আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার- বিষের ছোবল

আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়, পাড়ে লয়ে যাও আমায় -শোন,আমি তোকে বলি,এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। তিথির স্মৃতি বুকে নিয়ে তোকে বেঁচে থাকতে হবে। প্লিজ,দোস্ত আমার। কথাগুলো একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিলো শরীফ। তাকে জড়িয়ে ধরে তখনও কেঁদে চলছে আশরাফ।

-‘আমার আগে কেন সে চলে গেলো!আমি তাকে মানা করেছিলাম হাইওয়েতে একা ড্রাইভ না করতে!মাত্র শিখছিলো সে। ’ অধিক শোকে পাথর আশরাফ বারবার এই কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছিলো। অবিরাম পানি ঝরছে দুচোখ থেকে। আশরাফ আর শরীফ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা ঢাকা মেডিক্যালের মর্গ। আশেপাশে মৃত মানুষের স্বজনদের দীর্ঘসারি।

কাফেলা বেঁধে এখানে উপস্থিত থাকে মৃত্যুর দেবতারা। সারাক্ষণ ডাকতে থাকে কালো কাকের দল,মৃতের স্বজনদের দুঃস্বপ্নের পয়গম নিয়ে হাজির হয় অদৃশ্য যমদূত। আশরাফের বাগদত্তা তিথির লাশ বুঝে নিতে তারা উপস্থিত হয়েছে ধূসর জায়গাটিতে। পাশে ক্ষণকাল পরপর মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিথির মা। এক মাত্র মেয়ের মৃত্যুতে শোকে নির্বাক তিথির বাবা।

নিয়ন্ত্রন হারিয়ে একটি টয়োটা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের খাদে পড়ে যায়। চালক ছিল তিথি,গাড়ির দুমড়ানো বডি থেকে যাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বোধহয় তোর ঢাকার বাইরে বেড়িয়ে আসা উচিত কয়েকদিনের জন্য। শরীফ শুরু করে কথা। তিথির দাফন শেষে তিথিদের বাড়ির পুকুর ঘাটের বসে আছে তারা দুজন।

‘জানি না রে,কিছুই ভালো লাগছে না। মাথাটা পুরো জ্যাম হয়ে আছে। আমি আপাতত কদিন ওর কবরটার পাশে নাহয় থাকি। ’শরীফ আর ঘাঁটায় না আশরাফকে। ওকাজে যদি বেচারার শোক একটু কমে তাহলে ওকে বাধা দিয়ে লাভ কি? পরের শনিবার, শাহবাগের ছবিরহাটে গুড় চায়ের কাপ হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দুই বন্ধু।

এ কয়দিনে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে আশরাফ। বন্ধুর কোঠরে বসা চোখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজে ফিরে শরীফ। কিছু একটা মেলাতে পারে না। এক কাজ কর। তুই নাহয় তোর বড় বুবুর বাসা থেকে বেড়িয়ে আয়।

মন ভালো হয়ে যাবে!শরীফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আশরাফের দিকে তাকায়। আশরাফ নিজে ভাবে,হয়তোবা ঢাকা ছাড়া দরকার এই মুহূর্তে তার। বড়বুবু আর দুলাভাই কাপ্তাই থাকেন। যদিও তিনি তার মামাতো বোন,তবু আশরাফকে নিজের ভাই থেকে আপন চোখে দেখেন তিনি। বেশ কয়েকবছর আগে সে আর শরীফ একবার ঘুরে এসেছিলো কাপ্তাই।

হুম,দেখি। উত্তর দেয় আশফাক। উফ!জায়গাটা যেন একটুকরো স্বর্গ। কি করিনি গতবার আমরা? নীল টলমলে পানির লেকে বঁড়শি গেঁথে মাছধরা,দুপুরে দলবেঁধে পিকনিক,রাতে ভাগ্নে জিহানের সাথে রাতজেগে গল্প করা। বলে যেতে থাকে শরীফ।

