আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বোধি (শেষ কিস্তি)

সুখ চাহি নাই মহারাজ—জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত, অদ্য আমি জয়ী।

প্রথম কিস্তি এখানে ৪) শাহীনাকে তাই মাঝে মাঝেই অপরিচিত মনে হয় রেশাদের। আর তাই আজকের ঘটে যাওয়া দুঃস্বপ্নের মতো সেই ঘটনাটা কী রকম প্রতিক্রিয়া ওর মধ্যে সৃষ্টি করবে, এটা ভাবতে যেয়ে রেশাদ কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেললো এই মূহুর্তে। একটা সিগারেট ধরালো সে।

অন্ধকার ঘরের বুক চিরে দেশলাইয়ের আগুনটা জ্বলে উঠতেই স্যাঁত করে পিচ্ছিল অথচ দ্রুত গতিতে দরজা গলিয়ে বেড়িয়ে গেল প্রাণিটা। ভয় পেয়েছে তার পোষা বিড়াল। এতক্ষণ বেশ একটা শীতল আমেজ চারদিক ঘিরে ছিল ঘরটাতে। এখন আবার চাপা গুমোট গরম ভর করেছে। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমতে শুরু করলো ফের রেশাদের দেহে।

তার সাথে অসহ্য একটা চাপা সুতীব্র যন্রণাবোধ। অথচ সকালে ঝরঝরে শরীরে বেগবান স্ফূর্তিতে কেমন উড়ে উড়ে চলে গিয়েছিল সে দিদারুল আলমের আফিসে। নিজামুদ্দিন তার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ দুপুরের মধ্যেই বইটার ছাপার কাজ শুরু হবে! সদ্যপ্রসূত নারীর মতো গর্বিত বোধ করছিল তাই রেশাদ। সৃষ্টির আনন্দ যে কী বিশাল, তার অনুভূতিটা একমাত্র নারীদেরই করায়ত্ব ব’লে জানতো এতদিন সে।

আজ সকালে নিজামুদ্দিনের কাছে যেতে যেতে রেশাদের মনে হলো, এতদিন সে আংশিক হলেও ভুল ধারণা পোষণ করে এসেছে। নিজামুদ্দিন পান খায় না, কিন্তু তার ট্রাউজারের পকেটে সবসময় কাটা সুপারির কৌটা মজুদ থাকে। সেখান থেকে দু’টুকরো সুপারি মুখে ফেলে সোৎসাহে সে অভ্যর্থনা জানালো রেশাদকে, “আরে আস রে ভাই আস। বসো বসো, এইখানটাতে বসো”, বলে পাশের চেয়ারটা নিজের আসনের বেশ কাছাকাছি সরিয়ে এনে রাখলো নিজামুদ্দিন। -“চা খাবা তো!”, বলে উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই চিৎকার করে উঠলো সে, “পাগলা... ওই পাগলা... শালায় ধ্যান্দা না কী!” নিজামুদ্দিনের হানিফ নামক সেই ‘পাগলা’র ততোধিক উচ্চকিত, যেন বা সি মাইনরে বাঁধা চিঁ চিঁ কন্ঠস্বরটা ‘যে সার’ বলে প্রত্যুত্তর করে উঠলো।

এবং তার পরপরই সর্পিল ভঙ্গিমায় দরজা সেঁধিয়ে পাগলার প্রবেশ। -“চা আনরে ব্যাটা, চা আন! একটায় চিনি কম, বুঝছস?” লোকটা বাঁধাই সেকশনের কর্মচারী, জানে রেশাদ। তবু পিয়ন জাতীয় এতো লোক থাকতে এই হানিফকে দিয়েই নিজামুদ্দিন প্রায়ই তার ফাইফরমাস খাটায় কেন, এ ব্যাপারটা এখনও বোধগম্য নয় রেশাদের। -“নাও ততক্ষণে সুপারি চিবাও”, বলে কৌটাটা বাড়িয়ে ধরলো নিজামুদ্দিন। ভ্র কুঁচকে রেশাদ বললো, “ না, এখন আর ঐ জিনিস মুখে রুচবে না”।

