আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুবাইয়ে ফ্ল্যাট কেনা কি বন্ধ হবে?

দুবাইয়ে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির উদ্দেশ্যে ২২ ও ২৩ আগস্ট ঢাকার একটি পাঁচতারকা হোটেলে সম্ভাব্য ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েও আয়োজক আরব আমিরাতের দামাক করপোরেশন তা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। সংবাদপত্রের পাতায় বড় আকারের রঙিন বিজ্ঞাপন প্রচারের খরচটাই তাদের পানিতে গেল। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রচার এবং বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংকের হুঁশিয়ারির পর আয়োজকেরা পিছিয়ে যান। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে যাঁরা বিষয়টিতে নজর দিয়েছেন, তাঁরা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। তবে, আরও ভালো হতো যদি তাঁরা ওত পেতে থেকে আগ্রহী ক্রেতাদের খোঁজখবর নেওয়ার সুযোগ দিতেন।

তাহলে হয়তো দুবাইয়ে আবাসন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহীদের পরিচয় জানা যেত। এতে করে টিভি চ্যানেলের জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটা চমৎকার সুযোগ সম্ভবত নষ্ট হলো।
দুবাইয়ে এযাত্রায় যাঁরা বাড়ি কেনার বিষয়ে খোঁজখবর করতে অথবা বায়না করতে (বুকিং দিতে) পারলেন না, তাঁরা যে হাল ছেড়ে দেবেন, তেমনটা মনে করার কোনো কারণ অবশ্য দেখি না। বিদেশে বাড়ি কেনার জন্য অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে যেদিন সংবাদপত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলো, সেদিনই মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় আবাস প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম এবং কানাডায় বিনিয়োগকারী হিসেবে ভিসা পাওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন কাগজে একাধিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, মালয়েশিয়া ও কানাডায় টাকা পাচার যে ভালোভাবেই চলছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আর যে পন্থায় কুয়ালালামপুর বা টরন্টোতে টাকা পাঠানো যায়, নিশ্চয় সেই একই পন্থায় দুবাইয়েও তা পাঠানো সম্ভব।
মালয়েশিয়ার সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্য উদ্ধৃত করে খবর বেরিয়েছে যে গত ১০ বছরে সে দেশে ‘সেকেন্ড হোম’ ক্যাটাগরিতে যেসব বিদেশি ভিসা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যাটি বাংলাদেশিদের (মানবজমিন, আগস্ট ১২, ২০১৩)। ২০০৬ সালের পর
দুই-তিন বছর তা একটু কম থাকলেও গত বছরের প্রথম আট মাসেই তা আবার দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে চলে গেছে। দ্বিতীয় আবাসের ভিসার জন্য মাথাপ্রতি কত লাখ ডলার গেছে, তার হিসাবও সহজেই বের করা যায়।
কানাডায় কিছুদিন ধরে উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারী ভিসার আবেদন গ্রহণ বন্ধ থাকলেও তাদের কুইবেক রাজ্যে তা চালু আছে।

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশটিতে গত বছর ও তার আগের বছরগুলোতে নাগরিকত্ব পেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশই বিনিয়োগকারী বা উদ্যোক্তা। এই প্রক্রিয়ায় কতজন বাংলাদেশি ওই সুযোগের জন্য আবেদন করে সফল হয়েছেন, সেই তথ্য পাওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু মালয়েশিয়া ও কানাডার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বা দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো অনুসন্ধান চালিয়েছে বলে জানা যায় না। বরং বাংলাদেশে একাধিক বিদেশি ব্যাংক তাদের অনেক ধনবান এবং বিশেষ মর্যাদার অধিকারী (ভিআইপি) গ্রাহককে সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে কানাডার বিনিয়োগ ভিসার খুঁটিনাটি সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছেন বলে শোনা যায়। কোনো বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়া ওই ব্যাংকগুলোর এ ধরনের অভিবাসনে উৎসাহ জোগানোর কথা নয়।

আর, আলোচিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি ব্যাংক টাকা পাচার ও বেআইনি অর্থের লেনদেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শতকোটি ডলারের ওপর জরিমানা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই ব্যাংকের কার্যক্রম আদৌ নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখেছে, এমন কোনো তথ্য গণমাধ্যমে পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশে রাজনীতিক ও সাবেক আমলাদের অনেকেই প্রায় এক দশক ধরে তাঁদের দল ক্ষমতায় থাকলে দেশে ফেরেন, না হলে বিদেশে থাকেন। এই গোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দ হয় কানাডা, নয়তো মালয়েশিয়া। সরকারের শেষ বছরে অনেক দলবাজ আমলা ও পুলিশ কর্তাকে পাশ্চাত্যের শহরগুলোতে নানা অজুহাতে সফর করতে দেখা যায়; যাঁদের মূল উদ্দেশ্য সরকার বদল হলে দেশান্তরি হওয়া।