মনের জানালায় প্রতিটি মুহূর্ত উঁকি দিয়ে যায় আশরাফের। কিন্তু এবার কিছুই করার মানসিকতা নেই রে। কিছু করার অর্থ খুঁজে পাই না। বাঁচার ইচ্ছেটা মরে গেছে। শরীফকে থমিয়ে দেয় সে।

কিছু করতে কে বলেছে!কটা দিন থেকে আয় ওখানে। আপনাতেই মন ভালো হবে একটু। চায়ের কাপটা টেবিলে রাখে শরীফ। আমাকে একটু ভাবতে দে। আমি তোকে জানাবো।

আজ যাই রে। দক্ষিণের গেইটের দিকে হাঁটা দেয় আশরাফ। সেই রাতে,সিদ্ধান্তটা নিলো সে,আবার কাপ্তাই যাওয়া যাক। তবে এবার আগেই কিছু জানাবে না বুবুকে। থাক না সারপ্রাইজ!শরীফকে ফোন দিয়ে ট্রেইনের টিকিট কেটে দিতে অনুরোধ করে আশফাক।

কাপ্তাই যাওয়ার পথে চন্দ্রঘোনা নামের এক ছিমছাম মফস্বলের উপর দিয়ে যেতে হয়। এখানে নাকি দেশের সবচেয়ে বড় পেপার মিল আছে। আশরাফ জানালা দিয়ে দেখে বিশাল সবুজ পাহাড়গুলো। পাহাড়ের গায়ে আঁচড় কেটে যায় সাদা মেঘের দল। বাসের জানালা দিয়ে সবুজ প্রকৃতির নির্জনতার সাক্ষী হয়ে কখন যে অন্য জগতে চলে গিয়েছিলো আশরাফ,সে নিজেও জানে না।

বাস কন্ডাক্টরের হেঁড়ে গলার ডাক শুনে সংবিৎ ফিরে পেলো সে। ইতিমধ্যেই কাপ্তাই নতুন বাজারে বাস থেমেছে। পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবাসিক এলাকায় সবাইকে চেক করে তারপর ঢুকানো হয়। গার্ডের একগাদা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আশরাফ যখন হাঁপিয়ে উঠলো,তখনই সে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি পেলো। এক নিশ্বাসে সিএনজি নিয়ে বাঁধ পার হয়ে অফিসারস কোয়ার্টারের দুই তলায় উঠে এলো সে।

ডান পাশের প্রথম ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপলো এক নিঃশ্বাসে। ক্রিং ক্রিং ক্রিং। একবার। দু’বার। ভিতরে কি কেউ নেই?ওহ,দরজায় তালা দেওয়া এতক্ষন সে মোটেও খেয়াল করে নি।

বিরাট ফাঁপরে পড়া গেলো!বুবুরা গেলো কই?পকেট থেকে সেল ফোন বের করে বুবুর নাম্বারে কল দিলো আশরাফ। -হ্যালো,বুবু। আমি আশরাফ বলছি। -আশরাফ?ওমা,কেমন আছিস তুই ভাই?ওপাশ থেকে প্রশ্ন এলো। -এই মুহূর্তে ভালো নেই।

আমি তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি অথচ তুমি নেই। বাসায় তালাঅভিযোগের স্বরে উত্তর দিলো আশরাফ। -বলিস কি রে?তুই কাপ্তাই এখন?আসবি অথচ আমাকে আগে বললি না?এটলিস্ট একটা ফোন করে আসতে পারতি!আমার শহরে এসেছি। বাবুর জন্য কিছু কেনাকাটা করবো বলে। একটু পরেই ব্যাক করবো।

-আসলে ইয়ে,সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। -হুম,নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলি এখন। শোন,আমাদের ব্যাক করতে করতে ২ ঘন্টা লাগবে। তুই পাশের ফ্ল্যাটের………….ফোনটা কেটে গেলো। স্ক্রিনের দিকে তাকালো আশরাফ।

