আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিয় ঋতুর সন্ধানে

কল্যাণের কথা বলি, কল্যাণের পথে চলি।

আমার দেশ ষড়ঋতুর দেশ। একথাটা শুনলে বিদেশী বন্ধুরা আশ্চর্য হয়ে যায়। ওরা সবসময় শুনে এসেছে ঋতু চারটার কথা। আমরা শুনে এসেছি ছয়টা ঋতুর কথা।

যদিও অনেকেই এখন গান গায় এই বলে যে, “জন্মে দেখি বাংলা মা তোর মুখে মলিন হাসি / কোথায় মা তোর ছয়টি ঋতু, কে গায় বারমাসী?” তবুও ছয় ঋতুর দেশ আমাদের। এর মধ্যে শুনতাম বসন্ত হচ্ছে ঋতুরাজ। ঠিক কয়দিন বসন্ত থাকে বাংলাদেশে তা আবার বলা মুশকিল; যদিও ফাগুন আর চৈত মাস দু’টি আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্তের। কৃষ্ণচূড়া বসন্ত ঋতুরাজ হলেও ঠিক প্রিয় ঋতু মনে হয় আমার ছিলনা। দেশে থাকতে কোনটা প্রিয় ঋতু তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করিনি কখনো।

বাইরে আসার পর মনে হল শীত আমার প্রিয় ঋতু ছিল দেশে। মালয়েশিয়া যাওয়ার পর একটু শীতের জন্য হাসফাঁস করে মরার দশা। কারো কারো কাছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো হল চির বসন্তের। আমাদের ফাগুনের মতই সারা বছর আমের গাছে মুকুল বেরুচ্ছে; আবার সাথে সাথে কাঁচা-পাকা আমও ঝুলছে সারা গাছ জুড়ে। কিন্তু নিরক্ষীয় অঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলোতে তাপমাত্রা বেশী না হলেও বাতাসের প্রচণ্ড আর্দ্রতার কারণে অসহ্য ঠেকত বাইরের আবহাওয়া।

আর সারা বছরে একটাই ঋতু। কোন পরিবর্তন নেই। ফলে একঘেঁয়ে হয়ে যাওয়া ঋতুটাকে ঠিক পছন্দ হয়নি। শুধু ভাল লেগেছে দিন-রাতের প্রায় সমান সমান দৈর্ঘটাকে। আরো যা তাহল, ফুলের কোন গন্ধ পাইনি সেখানে।

দেশে একটা গাছে বকুল ফুটলে কত দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যেত। মন মাতানো গন্ধে হৃদয় সুরভিত হয়ে উঠত। অথছ এখানে সারা গায়ে ফুলের পোশাক পরা সারি সারি বকুল গাছের নীচে দিয়ে হেটে যাওয়ার পরও গন্ধ পাওয়া যায়না। গাছের নীচে পরে থাকা ফুলগুলো হাতে নিয়ে নাকের কাছে এনে কষ্ট করে শুঁকে দেখলেও গন্ধ আসেনা। দোকান থেকে টকটকে লাল গোলাপ কিনে নাকের একেবারে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেও কোন গন্ধ পাওয়া যেতনা।

ফুলের গন্ধ পেতে এজন্য মাঝে মাঝে পাহাড়ে যাওয়া দরকার হত। সমুদ্র সমতল থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত পাহাড়গুলোতে একটু ঠাণ্ডা ছিল। একবার গিয়েছিলাম ক্যামেরোন হাইল্যাণ্ড, পিকনিক করতে। মেঘগুলো যখন গা ছুঁয়ে যাচ্ছিল তখন তারা আলতো করে ঠাণ্ডার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল। দেশ থেকে নিয়ে আসা ফুলহাতা সোয়েটার এখানে যা একটু কাজে লাগছিল।

পিকনিকের বাস থেকে নেমে এদিক সেদিক ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে দেখলাম বিভিন্ন বাড়ীর সামনে ছোট্ট ছোট্ট ফুলের বাগান। সেখানে ফুটে আছে লাল গোলাপ। পাহাড়ী ঠাণ্ডায় সেগুলো দেশী গোলাপের মতই গন্ধ বিলাচ্ছিল, যা নীচের সমতলে থেকে কখনো পাইনি। আবার শীতের কথায় আসি। মালয়েশিয়ার নিরক্ষীয় আর্দ্রতায় সারা বছর কাটাতে কাটাতে দেশের শীতের শুষ্কতার অভাব বোধ হত বেশ।

আরো দেখলাম দেশে থাকতে ঐ একটি ঋতুতেই পাওয়া যেত নানা রকমের শাক সবজি, খেজুরের গুড় ও নানা রকমের পিঠা। বৃষ্টি আর গরমের অভাবে এদিক সেদিক চলাচলেও কোন সমস্যা হতনা। মনের মত করে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতেও তেমন সমস্যা নেই। সমস্যা যা তা হল ধুলোবালির আধিক্য। শীতকাল আমেরিকায় আসার পর শীতের প্রকোপ দেখে শীতের প্রতি ভালবাসা তিরোহিত হয়েছে পুরোপুরি।

