আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র



সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র লাতিন আমেরিকায় মৃণালকান্তি দাস ১৯৬০সালের ‘বিশ্ব কমিউনিস্ট মহাসম্মেলনের ঘোষণা’য় (একাশি পার্টির দলিল) বলা হয়েছিলো : আজ উপনিবেশবাদের প্রধান খুঁটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা নতুন পদ্ধতিতে এবং নতুন আকারে প্রাক্তন উপনিবেশগুলির জনগণের উপর ঔপনিবেশিক শোষণকে অব্যাহত রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে একচেটিয়া পুঁজিবাদীরা এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে তাদের আধিপত্য বহাল রাখতে সচেষ্ট। এই সমস্ত প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যই হলো, যে সমস্ত দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেই দেশগুলির অর্থনীতিতে তাদের অবস্থানকে সংরক্ষিত করা এবং অর্থনৈতিক ‘সাহায্য’-র ছদ্ম আবরণে নতুন স্থান দখল করা, তাদের সামরিক জোটে টেনে আনা, সেখানে সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও যুদ্ধ ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা। সাম্রাজ্যবাদীরা চেষ্টা করছে নব স্বাধীনতালব্ধ দেশগুলির জাতীয় সার্বভৌমত্বকে নির্বিষ ও খর্ব করতে।

জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতিকে বিকৃত করতে। ‘পারস্পরিক নির্ভরতা’-র কপটবুলির আড়ালে নতুন ধরণের ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তার করতে। এই সমস্ত দেশে ক্রীড়ানকদের ক্ষমতায় বসাতে। বুর্জোয়াদের একাংশকে ঘুষ দিয়ে কিনে নিতে। এই নতুন ধরনের ঔপনিবেশিক আধিপত্যই হলো নয়া-উপনিবেশবাদ।

এই নয়া-উপনিবেশবাদের বিস্তারে সবচেয়ে ধূর্ত ভূমিকা গ্রহণ করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। যদিও সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র কৌশলও ধাক্কা খাচ্ছে সমগ্র লাতিন আমেরিকায়। উদার নীতির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন যদি একটি কারণ হয়, তবে গত দশকে লাতিন আমেরিকায় মার্কিন প্রভাব নিস্প্রভ হওয়ার আরেকটি কারণ অবশ্যই বলিভারীয় বিপ্লব। গুয়েতামালা, কলম্বিয়া, পেরু, মেক্সিকো এবং কোস্টারিকার মতো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সমস্ত দেশেই নির্বাচিত হয়েছেন বামপন্থা ঘেঁষা নেতৃত্ব। এমনকি মধ্য আমেরিকাতেও পর্যন্ত।

যদিও এই প্রবণতার পরিবর্তনের একটি লক্ষণ দেখা গিয়েছে ২০০৯-এর ৩রা মে, যখন পানামার মানুষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করেন কোটিপতি ব্যবসায়ী রিকার্ডো মার্তিনেল্লিকে। মার্তিনেল্লিকে জেতাতে ইউনাইটেড স্টেটস এইড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউ এস এইড) এবং ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির (এন ই ডি) মাধ্যমে কোটি-কোটি ডলার ঢালে ওয়াশিংটন। এবং পায় বহু আকাঙ্খিত সাফল্য। কে না জানেন, লাতিন আমেরিকার কদর্য যুদ্ধের মূল হাতিয়ার ইউ এস এইড আর সি আই এ’র ‘ফ্রন্ট এজেন্সি’ এন ই ডি’র নাম। ১৯৬২তে তৈরি ইউ এস এইড আর্থিক দিক থেকে মার্কিন বিদেশ দপ্তরের ওপর নির্ভরশীল।

এই মুহূর্তে লাতিন আমেরিকাসহ ক্যারিবীয় আঞ্চলের ১৬টি দেশে রয়েছে ইউ এস এইডের এজেন্ট। দেশে দেশে মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠী এবং ছোট গোষ্ঠীগুলিকে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হওয়ার জন্য এরা ঢালে কাড়ি-কাড়ি ডলার। আর গত শতকের ছয় ও সাতের দশকে সি আই এ যা করত, এখন সেটাই বৈধতার নামাবলি চাপিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে এন ই ডি। ইউ এস এইড-এর লক্ষ্য ইউ এস এইড। বাংলা তর্জমা করলে যার অর্থ, মার্কিন অর্থ সহায়তা।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের এই শাখা চালু রয়েছে ১৯৬২থেকে। শুরুতে বলা হতো মানবিক কারণেই নাকি এই অর্থ সাহায্য। ক্রমশ ফাঁস হয়ে পড়ে ওয়াশিংটনের আসল মতলব। ইউ এস এইড-র মূল উদ্দেশ্য মার্কিন হস্তক্ষেপ। একুশ শতক যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

