আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফারুকীর আরেকটি ছবি আর প্রাসঙ্গিক কিছু চিন্তাভাবনা

Let the wind blow out the candles

বাংলা ছবি এমনিতেই দেখি না। হলে গিয়ে দেখার তো প্রশ্নটা যে কারণে আপনা থেকেই বাতিল হয়ে যায়। তবে এই ফারুকীর সৌজন্যেই একবার একটা বাংলা ছবি সিনেপ্লেক্সে গিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আর সেটা হল মেইড ইন বাংলাদেশ। অনেকে হয়তো সন্দেহ করা শুরু করে দিয়েছেন সিনেপ্লেক্সে অন্য ছবি দেখতে গিয়ে টিকিট না পাওয়ায় ফারুকীকেই বেছে নেওয়া হোল কিনা, সেটাই হয়তো ঠিক! তবে যাই হোক, ছবি দেখার পর খুব একটা খারাপ লাগেনাই, তবে যতটা শুনেছিলাম ছবিটার ব্যাপারে সেটা প্রত্যাশাকে অনেক উচু লেভেলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে যখন পুরো ছবিটাকেই একটা মাত্র কক্ষের দৃশ্যায়নে জাহিদ হাসানের চিৎকার চেচামেচির মাঝে কিছু ভাড়ামিতে পরিণত করা হল, তখন বিরক্ত না হয়ে উপায় ছিল না।

ছবিটা দেখার পর পরিচালকের ওপর সেরকম ভালো ইম্প্রেশন না আসলেও, বিরক্তি তৈরি হয়নি কারণ হলে গিয়ে দেখার মত ছবি ছিল সেটি, হোকনা কমেডি নাটককে টেনেটুনে সিনেমা বানাবার অপপ্রচেষ্টা! প্রচুর হলিউডি মুভি দেখা হয় বলেই, যারা ইতোমধ্যে জনাব ফারুকীকে বিশ্বমানের খেতাব দিয়ে দিয়েছেন, তাদের প্রশ্ন করতেই হয় 'বিশ্ব' কথাটার মানে আদৌ বুঝে কিনা। ফারুকীর সর্বশেষ বিনোদন থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার - ছবি নিয়ে এর মাঝেই অনেক ভালো ভালো সমালোচনা পড়ে ফেলেছি। ছবি নিয়ে সমালোচনা করতে পারছিনা কারণ এখনো দেখা হয়নাই এই ছবি (সমালোচনা পড়ার পর দেখার ইচ্ছা থাকার কথাও না)। ছবির চরিত্রগুলোর মাঝে মোশাররফ করিম এর অভিনয় ভাল লাগে অসম্ভব, তাই দেখার ইচ্ছা ছিল। পরিচালক তাকে বেছে নেবে এতে কোন সন্দেহর অবকাশ নাই।

তবে কোকিল দিয়ে ময়ূরের রোল চালিয়ে নেবার অপচেষ্টায় যখন তপুকে নায়ক হিসেবে পর্দায় দেখি তখন হাহাপগে ছাড়া উপায় থাকে না। এমনিতেই গায়ক হিসেবে তাকে খুব একটা ক্লাসের মনে হয়না, তবে এটা সত্য বিশেষ গোত্রের কাছে তার পপুলারিটি আছে। পরিচালক সুকৌশলে এই পপুলারিটিকে কাজে লাগাতে চেয়েছে সন্দেহ নাই, যদিও এই ছবির পর গায়ক হিসেবে তার গ্রহনযোগ্যতা বাড়বে কিনা সেটাও সন্দেহ করার মত ব্যাপার। হয়তো গায়ক তপু অচিরেই নায়খ তপুতে ক্যারিয়ার বিকাশের চিন্তাভাবনা শুরু করবে আর আমরা ধরে নিতে পারি, পরিবারতন্ত্রের মতই ফারুকীর ভবিষ্যতের সব ছবির পোস্টারে আমরা গিটার হাতে এই টেকো নায়কমুখকে দেখার সৌভাগ্য পাব। আর টিষার ব্যাপারে কিছু বলার নাই।

অনেকেই হয়তো তারে ভালো পায় যাদের মাইনাস এড়াতে সুকৌশলে ব্লগে তার ছবিটি সংযোজন করা হয়েছে এবার ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু প্যাচাল পারি। জনাব ফারুকী সমাজের কিছু সমস্যা তুলে ধরতে চেয়েছেন। তার উপস্থাপনা ঠিক হয়নি বলে সবাই যে সমালোচনায় মেতেছেন, সেটা নিয়ে আমার কিছু বলার নাই। আমার প্রশ্নটা হল, চলচ্চিত্র যদি তৈরি করতেই হয়, সেটা কি নিয়ে তৈরি করা উচিত? বা আমাদের মত একটি পিছিয়ে পরা দেশে সীমিত রিসোর্স নিয়ে যেসব চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়, সেগুলোর বিষয়বস্তু আসলে কি হওয়া উচিত? এই বিচারে কি ফারুকীর ছবিটির বিষয়বস্তু বেছে নেওয়া আদৌ যৌক্তিক হয়েছে? হ্যা, বাইরে প্রচুর মুভি তৈরি হয়, সেসবের পেছনে বস্তা ভরা বাজেট থাকে। কিন্তু আমাদের মত দেশে তো সেই সুযোগ নেই।

