আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বোধি (প্রথম কিস্তি)

সুখ চাহি নাই মহারাজ—জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত, অদ্য আমি জয়ী।

১) খুব ছোটবেলায় হামাগুড়ি থেকে সবেমাত্র দু'চার পা হাঁটতে শেখার বয়সে রেশাদ প্রায়ই তার শিশুসুলভ সরল উতসুক্যে মোমবাতির জ্বলন্ত শিখায় আঙ্গুল ছোঁয়াতে যেত। হা হা করে তখন ছুটে আসতেন লায়লা বেগম, তার মা। অথচ বাবা আকবর দেওয়ান ধমকে উঠতেন স্ত্রীকে, "'অত দরদের কী আছে! মইরা তো আর যাবে না, দেখবা একবার ছেকা খাইলে দ্বিতীয় বার আর আগুনের ধারে কাছে আসবে না তোমার পোলায়।

ঠেইকা শেখন লাগবে, বুঝলা? ঠেইকা শেখনের চে বড় শেখন আর নাই। আম্মা প্রায়ই বলতেন এই ঘটনাটা রেশাদকে। বহু বছর পর আজ একা এই শূণ্য ঘরে বসে কথাটা নতুন করে মনে পড়লো রেশাদের। দর দর করে অনবরত ঘাম ঝরছে তার শরীর বেয়ে। বাইরে কয়লার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে।

রাস্তার বাতিগুলো আজ কেন যেন একটাও জ্বলছে না, তাই হয়তো এতো বেশী অন্ধকার। বিছানায় পা দুটো টান টান করে ছড়িয়ে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে রেশাদ। পোষা বিড়ালটা তার ন্যাকামো গলায় অস্ফুট শব্দ করে লাফিয়ে বিছানায় উঠে পা ঘেঁষটে শুতে চেল। মুহুর্তে ক্রুদ্ধ রাগে বিড়ালের পশ্চাৎদেশে লাথি কষালো রেশাদ। দূরে টেবিলের কোণে ছিটকে পড়ে বিহ্বল চোখে কিছুক্ষণ তার মনিবের দিকে দৃষ্টি রেখে কী যেন ভাবলো সে, তারপর দৌড়ে পালালো।

আমি কি মারা যাচ্ছি? বিড় বিড় করে উঠলো রেশাদ। অথচ আজকের দিনটা তো বড় সুন্দর হবার কথা ছিল। মাজা পিতলের মত ঝকঝকে রোদ উঠেছিল সকালে। তারপর শান্ত সুন্দর একপশলা বৃষ্টি। নতুন ব্লেডে দাড়ি কামিয়ে টগবগিয়ে প্রেসে চলে গিয়েছিল রেশাদ ক্ষীণ উতকন্ঠা আর চাপা এক আনন্দ বুকে নিয়ে।

আজই মেশিনে উঠছে তার প্রথম উপন্যাসটা। অথচ কী ভাবে বদলে গেল আজকের দিনটা! বদলে গেল সে নিজেও! ভিতরের সবকিছু ওলটপালট করে দিয়ে গেল আজকের দিনের ঘটনাটা। সময় বড় অস্থির- কেননা মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে, তার অসহিষ্ণুতাকে, অস্থিরতাকে লাগাতার ভাবে বুকে নিয়ে বেড়াচ্ছে সে। মৃত মানুষের মত চিত হয়ে পড়ে আছে রেশাদ। মৃত্যু বেপারটা নিয়ে এতদিন নাক সিঁটকিয়ে এসেছে সে।

মৃত্যুকে সে এই পরিণত বয়সে এসে হেঁয়ালি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি। কেননা আত্বার অস্তিত্ব যখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়, তখন থাকে শুধু অন্তহীণ শূন্যতা। । এখন এ ঘরে শূণ্যতা। এখন এ ঘরে কোন দৃষ্টি নেই।

এখন এখানে কোন চিন্তা নেই, কোন স্বর নেই। এখন এ ঘরে কোন অন্ধকার নেই, কেননা দেহবর্জিত শূণ্যতার কোন রঙ নেই। এখন এ ঘরও নেই- মনে হলো তার। বাইরে একটা অটোরিকশার আওয়াজ পাওয়া গেল। শাহীনা এলো কি? বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রেশাদ।