ওয়াশিংটনের মানবিক মুখের আড়ালে থাকা হিংস্র মুখ এই শতক দেখছে বারে বারে। বামপন্থার জোয়ারে থাকা ঐক্যবদ্ধ লাতিন আমেরিকা এখন হোয়াইট হাউসের প্রতিদিনের দুঃস্বপ্ন। তাই কিউবাসহ লাতিন আমেরিকায় অস্থিরতা গড়ে তুলতে মরিয়া মার্কিন প্রশাসন। শুধু ২০০৯-এ ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’ খাতে ইউ এস এইড-র নামে ৫২০০ লক্ষ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, কলম্বিয়ার মাধ্যমে লাতিন আমেরিকায় অস্থিরতা গড়ে তোলা।

খোদ ‘বলিভারিয়ান নিউজ এজেন্সি’ ফাঁস করে দিয়েছে এই চক্রান্ত। গত দশ বছর ধরে লাতিন আমেরিকাকে ঘিরে মার্কিন ষড়যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করছেন ইভা গলিনজার। তিনি ভেনেজুয়েলা-আমেরিকার একজন গবেষক এবং আইনজীবী। সম্প্রতি এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে ইভা ফাঁস করে দিয়েছেন ওয়াশিংটনের ষড়যন্ত্র। ইভার কথায় ইউ এস এইড-র এই বিপুল পরিমাণ অর্থের অর্ধেকই দেওয়া হচ্ছে উত্তর আমেরিকার মার্কিন চরদের, শুধুমাত্র লাতিন আমেরিকায় প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপকে জোরদার করবার জন্য।

ইতোমধ্যে ৬৫০.৩৩লক্ষ মার্কিন ডলার ইউ এস এইড-র মাধ্যমে গত দু’বছরে জোগান দেওয়া হয়েছে শুধু কিউবাতেই। ২০১০-এ দেওয়া হবে অতিরিক্ত ২০০লক্ষ ডলার। সবটাই কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে, রাজনৈতিক প্রচারের জন্য। ৪৯০লক্ষ ডলারের কাছাকাছি দেওয়া হয় ‘সিভিল সোসাইটি’-কে। খাতায়-কলমে মানবাধিকারের কাজেই এই বরাদ্দ বলা হলেও বাস্তবে লাতিন আমেরিকাকে অশান্ত করে তুলতেই দেওয়া হয় এই মার্কিন সাহায্য।

ইভা তাঁর গবেষণায় কাজে করতে গিয়ে চিহ্নিত করছেন মোট ৩১টি মার্কিন সংস্থাকে। যারা কলম্বিয়ার মাধ্যমে লাতিন আমেরিকাকে অস্থির করে রাখতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট-র সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। এরা সকলে ডলারের সাহায্যপুষ্ট। ইভা বলছেন, আগস্ট ২০০২-তে তৈরি করা হয় ‘অফিস অব ট্রানশিশন ইনিশিয়েটিভ’ সংক্ষেপে ও টি আই নামে একটি সংস্থা। এই ও টি আই-র অন্তর্ভুক্ত ছিল মোট ৪৫০টি এন জি ও এবং রাজনৈতিক গ্রুপ।

বলিভারিয়ান বিপ্লবের বিরুদ্ধে চক্রান্তকে তীব্র করতে তাদের দেওয়া হয়েছিল ৬০০লক্ষ ডলার। ২০০৮সাল থেকে এই ও টি আই-কে লাতিন আমেরিকায় রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরির জন্য দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত ৮০.৩৮৩লক্ষ ডলার। এখন স্পষ্ট যে এই ও টি আই আসলে ইউ এস এইড এরই একটি শাখা। লক্ষ্য করুন, সম্প্রতি ‘স্মার্ট পাওয়ার’, ‘ইনটেলিজেন্ট পাওয়ার’- নতুন এই শব্দগুলো ব্যবহার করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা। যার মানে আর্থ-সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক সর্বস্তরেই সামরিক আগ্রাসন।

প্রথাগত এবং অপ্রথাগত এই দুই যুদ্ধের মধ্যে ব্যবধান বহু। প্রথাগত হলো যুদ্ধের প্রচলিত নিয়মে অস্ত্র ও সামরিক শক্তিতে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। অপ্রথাগত হলো রাষ্ট্র যন্ত্রকে আড়াল করে জনগণকে বিভ্রান্ত ও বিক্ষুব্ধ করে তোলা । যার অন্যতম উদ্দেশ্য প্রতিবিপ্লব। এটা করা হয় অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণ চালিয়ে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঘটিয়ে এবং সামরিক বাহিনীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলে।

বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ইভা। একুশ শতকে ইউ এস এইড কাজ করেছে পেন্টাগনের সহযোগী হিসাবে। লাতিন আমেরিকাকে অস্থির করে তুলতে চলছে ঢালাও ডলার সাহায্য। লক্ষ লক্ষ মার্কিন জনগণের থেকে আদায় করা রাজস্বের বড় অংশটাই প্রতি বছর ব্যবহার করছে ইউ এস এইড। কিউবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে গভীর ষড়যন্ত্রে নেমেছে তাও ফাঁস হয়ে গেছে সম্প্রতি।

কিউবার বিরুদ্ধে করদাতাদের অর্থের অপব্যয় করা হয়েছে বলে সম্প্রতি জনসমক্ষে স্বীকারও করে নিয়েছে ইউনাইটেড স্টেটস এইড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউ এস এইড)। এক বিবৃতিতে দ্বিধাগ্রস্ত শব্দ ও পরিভাষা চয়নের মাধ্যমে এই স্বীকারোক্তি করা হয়েছে। সম্প্রতি ইউ এস এইড-এর প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠীর অডিট রিপোর্টও প্রকাশ হয়ে পড়ে। অস্বস্তিতে পড়ে যায় ইউ এস এইড। এর বিপুল বাজেটের থেকে ১কোটি ডলার ‘ক্যালজোন’ নামে এই গোষ্ঠীর পিছনে খরচ হয়েছে।

আইনী উপদেষ্টাদের নৈতিক শক্তির চাপে কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই নিজেদের ভরতুকির ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কথা খোলামেলাই স্বীকার করেছে ইউ এস এইড। ২০০৬সালে গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টেবিলিটি অফিস (গাও) এর কিউবা প্রোগ্রাম এবং ২০০৭সালে অফিস অব ইন্সপেক্টর জেনারেল (ও আই জি) এই দুই বিষয় সংক্রান্ত অডিট রিপোর্টেই ত্রুটির কথা উঠে এসেছে। এক প্রকার বাধ্য হয়েই ২০০৯-এর ১৮ই জুলাই ইউ এস এইড-এর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবিকতার স্বার্থে ত্রাণ পরিচালনার কথা থাকলেও জনসাধারণের তহবিল পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা সরাসরি স্বীকার করে নিয়েছে ইউ এস এইড। পরিবর্তে অসংখ্য সি আই এ-র কর্মীর নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে ইউ এস এইড।

এমনকী ইউ এস এইড ভুলেও ফ্রিডম হাউস এর নাম উচ্চারণ করেনি। এই ফ্রিডম হাউস, এইড এর এক স্ট্র্যাটেজিক সহায়ক সংস্থা। এই সংস্থাই ক্যালজোনকে তহবিল তছরুপের আদবকায়দা শিখিয়েছে। সি আই এ এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক শাখা মধ্য আমেরিকায় বেশ কয়েকবছর ধরে কাজ করছে। নিকারাগুয়ার সান্দিনিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে এই সংস্থা কাজ করেছে।

এল সালভাদোরে এরিয়া পার্টি এবং তার ঘাতকবাহিনীকেও সরাসরি সমর্থন জানিয়েছে এই ফ্রিডম হাউস। শুধু কিউবায় নয়, গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়ে এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন এজেন্টরা যেভাবে দক্ষিণপন্থী সংগঠনের হয়ে কাজ করছেন তাও প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। সি আই এ নির্দেশিত কর্মসূচী অনুসারেই কাজ করছে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আই আর আই), ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট (এন ডি আই), ফ্রিডম হাউসের মতো সংস্থাগুলি। হাইতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সংস্থা হিসেবে কাজ করেছে ইউ এস এইড। হাইতির বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে সংগঠিত, চালনা করেছে এইড।

অর্থ সাহায্যও করেছে। প্রেসিডেন্সি জাঁ-বাট্র্যাল্ড অ্যারিস্টাইডের অপহরণ এবং অপসারণের ক্ষেত্রেও প্ররোচনা জুগিয়েছে এই সংস্থা। ভেনেজুয়েলায় ২০০২সালের ১১ এপ্রিল ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী এবং শক্তিগুলিকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন জুগিয়েছে এই সংস্থা। দেশে দেশে নাশকতা ও ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত থাকার সুবাদে ইউ এস এইড এবং তার সহযোগী সংস্থাগুলির তহবিল অপব্যয়ের অভিযোগ সঙ্গত কারণেই উঠেছে। দেশে দেশে মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠী এবং ছোট গোষ্ঠীগুলিকে অর্থ সরবরাহ এবং ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার দরুন ইতোমধ্যেই এইডসহ এই সংস্থাগুলির দেড় কোটি ডলার বাড়তি খরচ হয়েছে।

