আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাদাম তুসের গল্প

পঙ্খিরাজে চাদেঁর দেশে
লন্ডনে মাদাম তুস পর্যটকদের কাছে সবচে’ আকর্ষণীয় স্থান। প্রতিবছর ১০ মিলিয়ন (এককোটি) বিদেশী পর্যটক দেখতে আসেন। এই অদেখাকে দেখার আকর্ষণ সবার অন্তরে। কিন্তু লন্ডনে আসার পর ভ্রমণের মন যেন কেমন হয়ে গেছে। এখানে কর্মব্যস্ততার স্রোতে প্রবাহমান।

আমি অবশ্যি কর্ম ব্যস্ততা মনে করিনা। অধিকাংশ মানসিক অস্থিরতা। মানুষ কর্ম-ব্যস্ততার চেয়ে মানসিক অস্থিরতায় পর্যদস্ত। লন্ডনে আসার পর বাংলাদেশে দু’বার গিয়েছি। প্রত্যেকবার আমার চাচা শাহ্ মোঃ মখলিছুর রহমান জিজ্ঞেস করেছেন মাদাম তুস কি গিয়েছি? চাচাকে খুশি করার জন্য প্রথমবার বলেছি ‘টাওয়ার অব লন্ডন’ গিয়েছি।

দ্বিতীয় বার বলেছি বৃটিশ মিউজিয়ামে গিয়েছি। তিনি একটু আক্ষেপের সুরে বলেছেন তুমি ও তাদের মত হয়ে যাবে! অর্থাৎ আমাদের আত্মীয়-স্বজন যারা। প্রবাসে বৃত্তের বশে আছেন। তবুও মাদাম তুস দেখার কোন সমূহ আগ্রহ ছিল না। দেখব দেখব ভাব ! কিছুদিন থেকে সিকিউরিটি কাজে নিয়োজিত হয়েছি।

ফিফটি ফাইভ বেকার স্ট্রীটে মাঝে মাঝে আমার কাজ থাকে। যখন বেকার ষ্টীট আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে বের হই মেরিলিবোন রোডে একটি ডোম চোখের সামনে পড়ে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় মাদাম তুসাড লেখা। এভাবেই দেখার ইচ্ছে জাগে! শনিবারে অর্ধদিবস কাজ ছিল। আগের দিন থেকে মনস্থির করেছি কাজ শেষে মাদাম তুস যাব।

যেমন চিন্তা তেমন কর্ম। কাজ থেকে তিন চার মিনিটের রাস্তা। দুপুরবেলা ভেবেছিলাম দর্শনার্থীর ভীড় কম থাকবে ! কিন্তু গিয়ে দেখি মেইন রাস্তার ফুটপাতে দিয়ে দর্শনার্থীদের লম্বা লাইন। আমার কাছে মনে হল এত মানুষ কখন ভিতরে ঢুকবে আর আমি সুযোগ পাব ! তবু লাইনের পিছনে দাঁড়াই। কিছু সময় পরে দেখি আমি একা নই।

আমার পিছনে শ’খানেক মানুষ। ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে মাদাম তুসাড’র টিকেট হলে প্রবেশ করি। সেখানে প্রবেশ করে সামনে যাব, না পিছনে যাব কোন হিসাব পাচ্ছিনা। যেদিকে চোখ যায় মানুষ সাপের মত আকাঁ-বাঁকা লাইন ধরে মন্থর গতিতে যাচ্ছে। টিকেট কাউন্টার কতদূর অনুমান করা যাচ্ছেনা।

একটু পরে দেয়ালে লেখা দেখি এখান থেকে একঘন্টার কাছাকাছি সময় লাগে টিকেট সংগ্রহ করতে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে লাইন এঁকে বেঁকে গিয়ে সিঁড়ি প্রথম তলায় উঠে। সেখানে কয়েক বক্ররেখা পেরিয়ে কাউন্টারের দেখা মিলে। তবে মানুষের ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়। দু’ঘন্টার মত লাইনে থেকে টিকেট সংগ্রহ করে।

কেউ কারো সামনে যেতে চায়না। যদিও যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে। আমার দেখামতে দীর্ঘ লাইনে কোন নিরাপত্তা কর্মী ছিল না। প্রথমে কেবল একজন সিকিউরিটি প্রত্যেকের ব্যাগ চেক করেছে। কাউন্টারের সামনে গিয়ে বলি কতগুলি টিকেট কাউন্টার ? একজন মহিলা বলে এখানে ছয়টি অন্যখানে দু’টি।

