আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনীতি কেড়ে নিচ্ছে শৈশব

রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে তখন মধ্যদুপুর। স্টেশনের মেঝেতে ঘুম থেকে উঠে সেখানেই বসেছে দুই শিশু। তারা দুই ভাই। বড় ভাই আউয়ালের বয়স আনুমানিক সাত বছর। ছোট ভাই মজনুর বয়স চার-পাঁচ বছর।

কথায় কথায় জানা গেল, তাদের বাবা রিকশা চালাতেন। এক বছর আগে তাদের মাকে ছেড়ে তিনি আরেকটি বিয়ে করেছেন। মা থাকেন দুই সন্তানের সঙ্গেই। বাসা-বাড়িতে ঘর ধোয়া-মোছা ও রান্নার কাজ করেন। সম্প্রতি এক হরতালের আগের দিনে কয়েকজন তাদের কাছে এসে হরতালের দিন সকালে তৈরি থাকার জন্য বলে।

মিছিলে যাওয়ার বিনিময়ে তাদের বিরিয়ানি খাওয়ানো হবে বলা হয়। হরতালের দিন সকালে আরও গোটা বিশেক শিশু ও মধ্য বয়সী কয়েকজন লোকের সঙ্গে আউয়াল ও মজনু পল্টন-প্রেসক্লাব এলাকায় মিছিলে অংশ নেয়। সেখানে পুলিশের তাড়া খেয়ে তারা অন্যদের সঙ্গে পালিয়ে যায়। এর আগেও তারা কয়েকবার হরতালে মিছিলে গিয়েছে ও পিকেটিং করেছে। তখন কয়েকবার বাসে ইট ছুড়ে মেরেছে।

এর বিনিময়ে একবার পেয়েছে ২০ টাকা, একবার খাবারের প্যাকেট পেয়েছে। আর একবার তাদের কিছুই দেওয়া হয়নি।
১২ এপ্রিল কমলাপুর রেলস্টেশনে আউয়াল ও মজনুর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। জিগ্যেস করি, মিছিলে যেতে বা ইট-পাটকেল ছুড়তে ভয় লাগে না? ‘টেকা পাই, খাওন পাই, মিছিলে যাইতে মজাই লাগে। এমনে তো আমাগো কেউ টেকা, খাওন দিতে চায় না।

’ স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না? এ প্রশ্নে আউয়াল বলে, ‘মায় কইছে, গরিবের লাইগ্যা লেখাপড়া লাগে না। ’ এর মধ্যে একটি ট্রেন চলে এসেছে স্টেশনে। আউয়াল ও মজনু চঞ্চল হয়ে ওঠে। থেমে থাকা ট্রেনে খাবারের খোঁজ করতে তারা সেদিকে ছুটে যায়। এই দুই শিশুর মতো এখন অনেক শিশুকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে।

অথচ জাতীয় শিশু নীতি অনুযায়ী শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন বেশ উত্তপ্ত। মিছিল, পিকেটিংসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার বেড়েছে। সম্প্রতি ঢাকাসহ সারা দেশেই রাজনৈতিক সমাবেশ, মিছিলসহ সহিংস কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে। সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গরিব ও ছিন্নমূল শিশুদের এসব কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে।

এতে শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং শিশুর সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ ও বিকাশ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল যে তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার করবে না। অথচ দুটি দলের রাজনৈতিক মানববন্ধন, সমাবেশ এবং হরতালের পিকেটিংয়ে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় শিশুদের ব্যবহার করেছে। গাইবান্ধা, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, সাতক্ষীরায়ও এটি দেখা গেছে।

চলতি মাসে ঢাকায় ও সিলেটে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে শিশুদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পরে সম্প্রতি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পুলিশ তদন্তকেন্দ্রে, রেলস্টেশন, হিন্দুদের মন্দির ও বাড়ি, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়ে হামলাসহ সহিংস সব ঘটনায় ব্যবহার করা হয়েছিল শিশু-কিশোরদের। হরতালে রাজপথ অবরোধ ও জামায়াত-শিবিরের মিছিলেও তাদের সামনে রাখা হয়। এর আগে পলাশবাড়ী উপজেলায় গণজাগরণ মঞ্চ ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনার দিনেও মাদ্রাসার শিশু-কিশোরদের সামনে রেখে পেছন থেকে নেতৃত্ব দেন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, ক্ষতিগ্রস্ত ও আহত লোকজন এবং পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বলছেন, এসব শিশু-কিশোরের বয়স ১০ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।

তারা গাইবান্ধার বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র। সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় সহিংসতায় মাদ্রাসার ছাত্রদের বেশি ব্যবহার করা হয়।
‘বিবিসি সংলাপে’ ৭ এপ্রিল বিয়াম মিলনায়তনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার কতটুকু যৌক্তিক—এ প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার করা ঠিক নয়, শিশুদের ভোটাধিকার নেই, তাদের রাজনীতিতে জড়ানো উচিত নয়। ’
একই প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, শিশুদের ব্যবহার মোটেই যৌক্তিক নয়, আমি এর বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য তাদের টাকা, খাবার দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়।

গরিব ও ছিন্নমূল শিশুদের এসব কাজে সহজেই ব্যবহার করা হয়।
সম্প্রতি মন্ত্রিসভা শিশু আইন ২০১৩-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে। এতেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহারের বিরোধিতা করা হয়েছে। শিশু আইনে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহারের শাস্তি হিসেবে পাঁচ বছরের জেল ও এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে বলে সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা। তিনি বলেন, এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যাতে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা, ভোগান্তি সৃষ্টি বা শিশুর অঙ্গহানি হয়।

এ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুকে শোষণ এবং শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তিতে উৎসাহিত করা হলে তাও অপরাধের আওতায় আসবে বলে জানান তিনি। এই আইনের আওতায় শিশুর কল্যাণ ও অধিকার রক্ষায় জেলা পর্যায়ে শিশু আদালতও স্থাপন করা হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছে, এটা চরম লজ্জাজনক। এটা শুধু দেশের প্রচলিত আইনকেই অবজ্ঞা করা নয়, মানবতার বিরুদ্ধেও একটি অপরাধ। এতে শিশুরা তাদের শৈশব হারায়, তাদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ে।

সাংঘাতিক বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় এর মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, যে দলগুলো শিশুদের ব্যবহার করছে, তাদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। এ থেকে উত্তরণ হতে গেলে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আত্মোপলদ্ধি ঘটাতে হবে। দলগুলোকে সচেতন হতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকে এই অপরাধ চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলেন, সাধারণত ছিন্নমূল শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে।

শিশুকে রাজনীতিতে ব্যবহারের ফলে যেমন তার সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ হয় না, তেমনি এতে তার স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হয়। রাজনৈতিক সহিংসতায় সরাসরি অংশ নিলে তার আচরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা সারা জীবনে শিশুর বিকাশে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। রাজনীতিতে ব্যবহারের ফলে শিশু আর শিশুসুলভ আচরণ করে না। আচরণে এক ধরনের উন্মাদনা দেখা দেয়। শিশুরা বারবার রাজনৈতিক কাজে অংশ নিলে এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়।

সব মিলে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহারকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর প্রধান নির্বাহী সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে খুব খারাপ স্বার্থে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। অনেক এলাকায় সহিংসতায় শিশুদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

এভাবে রাজনৈতিক কাজে শিশুদের ব্যবহারকে তিনি সংবিধান, আন্তর্জাতিক শিশু সনদ এবং জাতীয় শিশুনীতির পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.