বলিভিয়ায় দেশের বলকানিয়করণ এবং প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যকলাপে মদত দিয়ে আসছে ইউ এস এইড। মাসকয়েক আগে কোচাবম্বা অঞ্চলে এই সংগঠনের লোকজন ষড়যন্ত্রমূলক কাজে যুক্ত থাকার জন্য বিভিন্ন কৃষক সংগঠন এবং পাঁচটি মিউনিসিপ্যালিটি ইউ এস এইডের এজেন্টদের বহিষ্কার করে। ঘাতকদের ডেরা বলিভিয়ায় ইউ এস এইচ-এর মানবিক প্রতারণার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭১সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর চিলি সফরের সুযোগ নিয়ে সি আই এ তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। এই গুপ্তহত্যা পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন আন্তেনিও ভেসিয়ানা।

আলফা সিক্সটি সিক্স গোষ্ঠীর এই সন্ত্রাসবাদী কেনেডি গুপ্ত হত্যার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বলিভিয়ার মার্কিন দূতাবাসে ইউ এস এইড-এর আধিকারিক হিসেবে ভেসিয়ানা ওইসময় কাজ করছিলেন। লাতিন আমেরিকায় মার্কিন এই সংস্থার ইতিহাস অনুযায়ী সত্তরের দশকের শেষে ড্যান অ্যান্থনি মাইট্রিয়ন নামে উরুগুয়েতে ইউ এস এইডের হয়ে কাজ করছিলেন। গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়ে বামপন্থী শক্তিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পুলিস প্রশিক্ষণের গোপন কর্মসূচী নেওয়া হয়েছিল। ইউ এস এইড নিজের ঘৃণ্য কার্যকারিতার ওপর পর্দা ফেলতে চাইছে।

নিজস্ব অর্থের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে বলে ইউ এস এইড আগেই স্বীকার করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক এই সংস্থা আসল পরিচয় সি আই এ-র পরিকল্পনার বিশ্বস্ত কার্যনির্বাহী। মার্কিন স্ট্রেট ডিপার্টমেন্টের গোপন পরিকল্পনার আগ্রহী সমর্থক ও উদ্যোগী ইউ এস এইড। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রধান অস্ত্রগুলির অন্যতম এই সংগঠন যার মাধ্যমে আমেরিকা লাতিন আমেরিকার সর্বত্র কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে। লাতিন আমেরিকার বিরুদ্ধে একাধিক কৌশল ‘মার্কিন স্বার্থ ও মতাদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত’ জমানাকে বসাতে ওয়াশিংটন বেছে নিয়েছে সেনা অভ্যুত্থানের পুরনো কৌশলও।

স্রেফ মার্কিন অক্সিজেনে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে হন্ডুরাসে। নির্বাসিত রাষ্ট্রপতি জেলায়া ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি সাভেজকে জানিয়েছেন, তাঁকে অপসারনের নির্দেশ এসেছিল হন্ডুরাসে মার্কিন সেনাঘাঁটি থেকে। সাভেজ সরাসরি এই অভিযোগ আনলে, চাপের মুখে তা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় খোদ মার্কিন বিদেশ দপ্তর। মানবাধিকারের এই বেপরোয়া লঙ্ঘন, অভ্যুত্থানের এই ‘সাফল্য’-ই কি ভবিষ্যতের জন্য হতে চলেছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত লাতিন আমেরিকার বামপন্থা ঘেঁষা রাষ্ট্রপতিদের জন্য একটি বার্তাবহ ঘটনা! সতর্ক করে দিয়ে ফিদেল বলেছেন, ‘যদি রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল জেলায়াকে ফিরিয়ে আনা না যায়, তবে উঠবে সামরিক অভুত্থানের ঢেউ, যাতে ভেসে যাবে লাতিন আমেরিকার বহু সরকার, অথবা তাঁদের থাকতে হবে স্কুল অব আমেরিকাসের নিরাপত্তার তত্ত্বগত শিক্ষায় শিক্ষিত, অত্যাচার নিপীড়ন ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ও সন্ত্রাসে সুদক্ষ অতি দক্ষিণপন্থী সেনাবাহিনীর দয়ার ওপর। দুর্বল হবে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বহু অসামরিক সরকারের কর্তৃত্ব।

’ প্রকাশ্যে এই আতঙ্কই এখন ঘুরছে লাতিন আমেরিকা জুড়ে। এবং বেশ কয়েকজন মার্কিন তাঁবেদার রাষ্ট্রপতি একে দেখছেন একটি ‘উদাহরণ’ হিসেবে, ‘সাফল্য’ পেলে যাকে অনুসরণ করা হবে। প্রতিবেশী দেশগুলির বিরোধী দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল, ওয়াশিংটনের সঙ্গে যাদের গাটছড়া বাধা, তারা হটাৎই তৎপর হয়ে উঠেছে। বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি ইভো মোরালেস, ইকুয়েদরের রাফায়েল কোরিয়া দু’জনেই প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা করছেন। এমনকি গুয়েতেমালার রাষ্ট্রপতি আলভারো কোলোম পর্যন্ত।