না, শাহীনা নয়। পাশের বাড়ির মল্লিক সাহেবের বাসায় যাত্রিকে নামিয়ে দিয়ে ফট ফট শব্দ করে চলে গেল অটোরিকশাটা। অবশ্য এতো তাড়াতাড়ি আসবার কথাও নয় শাহীনার। মুন্নি খালার বাসা থেকে একবারে রাতের খাবার সেরে আসার কথা ওর। না, আজ আর শাহীনার মুখোমুখি হতে চায় না রেশাদ।

আজকের দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার পর কিছুতেই আর সম্ভব নয় রাতে ওর সাথে বাক্য বিনিময় করা। মরে গেলেও নয়! ২) উত্তরার এ প্রান্তটা বড় বেশি চুপচাপ। নতুন লোকালয় গড়ে উঠছে। মফস্বলী এবং কিছুটা বনজ পরিবেশ এখনও বিক্ষিপ্ত ভাবে রয়ে গেছে এদিকটায়। গজিয়ে উঠা নতুন সমাপ্ত বাড়িগুলোকে দূর থেকে কেমন ভৌতিক বলে মনে হলো রেশাদের।

বারান্দায় চেয়ারে বসে সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আজকের ঘটনার অদ্ভুত উপলব্ধিটা আবার ছেয়ে ফেললো তাকে। কখন হঠাৎ করেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে খেয়াল ছিল না তার। রেশাদের মনের আচ্ছন্ন ভাবটাকে আরও যেন উসকে দিল এই উগ্র বৃষ্টির তোড়। অসহ্য এ পরিবেশ! ওর সমস্ত অনুভূতিকে যেন বা আজ ফুটো করে দিয়ে নেমে আসছে তীব্র তীক্ষ্ণ এক একটা বৃষ্টির কণা। এ যেন এক পুর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র! আজ সন্ধ্যা থেকে প্রচন্ড হতাশা ও দুঃখবোধ রেশাদকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে, আর এই হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটাও যেনবা সুতীব্র ব্যাথার প্রতীক হয়ে ঝরে পরছে উত্তরার এই আধা মফস্বলী আধা বনজ পরিবেশে।

বাইরে এখন অজস্র বর্ষণ। পরিবেশটা এখন ভোঁতা। রাতের এই উটকো বৃষ্টিটা ক্রমশঃ আরও দুঃখময় করে তুলছে তাকে। জানুতে এসে ঠেকেছে তার মাথা। আত্মশ্লাঘায় আরও নুয়ে পড়লো সেটা, তুলতে চেষ্টা করেও পারলো না সে।

আর এই আত্মশ্লাঘাটা এককভাবে আজকের ঘটনার জন্য শুধু নয়, বরং সমস্ত অস্তিত্বকে নিয়ে, সমস্ত প্রকৃতিকে ঘিরে এখন তার এই আত্মশ্লাঘা, তার এই দুঃখবোধ। গত রাতে সুধীন মিত্র ও নিজামুদ্দিনকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় দিতে একটু বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল। দুজনেই প্রিন্টিং প্রেসের লোক। সুধীন মিত্র মেশিন ইন চার্জ, পেস্টিং-এও পাকা হাত তাঁর। আর নিজামুদ্দিন এসিস্টেন্ট ম্যানেজার।

এই নিজামুদ্দিন লোকটাকে মোটেই সহ্য করতে পারে না শাহীনা। বেশ বাচাল আর প্রায় অশ্লীল সব রসালো গালগল্প হচ্ছে লোকটার কথা বলার প্রধান বিষয়। স্থান-কাল-পাত্র কিছুই সে বিবেচনায় আনে না কথা বলার সময়। বলতে গেলে অনেকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই পৃথিবীর যত সব অযাচিত খিস্তিখেউর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে নিজামুদ্দিনের। রাতে খাবার টেবিলে গরুর মাংস চিবাতে চিবাতে “ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট ক্লাস” বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো নিজামুদ্দিন।