ধ্যাত শালা,চার্জ শেষ!বেছে বেছে নিজেকে কয়েকটা গালি দিলো সে। ‘কাউকে খুঁজছেন?’ পিছন থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এলো কানে। ঘুরে তাকালো আশরাফ। এক সৌম্য চেহারার ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে লাল পাঞ্জাবী।

উপরে কফি কালারের শাল। বেশ ভালোই মানিয়েছে লোকটিকে। -মানে,ডানপাশের ফ্ল্যাটে আমার বড় বোন থাকেন। উনার কাছে এসেছিলাম। কিন্তু বুবু আর দুলাভাই জানতেন না আমি আসবো।

উনারা শহরে গেছেন। -তালাবদ্ধ বুঝি?ভালোই সমস্যায় পড়লেন আপনি। আমি দেবেশ চক্রবর্তী। এখানকার পাওয়ার সেকশনের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছি। -আমি আশরাফ।

একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আছি। -বাহ,বেশ তো। আপনার দুলাভাই আর বোন মানে মিস্টার এন্ড মিসেস মাহমুদ আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি অনুরোধ করবো উনারা শহর থেকে ব্যাক না করা পর্যন্ত আপনি আমার ফ্ল্যাটে রেস্ট নিন। ‘ধন্যবাদ আপনাকে।

’আমি কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে পারবো। ইতস্তত করে আশরাফ। -তা কি করে হয়?আপনি ঢাকা থেকে এসেছেন অতিথি মানুষ। প্লিজ আসুন। কোন কিন্তু নয়।

অগত্যা রাজি হয় আশরাফ। মিস্টার চক্রবর্তীকে অনুসরণ করে সে। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেন মিস্টার চক্রবর্তী। কেমন লাগছে কাপ্তাই?চক্রবর্তীর ড্রইংরুমের সোফাতে বসে আছে আশফাক। ‘তা মন্দ না।

এমন পরিবেশ ঢাকায় পাওয়া যায় না। এককথায় ন্যাচারাল বিউটি। বিশ্বাস করুন এখানে এলে থেকে যেতে ইচ্ছে করে। ’স্মিত হেসে উত্তর দেয় সে। -জানেন তো,গোলাপেও কিন্তু কাঁটাটা থাকে।

এদিকার এলাকা ছিমছাম ঠিক। কিন্তু খুব যে স্বস্তির,তা কিন্তু নয়!মৃদু হেসে উত্তর বললেন চক্রবর্তী। -বোঝো!কর্তা যখন বাড়ির খবর রাখেন,তখন মুখপোড়া প্রতিবেশীর কানপড়ায় কি বা আসে যায়!ইতিমধ্যেই বেশ সহজ হয়ে এসেছে দুজনের মধ্যের সম্পর্ক। আশরাফ উত্তর দেয়। আমার কাছে কিন্তু ভালোই লেগেছিলো।

গেলবার কোন অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্যে পড়ি নি। -এ বছরটা এখানে শুরু হয়েছে মার্ডারের ঘটনা দিয়ে। এই বাঁধ এলাকাতেই। -বলেন কি?নড়েচড়ে বসে আশরাফ। মার্ডার মানে? -হুম,পিউর খুন মিস্টার।

আতংকিত গলায় বললেন চক্রবর্তী। -উনি মানে ওই লোক কি স্থানীয় কেউ ছিলেন?জিজ্ঞেস করে আশরাফ। -স্থানীয় নয় ঠিক,ভিকটিম এখানকার এক ইঞ্জিনিয়ার। জয়েন করেছিলো বেশ কিছু দিন আগে। সদ্য বিবাহিত।