নিজামুদ্দিন বললো, “ কেনরে ভাই, খুব টেনশনে আছ না কি? তা শুনলাম পনের-বিশ মিনিট আগেও নাকি তুমি মোড়ের দোকানে দাড়ায়া সিগারেট টানতেছিলা?” অস্বীকার করলো না রেশাদ। বললো, “হ্যাঁ, পৌণে দশটার দিকেই পৌঁছে গেলাম। তোমার সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দশটায়, অতএব...”, হঠাৎ কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো রেশাদ, “ তা তুমি জানলে কি করে যে আমি মোড়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলাম? দেখেছিলে না কি আমাকে?” ভ্রু নাচিয়ে নিজামুদ্দিন বললো, “ না রে ভাই না, আমি দেখবো কেন? আমি তো আসি নয়টায়। তবে খবরাখবর রাখনের পাবলিক আছে আমার। তাদেরই একজন কইলো তোমারে দেখা গেছে মোড়ের দোকানে দাঁড়ায়া আছো`।

বিরক্ত বোধ করলো রেশাদ। যেন বা তার মুখের ভাষা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাত নিজামুদ্দিন বললো, “ কি ভাই, নাখোশ হইলা না কি?” তারপর এগিয়ে এসে রেশাদের পিঠে একটা চাপর মেরে বললো, “ এডমিনিস্ট্রেশান চালানো বড় কঠিন জিনিস, বুঝলা রেশাদ? খুঁটিনাটি সব খবর রাখা ভালো, বুঝলা কি না? তো দুই চারটা টিকটিকিও পুইষা রাখছি এর জন্য। তারাই আগ বারায়া খবর দেয়। আনন্দম পাবলিকেশনের ভিতরের খবর, বাইরের খবর। এ শালা দিদারুল কি আর বুঝে কত কঠিন দায়িত্ব আমার? ঐ শালায় তো খালি...”, দিদারুল আলম সম্পর্কে আরো কিছু কটুক্তি করতে যেয়েও হঠাৎ থেকে গিয়ে প্রসঙ্গ পালটালো নিজামুদ্দিন, “ তা তুমিই বা কেমন লোক মিয়া? পনের মিনিট আগেই যখন পৌছাইলা, তখন সোজা আমার কাছেই চইলা আসতা! খামোখা বাইরে দাঁড়ায়া ছিলা...” -“তোমার সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল সকাল দশটায়, মনে নেই?” -“লে হালুয়া!”, বলেই হা হা করে হেসে উঠলো নিজামুদ্দিন, “তুমি দেখি মিয়া পাংকচুয়ালিটির পরাকাষ্ঠা, এ্যাঁ!” আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, ইতিমধ্যে চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো পাগলা ওরফে হানিফ।

পাগলে পাগলে ভালই মিলেছে, ভাবলো রেশাদ। তারপরই এলো এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ, অন্ততঃ রেশাদের কাছে তা-ই! ৫) উত্তরায় শীতটা এখন আরো বেশী নগ্ন ভাবে পড়েছে। শহরতলী বলেই কি শীতের প্রকোপটা বেশী? এ মূহুর্তে রেশাদ ঘরে বসে ঠক ঠক করে কাঁপছে। গায়ে গরম কাপড় নেই, বাতিও জ্বালায়নি সে। ক’টা বাজে? একটা পুলওভার গায়ে দিতে দিতে ভাবতে চেষ্টা করে সে।

হাতঘড়ি পড়বার অভ্যাস তার নেই। শাহীনার ফিরতে কি দেরী হয়ে যাচ্ছে? যদিও এ ব্যাপারে সে এখনও উদ্বিগ্ন নয়, তবু শাহীনার কথা ভাবতেই কেমন কুঁচকে গেল রেশাদের দেহটা। শাহীনার ফিরতে যদি আজ দেরী হয়? শাহীনা যদি আজ কোন কারণে না ফিরে? পথে এ্যাক্সিডেন্টে শাহীনা যদি দিন দশেকের জন্য সংজ্ঞাহীণ হয়ে পড়ে? ভাবতে ভাবতে রেশাদ নিজেই দু’দিকে মাথা নাড়লো, বিরক্ত হলো নিজের উপরই। অথচ মনের খুব গভীরে এ ভাবনাটা যেন তাকে জ্বালা উপশমকারী মলমের মতো সুশ্রুষা করে গেল। নাহ! আবার দ’দিকে মাথাটা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটা তাড়াবার চেষ্টা করলো সে।