আমি বল্লাম নিতান্ত বিশটি কাউন্টার রাখা উচিত। সে বলে ভবিষ্যতে হয়তো হবে। তবে বর্তমানে ফোনে বা অনলাইনে ও টিকেট বুকিং করতে পারেন। পচিশ পাউন্ডে টিকেট সংগ্রহ করে ভিতরে প্রবেশ করি। প্রথমে যে রুমে প্রবেশ করি এটি হচ্ছে গার্ডেন পার্টি।

পৃথিবীর বিখ্যাত সেলিব্রেটিরা সেখানে রয়েছেন। ইন্ডিয়ান মিউজিক চলছে। মানুষের ভিড় যেখানে স্বভাবত সেখানে চোখ চলে যায়। এই ভিড়ের মধ্যে দেখি বলিউডের তিন তারকা ঝলমল করছেন। স্টেইজের মধ্যখানে বলিউডের বাদশা শাহরুখ খান তার ডানে ঐশ্বরিয়া রায় ও বামে অমিতাব বচ্ছন।

ঐশ্বরিয়া রায় মেরুন রংঙের শাড়ী পড়ে ডান হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। শাহরুখ খান সুট-বুট পরে মাথা একটু বাম দিকে পিরে তাকিয়েছেন। আর বলিউডের রাজমুকুট অমিতাভ বচ্ছন কালো শেরওয়ানী পড়ে কাঁধে নঁকশি চাদর দিয়ে হাসিমুখে সবার দিকে তাকিয়ে আছেন। একে একে বা গ্র“প বেঁধে তাদের সাথে ফটো তুলতে দর্শক ব্যস্ত। হলিউডের তারকাদের পাশে ও এত ভীড় নয়।

শাহরুখ খান মাদাম তুসাড’র নতুন সংযোজন। ডোমের বাইরে দুদিকে বড় করে তার ফটো লাগানো। কখনো মনে হয় কোন ফ্লিমের পোষ্টার। কাছে গিয়ে দেখলে বুঝা যায় কিছু দর্শক তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ইংরেজীতে লেখা স্টার শাহরুখ খান নাউ লাইভ এট মাদাম তুসাড।

প্রবেশ দ্বারের কাছে ডেভিড বেকহাম তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়াকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুদূরে স্পাইডার ম্যান এবং অন্যপাশে মাইকেল জ্যকশন গানের ভঙ্গিমায় মাউথপিস হাতে। কালো চশমা পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর্নল্ডশস নিগার। তার পিছনে ‘ফেইস অফ’ ফিল্মের একটর নিকোলাস কেইজ লম্বা মটর বাইক সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যদিকে এক কর্ণারে এন্ট ও ডেক দু’টি চেয়ারে উপস্থাপনার ভঙ্গিতে বসেছেন।

তাদের মধ্যেখানে একটি চেয়ার। দর্শকরা চেয়ারে বসে তাদের সাথে ফটো তুলছেন। আরো অনেক সেলিব্রেটি সেখানে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় আছেন। প্রতিমূর্তি আর মানুষের মধ্যে তফাৎ বুঝা যায় না। এ যেন পরিপূর্ণ মানুষের আকৃতি।

ফটো তুলার জন্য পাশে দাঁড়ালে বুঝা যায় না কে জীবন্ত আর কে প্রতিকৃতি। সাবধানে চিন্তা করতে হয়। তাড়াহুড়া করলে ভুল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। আমার বেলায় শুধু তা নয়! সকলের জন্য প্রজোয্য। আমি একটি প্রতিমূতির কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর নাম জন্ম তারিখ প্রভৃতি দেখছি।

একজনতো আমাকে প্রতিমূর্তি মনে করে চেয়ে আছে। আমি মাথা তুলে দেখি দর্শকের অপলক দৃষ্টি আমার দিকে। আমি হাসতেই কিছুটা লজ্জিত মনে চলে যায়। রুমের কোণে বা মেঝেতে প্রতিমূর্তি রাখা। হঠাৎ দেখে মনে হয় এখানে এই লোক একা কেন ? পরে দেখা যায় জীবন্ত নয় প্রতিকৃতি।