আমি কাপলটাকে বেশ ক’বার দেখেছি। চমৎকার। -কে মার্ডার করেছে?সাসপেক্ট?পুলিশ কাউকে সন্দেহ করেছে? -সে তো করেছেই। ভদ্রলোকের স্ত্রী পলাতক। সন্দেহের তীরটা গিয়ে পড়ে তার উপর।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়,ভিক্টিমের স্ত্রীর নাকি পরকীয়া ছিলো। তার জের ধরেই এই ঘটনা। -কিভাবে মার্ডার হয়েছিলো স্যার?ফিসফিসে গলায় জানতে চায় আশরাফ। -বাঁধ রাস্তার নিচের খাদে ইঞ্জিনিয়ারের গাড়ি পাওয়া যায়। মৃত ইঞ্জিনিয়ারকে সহ।

এরপর স্ত্রীকে সংবাদ দিতে গিয়ে পুলিশ দেখে মহিলা নেই। একেবারে বেপাত্তা! পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ-রাস্তাটা আগে দেখেছে আশরাফ। ওপাশে কাপ্তাই লেক। আর বাঁধের এপাশে বিশাল ধানী জমি। উপরে এক লেইনের পিচ ঢালা রাস্তা।

প্রায় এক দেড় কিলো হবেই। বলেন কি?গাড়ি এক্সিডেন্ট তো হতে পারে? আপনি বসুন মিস্টার। আমি আবার চা নিয়ে আসি। চক্রবর্তী এর মাঝে উঠে গেলেন। এদিকে বেশ কিছুক্ষণ হলো,বুবুদের আসার নাম গন্ধ নেই।

আশরাফ চিন্তায় পড়ে গেলো। উনারা প্রায় আসছেন। আশরাফের কুঁচকানো কপাল দেখে মন্তব্য করলেন চক্রবর্তী। আর আধ ঘণ্টা লাগবে,একটু আগেই আমার নাম্বারে ফোন করেছেন,আমি যখন কিচেনে ছিলাম। নির্ভয়ে থাকতে পারেন।

ট্রে নিয়ে কখন যে চক্রবর্তী ব্যাক করেছে খেয়াল করে নি সে। ‘ওহ,থ্যাংকস। আমার জন্য অনেক করছেন আপনি। কি বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাবো!’ -এটা কিছু নয়। কৃতজ্ঞতার কিছুই নেই।

নিজের দায়িত্ব থেকে যতটুকু করা সম্ভব করেছি। আচ্ছা,আপনি কি যেন জিজ্ঞেস করেছিলেন? -বলছিলাম,হতে পারে না যে,একই লোক এসে ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রীকে মেরে গুম করেছে আগেই তারপর ইঞ্জিনিয়ারকে হত্যা করে সন্দেহটা নিজের উপর থেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছে? -নাহ,গাড়ির ব্রেক কাটা ছিলো। পুলিশ জানিয়েছে। আর ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী যে সতি সেটা আমি বিশ্বাস করি না। চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বললেন চক্রবর্তী।

-কিন্তু স্যার, আপনার বিশ্বাসে কিছু তো প্রমান হয় না!আশরাফ বললো। -হুম, হয়। -কিভাবে সেটা ? চামচ নামিয়ে রেখে আশরাফের চোখে চোখ রাখেন চক্রবর্তী। ‘হয় কারন, আমিই সে মৃত ইঞ্জিনিয়ার। যাকে তার স্ত্রী হত্যা করেছে’।

আশরাফ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো মিস্টার চক্রবর্তীর দিকে। তারমানে?অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো সে। হঠাৎ খেয়াল করলো,তার চোখে প্রচণ্ড তন্দ্রালু ভাব চলে এসেছে। চোখ দুটো মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। জ্ঞান হারানোর আগে দেখতে পেলো সামনে চক্রবর্তী নেই।

মুহূর্তেই ইকেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। ‘উঠুন মিস্টার আশরাফ। আমি ভূত নই। রক্ত মাংসের মানুষ। এই যে হাত বাড়িয়ে দিলাম চিমটি কেটে দেখতে পারেন।

’ হাত বাড়িয়ে দিলো চক্রবর্তী। সদ্য জ্ঞান ফিরেছে আশরাফের সেইসাথে ইলেক্ট্রিসিটিও। চোখ দুটো তখনও পিটপিট করছিলো। দুর্বল হাতে সে স্পর্শ করলো চক্রবর্তীর বাড়ানো হাত। চোখে তখনও রাজ্যের অবিশ্বাস।