দুবাইয়ের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাতাদের কাছে এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীর গুরুত্বই আলাদা। তাই ঢাকায় তাঁরা কোনো বায়না না পেলেও তাঁদের একেবারে নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বিদেশে যাঁরা নিরাপদে টাকা জমা রাখতে চান, তাঁদের বহুদিনের পছন্দ সুইজারল্যান্ড। সেই সুইজারল্যান্ডেও বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ এক হাজার ৯০৮ কোটি টাকার সমান বলে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত হিসাবে বলা হয়েছে ( প্রথম আলো, ২৪ জুন, ২০১৩)। সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার কিছু অংশ অবশ্য প্রবাসী পেশাজীবীদেরও হতে পারে।

কয়েক বছর ধরে অবশ্য সুইজারল্যান্ড আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বেআইনি পাচার অথবা অবৈধ সম্পদ জমা রাখার বিষয়ে সহযোগিতা শুরু করেছে। যার মধ্যে নাইজেরিয়ার সাবেক সেনাশাসক সানি আবাচার টাকা সে দেশকে ফেরত দেওয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়া তারা ভারত সরকারকে ভারতীয়দের গচ্ছিত সম্পদের বিবরণ হস্তান্তর করেছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিংবা দুদক সুইজারল্যান্ডের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে, এমন কোনো কথা অবশ্য আমরা শুনিনি।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) ফাঁস করা নথিপত্রে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য এবং তাঁর সংসদ সদস্য স্ত্রী, পুত্রসহ আরও অন্তত ২০ জন ব্যবসায়ীর বিদেশে সম্পদ গচ্ছিত রাখার বিবরণ প্রকাশ করেছে নিউ এজ (১২ ও ১৪ জুলাই, ২০১৩)।

তাঁরা সিঙ্গাপুর এবং ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জসহ কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যায় এমন কিছু দেশ বা দ্বীপরাজ্যে টাকা গচ্ছিত রেখেছেন বলে ওই সব নথিতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এরপর এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা দুদক কোনো তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায় না। বৈধভাবে তাঁদের কারোরই বিদেশে সম্পদ স্থানান্তরের সুযোগ থাকার কথা নয়। আইসিআইজের ফাঁস হওয়া নথিগুলো ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপের নানা দেশ, এমনকি ভারতও তদন্ত শুরুর কথা জানিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশই মনে হয় একমাত্র ব্যতিক্রম।


সরকার ও দুদক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র কোকোর পাচার করা টাকা দুই দফায় ফেরত এনে প্রমাণ করেছে যে আন্তরিকতা থাকলে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। কিন্তু এই এক সাফল্যেই দুদক আত্মহারা হয়ে থাকলে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ থেকে পার পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না।
২৭ আগস্ট ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে দুদকের নতুন চেয়ারম্যান বলেছেন, বিদেশে সম্পদ পাচারকারী আরও অনেক রাজনীতিকের নাম তাঁরা জানেন। তিনি আরও বলেছেন, ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী উভয় দলের নেতারাই অর্থ পাচার করেছেন (সমকাল, ২৮ আগস্ট, ২০১৩)। তা হলে তো এখন পর্যন্ত তাঁদের একজনের বিরুদ্ধেও কোনো আইনি পদক্ষেপ শুরু হলো না কেন? ডেসটিনির পরিচালকদের অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার কথা শোনা গেছে বছর খানেকেরও আগে।

কিন্তু সেই তদন্ত শেষ হয়নি। অথচ ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের রোষানলে যে-ই পড়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে দুদকও তাঁর পিছু নিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাংসদ গোলাম মাওলার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আগে যখন শোনা গেছে, তখন দুদক চোখ-কান বন্ধ রেখেছিল। যেই ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে তাঁর চেয়েও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে পেরে না ওঠায় তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে, অমনি দুদক সেগুলোর অনুসন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একইভাবে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের বিরুদ্ধেও এখন আর্থিক অনিয়মের তদন্তের কথা শোনা যাচ্ছে।

পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র তদন্তে ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ রক্ষার চেষ্টা, হল-মার্কের মতো মেগাদুর্নীতির তদন্তে শ্লথগতি—এ সবকিছুই রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের আলামত হিসেবে মানুষের মনে প্রায় গেঁথে গেছে। এই অবস্থায় দুদক চেয়ারম্যানের নতুন বক্তব্য রাজনৈতিক হাওয়াবদলের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা নয় তো?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।