বলিভিয়ার সীমান্ত থেকে মাত্র ২০০কিলোমিটার দূরে প্যারাগুয়ের মারিসকাল এস্তিগারিবিয়াতে রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি, যেমন রয়েছে হন্ডুরাসের সোতো কানোতে। ২০০৫এর মে মাসে, প্যারাগুয়ের সেনেট মার্কিন সেনাবাহিনীকে তাদের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুমতি দেয়। যেখানে অনায়াসে নামতে পারে বিশাল বিমান, রয়েছে একসঙ্গে ১৬হাজার সেনার থাকার আবাসন। যেখান থেকে সহজেই নজরদারি রাখা যায় আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের ওপর। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে লুগো বলেছিলেন, ‘মারিসকাল এস্তিগারিবিয়াতে এই মার্কিন সেনা ঘাঁটির ঝাঁপ বন্ধ করতে হবে।

’ স্বাভাবিকভাবেই প্যারাগুয়েতে বামপন্থী আন্দোলনের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সেনা নিপীড়ণ। চলছে অস্থিরতা তৈরির গভীর ষড়যন্ত্র। যা রাষ্ট্রপতি ফার্নান্দো লুগোর বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থানের জমি তৈরি করতে পারে। প্যারাগুয়ের কংগ্রেসও লুগোর বিরুদ্ধে কোমর বেধে নেমে পড়েছে। দীর্ঘ ষাট বছরের একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৮-এ প্যারাগুয়ের মানুষ নির্বাচিত করেছেন বামপন্থা ঘেঁষা প্রার্থী ফার্নান্দো লুগোকে।

কলম্বিয়া এখন ‘লাতিন আমেরিকার ইজরায়েল’ ২০০৯-এর ৩০ জুন, হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার বিশেষ অতিথি কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি আলভারো উরিবে। আর সপ্তাহখানেক বাদেই ঘোষণা, কলম্বিয়ায় পাঁচটি নতুন বায়ু ও নৌসেনার ঘাঁটি ব্যবহার করবে পেন্টাগন। দশ বছরের লিজ। বায়ু সেনার তিনটি ঘাঁটি হলো — পূর্বের সমতলে অ্যাপিয়া, রাজধানী বোগোতা থেকে ৬০মাইল উত্তর-পশ্চিমে পালানকুয়েরো এবং ক্যারিবিয়ান উপকূলে আলবার্তো পাওয়েলস। এই পালানকুয়েরো সেনাঘাঁটির আধুনিকীকরণের জন্য ওবামা তাঁর ২০১০সালের প্রতিরক্ষা বাজেটে ৪কোটি ৬০লক্ষ ডলার মঞ্জুর করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

এছাড়াও রয়েছে দু’টি নৌঘাঁটি — প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে মালাগা এবং ক্যারিবিয়ান উপকূলে বন্দরনগরী কার্তাজেনা। পরে জানা যায়, তালিকায় রয়েছে আরও দু’টি সেনাঘাঁটি। এরমধ্যে একটি হলো ভেনেজুয়েলা সীমান্ত লাগোয়া মালামবো, অন্যটি হলো ইকুয়েদর সীমান্তে ফ্লোরেন্সিয়া। ১৯৯৯তে চুক্তিতে সই করেছিলেন ইকুয়েদরের রাষ্ট্রপতি জামিল মাহুয়াদ। সেদিন নেই।

ইকুয়েদরে এখন বামপন্থা ঘেঁষা রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরিয়া। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েই কোরিয়া ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দেন, ‘মানতায় যেখানে মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে, তার মেয়াদ ২০০৯এ শেষ হলে, আর অনুমোদন করা হবে না। কারণ সার্বভৌমত্ব বিক্রির জন্য নয়। ’ এবং করেছেনও তাই। গত বছর মার্চের ১তারিখ ইকুয়েদরের ভূখন্ডে ঢুকে বামপন্থী গেরিলা সংগঠন রেভেলিউশনারি আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া (ফার্ক)-র নেতা রাউল রেইসের ছাউনিতে বেপরোয়া আক্রমণ চালায় কলম্বিয়া।

এই ঘটনায় মানতায় সামরিক ঘাঁটিতে থাকা মার্কিন বোমারু বিমানের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, এই তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গেই কোরিয়া মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গুটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। পরে ইকুয়েদরের জাতীয় পরিষদ কোরিয়ার এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা যদিও নভেম্বরে, কিন্তু মে মাসেই ওয়াশিংটন ঘোষণা করে, তাদের সেনাবাহিনী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই মানতা ছাড়বে। তারপর শুরু হবে পরিকাঠামোসহ যাবতীয় নির্মাণ কলম্বিয়াকে হস্তান্তর করার কাজ। চুক্তি মেনে পাততাড়ি গোটানোর সময় পেন্টাগন কিন্তু একবারও সেই মুহূর্তটিকে এই অঞ্চলে তার ব্লুপ্রিন্টকে খতিয়ে দেখার কাজে ব্যবহার করেনি।