দম বন্ধ হয়ে এলো রেশাদের। ছুটে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো। সামনেই ফাঁকা প্লট বেশ কয়েকটা। দূরে একটা প্লটে শুধু ফাউন্ডেশনের ইট পাথর চোখে পড়ে, বাকি পুরো যায়গাটা মাঠই বলা চলে। মাঠে এসে দাঁড়ালো রেশাদ।

এখন শীতটা আরো বেশী, আরো তীক্ষ্ণভাবে ঠোঁকরাতে লাগলো তার মোটা পুলওভার ভেদ করে। নাকি শীতের তীব্রতাটা কল্পনাশ্রয়ী? সেই দুঃসংবাদ থেকে শুরু করে আজকের পুরো ঘটনাটাই এ শীতে পাওয়া ভাবটার জন্য দায়ী? যে কারণেই হোক, ফের কেঁপে উঠলো রেশাদ। যেমন আজ সকালে কেঁপে উঠেছিল খবরটা শুনে! নিজামুদ্দিন তখনও চা টা শেষ করেনি, এমন সময় গলায় মাফলার জড়ানো এক লোক এসে খবর দিল দিদারুল আলমের ঘরে ডাক পড়েছে তার। -“স্যাররে বলো এখুনি আইতাছি”, বলে উঠে দাঁড়িয়েও গেল না নিজামুদ্দিন। তার বদলে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে আবার জড়ো করার ভঙ্গিতে ব্যায়াম শুরু করলো সে।

তারপর জিজ্ঞাস করলো, “তা দোস্ত, অনুভূতিটা কি রকম?” চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে রেশাদ বললো, “ কিসের?” -“এই যে বইয়ের! অফসেট প্রিন্ট, ফোর কালার ইলাস্ট্রেশন, আর সামনের বইমেলা!” -“ওহ গ্রেট! তবে আমি সবচে’ কৃতজ্ঞ কাগজে এড-এর ব্যাপারে”, রেশাদের স্বীকারোক্তি। -“কিসের এড?”, বলেই দাঁত বের করে হাসলো নিজামুদ্দিন। তারপর বুকের উপর সদম্ভে চাপড় মারলো সে, “সবই এই নিজাম মস্তানের কীর্তি, বুঝলা? তবে ঐ রয়াল্টির টুয়েন্টি পার্সেন্ট কিন্তু আমার। টোকেন মানি আর কী, হা হা হা। কি বুঝলা?” -“তুমিও শালার কম ফকিরনি না”, কৃতজ্ঞতার হাসি হাসতে হাসতে বললো রেশাদ।

ঐ পার্সেন্টেজটা নিয়ে তাকে যে নিজামুদ্দিন কিছুটা দায়মুক্ত করতে চাইছে, এই ব্যাপারটা সবচেয়ে নাড়া দিল রেশাদকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে একটু গম্ভীর স্বরে নিজামুদ্দিন বললো, “দুইটা কথা বলি তোমারে, আশা করি মনে কিছু নিবা না...” বলতে বলতে বাম হাতের তর্জনীটা ডান হাতের তর্জনীর উপর রাখলো, “এক, মানুষকে অবহেলা করবা না। কার মধ্যে কী লুকাইয়া থাকে তুমি আমি কেমনে বুঝবো যদি তারে অবহেলাই করি? আর দুই...”, দম নিলো না সে, বলে চললো, “লেনদেন পরিস্কার রাখবা। এতে হাত পরিস্কার, সম্পর্ক পরিস্কার। কি বুঝলা? আসলে তোমারে বললাম, কারণ আর কেউ আমার এই কথা বুঝবার চেষ্টা করে না।

অতি সামান্য কথা, কিন্তু...” রেশাদকে চুপ করে থাকতে দেখে সে আবার শুরু করলো, “কী ব্যাপার, তোমার কোন মতামত নাই? হা হা হা...এই তো মানুষের দিন রে ভাই! আজকে ঠুটা নিজাম বক্তৃতা মারে, আর বোদ্ধা রেশাদ শুনে। সবই চান্সের দুনিয়া, বুঝলা দোস্ত?” রেশাদ বুঝে, বিশ্বাসও করে। কিন্তু নিজামুদ্দিনকে কিছুই বলতে পারে না। আসলে এমন এক একটা সময় বা পরিস্থিতি আসে, যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি বড় অসহায় হয়ে পড়ে। বোবা নিরীহ প্রাণীর মতো এই অসহায়ত্ব একান্তই মধ্যবিত্তের, আর কারো নয়।