তারপর পাশে বসা সুধীন মিত্রকে খোঁচা মেরে বললো, "আপনারা হিন্দুরা বড়ই অভাগা সুধীনদা। কে কবে কোন কালে আইন করে দু'পাতা লিখে দিল, আর অমনি আপনারা গরুভক্ত হইয়া এমন সাধের ডিশটা একযোগে বর্জন করলেন? আফসোস আফসোস!" আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল নিজামুদ্দিন, হঠাৎ শাহীনার দিকে চোখ যেতে এক গাল মাইডিয়ার হাসি হেসে থেমে গেল সে। তারপর মুখটা বেঁকিয়ে হাড় চিবানোতে মন দিল। ভাল মানুষ সুধীন মিত্র হেসে বললেন, "না ঠিক তা নয় নিজাম মামু। আমাকে তো জানেনই ভালো করে, ঐসব জাতপাত ছোঁয়াছুয়ি তো সেকেলে ব্যাপার।

শুধু এই গরুর মাংসটাই ধরা হলো না। বুঝেন না? প্র্যাকটিস নাই আর কী... তাই মুখে দিতে কেমন কেমন ঠেকে। " - "আপনিই বা শুয়োর খান না কেন নিজাম ভাই? আপনার কিতাবে বারণ আছে বলে?" শ্লেষ্মা মেশানো স্বরে বলে উঠলো শাহীনা। - "কী যে বলেন ভাবী! আমাকে এখনও চিনতেই পারলেন না আপনি। সব মাংসই টেস্ট করা আছে আমার।

কোন বাজারে কোন মাংস পাওয়া যায় তা-ও আমার মুখস্ত। বাজার তো আর কম ঘুরলাম না!", বলে চোখ মটকে রেশাদের দিকে একটা ইঙ্গিতময় হাসি ছুঁড়ে দিল নিজামুদ্দিন। বুঝলো রেশাদ। এবং সঙ্গে সঙ্গে বিব্রত মুখে শাহীনার দিকে চকিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। কিন্তু কিছুই বুঝা গেল না ওর মুখ দেখে।

আবার কথা শুরু করলো নিজামুদ্দিন, "একটা কথা জিগাই সুধীনদা। গরুর গাড়ির ড্রাইভারের পাশটাতে বইসা কোথাও গেছেন কোনদিন?" –এমন অদ্ভুত প্রশ্নে থতমত খেয়ে দু'দিকে মাথা নাড়লো সুধীন মিত্র। -"হে হে... একদিন ড্রাইভারের পাশে বইসা গরুর গাড়ি চড়বেন দাদা, বুঝলেন? এ আমার অনুরোধ, জাস্ট ওয়ান রিকোয়েস্ট", আঙুল চাটতে চাটতে দু'চোখে রাজ্যের কৌতুক নিয়ে বললো নিজামুদ্দিন। সুধিন মিত্র বললেন, "এ আবার কী কথা! কেন?" -"বুঝলেন না?", সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে নিয়ে যেন নতুন কোন খবর ফাঁস করে দিচ্ছে ভঙ্গিতে মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে নিজামুদ্দিন বললো, "গরু যখন চলা শুরু করে তখন খুব কাছ থেকে অবজার্ভ করতে পারবেন পাছাটা- ইয়ে মানে কী যেন কয় খাটি বাংলায়? পশ্চাৎদেশ! দেখবেন পেন্ডুলামের মতো একবার ডানে একবার বামে মুভ করতেসে। কী চেকনাই সেই দৃশ্যের! গুড গড, যারে বলে কোন মেয়েছেলের হাইটা যাওয়া দেখতেসেন আপনি।

এরপর খাবার টেবিলে বিভ দেখে কি মুখ ঘুরাইয়া রাখা যায়?", বলে একা একাই হা হা করে হেসে উঠলো নিজামুদ্দিন। সবাই এক অদ্ভুত বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সুধীন মিত্রের পান খাওয়া মুখটা হা হয়ে রইলো। কী বুঝলো সে-ই জানে, আবার শুরু করলো নিজামুদ্দিন, "তবে বুঝলা রেশাদ, শুয়োরেও যদি গাড়ি টানতো, আই মিন গরু গাড়ির মতো, তাইলে বিফ-এর মতো পোর্কও আমার খাবার টেবিলের রেগুলার ডিশ হইয়া যাইতো। আপনি কি বলেন ভাবী, হ্যাঁ?" আর বসে থাকা যায় না।