কিংবা এতটুকু সংশোধন করেনি তার অতি তৎপরতাকে। বরং, আন্দিজে সে তার সামরিক তৎপরতাকে আরও বাড়িয়েই চলেছে। এই মুহূর্তে কলম্বিয়াতে রয়েছে অন্তত ন’টি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। আর এই ঘাঁটিগুলিতে রয়েছে কয়েকশ’ মার্কিন সেনার উপস্থিতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর কলম্বিয়ার মধ্যে সামরিক জোট বন্ধন আদৌ নতুন নয়।

চল্লিশ বছরের ওপর ‘গণতন্ত্রের বধ্যভূমি’ কলম্বিয়াই পশ্চিম গোলার্ধে ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত দেশ। বছরের পর বছর ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’, ‘প্ল্যান প্যাট্রিওটা’র নামে কাড়ি-কাড়ি ডলার ঢেলে আসছে ওয়াশিংটন। মূল লক্ষ্য বামপন্থী গেরিলা সংগঠন রেভেলিউশনারি আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া (ফার্ক) এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা গ্রুপ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (ই এল এন)-র প্রভাবকে গুড়িয়ে দেওয়া। একইসঙ্গে মার্কিন প্রশিক্ষণ, সমরাস্ত্রে সমৃদ্ধ কলম্বিয়ার ‌আধা সামরিক বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সংগঠনের নেতা, আদি জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য সংগঠনের বিরুদ্ধে। যা কেড়ে নিয়েছে ৪০হাজার মানুষের জীবন।

সংঘর্ষের কারণে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে পঁচিশ লক্ষের বেশি মানুষকে। কলম্বিয়া মানে, লাতিন আমেরিকায় সর্বোচ্চ এবং ইজরায়েল, মিশরের পর বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম মার্কিন সামরিক সহায়তা পাওয়া দেশ। দশ বছর আগে ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’ শুরু হওয়ার পর থেকে এযাবৎ পেন্টাগনের কাছ থেকে কলম্বিয়া পেয়েছে ৬০০কোটি ডলার সহায়তা। কলম্বিয়া মানে, লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম সশস্ত্র বাহিনী। সাড়ে ৪কোটির দেশ কলম্বিয়াতে এখন রয়েছে ২লক্ষ ৭০হাজার প্রশিক্ষিত সেনা।

সঙ্গে ১লক্ষ ৪২হাজার পুলিস কর্মী। আর এই কলম্বিয়াকেই কেন্দ্র করে লাতিন আমেরিকায় আগ্রাসনের ছক কষছে আমেরিকা। ভূস্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের দিক থেকে কলম্বিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। লাতিন আমেরিকার বাকি দেশগুলির তুলনায় এটি অনেকটাই কেন্দ্রে অবস্থিত। যা যোগ করেছে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকাকে।

কাছেই পানামা খাল। একদিকে ক্যারিবিয়ান সাগর, অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগর। ভেনেজুয়েলা ও ইকুয়েদরের ঠিক মাঝখানে কলম্বিয়া — যে দু’টি সরকারই এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের আঞ্চলিক দাপটকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে। কলম্বিয়া গেরিলা সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘মার্কিন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নতুন এই চুক্তির লক্ষ্য আসলে প্রতিবেশী দেশ ভেনেজুয়েলা। এটি স্পষ্ট, আন্দিজে ওয়াশিংটনের যুদ্ধ পরিকল্পনার একটি ‘উইং’ হলো কলম্বিয়া সরকার।

লক্ষ্য আসলে রাষ্ট্রপতি সাভেজের বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করা। লক্ষ্য সাভেজের আলবা প্রকল্প, তাঁর প্রভাবকে গুড়িয়ে দেওয়া। ২০০২এ, সেনা অভ্যুত্থানে ব্যর্থ হয়ে লক্ষ্য এবার প্ল্যান-বি। তাছাড়া, ইকুয়েদরের সরকারের সঙ্গে কলম্বিয়ার সংঘাতও অন্যতম একটি কারণ। ’ এরমধ্যেই আগস্টের ১৪তারিখ কলম্বিয়ার আধা সামরিক বাহিনীর দেড়শ জওয়ান সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে ভেনেজুয়েলার ভূখন্ডে, জুলিয়া প্রদেশে।

চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ফের ‘নারকো আধাসামরিক’ রাষ্ট্রপতি উরিবের তিনটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার সীমান্ত পেরিয়ে দশ মিনিটের ওপর চক্কর খায় জুলিয়ার আকাশে। ভেনেজুয়েলার সীমান্ত পেরিয়ে কলম্বিয়ার সামরিক বাহিনীর এই তল্লাশি অভিযানকে ‘ভেনেজুয়েলার জনগণের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের প্ররোচনা’ বলে কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভেনেজুয়েলার কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরো। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অস্কার ফিগুয়েরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এটি আসলে ভেনেজুয়েলাকে অস্থিতিশীল করার ব্লুপ্রিন্টের একটি অংশ। সেই লক্ষ্যেই ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতে ইন্ধন দিতে এটি একটি প্রকাশ্যে প্ররোচনা। ’ এঘটনায় দেশবাসীসহ আন্তর্জাতিক মহলকে সতর্ক করে দিয়েছে ভেনেজুয়েলার কমিউনিস্ট পার্টি।

বলেছে, ‘লাতিন আমেরিকার একাধিক সরকারকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র চলছে। এজন্য কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে লড়াই বাধিয়ে দেওয়ার প্ররোচনা তৈরি করা হচ্ছে। যা তৈরি করতে পারে স্থানীয় যুদ্ধ, যার প্রেক্ষাপটে অনায়াসে সামরিক আগ্রাসনের সুযোগ পেয়ে যাবে সাম্রাজ্যবাদ। ’ কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য, ‘কলম্বিয়ায় মার্কিন সেনাদের তৎপরতা, ক্যারিবিয়ানের জলে মার্কিন চতুর্থ নৌবহরকে চাঙ্গা করা, পানামার মতো দক্ষিণপন্থী সরকারগুলির অতি সক্রিয়তা তারই লক্ষণ। ’ লক্ষ্য, ভেনেজুয়েলার তেল সৌদি আরবের পর যার তেল ভান্ডার এই বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম।

১৯৭৩এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার জ্বালানি তেলের ৩৬শতাংশ আমদানি করত। এখন আমদানি করতে হয় ৫৬শতাংশ। অর্থাৎ আমদানি বেড়েছে ২০শতাংশ। এবছরের মে মাসে খোদ মার্কিন প্রশাসনের দেওয়া তথ্য জানাচ্ছে, সৌদি আরব, কিংবা ইরাক নয়, এই তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভেনেজুয়েলা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। কানাডার ‌ঠিক পরেই।

আর কলম্বিয়া দশ নম্বরে। কলম্বিয়ার পরেই ইকুয়েদর। অথচ, ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রন কলম্বিয়াতে যেমন তীব্র, তেমন ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েদরে শূন্য। তাই ‘ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আসলে আমেরিকার একটি ছুতো — যা দিয়ে ওয়াশিংটন চায় লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশকে কবজা করতে। ইরাকের ক্ষেত্রে সমরাস্ত্র ধ্বংস করা যেমন নির্ভেজাল মিথ্যে, তেমনই লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে ‘মাদক সন্ত্রাসবাদ’ একটি অজুহাত মাত্র।

আর এই লক্ষ্যেই ড্রাগের চোরাকারবারী আর দেশপ্রেমিক, সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা গেরিলা মুক্তি যোদ্ধাদের একই পংক্তিতে দাঁড় করিয়ে দিতে এরা ‘নারকো গেরিলা’র মতো কদর্য পরিশব্দের জন্ম দেয়। আসলে ওরা কী চায়? ওয়াশিংটনের লক্ষ্য আসলে তেল। আর সেই লক্ষ্যেই প্ল্যান কলম্বিয়া। লক্ষ্য মার্কিন তেল কোম্পানিগুলির স্বার্থ। তাদের মুনাফা।

আর সেকারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কলম্বিয়ার তিনভাগের দু’ভাগ সেনাবাহিনী এখন দেশের তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলে বহুজাতিক সংস্থার মুনাফাকে নিশ্চিত কারার জন্য নিরাপত্তার কাজে যুক্ত। পাইপলাইনগুলির সুরক্ষায় ওয়াশিংটন সম্প্রতি দিয়েছে ১০টি হেলিকপ্টার। এরসঙ্গেই রয়েছে আই এম এফের ‘কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচী’। যার লক্ষ্য, কলম্বিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ক্ষেত্রের বেসরকারীকরণ। হচ্ছেও তাই।

রাষ্ট্রপতি উরিবে ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা ইকোপেট্রোলের বেসরকারীকরণ করেছেন। বিদেশী লগ্নীকে উৎসাহিত করতে বাড়িয়েছেন লিজের মেয়াদ। এবং তা অনির্দিষ্ট কালের জন্য। কমিয়েছেন রয়ালটির পরিমাণ। বস্তুত, কলম্বিয়ার সরকার এখন নিজের তেলই কিনছে ক্যালিফোনিয়া-কেন্দ্রিক অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়ামের মতো বিদেশী সংস্থার কাছ থেকে।

