আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জলবায়ু পরিবর্তন ও পুঁজিবাদের মুনাফা লিপ্সা - ১

"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা

জলবায়ু পরিবর্তন ও পুঁজিবাদের মুনাফা লিপ্সা - ১ বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই বন্যা হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ বানের জলে ভাসে। আর বড় বন্যা হলে তো কথাই নেই। এ দুর্যোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় ক্ষণস্থায়ী বা অল্পস্থায়ী।

বন্যার পানি সরে যায়, মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। কিন্তু পরিবেশ বিজ্ঞানীরা যে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ ভাগ এলাকা স্থায়ীভাবে পানিতে তলিয়ে যাবে, দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ চিরতরে উদ্বাস্তু হবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দুনিয়াই আজ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে। ধ্বংস হতে চলেছে আমাদের বাসভূমি শস্য-শ্যামলা পৃথিবী - এমনই একটা শোর উঠেছে চারিদিকে।

মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চাতা বেড়ে গিয়ে পৃথিবীর বহু নিম্নাঞ্চল, কমপক্ষে ৪২টি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশসহ সমুদ্র উপকূলীয় অনেকগুলো দেশের নিম্নাঞ্চল ডুবে যাবে। কোটি কোটি মানুষ বাস্তুহারা হবে। যত দিন যাবে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাবে, আবহাওয়ায় স্থায়ী পরিবর্তন আসবে যার ফলে গোটা জীবজগতের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। কি পরিবেশ বিজ্ঞানী, কি পরিবেশবাদী সংগঠন, কি এনজিও সংস্থাগুলো, কি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক - এ শোরগোলে কণ্ঠ মেলাতে কেউই বাদ পড়েনি।

এ শোরগোলের সর্বশেষ গোলমেলে কাণ্ডটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কোপেনহেগেনে, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে। বাংলাদেশের একটা বড় অংশ ডুবে যাবে, বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হবে - এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য নয়। আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপারা হল, যাদের হাতে আমাদের দেশ শাসনের ভার, তাদের ভূমিকা। একই কথা পৃথিবীর ক্ষেত্রেও খাটে। বিশ্বের যারা নীতি-নির্ধারক, জলবায়ু পরিবর্তনের ড়্গয়ড়্গতির তুলনায় তাদের ভূমিকাই বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের কারণ।

কোপেনহেগেন : পর্বতের মূষিক প্রসব! আলোচনায় বার বার অচলাবস্থা সৃষ্টি, তর্ক-বিতর্কের ঝড়, সম্মেলনের সভাপতি ডেনমার্কের পরিবশে মন্ত্রী কোনি হেডেগার্ড পদত্যাগ, সম্মেলন স্থল বেলা সেন্টারের বাইরে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ এবং তাদের ওপর পুলিশী হামলা-গ্রেফতার, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে অতিরিক্ত সময়ে সম্মেলন গড়ানোসহ বহু নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ১৫তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। জলবায়ু পরিবর্তন দুনিয়া জুড়ে এক আলোচিত বিষয়। ১৯৭২ সাল থেকে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হলেও গত কয়েক বছর ধরে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হচ্ছে। ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ জলবায়ু সম্মেলনের পর থেকেই বিশ্ববাসীর নজর ছিল পরবর্তী সম্মেলনের দিকে। সেটাই এবার অনুষ্ঠিত হল ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনগেগেনে।

৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে নির্ধারিত ১২ দিন পেরিয়ে ১৯ ডিসেম্বর এ সম্মেলন শেষ হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ১৯৩টি দেশের সরকারি পর্যায়ের ১৫ হাজার প্রতিনিধিসহ মোট ৪৫ হাজার প্রতিনিধি। শেষ পর্যায়ে উপস্থিত ছিলেন ১১০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। এক এলাহি কারবার। কিন্তু ফলাফল কি? পর্বতের মূষিক প্রসবই বলা চলে।

কোপেনহেগেন সম্মেলন শেষ হয়েছে কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা ছাড়াই। অনেক দর কষাকষির পর সম্মেলন শেষে বিশ্ববাসীর প্রাপ্তি মাত্র তিন পৃষ্ঠার একটা কাগুজে দলিল, একটা তথাকথিত রাজনৈতিক সমঝোতা। বিশ্বের বৃহৎ শিল্পোন্নত প্রভাবশালী দেশগুলো এ সম্মেলনকে সফল হিসাবে আখ্যায়িত করেছে, চুক্তিটিকে অর্থবহ দাবি করেছে। কোপেনহেগেন ত্যাগের প্রাক্কালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কোপেনহেগেন সমঝোতাকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, কোপেনহেগেনে অর্থবহ অগ্রগতি হয়েছে। তার মতে, বিশ্বের এতগুলো দেশের দাবিগুলোকে একত্রিত করে একটি গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছানো খুবই কঠিন কাজ।