সশব্দে চেয়ার ঠেলে একই সাথে বিরক্তি আর রাগে টং হয়ে শোবার ঘরের দিকে চলে গেল শাহীনা। খাওয়াদাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ বসবার ইচ্ছা ছিল নিজামুদ্দিনের, কিন্তু সুধীনদা এক প্রকার জোর করেই তাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রেশাদ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তাতে। অথচ এই নিজামুদ্দিনকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় রেশাদের। কেননা প্রকাশক দিদারুল আলমের হয়ে আনন্দম প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশনের পুরো এডমিনিস্ট্রেশনটাই বলতে গেলে দেখাশুনা করে এই নিজামুদ্দিন।

এডমিনিস্ট্রেশনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের উপর তার তীক্ষ্ণ নজর। দিদারুল আলমের তাই সবচে পেয়ারের লোক হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। অবশ্য নিজামুদ্দিনের একটা ব্যাপার অস্বীকার করতে পারে না রেশাদ। তা হলো, ভীষণ কাজ কাজ পাগল এই লোকটা। এবং মহা ফুর্তিবাজ।

জীবনের ফাঁক গলে কোন আনন্দই বেরিয়ে যেতে পারে না নিজামুদ্দিনের। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে সে উপভোগ করে নেয় চেখে চেখে, চুষে চুষে। জাগতিক পণ্যের সফল ভোক্তা সে। যদিও তার ফুর্তির ধরণটা আদি রসের গন্ডি পেড়িয়ে অন্য কিছুতেই স্থিতি পায় না, তবু মাঝে মাঝে তাকে দেখে ঈর্ষা হয় রেশাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রেশাদ একেবারেই কাছে ঘেঁষতো না নিজামুদ্দিনের।

অথচ আশ্চর্য, এই লোকটাই আগ্রহ ভরে রেশাদের উপন্যাস প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিল দিদারুল আলমকে ধরে। যদিও সাহিত্য-টাহিত্যর কথা উঠলেই নাক শিঁটকায় নিজামুদ্দিন, "আমি ভাই তোমাদের ওইসব কবিতা গল্প পইড়া সময় নষ্ট করতে বিলকুল নারাজ। ওসব ন্যাকা কথাবার্তা পড়ার চেয়ে স্টেডিয়ামে বইয়া ওয়ারী-রহমতগঞ্জের বল গুতাগুতি দেখা ঢের ভালো!" -"ন্যাকা ন্যাকা?" হা হা করে হেসে উঠেছিল রেশাদ। "ভালই বললে নিজাম, তোমার বুঝি এ-ই ধারণা লেখক সম্পরকে?" নিজামুদ্দিন বললো, "এ ছাড়া আর কী! সেদিন দেখলাম সোবহানবাগের এক ঢ্যাংঢেঙ্গা পিসলা আঁতেল দিদার ভাইয়ের রুমে বইসা চিঁ চিঁ কইরা তার গাবদা গোবদা কবিতার পান্ডুলিপিটা আগাইয়া দিল। আর নাম কি রাখছে শুনবা? 'প্রাকৃতজনের প্রাকৃতকথন'।

শালা!" -"আহা, ধুস!" উষ্মা প্রকাশ করলো রেশাদ। নিজামুদ্দিন বললো, "কসম আল্লার, মিথ্যা বলতেছি না। ইচ্ছা হইলো শালার ব্যাটার গাঞ্জা খাওয়া পোঁদে দুইটা লাথি মাইরা ওর অতিপ্রাকৃত ভাবটা মিটাইয়া দেই। " তারপর একটু চুপ করে থেকে মুখে চিটচিটে হাসি মেখে বললো, "বাট ডোন্ট টেইক ইট আদারওয়াইজ। আমি কিন্তু তোমারে মোটেই ওইভাবে মিন করতেছি না।