সেখানে ঘন্টাখানিক বিচরণ করে এসব অবলোকন করি। কেউ প্রিয় নায়ক নায়িকা জড়িয়ে ফটো তুলে চুমু দিয়ে। আবার কেউ স্বাভাবিক ভাবে তুলে। সেলিব্রেটির রুম পেরিয়ে আসি খেলার জগতে ‘স্পোর্টিং গ্রেটস হল’। ক্রিকেটার শ্যান ওয়ান ও ব্রায়ন লারা পাশাপাশি।

লারা ব্যাট কাঁধে তুলে দাঁড়ানো। তাদের পরে ফুটবল তারকা ওয়াইন রুনি অট্রহাসি দিয়ে চেয়ে আছে। তার পাশে মাইকেল ওয়েন দাঁড়ানো। সাবেক ফুটবল তারকা ও বর্তমানে টিভি উপস্থাপক গেরিলিনিকা মাউথপিস হাতে একপাশে। মুষ্টিযুদ্ধের অমর নায়ক মোহাম্মদ আলী দু’হাতে গ্লাভ পরিহিত মুষ্টিযুদ্ধের ভঙ্গিতে।

তাঁর সামনে একটি ফুটবলের উপর বসে আছেন ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তী পেলে। রাগবি স্টার জনি উইকিন্সন একদিকে দাঁড়িয়ে। অলিম্পিক দৌঁড়ে চ্যাম্পিয়ান বৃটেনের লিনফোর্ড ক্রিস্টি, বিশ্ব রেইসিং চ্যাম্পিয়ান দ্য সিলভিয়া সাইকেলের উপর। বিভিন্ন ক্রিড়া নৈপূন্যের কৃতিমান ব্যক্তি এখানে প্রত্যেকের পারর্ফমেন্স ভঙ্গিতে আছেন। ক্রীড়া জগত পেরিয়ে আসি রাজ পরিবারের সদস্যদের কাছে।

একটা স্টেইজে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ দাঁড়িয়ে আছেন। বামপাশে তার স্বামী ডিউক অব এডিংবরা দাঁড়িয়ে। স্টেইজের নিচে ডানে রাণী মাতা এবং বায়ে কুইন ভিক্টোরিয়া। রাণী মাতার একটু সামনে সদা হাস্যোজ্জল ডায়না। রাণী ভিক্টোরিয়ার একটু সামনে প্রিন্স চার্লস ও ডানে বড় চেলে উইলিয়াম বামে ছোট ছেলে হেনরি।

এখানে দর্শনার্থীদের প্রচুর ভীড়। বিশেষত রাণীর পাশে ফটো তুলার জন্য। রাণীর সামনে স্ট্যান্ডবাই ক্যামেরা নিয়ে মিউজিয়ামের একজন সদস্য আছেন। রাণীর কাছে যে যান তার ফটো তুলেন। একটি রিসিট দিয়ে বলেন ফটো সংগ্রহ করতে।

তাতে খরচ হয় সাত পাউন্ড। দ্যা ওয়াল্ড স্টেইজ ফটো ডেস্ক থেকে সংগ্রহ করা যায়। অথবা ‘দ্য স্পিরিট অফ লন্ডন রাইড’ চড়ার পরের স্থান থেকেও সংগ্রহ করা যা। ইচ্ছে করলে টি শার্টে, ব্যাগে, মগে, পোষ্টারে, কী রিংগে মাউস ম্যাটে ও নিজের ফটো তুলা যায়। আমার নিজের ক্যামেরা দিয়ে মাদাম তুসাড’র কর্মী ও অন্য দর্শকদের দ্বারা রাণীর সাথে কয়েকটি ফটো তুলি।

রয়েল ফ্যামেলি পরে কবি সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীদের স্ট্যাচু রাখা হয়েছে। ইংরেজী সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ উইলিয়াম সেক্সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) এক পাশে রোলিং কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে। সামনে অস্কার ওয়াইল্ড (১৮৮৫-১৯০০) দাড়িয়ে আছেন। তিনি প্লে রাইট এবং পয়েট। তাদের কাছে বিসেন্ট বান গগ, (১৮৫৩-১৮৯০) বিখ্যাত আর্টিস্ট।

অন্যপাশে লম্বা দাড়ী মুখে চারলেস ডারউন (১৮০৯-১৮৮২) বিজ্ঞানী। বানর থেকে মানুষের সৃষ্টি তার বিতর্কিত মতবাদের জন্য বিশ্বের মানুষের কাছে বেশি পরিচিত। উস্ককুষ্ক সাদা চুল মাথায় গাণিতিক এলবার্ট উইনস্টন (১৮৭৯-১৯৫৫)। তার কাছে মধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিস্কারক পদার্থ বিজ্ঞানী ও গাণিতিক স্যার ইসাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)। তাদের পাশ ঘেষে একটু এগুলে দেখা যায় বিশ্বরাজনীতির নেতৃবৃন্দ।