তারপরও কিছুটা হলেও আশার আলো নিয়ে ফিরে যাবেন সবাই। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন সাংবাদিকদের বলেছেন, অবশেষে আমরা একটি সমঝোতায় পৌঁছেছি। যদিও পরিবেশ বিজ্ঞানী, বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এবং আন্দোলনকারী শক্তিগুলো এ চুক্তিতে হতাশা ব্যক্ত করেছে। তারা বলছেন, এতে আশা পূরণ হয়নি। এটি একটি দায়সারাগোছের রাজনৈতিক চুক্তি।

এর ফলে কিয়োটো প্রটোকল অব্যাহত রাখাসহ ধনী দেশগুলোর কার্বন নির্গমন হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতার জন্য মেক্সিকো সম্মেলন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হবে ১৬তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। ওই সম্মেলনেই বালি অ্যাকশন প্ল্যানের সফল পরিণতি ঘটবে বলে আশা দেয়া হয়েছে। সম্মেলনে আইনি কাঠামোর বিরোধিতা করেছে যেসব দেশ তাদের অন্যতম হল চীন ও সৌদি আরব। ১৮ ডিসেম্বর সম্মেলনের সভাপতি ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী লারস লককি রামসেন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত খসড়া টেক্সটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করেন।

সুদানের পক্ষ থেকে খসড়া টেক্সট প্রত্যাহারের প্রস্তাব আনা হয় এবং এতে অধিবেশনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। অনেক দেশ এ খসড়াকে গোপন সমঝোতামূলক এবং বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। রাতভর দরকষাকষি, প্লেনারি অধিবেশনে বিতর্কের কারণে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন নির্ধারিত ১৮ ডিসেম্বর পেরিয়ে ১৯ ডিসেম্বরে গড়ায়। দেড় ঘণ্টা বিরতির পর আবার শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় মুলতবি অধিবেশন শুরু হয়। এই দেড় ঘণ্টায় যেসব দেশ আপত্তি প্রদান করেছিল, তাদের লবিংয়ের মাধ্যমে খসড়া টেক্সটের পক্ষে সম্মত করা হয়।

এবার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় সুদানের সহকারী প্রেসিডেন্টের ওপর। তিনি দায়িত্ব নিয়েই খসড়া টেক্সট অনুমোদনের জন্য ফ্লোরে দেন। শেষ পযন্ত কোনো প্রকার আপত্তি ছাড়াই কোপেনহেগেন চুক্তি নামে পরিচিত ১৫তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের খসড়া টেক্সট সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। সমঝোতায় অংশ নেয়া বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি জানান, বিতর্কিত খসড়াটি ২৫টি দেশ মিলে তৈরি করলেও পরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা চূড়ান্ত করে। দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বাড়তে না দেয়াসহ বেশকিছু শর্তে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাজি হয়েছিল।

কিন্ত চীনের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। চার দফা পরিবর্তনের পর কোপেনহেগেন খসড়া টেক্সট চূড়ান্ত করা হয়। ওই খসড়ায় বলা হয়, কার্বন নির্গমন হ্রাসে কিয়োটো প্রটোকলকে আরও শক্তিশালী করা হবে। প্রধান উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নির্গমন হ্রাস করবে। স্বল্পোন্নত দেশগুলো সহায়তা প্রাপ্তির ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় কার্বন নির্গমন হ্রাস করবে।

গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে থাকবে। কার্বন নির্গমন হ্রাসের ক্ষেত্রে ভিত্তি ধরা হবে ১৯৯০ এবং ২০০৫ সালকে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো আগামী জানুয়ারি মাসে কে কি পরিমাণ কার্বন হ্রাস করবে তার প্রতিশ্রুতি দেবে। এর ভিত্তিতে কার্বন নির্গমন হ্রাসের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। উন্নত দেশগুলো আগামী তিন বছরে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল নাগাদ কার্বন নির্গমন হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদে তিন হাজার কোটি ডলার প্রদান করবে।

অর্থাৎ প্রতিবছর এক হাজার কোটি ডলার করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দেয়া হবে। এ অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত ক্ষুদ্র উন্নয়নশীল দ্বীপদেশ ও আফ্রিকার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এছাড়া উন্নত দেশগুলো কার্বন নির্গমন হ্রাসকে অর্থবহ করার জন্য ২০২০ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা পূরণের জন্য অভিযোজন ব্যয় নির্বাহে একশ’ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেবে। ২০১৫ সাল নাগাদ এ চুক্তির অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে। এছাড়া এ চুক্তির আওতায় কোপেনহেগেন গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড নামে একটি ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা হবে, যা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর ব্যয় নির্বাহ করা হবে।