-“দিদারুল আলম তোমাকে ডাকছে, ভুলে গেছ?” হা হা করে হেসে উঠে নিজামুদ্দিন, “আরে এত সিরিয়াস হয়ে যাবা জানলে তো ওসব বলি না ভাই!” -“কোথায় সিরিয়াস দেখলে আমাকে?” -“ওহ, দ্যাটস ফাইন। তবে দিদারুল আলম ডাকলেই নিজামুদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে রেসপন্স করে না, বুঝলা?”, চোখ মটকে বলে নিজামুদ্দিন, “এইটা হইলো আমার স্ট্র্যাটেজি। ওইসব তুমি বুঝবা না। যাই হোক, এখন যাওয়া দরকার। বুড়ায় কেন ডাকে, কে জানে! এখুনি আসতেছি, ফিরে এসে প্রেসে যামু তোমার কাজ দেখতে, কি বলো?”, হাসিতে উদ্ভাসিত করে দিয়ে বেরিয়ে গেল নিজামুদ্দিন।

৬) রাত এখন ক’টা তা বুঝতে পারে না রেশাদ। শাহীনার ফিরে আসবার সময় ক্রমশঃ পেরিয়ে যাচ্ছে, এটুকু শুধু বুঝতে পারে সে। ওর খালার বাসায় কি একবার খোঁজ নেয়া দরকার? ক্ষীণ উত্তেজনা দানা বেঁধে উঠছে শাহীনার দেরী হচ্ছে দেখে, অথচ এক ধরণের স্বস্তিও যেন বা পাশাপাশি বোধ করে রেশাদ। আজ রাতটা শাহীনার মুখোমুখি হবার দায় থেকে এক ধরণের মুক্তি! সারাটা দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যেন বা এক একটি চিত্রকল্প, রেশাদ নামক একমাত্র দর্শকটিই যার নির্মাতা। দিদারুল আলমের ঘর থেকে যখন বেরিয়ে এসেছিল নিজামুদ্দিন, পাশের ডেস্কের ফোনটা উঠিয়ে তখন ডায়াল করছিল রেশাদ।

ওর হাত থেকে রিসিভারটা প্রায় কেঁড়ে নিয়ে রাখতে রাখতে বলে উঠলো নিজামুদ্দিন, “ খারাপ খবর আছে”। -“কার জন্য?”, অবাক হলো রেশাদ। -“তোমার জন্য”। -“কি রকম?” -“মেশিনে উঠবে না আজ তোমার বই”। -“মানে?”, চেঁচিয়ে উঠলো রেশাদ।

-“মাথা ঠান্ডা রাখো দোস্ত”, নিজামুদ্দিনের কন্ঠে বরফ শীতল নির্লিপ্ততা, “আমার কথা শুনো। কাল রাতেই ঐ দিদারুল আলমের হাতে হুমায়ুন আহমেদ আর মিলনের মোট তিনটা উপন্যাসের পান্ডুলিপি আইসা যায় ফাইনাল প্রুফ সহ। অথচ কুত্তার বাচ্চা আমারে আগে কিছুই জানায় নাই!” দর দর করে ঘাম ঝরছে রেশাদের। নিজামুদ্দিন বলে চললো, “তোমারে ধৈর্য ধরতে হবে দোস্ত। এটারে এক্সিডেন্ট হিসাবে ধইরা নাও।

আফটার অল আমি তো আর মালিক না। তবে দিদারের বাচ্চা আমারে গোপন করলো কেন, এটা বুঝলাম না। কথা দিলাম, বই মেলাটা ধরায়া দিমু তোমারে। বইমেলা শেষ হইবার একদিন আগে হইলেও বাজারে যাবে তোমার উপন্যাস”। এর মিনিট পনের বাদেই ওরা দু’জন নাইটেঙ্গেল বার-এ বসে চোঁ চোঁ করে মদ গিললো।

যখন বেরিয়ে এলো, তখন বিকেল প্রায়। ফূর্তির মেজাজে পেয়েছে আজ নিজামুদ্দিনকে। ইস্কাটনের এক অভিজাত মাসাজ পারলারে ওদের দেহ আধঘন্টা ধরে ছানাছানি করলো দু’জন মেয়ে। তারপর রেশাদ একা। একটা বাক্যও উচ্চারিত হয়নি এতক্ষণ ওর গলা থেকে।