‘ওয়াল্ড লিডারস’ মঞ্চে দাঁড়ানো বুশ, ব্লেয়ার’র মধ্যখানে ডায়েস। দর্শনার্থীরা ডায়েসে হাত রেখে বক্তব্যে রাখার অভিনয়ে ফটো তুলছেন। তাদের কিছু পিছন দিকে দাঁড়িয়ে আছেন বৃটেনের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী মারগরেট ট্যাচার। তিনি (১৯৭৯-১৯৯০) এগারো বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার পাশে আছেন আমেরিকার ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান (১৯১১-২০০৪)।

তাদের একটু পিছনে ধূতি পরিহিত কিছুটা বাঁকা হয়ে গল্লায় ভর দিয়ে দাঁিড়য়ে আছেন ভারতের মোহন চাঁদ করম চাঁদ মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) এবং তার পাশে সুযোগ্য মেয়ে ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী (১৯১৭-১৯৮৪)। তিনি ১৯৬৬-১৯৭৭ ও ১৯৮০-১৯৮৪ দুই টার্মে পনের বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই সারির সর্বশেষ পাকিস্থানের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভূট্টো (১৯৫৫-২০০৭)। তিনি ১৯৮৮-১৯৯০ ও ১৯৯৩-১৯৯৬ দুই টার্মে পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি সবুজ কামিজ পরে মাথায় সাদা স্কার্প দিয়ে দু’হাত সামনে একত্র করে দাঁড়িয়ে আছেন।

তাদের সামনে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছেন কঠিন মানব এডল্ফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫)। আমার কাছে মনে হয় মানুষ তাকে যতটা ঘৃনা করার কথা, তারচে’ বেশি শ্রদ্ধা করে। অবশ্যি সাহসের জয়, চিরদিন হয়। একসাদা বৃদ্ধমহিলা খুশিতে বগবগ হয়ে বলেন, আমার স্বামীর সাথে একটি ফটো তুলে দাও ! আমি কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। তার সাথে যে লোক সে স্বামী হবার কথা নয়।

বয়সে অনেক ছোট। ক্যামেরা হাতে দিয়ে হিটলারের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায়। আমার বিভ্রান্তির বেড়াজাল চিহ্ন হয়ে যায়। উইনস্টন চারচিল’র (১৮৭৪-১৯৫৬) প্রতিমূর্তি হিটলারের পাশে দেখে আশ্চর্য লাগে। তিনি (১৯৪০-১৯৪৫) বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

তবে কি মর্তলোকে তাদের শক্রতা থাকলেও পরজীবনে মিত্রতার হাত বাড়িয়ে পাশাপাশি থাকবেন ! চারচিল ১৯৫৩ সালে সাহিত্য নোবেল পুরুস্কার পান। এই বিশ্বনেতৃবৃন্দের অন্যদিক থেকে শুরু করলে প্রথমে আসেন ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট জলপাই রঙের পোশাকে ইয়াসির আরাফাত (১৯২৯-২০০৪)। সামরিক পোশাকে সংগ্রামী সৈনিক সাদ্দাম হোসেন (১৯৩৭-২০০৬)। ‘লৌহ মানব’ শিরোনামের কবিতায় তাঁেক নিয়ে লেখেছি; তুমি ছিলে সত্য সবাক দ্বীপ্ত লৌহ মানব/ তোমার ভয়ে ধরার বুকে কাপঁত যত দানব। সত্য ন্যায়ের অগ্রপথিক সাহসী একবীর/ ভয়কে সদা জয় করেছ নত করনি শীর।

ফাঁসির কাষ্ঠে প্রান দিয়েছ পাওনি কোন ভয়/ বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছে তোমার জয়। হাসি মুখে ফাঁসির রশি নিয়েছ তুমি গলে/ মরিয়াও অমর তুমি সবার কাছে হলে। এরপর চায়নার পঞ্চম প্রেসিডেন্ট জিয়ান জেমিন। তার শাসন কাল (১৯৯৩-২০০৩) দশ বছর। তাদের পাশে রিপাবলিকান টারকি প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট কামাল আততারক (১৮৮১-১৯৩৮)।