আমি সত্যিই তোমার বক্তৃতার এডমায়ারার ছিলাম, বুঝলা? মধুর ক্যান্টিনের সামনে দাড়াইয়া তোমার সেই বক্তৃতাগুলা! জটিল! যদিও সব কথা বুঝতাম না, তবু একটা জ্বালা ধইরা জাইতো সারা গায়ে। ঐ থেইকা আমি তোমার সিলিং ফ্যান, বুঝলা? তুমি তো মিয়া পাত্তাই দিতা না আমারে। ভাগ্যিস সুধিনদা’র লগে তোমার পরিচয় ছিল, না হইলে তো আর দেখাই হইতো না তোমার সাথে। " রেশাদ বললো, "বই ছাপার ব্যাপারে আমি কিন্তু কারো করুণা চাইনি নিজাম। " -"না না ছি ছি", ব’লে দাত দিয়ে জিভ কাটলো নিজামুদ্দিন, "তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা হইলো গিয়া যারে কয় বন্ধুত্বের, মহব্বতের।

আমি চাই আমার দোস্তের কিছু খ্যাতি-ট্যাতি হোক, আমারও কমিশন বাবদ যা হোক কিছু আইসা যাবে। কি বলো, হ্যাঁ? হে হে... তোমার খ্যাতি, আমার কমিশন। " আর কথা বাড়ায়নি রেশাদ। প্রথম উপন্যাস প্রকাশের গা ঝিম ঝিম করা আনন্দে বিভোর হয়ে ছিল সে। না হয় খেলই টু-পাইস কমিশন।

প্রকাশকের কাছ থেকে কোন পয়সা না পেলেও কিছুই এসে যেত না রেশাদের। -"তাহলে আগামীকাল দেখা হচ্ছে প্রেসে", বলে রেশাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সুধীন মিত্র। "‘আর আমার সাথে দেখা করবা তুমি ঠিক দশটায়, অফিসে। তখনই ফাইনাল কথাবার্তা হবে, ও কে?", বললো নিজামুদ্দিন। সম্মতিসূচক একটা শব্দ করে দরজা পর্যন্ত ওদের এগিয়ে দিল রেশাদ।

৩) বৃষ্টিটা থেকে গেছে অনেকক্ষণ। একটা হালকা শীতের আমেজ যেন ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার দল রাতের এ অন্ধকারে জেগে উঠে কোন সে গোপন স্থান হতে দাপটের সাথে ডেকে চলেছে একটানা। একতলার বাইরের ঘর থেকে টিভিতে রাত আটটার খবরের আওয়াজ শুনা গেল। অনেক কথা ভাবছিল রেশাদ।

অনেকের কথাও। দিদারুল আলমের কথা, সুধীন মিত্রের কথা, নিজামুদ্দিনের কথা। আর শাহীনা? চমকে উঠলো রেশাদ তার স্ত্রীর কথা মনে হতেই! চেয়ার ছেড়ে উঠে বারান্দায় রেলিং-এ পিঠ কুঁজো করে ভর দিয়ে দাঁড়াল রেশাদ। মনে মনে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে, আজকের ঘটে যাওয়া পুরো ব্যাপারটা খোলাখুলি ভাবে বলবে শাহীনাকে। কিন্তু তারপর? কি ভাবে নেবে সে ব্যাপারটা? ভাবতেই একসাথে হাজারটা সাইরেন বেজে উঠলো যেন রেশাদের মাথার মধ্যে।

আগের চেয়েও দ্রুত হয়ে উঠলো হৃদকম্প। ও কি স্তম্ভিত হয়ে যাবে না রেশাদের ছত্রিশ বছরের সবচে’ ওলটপালট করা এই দিনটির কথা শুনে? প্রচন্ড পানির পিপাসায় ছুটে গেল সে ঘরের মধ্যে। আলো জ্বালিয়ে আকন্ঠ পান করলো সে গ্লাসের পর গ্লাস। না! শাহীনাকে তার সব কথা বলা চা-ই চা-ই! আজ নিজামুদ্দিনের সাথে গিয়ে যে কান্ডটা করলো সে, তার কথা। তারপর নতুন যে উপলব্ধিটা তার সমস্ত চিন্তাকে, অনুভূতিকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল নাড়া দিয়ে ওর ভিতরের সবকিছু কেমন ওলতপালট করে দিয়ে গেছে, তার কথা।