-এইবার বিশ্বাস হলো তো?জোকস করছিলাম। এমন সময় বেরসিকের মতো কারেন্টটা চলে গেলো। -নাইস ওয়ান। একেবারে কলিজা কাঁপিয়ে দিয়েছে। কিছুটা স্বাভাবিক হলো আশরাফ।

উফ!এবার যদি স্পর্শ করে টের পেতাম আপনি মানুষ না তবে আমি সত্যিই হার্ট এটাকে মরা যেতাম। -হেহেহে!বাট সরি ফরদ্যাট ইয়াংম্যান। কিছু যদি মনে না করো,তুমি করে বলি। ড্রিংস চলবে?পাশের ব্যান্ডির বোতলটার দিয়ে ইঙ্গিত করলেন মিস্টার চক্রবর্তী। একটু রয়ে সয়ে বসলো আশরাফ।

ইতস্তত করে কিছুক্ষণ। হুম,চলবে। প্রত্যুত্তর দেয় সে। -হুম। তুমি যেমনটা বলেছো,দুর্ভাগা ইঞ্জিনিয়ারের তেমনটা ঘটার সম্ভাবনাও আছে।

উড়িয়ে দেওয়া যায়না। কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর মন্তব্য করে চক্রবর্তী। -আচ্ছা,আপনার ফ্যামিলির আর কাউকে তো দেখছি না!বাকিরা কি এখানে থাকেন না?উত্তপ্ত তরল গলায় ঢেলে জিজ্ঞেস করলো আশরাফ। ততক্ষণে বেশ খানিকটা গিলে ফেলেছে চক্রবর্তী। হুম, আছে।

তোমার বৌদি ভিতরেই থাকেন সবসময়। বাইরে আসেননা। দেখবে তাঁকে? -উনি যদি মাইন্ড করেন তবে দরকার নেই। -কিছুএকটা ভাবে চক্রবর্তী। আচ্ছা চলো,তোমাকে তারসাথে দেখা করিয়ে আনি।

আমাকে ফলো করো। উঠে দাঁড়ান ভদ্রলোক। ইঙ্গিতে অনুসরণ করতে বলে আশরাফকে। ভিতরের রুমে নিয়ে যান আশরাফকে। ‘তারআগে সামনের ওটা দেখছো?’প্রশ্ন করেন চক্রবর্তী।

ইঙ্গিতে ডিপফ্রিজটা দেখান তিনি। হুম,উত্তর দেয় আশরাফ। -‘বৌদির সাথে দেখা করার আগে ওটা খুলো,প্লিজ। ’ নির্দেশমতো সামনে এগিয়ে যায় আশরাফ। ফ্রিজের ডালাটা আস্তে আস্তে উপরে তুলতে থাকে সে।

অনেকদিন ধরে বোধহয় খোলা হয় না। জ্যাম হয়ে গেছে। উঠবে বলে মনে হচ্ছে না। নাহ,এইতো উঠে গেছে প্রায় ডালাটা। ভিতরে চোখ রাখে আশরাফ।

একজন নগ্ন মহিলা শুয়ে আছে ভিতরে। কুণ্ডলী পাকিয়ে। গায়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। গা গুলিয়ে এলো আশরাফের। চিৎকার করে দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারালো সে।

পানির ঝাপটায় আবার জ্ঞান ফিরে এলো তার। মুহূর্তেই সোফা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। প্লিজ,আর না। আপনি এভাবে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন কেনো?রাগত স্বরে প্রশ্ন করে আশরাফ। -বারে!তুমিই তো তোমার বৌদির কথা জিজ্ঞেস করেছিলে।

আমি তার সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। আমার কি দোষ? -ওখানে একজনের লাশ ছিল। একজনের লাশ। রাগ এখনও যায় নি আশরাফের। -হ্যাঁ।