একাই বকে গিয়েছিল নিজামুদ্দিন, জবাবে রেশাদের শুধু হুঁ হাঁ ধ্বনি। ৭) নিশি পাওয়ার মতো ঘোর লাগা চোখে কোথায় যাচ্ছে সে অতঃপর? এঁদো গলির মোড়টাতে রিকশাটা থামতেই দু’তিনজন এসে ঘিরে ধরলো রেশাদকে। -“ওই হালারা ভাগ ভাগ, এইডা আমার কাস্টমার”, বলে বগলদাবা করলো লোকটা রেশাদকে, “আমার নাম মিঃ আদিল, সার! নেশা করি, মাগর বেঈনসাফি করি নাই কারো লগে আজতক। এককেরে কচি মাল দেখামু। চয়েজ আপনার।

পছন্দ না অইলে হোগার মইধ্যে তিনটা লাথথি দিয়েন সার”, বলতে বলতে হিড় হিড় করে টেনে এনে মিঃ আদিল বসালো ওকে একটা টং চায়ের দোকানে। নেশায় ঢুলুঢূলূ চোখে আরেকবার দেখে নিল সে রেশাদকে। মনে মনে বললো, খানকির পুত! নারায়নগঞ্জের এপাড়ায়, অর্থাৎ এদিকটায় রেশাদ এই প্রথম। অবাক হয়ে দেখলো সে, উঁচু উঁচু কয়েকটি ভবন জালের মতো ঘের দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাদাগাদি করে। অসংখ্য মুখ, অসংখ্য মানবিক চরিত্র, অসংখ্য হাঁক-ডাক, অসংখ্য উত্থিত শিশ্ন আর মৃত জরায়ুতে মাখামাখি হয়ে থাকা ভবন কোন্দর।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মদ ও গাঁজার দোকান। গলিগুলোতে থকথকে কাদা। সেই কাদা মাড়িয়ে থপ থপ করে এগিয়ে যেতে যেতে দু’টো মৃদুগম্ফু কিশোর কাকে যেন গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো, “বয়স কত?” খিলখিল হাসিতে জবাব এলো, “ষোল, দুই হাতে ডলো”। সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া গলিগুলো ভবনগুলোকে ঘিরে রেখেছে। অসংখ্য নারীর মেলে ধরা শরীর থিক থিক করছে- একতলা, দোতলা, তিনতলা, চারতলায়।

সর্বত্র! অন্ধকার গহ্বরে ঝুলে থাকা সারি সারি বাদুরের মতো। হাটুরেদের বয়স বিভিন্ন। তাদের কোন তাড়া নেই, কোন চঞ্চলতা নেই, ঠকবার ভয়ও তাই নেই। নারায়নগঞ্জ বণিক সমিতির নথিভুক্ত নয় এ বাজার। তবু এক অকথিত বাজারি আইন এখানে মেনে চলে সবাই।

হাতের চেটোতে থুথু দিয়ে তাতে গাঁজা ডলতে ডলতে এগিয়ে এলো বছর ত্রিশের এক ছোকরা। মিঃ আদিল তাকে বললো, “ কি খবর?” -“বেবী আফার ঘর খালি”, বলে থুক করে একদলা কফ ফেললো সে পায়ের কাছে। রেশাদের কোন উত্তেজনা নেই এখন। নিশি পাওয়ার মতই এখন সে এঁদো কাদা মারিয়ে চলেছে ওদের সাথে। বকবক করছে মিঃ আদিল, একটি শব্দও শ্রুতিগোচর হচ্ছে না রেশাদের।

ঘুটঘুটে অন্ধকারময় পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে চারতলা পর্যন্ত উঠতে যেয়ে ঘামতে লাগলো রেশাদ। তলপেট পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত বোধ করছে সে। অথচ এসব কিছু ছাপিয়ে উঠে এই প্রথম আশ্চর্য হলো সে- এখনও সন্ধ্যা নামেনি, তবু এতো অন্ধকার কেন চারদিক? কেন এরা আলো জ্বালে না বেশী করে? মিঃ আদিল হাঁক ছাড়লো, “বেবী আফা কই?” সারি সারি ঘরগুলোয় দাঁড়ানো মেয়েগুলো এতক্ষণ পর্যবেক্ষনী দৃষ্টি নিয়ে রেশাদের প্রতি ছুঁড়ে দিচ্ছিল বিভিন্ন মন্তব্য- ‘ও জামাই, এই ঘরে আইসো গো!’, অথবা ‘পালাও কই গো সতিনের পুত?’ মিঃ আদিল অমনি ধমকে উঠে, “ওই বিডি, এক থাপ্পড়ে তোর দাত ফালায়া দিমু!” এ কথনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে ওরা সবাই। বেবী আপা রেশাদের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হাত ধরে টেনে নিল নিজের ঘরে। চল্লিশ ওয়াটের টিমটিমে আলোয় ঘরের আনাচে কানাচে চাপ চাপ অন্ধকার জমে আছে।

