আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষা আইন, না শিক্ষানীতি

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে ধারণা হয়েছিল যে কোনো কোনো নীতি বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রয়োজন। জাতীয় সংসদ কর্তৃক জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ গৃহীত হওয়ার দীর্ঘ দুই বছর পর শিক্ষা আইন, ২০১৩-এর খসড়া জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে। শিক্ষা আইন প্রণয়নের খবর জেনে যতটা না আনন্দিত হয়েছিলাম, শিক্ষা আইন, ২০১৩-এর কপি হাতে পেয়ে তার চেয়ে বেশি হতাশ হয়েছি। এর কারণ সম্ভবত নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। নীতি ও আইন সম্পর্কে আমার যে ধারণা ছিল, আইনের বৈশিষ্ট্যগত বিবেচনায় শিক্ষা আইন, ২০১৩ তাতে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে।

শিক্ষা আইন, ২০১৩-এর সঙ্গে আমার পূর্ব ধারণা সাংঘর্ষিক। এমনটি হওয়ার কারণ—
প্রথমত, ৬৫টি ধারাসংবলিত খসড়া শিক্ষা আইনের প্রথম তিনটি এবং শেষ দুটি ধারা যেকোনো আইনে সামগ্রিক ধারণায় প্রযোজ্য, অবশিষ্ট ৬০টি ধারার মধ্যে উপধারার সংখ্যা ২১৪টি। আমার বিবেচনায়, ২১৪টির মধ্যে ১৯০টিই নীতি এবং মাত্র ২৪টি আইন। শতকরা হিসাবে ৮৮.৮ ভাগ নীতি এবং ১১.২ ভাগ আইন। যেমন ৮(৫) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন শিশুকে কোনো প্রকার মানসিক নির্যাতন বা শারীরিক শাস্তি প্রদান করা যাইবে না।

’ বা ‘২৩(৩) ইংরেজি মাধ্যমসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফিস সরকার বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে নির্ধারণ করিতে হইবে। ’—এসব আইন। এসব আইন অমান্যকারীদের জন্য শিক্ষা আইনে শাস্তির প্রকৃতিও নির্ধারণ করা আছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো, ৬(২) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার জন্য স্থানীয় সমাজকে সম্পৃক্ত করা হইবে। ’ বা ‘১৪(৬) ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্রাইমারি এডুকেশন (নেপ)-কে শীর্ষ পর্যায়ের জাতীয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিবার লক্ষ্যে ইহার কার্যপরিধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।

’—এগুলো কি আইন? ‘গ্রহণ করা হইবে’ বলা হয়েছে, কে গ্রহণ করবে? গ্রহণ না করলে কী শাস্তি? এগুলো আইন নয়, নীতি। যে শিক্ষা আইনের শতকরা ৮৯ ভাগ দখল করে আছে নীতি, তাকে কী করে শিক্ষা আইন বলি!
দ্বিতীয়ত, আইনের সঙ্গে শাস্তির বিধান থাকতে হয়। কোনো একটি আইন অমান্য করলে কী শাস্তি পেতে হবে তা আইনে উল্লেখ থাকতে হয়। শিক্ষা আইন, ২০১৩-এ আমার বিবেচনায় আইনের ধারা মাত্র ২৪টি। এর মধ্যে মাত্র ১৩টির ক্ষেত্রে শাস্তির প্রকৃতি উল্লেখ করা আছে।

অবশিষ্ট ১১টি অমান্য করলে কোনো শাস্তি পেতে হবে না। যেমন, ৮(২) উপধারায় ‘প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি ফি এবং যাচাই পরীক্ষা গ্রহণ করা যাইবে না এবং ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো শিশুর প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না। ’ এবং ‘১১ প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এবতেদায়ি মাদরাসার
শিক্ষার জন্য বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কোন প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পরিচালনা করা যাইবে না। ’—এসব আইন অমান্য করলে কোনো শাস্তি পেতে হবে না। এখানে আরও একটি প্রশ্ন জাগে।

তাহলে কি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কিন্ডারগার্টেন বা ইংরেজি স্কুল স্থাপন বা পরিচালনা করা যাবে? এ ক্ষেত্রেও কোনো আইনগত বাধা থাকছে না।
তৃতীয়ত, ধারা ২১:১ ‘মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর হইবে নবম হইতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত চার বৎসর মেয়াদী। ’—এর জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এটা কি আইন? কে শিক্ষা প্রবর্তন করবে? না করলে কে শাস্তি পাবে? শিক্ষা আইন, ২০১৩-এ যেসব ধারণা বা সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তার বেশ কয়েকটি দেশে বহুল প্রচলিত ধারণা বা সংজ্ঞার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন কারিকুলামের বাংলা প্রতিশব্দ শিক্ষাক্রম, শিক্ষা আইনে বারবার ‘পাঠ্যক্রম’ ব্যবহার করা হয়েছে, যা সঠিক নয়।