লাশ ছিলো। আমি খুন করেছি তাকে। গতকাল রাত বারোটায়। আমার সাথে প্রতারনার ফল। দ্যাখো,কত সহজেই তোমাকে বিশ্বাস করে আমি স্বীকারোক্তি দিয়ে দিলাম।

দেখেছো? -আমি যদি পুলিশকে বলে দিই?প্রশ্ন করে আশরাফ। দুই দুইবার সাডেন মেন্টাল শকের পর অনেকটা দুর্বল সে। কিন্তু তখনও সে ঠায় দাঁড়িয়ে। -তুমি পুলিশের আছে যাবে না। আমি জানি।

আর যাওয়ার আগেই আমি আত্নহত্যা করবো। লাভ হবে না। হঠাৎ নিজের শরীরে একটা সিরিঞ্জ পুশ করে চক্রবর্তী। ‘বিষ পুশ করলাম। আর মাত্র ৩০ মিনিট বাঁচবো।

’ফিসফিস করে বলে উঠে সে। -মাই গড!মুহূর্তের মধ্যেই বসে পড়ে আশরাফ!আপনি একজন খুনী। একটা সাইকো। কেন পুশ করলেন! -বাঁচার ইচ্ছে নেই। -আমি কিন্তু এখনও পুলিশের কাছে যেতে পারি।

-আমি জানি আশরাফ,তুমি যাবে না। কারন আমার মতো তুমিও একজন খুনী। একজন খুনীর সাইকোলজি আমি বুঝতে পারি। -হোয়াট??আমি খুনী?অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। -প্রথমবার জ্ঞান ফেরার পর তুমি বিড়বিড় করছিলে-“তিথিকে সরিয়ে দিয়েছি পৃথিবী থেকে।

” অবাক হয়ে গেলো আশরাফ,আমি?তিথিকে?থামলো সে। -আপনি মারা যাচ্ছেন কিছুক্ষন পর কাজেই আপনাকে বললে ক্ষতি নেই। হ্যাঁ,তিথি নামের রাস্তার মেয়েটাকে আমি ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছি। আত্ন-তৃপ্তির হাসি হাসলো সে। অনেক ঠাণ্ডা মাথার প্ল্যানে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার ফল আমি তাকে উপহার দিয়েছি।

হেহেহ। হেসে উঠলো আশরাফ। -কিভাবে?প্রশ্ন করলো চক্রবর্তী। -যখন জানলাম তিথি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমি তাকে সরানোর প্ল্যান করলাম। আমি সে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করি সেখানে ওষুধ ইমপোর্ট করা হয়।

একজন ফার্মাসিস্ট হওয়ার সুবাদে অনেক পয়জন সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা আছে। কিছুদিন আগে এমন একটা পয়জন সম্পর্কে আমি ধারণা পাই যা ভিকটিমকে শরীরে প্রবেশের তিন ঘণ্টা সময় পর বিষক্রিয়া করে মুহূর্তেই ভিক্টিমকে মেরে ফেলবে কিন্তু নিজে নিহতের শরীরে কোন প্রমান রেখে যাবে না। -মাই গড!চক্রবর্তীর গলা থেকে স্বর বের হয়। -সেদিন আমি আর তিথি বনানীর একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করি। তার অলক্ষে আমি স্যুপের বাটিতে পয়জনটা মিশিয়ে দিই।

-আর লাঞ্চের পর সে জানায়,টাঙ্গাইল যাচ্ছে সে,কাজিনের বাসায়। আপনি মনে মনে ছক কষে ফেলেন,বিষক্রিয়া শুরু হবে মহাসড়কে। এবং তাই হয়!তার গাড়ি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে একসিডেন্ট করে। সে মারা যায়। সবাই ভাবে,নিখাত দুর্ঘটনা।