তার শাসনকাল (১৯২৩-১৯৩৮) পনের বছর ছিল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ১৯৯৩ নোবেল শান্তি পুরুস্কার বিজয়ী কালো মানুষের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি সাউথ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট (১৯৯৪-১৯৯৯)। তাদের পরে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্টদের প্রতিমূর্তি। প্রথমে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৬৯-১৭৯৭) তার শাসন কাল ছিল ২৮ বছর।

তিনি কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাশে চেয়ারে বসা কালো দাড়ি মুখে আব্রাহাম লিংকন (১৮০৯-১৮৬৫)। যার গণতন্ত্রের সংজ্ঞা সর্বজন স্বীকৃত ও জনপ্রিয়; গার্ভম্যান্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল এন্ড বাই দ্য পিপল। এরপর জন এফ কেনেডি আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট (১৯১৭-১৯৯৩) প্রমূখ উল্লেখযোগ্য। বিশ্বনেতৃবৃন্দের পাশ কেটে সিড়ি বেয়ে নামলে আসে দ্য চেম্বার লাইভ’ লাইভ একটরস্ ডু নট টাচ ! এই চেম্বারে প্রবেশের পূর্বে বিভিন্ন শতাব্দীতে মানুষের উপর অত্যাচারের নির্মম দৃশ্য স্ট্যাচুর মাধ্যমে রাখা হয়েছে।

প্রথমে অষ্টম শতাব্দীর সূচনা লগ্নে মাথা নিচে দিয়ে হাতে পায়ে পেরেগ মেরে হত্যার একটি দৃশ্য। একটু পরে ১৭শ শতাব্দীতে একটি লোমহর্ষক দৃশ্য। চেয়ারে বসিয়ে পেছনে হাত বেঁধে গলায় লোহার শিকল চেপে হত্যা। অন্যদিকে ষোল্ল শতাব্দীতে গলায় রশ্মি বেঁধে ঝুলিয়ে ফাঁসির দৃশ্য রাখা হয়েছে। আরো অনেক ভয়ংকর দৃশ্য দেখে গা শিউরে উঠে ! যেন পাষাণ মৃত্যুপুরী।

এসব দেখতে দেখতে ‘দ্য চেম্বার লাইভ’র প্রবেশদ্বার আসে। দশজন করে দু’তিন মিনিট পরপর পাস দেয়া হয়। প্রবেশের সময় ভুতুড়ে দ্বার রক্ষক সংক্ষিপ্ত সংলাপ বলে তার চোখে মুখে কালো দাগ। গালে রক্তের প্রলেপ। ‘এখানে প্রবেশ করলে জীবনের নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করবে।

জীবন্ত ভূত ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু স্পর্শ করতে পারবেনা। কোন হৃদরোগী বা গর্ভবতী প্রবেশ করবে না। আমার কথা বুঝলে ? ভুতুড়ে লোক চিৎকার করে বলে। প্রবেশ করতে বিভিন্ন রকমের ভয়ানক শব্দ ভেসে আসে।

মাঝে মাঝে ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে যায়। অন্ধকার সরু আকা-বাকা পথ। ভয়ার্ত শব্দে চারদিকে আর্ত মরণ চিৎকার। অকৃত্রিম মনে হলে ও সবকিছু কৃত্রিম। হঠাৎ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে সাদা কাপড় মোড়া ভয়ংকর দানব।

হু করে মুখের সামনে এসে আবার চলে যায়। অন্ধকারে এরকম দৃশ্য নির্মল আনন্দের পরিবর্তে ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। মেয়ে দর্শকরা ভূতের আগমনে অহরহ চিৎকার করে। ভূতগুলি ও সুযোগ বুঝে তাদের কাছে আসে। আমার গ্র“পে অধিকাংশ মেয়ে ছিল।

তারা দু’একবার ভূতের আগমনে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে যায়। আমি তাদের সামন দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। তারা পিছন আসে। তখন আর ভূতগুলি আসে না। আমি বলি, তোমরা আগে যাও।

তারা যেত রাজি হয় না। আমি ও দাঁড়িয়ে থাকি। অন্ধকারে বিদঘুটে শব্দ। তারা বাধ্য হয়ে সামনে গেলে আবার ভূতের লাফঝাপ শুরু হয়। তাদের চিৎকারে চিৎকারে একসময় ‘দ্য লাইভ’ থেকে বেরিয়ে আসি।