তিনটা খাট জোড়া লাগিয়ে লম্বা একটা বিছানা বানানো হয়েছে ঘরের অর্ধেক জায়গা জুড়ে। পুরো লম্বা বিছানাটাতেই আড়াআড়ি রশি ঝুলিয়ে পর্দা ফেলে তিনটি প্রকোষ্ঠের মত করা হয়েছে। বিছানার শেষ প্রান্তের পর্দা ফেলা প্রকোষ্ঠতে এক জোড়া নারী-পুরুষের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। ঘরের আরেক প্রান্তের কোণায় গোসলখানার পানি নির্গমনের ব্যবস্থার মতো একটা নালা বানানো হয়েছে ধৌতকার্যের জন্য। পাশে পানি ভর্তি পানি ও মগ।

কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই বেবী আপা রেশাদের সামনে জনচারেক কিশোরীকে এনে দাঁড় করালো প্রদর্শনীর মতো করে। আর মিঃ আদিল ওদের প্রত্যেকেরই কৈশোরীক জননেন্দ্রিয়ের সূচিতা ও স্থৈল্যহীণতা সম্পর্কে নিশ্চয়তাসূচক বাক্যবন্ধ রেশাদের শ্রুতিতে গাঁথবার একঘেঁয়ে চেষ্টায় ব্যাস্ত থাকলো। রেশাদের শিরা-উপশিরা ঘিরে তখন হিংস্র রক্তের নাচন। নিশি পাওয়া রেশাদ তখন তার উত্থিত শিশ্নের অহংকার নিয়ে সয়ম্ভু এক পুরুষ। ৮) তখন শীতের সান্ধ্য কুয়াশার চাদর ছড়িয়ে শহরের বুকে।

খুব দূর থেকে ভেসে আসছে মাতালের চিৎকার। কোথায় যেন বেজে চলেছে হিন্দী গানের কলি। বেবী আপা তাড়া দিল, “কইরে বকুল, হইলো তগো?” কিশোরী বকুল ক্লান্ত স্বরে বললো, “আর দেরী নাই”, তারপর রেশাদের পাঁজড়ে খোঁচা মেরে বললো, “এইবার উঠেন, আর টাইম নাই”। একটা গা ঘিনঘিনে ক্লেদাক্ত অনুভূতি নিয়ে রেশাদ কাপড় পরলো। কেমন বমি আসছে তার, আবদ্ধ ভারী বাতাসে হাপরের মতো শ্বাস নেবার চেষ্টা করলো সে।

তার কান্না পাচ্ছে, ভীষণ কান্না পাচ্ছে। হঠাৎ ঝাঁ করে উঠলো রেশাদের মাথাটা! কোথায় ওর টাকার ওয়ালেটটা? আশ্চর্য, কোথায়? তন্ন তন্ন করে খুঁজলো সে আশপাশ। নেই। কোত্থাও নেই! আতঙ্কিত উদ্ভ্রান্তের মতো তাকালো সে বকুলের দিকে। -“কী হইলো?”, বকুল সন্দিগ্ধ।

-“আমার মানি ব্যাগ? সব টাকা যে ওটার মধ্যে!”, অস্ফুট ভয়ার্ত আওয়াজ বেরিয়ে এলো রেশাদের গলা হতে। বকুল বললো, “হারামীর বাচ্চা!” রেশাদ বললো, “ বিশ্বাস করো আমাকে!” বকুলের চীক্ষ্ণ চোখ রেশাদকে দেখলো। ঘৃণায় নীল হয়ে আছে বকুলের মুখ। একটা বাক্যব্যয়ও করলো না সে, নিঃশব্দে বেবী আপাকে ডাকলো। -“ট্যাকা বাইর কর জলদি, কুত্তার বাচ্চা”, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো বেবী আপা।