আপনি ভাবেন, ফরেনসিক রিপোর্টে বিষক্রিয়া বা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাবে না। তাই না?একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যেতে থাকে চক্রবর্তী। -কিন্তু কিন্তু…………… আপনি কিভাবে জানতেন সে এক্সিডেন্টে মারা গেছে? টাঙাইল যাচ্ছিলো এটাইবা জানলেন কিভাবে? মুহূর্তের মধ্যে ঘরের দরজা খুলে যায়,পুলিশে ভরে যায় ঘরের ভিতরটা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আশরাফ। কি হচ্ছে এখানে?মিস্টার চক্রবর্তী? -উত্তর না দিয়ে আবার বলা শুরু করেন চক্রবর্তী।

আপনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন মিস্টার আশরাফ। কোন প্রমান নেই। তিথির মৃত্যুরপর সবচেয়ে বেশী ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায় আপনাকে। এমনকি তিথির বাবা-মা থেকেও। আসলেই কোন প্রমান ছিলো না।

একেবারে উতরে গেছিলেন আপনি!কিন্তু আপনার হিসেবে ভুল ছিলো। পয়জনের সামান্য নমুনা রয়ে গিয়েছিলো তিথির শরীরে। আমরা তিথির বাবা-মাকে জানাই লাশ হস্তান্তর করার আগে। তিথিকে বিষক্রিয়ায় খুন করা হতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়ে বিষয়টি তদন্তের স্বার্থে তাদের চেপে যেতে বলি। -স্টপ দিস!প্লিজ।

দুহাতে কান ঢেকে ফেলে আশরাফ। -কেন?মিস্টার আশরাফ?শেষটুকু শুনবেন না?বলে যেতে থাকেন চক্রবর্তী। বিশেষজ্ঞরা রিপোর্ট দেন যে,এটা যেই সেই পয়জন নয়। তদন্ত করে আমরা জানতে পারি শুধু মাত্র তিনটি কোম্পানিরই দেশে এই ধরনের পয়জন ইমপোর্ট করার লাইসেন্স আছে। গোয়েন্দারা অবাক হয় যখন দেখে,এদের মধ্যের একটি কোম্পানিতে রিসার্চ এসিস্টেন্ট হিসেবে আছেন কাজি আশরাফ চৌধুরী,ফারজানা তিথির প্রেমিক ও হবু বর।

তারপর জাল পেতে আপনাকে নিয়ে আসা হয় কাপ্তাই। তারপর?আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন। আপনার প্রতিটা উচ্চারিত শব্দ রেকর্ড করা হয়েছে। নিজেই আমার কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন অজান্তেই। আদালতে আপনাকে দোষী প্রমান করার জন্য যথেষ্ট।

-কিন্তু ? আপনি? ফ্রিজের লাশ?আপনার পুশ করা বিষ? -এগুলো সবই সাজানো নাটকের অংশ ছিলো। আপনাকে প্রথমবার মেন্টাল শক দেওয়া হয়েছে,প্ল্যানের অংশ হিসেবেই। যাতে আমি আপনার সাথে ফ্রি হতে পারি। দ্বিতীয়বার ফ্রিজারে লাশ দেখানো হয়েছে যাতে আপনি আমাকে খুনি মনে করেন। এবং ক্লাইম্যাক্সটা আরও সহজ হয়ে যায়।

এর ফলশ্রুতিতে আপনি নিজেই নিজের বাগদত্তাকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে নেন এক পর্যায়ে!পকেট থেকে অডিও টেপ রেকর্ডার বের করে টি টেবিলে রাখেন তিনি। আর সিরিঞ্জে পানি ছিলো,বিষ নয়। আশরাফের মুখে রা শব্দ শোনা যায় না। চোখ বন্ধ করে নিয়তিকে মেনে নেয় সে। হ্যান্ডকাফ পড়া অবস্থায় আশরাফ শেষ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে চক্রবর্তীকে ‘কে আপনি ? ’ -আমি অমিয়,গোয়েন্দা অমিয় চক্রবর্তী।

স্মিত হেসে উত্তর দেন মিস্টার চক্রবর্তী। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।