শাহীনা কি বুঝতে পারবে রেশাদকে? সম্ভবত না। এ মুহুর্তে তাই বড় অসহায় লাগলো নিজেকে তার। কতটা চিনতে পেরেছে সে রেশাদকে এ ক’বছরে? রেশাদই বা কতটুকু চিনেছে তাকে? মানুষ কি শেষ অর্থে সত্যিই পারে অপরকে চিনতে খানিকটা হলেও? আর বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে? সামাজিক আনুষ্ঠানিকতাময় যে বন্ধনে দু’টি মানুষ একই ছাদের নীচে বাস করার এবং কিছু অলিখিত নিয়ম পালন করার চুক্তিনামায় সই করে বসে আছে, সেই বেড়াজালে জড়িয়ে পরে কিভাবে সম্ভব নিজেকে অপরের কাছে বইয়ের পাতার মত মেলে ধরা? বুক শেলফ-এ পড়ে থাকতে থাকতে বইয়ের গায়ে জমে উঠে যেমন ধুলোর স্তর, একই ঘরে বাস করা দু’জনের মধ্যেও তেমনি জমে উঠে মায়ার স্তর। বহু বছর বিড়াল পুষলেও তো মায়া পড়ে যায় তার উপর- ভালবাসা যেখানে একটা প্রাত্যহিক অভ্যাস মাত্র। সেই অভ্যাসজনিত ভালবাসায় পরস্পরকে বুঝা যায় বটে, কিন্তু চেনা বড় দায়! তবু শাহীনাকে বলতে হবে আজকের ঘটনাটির কথা।

গত রাতে সুধীন মিত্র ও নিজামুদ্দিনকে বিদায় দিয়ে বেডরুমে এসে রেশাদ দেখলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে শাহীনা। বুঝা গেল না রেগে আছে কী না সে। তার সারা মুখ জুড়ে আছে এক সীমাহীণ নির্লিপ্ততা। শাহীনার মুখের এই আদলটাই ঘাবরে দেয় রেশাদকে। খাবার টেবিলের এঁটো বাসনগুলো এখনও পড়ে আছে।

প্রতিদিন ধোয়াধুয়ির এই কাজটা ভাগাভাগি করে সারে ওরা। আজ আর বাসনে হাত লাগাতে ইচ্ছা হলো না রেশাদের। বরং শাহীনার মুখের ভাঁজগুলো পরীক্ষা করে নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো ঝড়টা ঠিক কিভাবে কখন শুরু হবে। অথচ কিছুই বুঝতে পারলো না সে, ঘন চাপা কালো মেঘ যে ওর সারা অবয়ব জুড়ে ছেয়ে আছে- এটুকু ছাড়া। শাহীনার এক ধরণের ঋজু ব্যক্তিত্বই প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করে রেশাদকে।

অথচ মাঝে মাঝে তার এই চাপা ব্যক্তিত্বের বলয়টা ঘারে বোঝার মতো চেপে বসে রেশাদের, বইতে পারে না সে এ বোঝা। বিছানাতেও শাহীনা প্রশ্রয় দেয় তাকে যেন অংক কষে, মেপে মেপে- পাছে তার চরিত্রের দৃঢ়তাটুকু প্রগলভ উচ্ছাসের তোড়ে ভেসে না যায়, এই ভয়ে। মাঝে মাঝে শাহীনাকে বড় জটিল বলে মনে হয় রেশাদের। এ এক নিছক ধারণা মাত্র, তবু তার যেন মনে হয় সমাজের সাথে শাহীনার কন্ট্রাস্টটা বড় অদ্ভুত। ও সমাজকে আঁকড়ে ভীষণ ভাবে বেঁচে থাকতে চায়, অথচ একজন নারীর কাছ থেকে এ ক্ষয়িষ্মু সমাজ তার যে সব আপাত মূল চাহিদাগুলো, প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে নিতে চায়, শাহীনা সে চাহিদাগুলো মিটিয়ে দিতে নারাজ।