একটু ঘরের বাইরে যেতে হলে স্তরের পর স্তর গরম কাপড় পরাতে লাগে প্রচণ্ড বিরক্তি, সাথে আছে মোটা উলের মোজা সহ জুতা পরা। প্রতিবার মসজিদে যেতেও এ পরতে হচ্ছে। বাইরের ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে যে কাপড় পরা হল তাই আবার মারাত্মক অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় কোন ঘর, অফিস বা শপিং মলের ভেতর। ঘরে বা অফিসে কোন রকমে গরম কাপড় খুলে রাখা যায়। কিন্তু শপিং সেন্টার বা অন্য কোন কাজে নিজের অফিস বাদে পোস্ট অফিস, ব্যাংক, হাসপাতাল বা সরকারী অফিস আদালতে গেলে হিটিং সিস্টেমের তীব্রতায় অসহ্য অনুভূতির মুখোমুখি হতে হয়।

শীতের যা একটু ভাল লাগা তা হল তুষারপাত। তাও আবার যতক্ষণ পড়ল ততক্ষণ; কারণ পরে আবার সেই বিরক্তিকর ঠাণ্ডা ও রাস্তাঘাটের বিশ্রী অবস্থা। শরৎকালে কাশের ফুল শরৎ ভাল লাগত কিছুটা দেশে থাকতে। বর্ষার তীব্রতা শেষে আকাশে পেজা তুলোর মত সাদা মেঘের আনাগোনা ও কাশফুলের শুভ্রতা মনেও কিছুটা শুভ্রানুভূতির জন্ম দিত। কদিন পরে হেমন্তও খারাপ লাগতনা।

মাঠে মাঠে পাকা আমন ধানের রূপ মনোমুগ্ধকরই ছিল। ধান কাটার সময়ে বৃষ্টির মৌসুম পুরোপুরি শেষ। ধান ক্ষেতের শুকনো আল ধরে ধানের শীষে হাত বুলাতে বুলাতে হাটার মজাটাই আলাদা। হেমন্তঃ পাতা ঝরার মৌসূম পশ্চিমে এই দুটো ঋতু নেই। এখানে যা আছে তা হল গ্রীষ্মের শেষে হেমন্ত [autumn/fall]।

পাতা ঝরার মৌসুম বলে Autumn না বলে অনেকেই একে বলে Fall। বসন্তের শুরূতে নতুন পাতার কুঁড়ি আর ফুল ফুটিয়ে যে গাছ সবুজ সতেজ রূপ ধারণ করেছিল, গ্রীষ্ম শেষে ধীরে ধীরে তা এখন হঠাৎ বর্ণিল রূপ ধারণ করেছে। পাতাগুলো সবুজ রঙ হারিয়ে লাল, খয়েরী ইত্যাদি রূপ ধারণ করে প্রকৃতির রূপটাকেই করে দেয় আলাদা। ধীরে ধীরে ঝরে যেতে থাকে পাতা। গাছের নীচে বা কোন বুনো পায়ে হাটা পথ ধরে হাটলে পায়ের নীচের পাতার মচমচানিই শুনতে পাওয়া যাবে শুধু।

তাপমাত্রা আরামদায়ক হলেও প্রকৃতির বিবর্ণ রূপটা কষ্টের কারণ হয় অন্তরে। গরমে জান যায় গ্রীষ্মের জন্য হা হয়ে থাকে পশ্চিমের মানুষ। অনেক উষ্ণমণ্ডলীয় ফল ও সূর্যের অফুরন্ত আলো ও তাপকে খুব ভাল ভাবেই উপভোগ করে এখানকার মানুষ। গ্রীষ্ম তাদের কাছে ক্ষণস্থায়ী। তাই এর যথার্থ ব্যবহারে উন্মুখ উচ্ছলতা সবার।

শীতের তীব্রতা শেষে বসন্তের উষ্ণতা গাছে গাছে সবুজ পাতার সমারোহ এনে শীতের উলঙ্গ গাছগুলোকে আবরণ পরিয়ে দিলেও গ্রীষ্মের তাপে এখানের মানুষেরা ছাড়তে থাকে তাদের খোলস। যত বেশী পরিমাণে স্বল্প বসন/বসনা হওয়া যায় তার প্রতিযোগিতা চলে সর্বত্র। বাচ্চাদের নিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করার মজা থাকলেও চোখের জন্য বিরক্তিকর গ্রীষ্ম। চারপাশে ঘোরাফিরা অসংখ্য প্রায়োলঙ্গ মানুষের। মেদবহুল বেঢপ আকৃতির শরীরের নারীদের প্রায়-উলঙ্গ চলাচল বমির উদ্রেক করে অনেক সময়।