তাছাড়া প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য ‘টেকনোলজি ম্যাকানিজম’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, এ চুক্তিকে আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনতে হবে। কোপেনহেগেন গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড গঠন করতে হবে। কেন এ চুক্তিতে পুরোপুরি অনুমোদন দেয়া হল না প্রশ্নের উত্তরে জাতিসংঘের মহাসচিব সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, সম্মেলনে ১৩০টি দেশের নেতারা ছিলেন। সব বিশ্বনেতা বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এটি একটি জটিল বিষয়। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি এবং এর পেছনে অনেক সময় ব্যয় করেছি। টাইমস পত্রিকার হিসাবে দেখা যাচ্ছে, কোপেনহেগেন সম্মেলন উপলক্ষে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ এত বিপুল সংখ্যক লোকের সমাবেশ ঘটেছে যে সেখানে ৪০ হাজার ৫০০ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিসৃত হয়েছে। শুধু বেলা সেন্টারকে সাজানো আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যয় হয়েছে ১২২ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশী টাকায় ৮৪ হাজার ১৪০ লাখ টাকা)। ভিভিআইপিদের থাকা-খাওয়ার খরচ আলাদা।

অর্থাৎ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে আয়োজিত সম্মেলন কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলেও যথেষ্ট কার্বন নির্গমন করতে সক্ষম হয়েছে! বাংলাদেশের ভূমিকা এ জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল ডুবন্ত বাংলাদেশ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। যেখানে ভারত থেকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অংশ নিয়েছেন মাত্র ৮ জন কর্মকর্তা নিয়ে সেখানে আমাদের পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারি পর্যায়ে ৯২ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। আর বেসরকারি পর্যায়ের আরও তিনশ জন। দি ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাটেজি ফর ডিজাস্টার রিডাকশনের এক সমীক্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশের নাম শীর্ষে উঠে এসেছে - ১৬ ডিসেম্বর সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ তথ্য উল্লেখ করে বলেন, ‘বন্যার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ প্রথম, সুনামির ঝুঁকিতে তৃতীয়, ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। ’ অতএব এ সম্মেলনে বাংলাদেশের দাবি কি? কার্বন নিঃসরণ কমানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে বাধ্য করা? না, তা নয়।

তিনি বলেছেন, ‘... এই সম্মেলনে আমাদের ক্ষতিপূরণমূলক অর্থিক সহায়তা দিতে হবে। ’ অভিযোজনের পুরো অর্থ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এই অর্থ অবশ্যই যথেষ্ট পরিমাণে ও সহজে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ’ তিনি বাংলাদেলশর উদ্বাস্তুদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসনের দাবিও তুলেছেন। কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছুই বলেন নি, তা নয়। কিন্তু ওই ভাষণ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনসহ অন্যান্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে যেসব বৈঠক ও আলাপ-আলোচনায় তিনি অংশ নিয়েছেন, সংবাদ মাধ্যমগুলোর পরিবেশিত তথ্য মতে, সেগুলোতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের কণ্ঠ ছিল সবচেয়ে সোচ্চার আর কার্বন নিঃসরণ কমানো বিষয়ে অপেক্ষাকৃত নিম্নকণ্ঠ।

আর সম্মেলন শেষে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, সম্মেলনের পর সারাবিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশ থেকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যেসব বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তাদের বরাত দিয়ে সংবাদ বেরিয়েছে, বাংলাদেশের জলবায়ু কূটনীতি সফল হয়েছে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, এ সম্মেলনের রাজনৈতিক চুক্তিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) দাবিগুলোর অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। বাংলাদেশের সফলতা বা ব্যর্থতা বোঝার আগে দেখা দরকার বাংলাদেশ কি লক্ষ্য নিয়ে সম্মেলনে গিয়েছিল। এর পাশাপাশি সম্মেলনে বাংলাদেশের মতোই ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ভূমিকাও আমাদের বিচার করে দেখতে হবে।

গত ২৮ নভেম্বর পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সচিবালয়ে তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। কোপেনহেগেন সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে সংলাপে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত গত ৩ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও এ বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন যে শর্তহীন তহবিল আদায় করাটাই বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য। এবং যে কারণে সম্মেলনে যখন বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য একটি আইনি কাঠামো প্রণয়ন করার কথা বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলোর, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের পক্ষাবলম্বন করে নিরবতা পালন করেছে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি কোপেনহেগেনে বলেছেন, ‘আমরা এখনই উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্বে যেতে চাই না। তাদের সহযোগিতা নিয়েই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কাজ করতে চায়।