এমনকি, একই অনুচ্ছেদে একবার পাঠ্যক্রম আবার শিক্ষাক্রম ব্যবহার করা হয়েছে (ধারা ২১)। ধারা ২(ছ) এ প্রাথমিক শিক্ষার ধারণা দিতে সাধারণ শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্ডারগার্টেন এবং ইংরেজি স্কুল অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ধারা ২(ঞ) সাক্ষরতার সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ কারণ ‘পড়িয়া বুঝিতে পারা’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ, নিজের মনোভাব লিখে প্রকাশ করার দক্ষতা উল্লেখ নেই। ২(ড), ‘ফরমাল এডুকেশন’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ শিক্ষা ব্যবহার সঠিক নয়, হবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এখানে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা আনা ঠিক হয়নি, কারণ এ শিক্ষা পরিকল্পিত নয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত নয়।

২(ঢ), ‘ইনক্লুসিভ’ শিক্ষার প্রতিশব্দ হিসেবে সর্বক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়ে আসছে ‘একীভূত শিক্ষা’। এখানে বলা হয়েছে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা’। সঠিক প্রচলিত প্রতিশব্দ বাদ দিয়ে নতুন প্রতিশব্দ ব্যবহার সমস্যা সৃষ্টির সহায়ক।
চতুর্থত, অনেক ক্ষেত্রে অসংগতি, অনেক ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী মনে হয়েছে। যেমন, ধারা ২৭(১) ক, খ-এ নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষকদের ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর নির্ধারণ করা হয়েছে।

বর্তমানে ‘ইন্টারমিডিয়েট কলেজে’-বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের ‘ওয়ার্ক লোড’ খুবই কম। যেমন অনেক ক্ষেত্রে একজন বিষয় শিক্ষক, ধরা যাক ইতিহাসের শিক্ষক সপ্তাহে তিন দিন কলেজে এসে প্রথম বর্ষের একটি এবং দ্বিতীয় বর্ষেও একটি করে ক্লাস নেন অর্থাৎ সপ্তাহে ছয় পিরিয়ড। বছরে ছয় মাস একটি বর্ষের ক্লাস নিতে হয়, অন্য বর্ষ ভর্তি বা পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় থাকে। এ ব্যবস্থা জাতীয় অপচয়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষক যদি নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ক্লাস নেন তাতে ‘ওয়ার্ক লোড’ বাঞ্ছনীয় বা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে, অপচয় কমবে, অন্য দিকে নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার সুযোগ পাবে।

ধারা ২২(গ) ৩-৫ এ জাতীয় জীবনে দক্ষতা সনদভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ কোথাও সনদ নেই, এমনকি প্রারম্ভিকেও সনদের সংজ্ঞা নেই। ধারা ৩২-এর উপ-শিরোনাম হচ্ছে ‘মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ’। এ ধারার অধীনে ‘৩২(২) বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসাসমূহে স্নাতক পর্যায়ের সকল কোর্সে ন্যূনতম ১০০ নম্বরের বা ৩ ক্রেডিট ইংরেজি বিষয় অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করা হইবে। ’ ইংরেজি কি মাতৃভাষা? আলাদা ধারায় ইংরেজি বাধ্যতামূলকের বিষয়টি আনা যেত।


পঞ্চমত, জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ বাস্তবায়নের জন্য যেসব আইনের প্রয়োজন, এর যথাযথ প্রতিফলন শিক্ষা আইন, ২০১৩-এ অনেক ক্ষেত্রে ঘটেনি। যেমন প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে ধারা ৫(১) এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ কার্যকর শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে সকল শিশুর জন্য শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হইবে এবং তাহা শিশুর অধিকার বলিয়া গণ্য হইবে। ’ ‘বাধ্যতামূলক হইবে’—কেন? বাধ্যতামূলক করার জন্যই তো আইন। আইনে কেন ‘হইবে’? ধারাটি অস্পষ্ট, বোধগম্য নয়। তা ছাড়া কত বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা, তা আইনে উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয় নয় কি? বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনটি নিম্নরূপ হলে কেমন হয়—
‘বাংলাদেশের ৬+ থেকে ১৩+ বয়সী সকল শিশুর জন্য প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।


জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসারে বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এমন যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.