আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শতবর্ষী বিপ্লবীর ছেলেবেলা

বুদ্ধদেব গুহের "মাধুকরি" উপন্যাসের পৃথু ঘোষ আমি

১০ জানুয়ারি ছিল দাদুর শততম জন্মবার্ষিকী। পুরো চট্টগ্রামজুড়ে তাই পালিত হয়েছে অন্য রকম উৎসব। এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন আগে কখনো আমাদের চোখে লাগেনি। এমন রূপ আগে কখনো ছড়ায়নি। এমন হাওয়া এই জনপদে আগে কখনো বয়ে যায়নি।

এই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে পাক-ভারত উপমহাদেশে। এমন কি গণমাধ্যম আর ইন্টারনেটের কল্যাণে সারা বিশ্বেও। বলছিলাম শতবর্ষী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর কথা। যিনি ছোট বড় সবার কাছে ‘দাদু’ নামে খ্যাত-পরিচিত। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা ইউনিয়নের উত্তরভূর্ষি গ্রামে জেছিলেন দাদু।

তাঁর বাবা কামিনী কুমার চৌধুরী ছিলেন ফটিকছড়ি থানার মুন্সেফ আদালতের উকিল। মা বামা সুন্দরী দেবী গৃহিণী। দাদুরা ছিলেন চার ভাইবোন। তিনি ছাড়া এখন আর কেউ বেঁচে নেই। দাদুর স্ত্রী ছিলেন বিভা চৌধুরী বেলা (সদ্যপ্রয়াত)।

দাদু থাকেন মোমিন রোডের জীর্ণ একটি দুকক্ষের কুটিরে। কোনো জলুস নেই। চাকচিক্য নেই। নেই বিলাসের কোনো ছায়া। বাসায় গেলে হয়তো দেখা যাবে দাদু আতশি কাচের সাহায্যে গভীর মনোযোগ দিয়ে দৈনিক খবরের কাগজ পড়ছেন।

হয়তো বিছানায় আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন অলস দুপুরে। বয়সের ভারে নুয়ে না পড়ে ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে দাদু হাঁটছেন রাজপথে-এটা চিরচেনা দৃশ্য। সাদাসিধে অনাড়ম্বর জীবনযাপন। কিন্তু দাদুর চলনে বলনে আছে দীপ্তি। আছে অন্য এক শক্তি।

যা সমীহ আদায় করে সবার। যা তাঁকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের আসনটি দিয়েছে। আমাদের দাদু ছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের অন্যতম সহযোদ্ধা। তাঁরা যুদ্ধ করেছেন ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে তাড়াতে। ওই যুদ্ধের নাম জালালাবাদ যুদ্ধ।

যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন। এ ছাড়া আমাদের ভাষা আন্দোলন আর মহান মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। দেশের দুঃসময়ে তিনি উদ্বিগ্ন হন। সঠিক পথের নির্দেশনা দেন বক্তৃতা আর বিবৃতিতে। অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হন।

নেমে পড়েন রাজপথে। তিনি বীর। তিনি বিপ্লবী। তিনি আপসহীন লড়াকু সৈনিক। তিনি আমাদের গৌরব।

তিনি সমাজের অভিভাবক। আমরা যত বড় হব তত অবাক হব তাঁর জীবন আর কর্মের আলোকিত সব অধ্যায় পড়ে। কেমন ছিল দাদুর ছেলেবেলা! জানতে ইচ্ছে করে? তবে শোনা যাক তাঁর মুখেই। ‘‘আমার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি গ্রামের বাড়ি অর্থাৎ উত্তরভূর্ষি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছয় বছর বয়সে বাবা আমাকে নিয়ে যান তাঁর ফটিকছড়ির কর্মস্থলের বাসায় এবং ভর্তি হই রাঙামাটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ানো হতো না। বাবার কাছেই ইংরেজি শিখতাম বাসায়। রাঙামাটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে চতুর্থ শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার পর বাবা আমাকে আবার ফটিকছড়ি করোনেশন উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন তৃতীয় শ্রেণীতে, ইংরেজিতে ভালো দখল নেওয়ার জন্য। কোনো শ্রেণীতে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় না হলেও এখানে আমার পড়ালেখায় শ্রেণীগতভাবে পদাবনতি হওয়ায় কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু ফটিকছড়ি উচ্চবিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করি।

সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ম্যাট্রিকে ভালো ফল লাভের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভুবন মোহন পাল ও বদিউল আলম পরামর্শ দিলেন শহরের কোনো একটি ভালো বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। কিন্তু সেই যুগে শহরে আমাদের আম্নীয়স্বজন ছিলেন না। ছাত্রাবাসে রেখে পড়ালেখার খরচ চালানোর মতো আর্থিক সংগতিও তেমন ছিল না-কারণ যৌথ পরিবারের অনেক সদস্যের ভরণপোষণ বাবাকে চালাতে হতো। তাই তিনি আমাকে নিজ এলাকা বোয়ালখালী পিসি সেন উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করান এবং সেখান থেকেই ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করি রায়চাঁদ-প্রেমচাঁদ বৃত্তি পেয়ে। এরপর ভর্তি হই আইএসসিতে।

এরপরের ইতিহাস আমার জেল-জুলুম-হুলিয়ার সঙ্গে লড়াই করে পড়ালেখা চালানো ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকার ইতিহাস। ... শৈশব থেকে খুবই নিরীহ ও রুগ্‌ণ প্রকৃতির ছিলাম। ম্যালেরিয়ায় ভুগতাম প্রায় সময়। মায়ের আদর স্নেহ পেয়েছি যথেষ্ট। শৈশবের কিছু স্মৃতি এ মুহূর্তে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মনের ভেতর।

ফটিকছড়ি করোনেশন উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ের কথা। ঢাকা থেকে আসা শিক্ষক সীতানাথ বসাক আমাকে শাসিত্মস্বরূপ বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখেন। আমি কেঁদে কেঁদে বেঞ্চ থেকে পড়েই যাচ্ছিলাম। এ সময় অন্য ছেলেরা ঘটনা দেখে আমাকে ধরে ফেলে এবং আমি গুরুতর আঘাত থেকে রক্ষা পাই। ক্লাসের ফার্স্ট বয় হয়ে বেঞ্চে দাঁড়াবার অপমান এখনো ভুলতে পারিনি।

একদিন ইংরেজি পরীক্ষা দেওয়ার সময় পরেশচন্দ্র নামের এক ছাত্র বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর বলে দেওয়ার জন্য বারবার আমাকে বিরক্ত করছিল। আমি তার খাতাটা টেনে নিয়ে ২০টি ইংরেজি অনুবাদ লিখে দিই এবং আমাকে আর বিরক্ত না করার জন্য অনুরোধ করি। এ কথা মনে হলে ভাবি বোকা না হলে কি কেউ নিজের লেখার কথা না ভেবে অন্যের খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখে দেয়? ছোটবেলা থেকে খেলাধুলার প্রতি আমার খুব ঝোঁক ছিল। ...বিদ্যালয়ে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে আমি ভিক্ষুক সেজে একটি গানও গেয়েছিলাম ‘হরি গাইযে তোমারই নাম...। ’ সেকালে এখনকার মতো এত এত মাসিক সাপ্তাহিক দৈনিক ছিল না।

বাবা মাসিক পত্রিকা ‘ছোটদের শিশুসাথী’ ও ‘সন্দেশ’-এর গ্রাহক ছিলেন। সেখানে দেওয়া ধাঁধার উত্তর দিতাম। জবাব সঠিক হলে আমার নাম ছাপা হতো। তখন কী যে আনন্দ লাগত বোঝাতে পারব না। ” [সূত্র: নানা রঙের দিনগুলি/মুহাম্মদ শামসুল হক, প্রথম আলো, ১৩.১২.২০০৭] আমরা দাদুর সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনা করি।

(লেখাটি দৈনিক অাজাদীর সৌজন্যে প্রকাশিত)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.