যদিও পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করে সে একটা স্বচ্ছল অংকের টাকা ব্যাগে পুরে বাড়িতে ফেরে, তবু সে একগুঁয়ের মতো যে ব্যাপারটা বুঝতে চায় না, অথবা না বুঝার ভাণ করে, তা হলো এই বাংলাদেশে দু’হাজার সালের শেষে অবস্থান করেও নারী যতই তার অর্থনৈতিক স্বধীণতা অর্জন করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত একসময় না একসময় প্রবহমান এই সমাজের মধ্যে বেচেঁ থেকে তাকে জীবনের কোন না কোন ক্ষেত্রে আপোষ করে নিতেই হয়। রেশাদের মনে হলো, এটাই হয়তো রুঢ় বাস্তবতা। সে ক্ষেত্রে শাহীনার মতো নারীর সামনে এক পর্যায়ে দ’টো পথই খোলা থাকে- হয় সে আপোষ করে নেবে, নয়তো বিদ্রোহ করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শাহীনার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন প্রকৃতির ব’লে রেশাদের কাছে মনে হয়। জীবনের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে এসে সমাজের সাথে না সে আপোষ মীমাংসায় আসছে, না বিদ্রোহ করছে।

বস্তুতঃ রুখে দাঁড়াবার মতো মেয়ে হয়তো সে নয়। কিন্তু শাহীনা যা করছে তা হলো জীবনের ঐ ক্ষেত্রগুলোর প্রশ্নে সমাজকে সে এড়িয়ে চলছে। ভয় হয় রেশাদের, কতদিন পারবে সে এভাবে এড়িয়ে চলতে? সে বুঝতে পারে না শাহীনার এই কৌশলটি সজ্ঞান না অজ্ঞানতাপ্রসূত। তবে এটা বলা চলে, তার এই ‘এড়িয়ে চলার’ কৌশলটি যে মস্ত বড় একটা ফাঁকি, শাহীনা নিজেই তা টের পায়। আর টের পায় বলেই নিজস্ব গড়া এক অহং দিয়ে সে এই ফাঁকিটাকে ঢাকার চেষ্টা করে; এবং প্রায়শঃই পরাস্ত হয়ে রেশাদকেই প্রতিদ্বন্দ্বী করে নেয় সে।

রেশাদ জানে কষ্ট হয় শাহীনার খুব। তবু প্রতিদ্বন্দ্বী রেশাদকে হারিয়ে দিয়ে শরীরী চাহিদার কষ্টটুকু ছাঁপিয়ে উঠে দাঁড়ায় ওর বিজয়ী অহংবোধ। এ মুহুর্তে এলোকেশী শাহীনার মুখের দিকে চেয়ে ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো রেশাদের। এগিয়ে গিয়ে ওর সফেদ গ্রীবায় একটা আলতো চুমু খেয়ে বললো, "খুব রেগে আছ, তাই না? আসলেই নিজামুদ্দিনটা বড় হারামী! আমি জানি ওকে তুমি পছন্দ করো না। কিন্তু কী করি বলো? ওই লোকটা ছাড়া আমার উপন্যাসটার যে কোন গতি হতো না! কিছু কিছু আনুষ্ঠানিকতা তো পালন করতেই হয়, কী বলো!" সম্পূর্ণ মুখটা ঘুরিয়ে রেশাদের চোখে চোখ রেখে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো একবার শাহীনা।

তারপর খুব স্পষ্ট উচ্চারণে বললো, "তুমি কি এখন ঘুমাবে?" -"কেন?", হাঁটু মুড়ে বসে ওর কোলে হাত রেখে প্রশ্ন করলো রেশাদ। -"আমি একটু গোসল করে নেব ভাবছি। ভীষণ গরম লাগছে", বললো শাহীনা। রেশাদ বললো, "ঠিক আছে গোসল সেরে এসো তুমি, আমি ততক্ষণ খাবার টেবিলটা গুছিয়ে নেই"। কী ভেবে যেন মুচকী একটু হাসলো শাহীনা, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ি খুলতে লাগলো।

