আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুঁজি যখন ঈশ্বর_আনু মুহাম্মদ

সত্য সব সময়ই সত্য, তবে আপেক্ষিকতার নিরিখে।

পুঁজি যখন ঈশ্বর কার্যত পুঁজিই এখন ঈশ্বর, নিরাকার। বিভিন্ন রূপে তা সক্রিয়, সর্বত্র বিরাজমান। দখল, ধ্বংস এবং উন্মাদনা সৃষ্টিতে সদা নিয়োজিত। পুঁজিবাদ টিকে থাকে, বিকশিত হয়, মানুষকে পাগল বানায় নানাভাবে।

মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করা, বৈরী করা, যন্ত্র বানানো ছাড়া পুঁজিবাদ টিকতে পারে না। মানুষের মধ্যে পণ্য কেনার উন্মাদনা, অর্থকেন্দ্রিক অস্থিরতা, হিংস্র প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনমুখিতা পুঁজির সচলতার জন্য দরকার। মিডিয়া মানুষের প্রয়োজন নির্ধারণ করে, ব্যক্তিত্বের মান নির্ধারণ করে, তৈরি করে সৌন্দর্যের মাপ। গায়ের রং, পোশাক, চোখ হাত পা নখ বুক পিঠ, হাঁটা, কথা বলা সবকিছু নির্ধারিত হয় বাজার থেকে। এই বাজার, মুনাফাকেন্দ্রিক, অর্থ-উন্মাদ-সংস্কৃতি শুধু একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষকে নয়; এক ব্যক্তি মানুষকেও নিজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্নতার অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে।

এক ব্যক্তির মধ্যে মানুষ এবং ক্রেতা ভিন্ন হয়ে যায়। ক্রেতার সুখই মনে হয় আসল সুখ। প্রকৃতি, সবুজ ভূমি, আকাশ, নদী, পাখি, বৃক্ষ, লতাপাতা সবই আড়ালে চলে যায়। পণ্য লক্ষ্য হতে হতে মানুষ নিজেও পণ্য হয়ে ওঠে। মানুষের মেধা, সৃজনশীলতা সবই তখন পণ্য।

বাজারমূল্যের অধীনস্থ হয়ে পড়ে মানুষের অন্তর্গত ক্ষমতা। এই বাংলাদেশে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই, শুধু ব্যবসা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকজন নয়, নাট্য প্রতিভা-চলচ্চিত্র প্রতিভা-সঙ্গীত প্রতিভা নিয়োজিত হয় দেশি বিদেশি নানা কোম্পানির পণ্য বিক্রির পথ প্রশস্ত করার কাজে, বিজ্ঞাপন নির্মাণে। পণ্য বিক্রির জন্য মোহ তৈরি, মিথ্যাচার, মানুষের মনোজগৎ দুর্বল ও দখল করবার জন্য নতুন নতুন কায়দা-কানুন বের করাই তখন হয় কৃতিত্বের কাজ। এ এক বিশাল প্রতারণা শিল্প। সে কারণে বিশ্বব্যাপীই পণ্য গবেষণা ও উন্নয়নের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থব্যয় করা হয় জনসংযোগমূলক বা পিআর তৎপরতায়, যার কাজ প্রকৃত অর্থে মানুষকে ভোক্তা হিসেবে উন্মাদ বানানো, মানুষের মধ্যে আচ্ছ’ন্নতা ও মোহ তৈরি।

গবেষণা সংস্থা, বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ বিজ্ঞাপনী সংস্থারই সম্পূরক। একচেটিয়া পুঁজির ধ্বংসক্রিয়াকে উন্নয়ন হিসেবে, যুদ্ধকে শান্তি, দখলকে গণতন্ত্র হিসেবে উপস্থিত করায় এদের ভূমিকা একটি বড় জালের অন্তর্গত। মিথ্যাকে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী তাই বিশাল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলছে: চলচ্চিত্র, প্রকাশনা, সঙ্গীত, থিয়েটার, বিজ্ঞাপন, প্রচারণা সব এখানে একাকার। এটাই বিশ্ব সংস্কৃতির একটি অভিন্ন আবহ তৈরি করেছে। স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেটসহ প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে যা কিছু অগ্রগতি তার একটি বড় শক্তি বিশ্বব্যাপী এক অভিন্ন পুঁজি-দাস, নিষ্ক্রিয় মস্তিক, বিভ্রান্ত, সেজোফ্রেনিক মানব সমাজ তৈরিতে নিয়োজিত থাকে।

এখানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, বাঙালি-অবাঙালি, মুসলমান-অমুসলমান একাকার। পার্থক্য তৈরি হয় ভাষা, অঞ্চল বা ধর্ম দিয়ে নয়, বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। প্রতিরোধ তৈরি হয় সেই জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে যারা এই অভিন্নতা, মোহ, বিভ্রান্ত এবং রোগগ্রস্ত অবস্থা থেকে নিজেদের মুক্ত করে দুনিয়া দেখতে সক্ষম হয়। সক্ষম হয় মানুষ হিসেবে উপলব্ধির ক্ষমতা রক্ষা করতে। সেই সক্ষমতা নির্মাণে প্রয়োজন হয় শেকড় সংলগ্নতার।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.