একারণে পাশের দেশটা মুকভর্তি মেকাপ আর পকেট ভর্তি বয়ফ্রেন্ড আর তাদের সাথে বহুমুখী সম্পর্ক নিয়ে মেগাসিরিয়াল তৈরির বিলাসিতে যেখানে দেখাতে পারে, আমাদের সেটা করার সুযোগ নেই। সিনেমার বিষয়বস্তু হিসেবে ফারুকী বেছে নিয়েছে স্বস্তা যৌনতা, মানি সেটা আমাদের সমাজে মেয়েদের অন্যতম হয়রানির বিষয়বস্তু, কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কি আরো কিছু ছিলো না? মেইড ইন বাংলাদেশ যেকারণে ভালো লেগেছিল, সেটাতে দেশের সমস্যাগুলোতে ফোকাস করা হয়েছিল, যদিওবা অবাস্তব সমাধানে। তারপরেও, সেখানে চিন্তা করার মত কিছু ম্যাটেরিয়ালস ছিল। আর এজন্যই, ছবিটা ভালো লাগে। আর এখন?! ফারুকী তুলে ধরতে চেয়েছে যৌনতা-ই সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যধি যে রোগে তরুণ বৃদ্ধ সবাই অসুস্থ।

ভালো। যদি সমাজের শৃঙ্খলে আটকে পড়া মেয়েদের জীবন নিয়েই সিনেমা তৈরি করতে হত, তাহলে সেটার একটা অংশ হয়তো হতে পারত থার্ড পার্সনের এই থিমটা, পুরো ছবি জুড়ে সেটার গ্রহনযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বেই। আরেকটা ব্যাপার, ছবি আসলে কি নিয়ে তৈরি করা উচিত? সমাজের সমস্যা, নাকি সম্ভাবনা? এই প্রশ্নে আমি অবশ্যই সম্ভাবনা কে প্রাধান্য দেব, বিশেষ করে যখন আমাদের মত গরীব দেশে যখন হাতে গোণা কয়টা ভালো ছবি তৈরি হয়। সমস্যা দেখিয়ে কোন লাভ নেই, যতক্ষণ না সেটার গ্রহণযোগ্য কোন সমাধানও ছবিতে দেখানো হয়। আমার জানা মতে, ফারুকী সাহেব কোন সমাধান দেখান নি ছবিতে।

বরং তিনি যা দেখিয়েছেন, তপু আর মো. করিম হাত ধরে প্যারালালি এগিয়ে যাচ্ছে, তার মানে কি? সমস্যা আমাদের মেনে নিতে হবে! ফারুকী যেখানে ছবি দেখাতে পারতো তরুণ সমাজ, স্পেশালি মেয়েরা কিভাবে একটা সমাজকে এগিয়ে নিতে পারে, সেখানে সে কি দেখালো? তরুণ সমাজ যৌনক্ষুধায় মৃতপ্রায়। আজব। ফারুকীর এই ছবি দেখে কোন শিক্ষা বা অনুপ্রেরণা কি নেবার থাকলো? মনে হয়না। বরং, একটা ছোট সমস্যাকে একশো গুণ বড় করে দেখালে সেটার গ্রহণযোগ্যতাই আরো বাড়ে। এখন যদি ইম্ম্যাচিউর কেউ ছবিটা দেখে এটা ভেবে বসে যে লিভ টুগেদার আমাদের দেশের অন্যতম কালচার, তাকে দোষ দেবারমত কিছু থাকবে না।

অনেকেই হয়তো তাদের ফ্রীক লাইফস্টাইলের এমন খোলামেলা প্রকাশটার চলচ্চিত্রায়নে বরং খুশিই হবেন। নিন্দুকেরা ইতোমধ্যেই, ফারুকী এবং তার সঙ্গীদের এই ফ্রিক গোষ্ঠীর অংশবিশেষ ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। কাজেই আমার মতামতটা এরকম, ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনার সাথে ছবিকে জড়িয়ে দর্শকদের বিভ্রান্ত করার আগে আরেকটু ভাবুন। ফারুকীর এই ছবির গ্রহনযোগ্যতা কতটুকু সেটা সময়ই বলে দিবে। কিন্তু আমি বলি, এইধরণের বাণিজ্যিক ছবি তৈরি না করে সম্ভাবনার কোন ছবি তৈরি করলে সেটার গ্রহণযোগ্যতা কি বাড়বে না? রস দেখার জন্য কেউ হলে গিয়ে ফারুকীর এই ছবি দেখবে না।

তাদের হাতে এর চেয়ে খোলামেলা অনেক অপশন আছে। তাহলে ছবিটা দেখতে যেতো কারা? আমাদের মত মানুষ, যারা একটা ভালো, ব্যতিক্রমী, সম্ভাবনাময় ছবি দেখতে আগ্রহী। ছবিতে একটু মেধার প্রতিফলন দেখতে চাওয়া এই দর্শকগোষ্ঠীকে ফারুকী হারালো তাতে সন্দেহ নেই। পাইরেট্স অব দ্যা ক্যারিবিয়ানের মত ছবির স্পেশাল ইফেক্টস টিমের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশী বংশদ্ভূত একথা ভেবে যখন গর্বিত হয়, তখনই দু:খ লাগে যে এইসব মেধাবীদের আমরা আমাদের চলচ্চিত্রে পাই না। ফারুকী স্বস্তা পপুলারিটির মোহ কাটিয়ে আমাদের উপহার দিক অন্যরকম কোন একটি ছবির।

যেখানে ভাড়ামী আর ন্যাকা ন্যাকা ডায়ালোগে ঠাসা ঢঙ্গী কেউ থাকবে না। থাকবে এমন কেউ, যাকে দেখা আমাদেরও স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করবে। ফারুকীর মতো লোকদেরই সম্ভব এরকম ছবি তৈরি করতে। আমরা তো আর স্পেশাল ইফেক্টসে ঠাসা ছবি চাচ্ছি না। চাইছি ছবিতে একটু মেধার প্রতিফলন, যেখানে থাকবে স্বপ্ন আর সম্ভাবনা, যেই ছবি দেখে আমিও বাঙ্গালী হিসেবে গর্ব বোধ করতে পারি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.