হঠাৎই পাঁজাকোলা করে ওর হালকা দেহটা তুলে নিল রেশাদ, তারপর বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। -"এই কি হচ্ছে কী", ব’লে অস্ফুট শব্দ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিবার চেষ্টা করলো শাহীনা। কিন্তু রেশাদের শক্ত হাত দু’টো আরো দৃঢ়ভাবে শাহীনার দেহটা আঁকড়ে ধরলো। শাহীনা বললো, "প্লিস রেশাদ, কী পাগলামী করছো? ছাড়ো! এখন না, প্লিস আজ না|" লাভ হলো না কোন। বিছানায় আঁছড়ে ফেলে দিয়ে শক্ত এক হাতে রেশাদ বেষ্টন করলো শাহীনার গলা, অন্য হাতে ওর সরু কোমর।

তারপর তীব্র চুমোয় ভরিয়ে তুললো ওর গন্ডদেশ, গাল, নাক, কানের লতি, চোখের দুই পাতা এবং বিযুক্ত দুই উষ্ণ ঠোঁট। বাধা দিল না শাহীনা, সাড়াও দিল না কোন। রক্তের কোষে কোষে যেমন ঝড় উঠেছিল রেশাদের, তেমনি হঠাৎই মৃয়মান হতে হতে স্তিমিত হয়ে গেল তার তলপেটের তীব্র দহন। দু’হাতের বেষ্টনী শিথিল হতেই পাশ ফিরে বালিশে মাথা গুঁজলো শাহীনা। ক্ষ্যাপা বাউলের মতো প্রমত্ত ঝংকারে বেজে উঠেছিল শাহীনার সমস্ত শরীর।

তবু সে দাঁতে দাঁত চেপে বালিশ আঁকড়ে উপুর হয়ে পড়ে রইলো। হেরে যাচ্ছে, হেরে যাচ্ছে শাহীনা! রেশাদ কেন ফের তাকে আঁকড়ে ধরে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিচ্ছে না এ দেহ? আচ্ছন্নের মতো সে কাছে পেতে চাইলো রেশাদকে। কাপুরুষ, কাপুরুষ! সীমাহীণ কান্নায় গুমরে গুমরে উঠতে চাইলো শাহীনার দেহ। এ সময় ওর পিঠে হাত পড়লো রেশাদের। জোর করে ফেরালো সে শাহীনার মুখ।

তারপর ফিসফিস করে বললো, "আ’ম প্লিডিং ইউ! কথা দিচ্ছি উটকো সব লোক আর ঘরে আনবো না। " -"ড্যাম উইথ ইয়োর নিজাম! ওর কথা মোটেও ভাবছি না আমি!" ওর মুখের খুব কাছে মুখ এনে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রেশাদ কিছুক্ষণ। তারপর বললো, "আগামীকাল আমার বইটা ছাপার মেশিনে উঠছে। তুমি খুশি নও?" শাহীনা বললো, "কেন এ প্রশ্ন করছো?" -"এড়িয়ে যেও না প্লিস...স্পষ্ট করে বলো!", গলায় দৃঢ়তা ফুটিয়ে বললো রেশাদ। -"আমি খুশি", নির্লিপ্ত স্বর ফুটে উঠলো শাহীনার গলায়, "এখন ছাড়ো তো! গোসল করে ঘুমাবো আমি, ভীষণ টায়্যার্ড লাগছে।

আর হাঁ, কালকে মুন্নি খালার বাসায় রাতে খেয়ে ফিরবো। তারপর তোমার আনন্দম পাব্লিকেশানের এক্সিপিডিশনের গল্প শুনবো, ঠিক আছে?", ব’লে রেশাদের কপালে ছোট্ট একটা টোকা মেরে ঠোঁটে হাসি খেলিয়ে উঠে চলে গেল শাহীনা বাথরুমের দিকে, শাওয়ারের নীচে। প্রাণ ভরে জুড়িয়ে নেবে সে শরীরের সমস্ত উত্তপ্ততা, শীতল পানির আলিঙ্গনে। (চলবে...)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.