-“খোদার কসম বলছি, আমি জানি না কখন হারিয়ে গেছে আমার মানি ব্যাগটা...”, বলতে বলতে কেঁদে ফেললো রেশাদ ঝরঝর করে, বছর পঁয়ত্রিশের সেই শহুরে মধ্যবিত্ত উপন্যাসিক। ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে সেখানে মিঃ আদিল সহ জনা কয়েক ষন্ডামত লোক। হাত ঘড়িটা খুলে নিল তারা রেশাদের কাছ থেকে। তারপর চুলের মুঠি ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে দীর্ঘদিন অব্যবহৃত বাতিহীণ একটি টয়লেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিল। -“পুংগির পুত, থাক এইখানে এক ঘন্টা আটকা পইরা”, কার যেন গলা শুনতে পাওয়া গেল, “শুয়োরের বাচ্চা, পকেটে নাই মাল, আবার...” স্তম্ভিত হয়ে রেশাদ শুনে যাচ্ছিল এসব খিস্তিখেউর।

লুপ্ত হয়ে গেছে তার সমস্ত বোধ, চিন্তারহিত এক ক্লীবে পরিণত হয়ে গেছে সে যেন এখন। রেশাদ মারা যাচ্ছে, মারা যাচ্ছে সে- এই ভাবনাটাই এখন সবচে’ প্রিয় হয়ে উঠেছে তার কাছে। একবারও চেষ্টা করলো না সে দরজাটা খুলবার। টানটান তন্ত্রিগুলো অল্প অল্প করে ঢিলে হতে শুরু করেছে এখন। এতটা অবসন্নতা আর কখনও ঘিরে ধরেনি তাকে।

টয়লেট থেকে উঠে আসা তীব্র দুর্গন্ধ মোটেই আর তাকে কষ্ট দিচ্ছে না। বদ্ধ ভ্যাপসা গরম আর তাকে মোটেই পীড়া দিচ্ছে না এক বিন্দু। সোঁদা ঘাম তার শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে গলগল করে। টয়লেটের বাতাস নির্গমনের একমাত্র স্কাই লাইটটা দিয়ে বাইরের একচিলতে আলো চিকন হালকা রোদের মতো এসে ঢুকছে ভিতরে। সেদিকে চোখ ফেরালো রেশাদ।

অন্ধকার হাতরে এগিয়ে গেলো সে স্কাই লাইটটার দিকে। দু’পায়ের পাতার উপর ভর করে গলা উঁচিয়ে সেই স্কাই লাইটের মধ্য দিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করলো বাইরের জগতে। কী আশ্চর্য! কোথায় জগত? শীতের আধো কুয়াশায় ঢাকা চারপাশের বিক্লিষ্ট ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। রেশাদের সেই মূহুর্তে মনে হলো, সারি সারি অসংখ্য মুখ যেন তারই মতো টয়লেটের গহীণ অরণ্যে এক বেদনারহিত অনুসর্গে বন্দী হয়ে আছে- যেমন হয়ে আছে এই মূহুর্তে রেশাদ, এই পরিত্যাক্ত টয়লেটে। রেশাদের আছে যেমন ঐ ছোট্ট স্কাই লাইটটা, ওদেরও আছে তেমনি এক চিলতে ছোট্ট ধুসর আকাশ।

৯) শাহীনা আর ফিরলো না। সারাটা রাত জেগে কাটালো রেশাদ। ওর কি তবে শাহীনার খোঁজে সকালেই বের হওয়া উচিত? শাহিনার কোন দুর্ঘটনা? অথবা অন্য কিছু? ওকে কি তবে আর রেশাদের বলা হবে না আজকের ঘটনাগুলো? বুঝে উঠতে পারে না রেশাদ। হয়তো শাহীনা ফিরে আসবে সকালে। বলবে, ইস জানো, খালা কিছুতেই ছাড়তে চাইলো না, তাই রাতে আর ফেরাই হলো না বাসায়।

তোমাকে কিন্তু খবর দেয়া হয়েছিল পাশের বাড়ির মল্লিক সাহেবের বাসায় ফোন করে। ওরা কি তোমাকে খবরটা পৌঁছে দেয়নি? অথবা হয়তো শাহীনা ফিরবে না কোনদিন।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.