’ সম্মেলন শেষ হওয়ার পূর্বে ১৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে শুরু হওয়া প্লেনারি সেশনে প্রথমেই বক্তব্য দেন টুভালু প্রতিনিধি। তিনি বলেন, জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে এ চুক্তি করা হচ্ছে। এরপর কিয়োটো প্রটোকলের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিশ্চিত করা হয়নি। এ চুক্তি তার দেশের পক্ষে স্বাক্ষর করা সম্ভব না বলে জানান তিনি। ভেনিজুয়েলার প্রতিনিধি কোপেনহেগেন সমঝোতার খসড়ার ওপরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রাতের বেলা সম্রাটের মতো এসে আমাদের সামনে একটি চুক্তি ছুড়ে দিয়ে গেছেন।

এরকম অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনোভাবেই মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। প্রস্তাবিত চুক্তিতে কিছু পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। এরপর বক্তব্য দিতে গিয়ে কড়া সমালোচনা করে সুদানের প্রতিনিধি লমুম্বা বলেন, কেউ না, ওবামা নয়, এমনি আপনিও (ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী) আমাদের এ খসড়ায় স্বাক্ষর করতে বাধ্য করতে পারেন না। ১০০ বিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়ে আমাদের মহাদেশকে ধ্বংস করা হবে। সম্মেলনে প্রথম থেকেই মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখলেও রাতের প্লেনারি আলোচনায় তিনি বলেন, এই খসড়ার প্রতি আমি বারবার আমার আপত্তির কথা জানিয়েছি।

তবে সার্বিক দিকে বিবেচনা করে একটি ঘোষণার জন্য হলেও এ খসড়ায় স্বাক্ষর করা যেতে পারে। এরপর নিকারাগুয়া ও বলিভিয়ার পক্ষ থেকেও খসড়া অঙ্গীকারনামার বিরোধিতা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের ১ হাজার ডলার দেওয়ার প্রস্তাবকে হাস্যকর বলে অভিহিত করেছেন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ। তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যেখানে নিজের দেশের দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে ৭০ হাজার কোটি ডলার দিচ্ছে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ১ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রস্তাব খুবই হাস্যকর’। তিনি আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় দূষণকারী।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীবনহানি যা গণহত্যার শামিল, এর জন্য তারাই দায়ী’। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য দশ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েকজন প্রতিনিধি বলেছেন, ‘এতে আমাদের দাফন-কাফনের খরচও হবে না। ’ টুভালু, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দ্বীপরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বলছেন - আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না, পুনর্বাসনের নিশ্চয়তাও চাই না। আমরা ডুবতে চাই না, কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী দেশগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা করা। ছোট দ্বীপরাষ্ট্র টুভালু, বাংলাদেশের আগেই যে ডুববে, তার প্রধানমন্ত্রী এ সমঝোতাকে ৩০ খণ্ড রূপার (প্রস্তাবিত ৩০ বিলিয়ন ডলারের সাহায্যের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে) বিনিময়ে ‘ভবিষ্যৎ বিক্রি’র সঙ্গে তুলনা করে এটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ‘টাকার বিনিময়ে আমরা আমাদের অস্তিত্ব বিক্রি করতে আগ্রহী নই’।

সম্মেলন চলার সময়ই জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। শেখ হাসিনাকে বারাক ওবামা ও গর্ডন ব্রাউনের টেলিফোন, বাংলাদেশকে আলাদাভাবে বিশেষ সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি কিংবা আলাদাভাবে যুক্তরাজ্য ও ডেনমার্কের মতো দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠক, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা তহবিল ব্যবস্থাপনার কাজে বিশ্বব্যাংককে যুক্ত করার বাংলাদেশী পরামর্শ ইত্যাদি কারণে অভিযোগ উঠেছে যে বাংলাদেশের সমর্থন ধনী দেশগুলো কিনে নিয়েছে। কোপেনহেগেন সম্মেলন উপলক্ষে পরিবশেবাদীদের বের করা বিশেষ পত্রিকা ‘ক্লাইমেট ক্রনিকলস’ এর চতুর্থ সংখ্যায় অভিযোগ তোলা হয়েছে : “যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি ‘সচেতনতা কিট’ বাংলাদেশকে সরবরাহ করেছে যাতে ‘কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ ও দেন-দরবারের সময় বাংলাদেশ দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে’। এর সাথে আরও যুক্ত ছিল ঢাকা ও লন্ডনে অনুষ্ঠিত অনেকগুলো নীতি-নির্ধারণী সেমিনার। ডেনিস দূতাবাস বাংলাদেশের ১২৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের কোপেনহেগেন যাত্রার খরচের জন্য দিয়েছে ১.১৪ মিলিয়ন ডেনিস মুদ্রা।

এ অর্থ দেওয়া হয়েছে জেনেভায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারেভেশন অব নেচার বা আইইউসি-র মাধ্যমে। ” .... ..... চলবে .... ... ২য় কিস্তি : Click This Link


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।