো জ্বলছিলো! স্রষ্টাকে অশেষ ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এর থাবা থেকে রক্ষা করেছেন.......” কেউ এক জন তখন তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কি মনে হয় জানোয়ারটা আপনাকে দমবন্ধ করে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো?” “হ্যা সেভাবেই তো মারা যাচ্ছিলাম” জবাবে শেখ বোললো। “ যাচ্ছিলাম মানে বুঝেছেনতো? বলতে চাচ্ছি” এই বলে তিনি হাত দুটোকে মিনারের মত উপরের দিকে প্রসারিত করে সামনের দিকে এগিয়ে এসে বল্লেন, “এদুটো দিয়ে আমাকে ঢেকে ফেলতে নিয়েছিলো! বুকের কাঁটা গুলো তার বেওনেটের মতো চক্ চক্ করছে ! সেসময় আল্লাতায়ালা যদি আমাকে আয়াতুল কুসরি পড়ার তৌফিক না দিতেন তাহলে এত ক্ষনে আপনারা একটা লাস ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতেন না।

” অন্য আরো এক জন বলে উঠলো, “ আপনার কি মনে হয় এইটা কোন মৃত লোক ছিলো? অবাক করার মত বিষয়!” “আগুনের মত জ্বলছিলো জানোয়ারটা,” জবাবে শেখ বল্লেন। “কুসরি সুরাই একে জ্বালিয়ে মেরেছে। তারপর সড়কে ওঠার আগ পর্যন্ত আর পেছনে ফিরে তাকাইনিরে ভাই...” যেদিক থেকে লোকটি এসেছিলো আঙ্গুল দিয়ে জায়গাটা দেখাবার সময় ঘুরে দাড়িয়ে প্রথমে আমাকে তার পেছনে দেখতে পেলো। অবাক হয়ে সাথে সাথে আমার দিকে আঙ্গুল তাক করে চিৎকার দিয়ে উঠলো, “এই ........ সেই........লোক.........” আমাকে ছাড়া কেউই বুঝলোনা কেন লোকটি চেঁচিয়ে উঠলো বা আঙ্গুল তাক করলো, তখন হাঁসি আটকাবার চেস্টায় আমার ভেতরটা প্রায় ফুটো হয়ে যাচ্ছিলো । অন্য দের মত আমিও সে যা দেখাতে চাইছিলো তার সন্ধানে আঙ্গুল বরাবর তাকালাম, লোকটার চারপাসে জড়ো হওয়া সবাই এক সাথে কেঁপে উঠলো।

কেউ এক জন চাঁপা স্বরে জিজ্ঞস করলো “কোথায়? কোথায়? কই আমরাতো কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। ” লোকটি বার কতক হাতদিয়ে মুখ মুছলো, তারপর একদম শান্ত ভঙ্গিতে বল্লো, “ অদ্ভুত, সত্যি বড়ই অদ্ভুত ঘটনা......অবিকল এই ভদ্র লোকের মত দেখতে। ” আমি আর হাঁসি ধরে রাখতে পারলাম না, মুখদিয়ে থুতুর ছিটে সহ বেরিয়ে গেলো,“ তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি দেখতে পিশাচের মত?” ধারে কাছে পরিচিত এক জন ছিলো, লোকটি একই সাথে চালাক ও চতুর। বোঝাই যাচ্ছিলো এতসব অদ্ভুত কথা বার্তায় তার সন্দেহ হয়েছে, হতে পারে সত্যিকার ঘটনা টুকু আপনা থেকে সে ভেবে নিয়েছিলো। “শুনুন,” সে আমাকে বল্লো, “আপনি কোন দিক থেকে এসেছেন?” বুঝতে পারলাম লোকটা কোথায় হাত দিয়েছে, তাই ইসারায় দেখিয়ে বললাম, “আমি ওদিক থেকে এসেছি।

” কথাটা মিথ্যা ছিলো, তবে আধাআধি সত্যে মেশানো। আমার ভয় ছিলো সত্য বেরিয়ে পরলে একদম বদনাম হয়ে যাবে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি সাইদা নাফিসা না পৌরভবনের দিক থেকে এসেছেন?” “পৌরভবন হয়েইতো আসলাম,” জবাবে আমি বললাম, “ কার এত বড় বুকের পাটা যে এত গুলো সারি সারি কবরের ওপর দিয়ে এত রাতে হেটে আসে?” বিড়বিড় করে লোকটা কিছু একটা বললো, আমি সেসব শুনতে পাইনি, তারপর সে আপনা থেকে চলে গেলো। আমিও সেবারের মতো বেঁচে গেলাম। তবে একটি রাতের জন্য আমি ঠিকই পিশাচ হয়ে রইলাম!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.