এক বাংলাদেশীর মন্তব্য ছিল “এখানে নারীরা পর্দা পরে শীতে; আর গাছগুলো তখন পুরো উলঙ্গ। অন্যদিকে গাছেরা পর্দার আবরণে আবৃত হয় গ্রীষ্মে; আর নারীরা হয়ে পড়ে উলঙ্গ। ” দিনের দৈর্ঘের কারণে অনেক কাজ সম্ভব হলেও অনেক সময় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার আধিক্য সহজে ক্লান্তি ডেকে আনে শরীরে। আর মাঝে মাঝে তাপ প্রবাহে জীবনের গতিই থেমে যায়। পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিদ্যুতের সুবিধার কারণে রাতের ঘুম মোটামুটি আরামদায়কভাবেই পার করা যায়।

কিন্তু দেশে প্রচণ্ড গরমে জনজীবনে অস্বস্তির অন্ত থাকেনা। কদমঃ বর্ষার ফুল বর্ষা দেশে আনত বৃষ্টির বাহুল্য। সেজন্যই ঋতুটা বর্ষা। অন্য কোথাও বর্ষা নামে আলাদা কোন ঋতু নেই। একটানা অনেক দিনের বৃষ্টির ঝমঝমানি ভালই লাগত।

স্কুল ফাঁকি দিয়ে কারো কাচারী ঘরে বসে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেয়া ও নানা ধরণের গ্রাম্য খেলা-ধূলার মাঝে চাল-ডাল ভাজা মজা করেই খাওয়া চলত। কখনো কখনো চলত বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সাগরের কাছের খালগুলোতে উপরের জমিন থেকে পানি ছেড়ে দিয়ে উজানে আসা সামুদ্রিক টেংরা মাছ ধরা অথবা খালের মধ্যে জাল বসিয়ে দিয়ে বিশেষ চিংড়ি [গ্রামের ভাষায় লইল্যা ইছা]ধরা ও তা নুন দিয়ে তাওয়ায় টেলে খাওয়া। মাঝে মাঝে স্কুলের মাঠে জমে থাকা হাটু পানিতে নেমে ফুটবল খেলা; আর শেষে বাড়ি ফিরে বকা খাওয়া। শেষ পর্যন্ত সর্দি লাগিয়ে কদিন জ্বরে কঁকানো। জল কাদায় চলাচলে বিরক্তি লাগলেও কদম ফুলের সৌন্দর্য মন ভরিয়ে তুলত কখনো কখনো।

এখানে তেমন বর্ষা নেই। কিন্তু দেশীয় ধরণে একটু কিছুক্ষণ বৃষ্টি ঝরলে ফ্ল্যাশ ফ্লাডিং হয়ে যায়। যা অবশ্য ক্ষণস্থায়ী। দেশের মত জমে থাকেনা। ফিরে আসি বসন্তে।

দেশের বসন্তকে মনে হত খুবই স্বল্পস্থায়ী একটা ঋতু। ফাগুনে আমের গাছে মুকুল আর কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে লাল টকটকে ফুল ফুটতে দেখে ঠিকই বসন্ত চেনা যেত। কোকিলের ডাক সাথে থাকত। আমার কাছে অবশ্য কোকিলের কুহু কুহু ডাককে কখনো খুব মধূর বলে মনে হয়নি। কেন তা জানিনা।

তবে অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে বলে পাখিটার প্রতি এমনিতেই বিরক্ত ছিলাম। তবে দু’মাস কখনো বসন্ত আমার কাছে মনে হয়নি। চৈত্রকেতো পুরোপুরি গ্রীষ্মই মনে হত। গরমে প্রাণ যাবার যোগাড়। পশ্চিমে বসন্ত তার রাজকীয় রূপ ধরেই আসে এবং মোটামুটি স্থায়ী হয়।

শীতের শেষে গাছে গাছে নতুন পাতা ও ফুলের কুঁড়ির সমারোহ। প্রথমেই বের হয় ফুলেরা। চেরী ফুলের মন মাতানো রূপ চার দিকে। মানুষের বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানগুলোতে নানা রঙের সুগন্ধি গোলাপের সাথে সাথে আরো নানান নাম না জানা ফুল। ফুলের কুঁড়ির পেছন থেকে বের হতে থাকে সবুজ পাতার কুঁড়ি।

ধীরে নানা বর্ণের ফুলের পাপড়ি ঝরে গিয়ে গাছগুলো পুরোপুরি সবুজ হয়ে উঠে। তাপমাত্রা থাকে সহনীয়। দিনের দৈর্ঘও মোটামুটি বড়। প্রকৃতি অপরূপ; হৃদয় মোহিত। এইতো বসন্ত, এইতো বসন্ত, প্রিয় বসন্ত।

এখন অপেক্ষার পালা বসন্তের জন্য। নিউ ইয়র্ক ডিসেম্বর ২৮, ০৯

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.