তাও বাজার দরে। স্বাভাবিকভাবেই গত দু’মাস ধরেই ভেনেজুয়েলার সরকার, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি সাভেজের বিরুদ্ধে কর্পোরেট মিডিয়া শুরু করেছে বেপরোয়া কুৎসা। ড্রাগ পাচারে মদত থেকে কলম্বিয়ার বামপন্থী গেরিলা সংগঠন ফার্ক-কে সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা, কলম্বিয়ার সীমান্তে লা’গুজারিয়াতে হিজবুল্লাহকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুমতি থেকে বেআইনী অস্ত্র কারবার, দেশে বাক্‌ স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো কুৎসা চালাচ্ছে সাভেজের বিরুদ্ধে। ফার্ক-কে ভেনেজুয়েলা অস্ত্র সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ এনে কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি উরিবে দাবি করেছেন, হগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে সাভেজকে অভিযুক্ত করা উচিত। পালটা ভেনেজুয়েলা সরকার বেআব্রু করে দিয়েছে, আসলে কীভাবে এই সমরাস্ত্র ফার্কের হাতে পৌঁছেছে, যা কেনা হয়েছিল আগের সরকারের আমলে, ১৯৮৮তে।

এবং একটি তল্লাশি অভিযানের সময় যা চুরি করেছিল কলম্বিয়ার অপর বামপন্থী গেরিলা সংগঠন ই এল এন। সাভেজ প্রথমবারের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ১৯৯৯সালে। তারপর তিনি একাধিকবার ফার্ককে অস্ত্র নামিয়ে রেখে রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাঁর এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার জন্য ২০০৭এ বেশকিছু বন্দীকে একতরফাভাবে মুক্তি দেয় ফার্ক। সাভেজ মনে করিয়ে দিয়েছেন, গতবছর মার্চ মাসে ইকুয়েদরের ভূখন্ডে ফার্কের একটি শিবিরে কলম্বিয়ার বেপরোয়া সামরিক অভিযান চালানোর কথা।

তার আগে ফার্কের উপস্থিতি নিয়ে এতটুকু তথ্য ইকুয়েদরের সরকারকে জানায়নি কলম্বিয়া। এরআগে ২০০৩এ, সম্পূর্ন বেআইনীভাবে ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে ঢুকে ফার্কের মুখপাত্র রডরিগো গ্রানদাকে গ্রেপ্তার করে কলম্বিয়ার এক পুলিস অফিসার। সাভেজ বলেছেন, কল্পনা করুন, ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনী গোপনে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায় ঢুকে গ্রেপ্তার করছে ভেনেজুয়েলার বনিকসভার প্রাক্তন প্রধান পেড্রো কারমোনাকে। ২০০২এ ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান মাত্র ৪৮ঘন্টার জন্য যাকে বসিয়েছিল স্বৈরশাসক হিসেবে। সেনা অভুত্থানের পালটা গণঅভ্যুত্থানে কারমোনা পালিয়ে গিয়ে শেষে আশ্রয় নেয় কলম্বিয়ার দূতাবাসে।

বোগোতা থেকে কারমোনা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন সাভেজ-বিরোধী ষড়যন্ত্র। সম্প্রতি লাতিন আমেরিকা সফরে এসেছিলেন ইজরায়েলের বিদেশমন্ত্রী অ্যাবিগদোর লিবারম্যান। কথা বলেন কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি উরিবের সঙ্গে। উরিবেকে তিনি মোসাদের প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রশিক্ষণ শিবির হওয়ার কথা এই সেনা ঘাঁটিগুলিতে।

স্কুল অব আমেরিকাসের গ্র্যাজুয়েটদের থাকার কথা প্রশিক্ষণের দায়িত্বে। ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ শুধু গোয়েন্দা তথ্যই সংগ্রহ করে না, গোপন অভিযান, আধা সামরিক কার্যকলাপ থেকে বহু রাজনৈতিক হত্যায় অভিযুক্ত। এদের কার্যকলাপ অনেকটাই সি আই এ, সিক্রেট ইন্টিলিজেন্স সার্ভিসের (এম আই ১৬এ) মতো। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ‘ইতোমধ্যেই (সামরিক) আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। ’ আগস্টের ৮তারিখ এক শ্রমিক সমাবেশে সতর্ক করে দিয়েছেন সাভেজ।

লিবারম্যানের সফর সম্পর্কে সাভেজ বলেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই লাতিন আমেরিকা সফরে এসেছিলেন’ লিবারম্যান। ইজরায়েলের বিদেশমন্ত্রীর অভিযোগ, কলম্বিয়ার সীমান্তে লা’গুজারিয়াতে হিজবুল্লাহকে প্রশিক্ষণের অনুমতি দিয়েছে ভেনেজুয়েলা। পালটা সাভেজ বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কলম্বিয়াকে লাতিন আমেরিকার ইজরায়েলে পরিণত করতে চাইছে’, যার প্রাথমিক লক্ষ্য ভেনেজুয়েলা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.