ভূতুড়ে নগরী পেরিয়ে আসি মাদাম তুসাড’র মূল গল্পে। মাদাম তুসাড’র কর্মবর্ণ পরিচয় সব তুলে ধরা হয়। এভাবে ‘এখানে একজন অসাধারণ রমনীর গল্প..... যিনি নিজেকে একটি প্রর্দশনীতে পরিণত করেছেন। অর্থাৎ ,মাদাম তুসাড প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার মূল নাম মেরী গ্রজহোলজ।

১৭৬১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক্তার ফিলিপ কার্টিয়াসের বাড়িতে তার মা কেয়ারটেকারের কাজ করতেন। ফিলিপ মুর্তির ভাস্কর্য তৈরী করতেন। মেরী ফিলিপ’র কাছে ভাস্কর্য তৈরীর কাজ শিখেন। তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ডাক্তার ফিলিপের মৃত্যুর পর তৈরী মূর্তিগুলি মেরী উত্তরাধিকার সূত্রে প্রদর্শনের দায়িত্ব পান। ফ্রান্সের ইঞ্জিনিয়ার ফ্রান্সকোয়িস তুসাড’র সাথে মেরী বিবাহে আবদ্ধ হন। ফলে মাদাম তুসাড নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৮৩৫ সালে বেকার স্ট্রীটে মিউজিয়াম স্থাপিত হয়। ১৮৫০ সালে ১৫ এপ্রিল ৮৯ বছর বয়সে মাদাম তুসাড মৃত্যু বরণ করেন।

সেন্ট মেরী চার্চে তাকে সমাধি করা হয়। ১৮৮৪ সালে মিউজিয়াম মেরিলিবোন রোডে বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৮৯ সালে মাদাম তুসাড’র প্রপৌত্র জনথিয়োডোর মিউজিয়াম'কে পাবলিক কোম্পানী ঘোষণা করে চীপ আর্টিষ্ট নিযুক্ত হন। মাদাম তুসাড নামে নিউইয়র্ক, লাসভেগাস, হল্যান্ডের আমস্টার্ডাম ও হংকং মিউজিয়াম রয়েছে। কিন্তু লন্ডনের মাদাম তুসাড দর্শকদের সবচে’ আকর্ষণ ও খ্যাতি বিশ্বজুড়া।

এই রুমের অন্যপাশে ভিডিও প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেখানো হয় কিভাবে সেলিব্রেটিদের মাপ নেয়া হয়। কিভাবে চুল বসানো হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কিভাবে মূর্তি তৈরী করা হচ্ছে। প্রতিটি মূর্তি তৈরীর খরছ হয় বিশ হাজার পাউন্ড। মোম দিয়ে মূর্তি তৈরী করা হয়।

সময় লাগে ছয়মাস। চুল স্থাপনে পাঁচ সপ্তাহ লাগে। প্রতিটি মূর্তি শতকরা দু’ভাগ মূল উচ্চতা থেকে উচুঁ। জীবিত কারো মূর্তি তৈরী করতে শরীরের ১৫০টি ভাইটাল স্থানের এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাপ নেয়া হয়। তাতে প্রায় দু’ঘন্টা সময় লাগে।

মৃত কারো মূর্তি তৈরী করতে কাপড় চোপড়ের মাপ এবং ছবি দেখে প্রতিমূর্তি তৈরী করা হয়। তবে মাদাম তুসাড এ কারো মূর্তি স্থায়ী নয়। প্রতিমাসে কর্তৃপক্ষ রিভিউ মিটিং করে মূর্তিদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। কারো জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে প্রতিকৃতি সরিয়ে গুদামে রাখা হয়। তবে অনেক আছে সব সময় জনপ্রিয়, তাদের সরানো হয় না।

ফলে দু’তিন বছর পূর্বে মাদাম তুসাড পর্যটকদের বর্ণনার সাথে বর্তমানের যথেষ্ট তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। ‘দ্য স্পিরিট অব লন্ডন রাইড’ আরোহণের পূর্বে একটি লাইব্রেরী রয়েছে। সেলফে বড় বই রাখা। কিন্তু বইগুলি ও মূর্তির মত। প্রত্যেক রাউডে দু’জন করে বসা যায়।

লম্বায় ডি,এল, আর ট্রেনের মত হবে। মিনিট দশেক হেলে দুলে ডানে বামে কাৎ হয়ে কখনো উপরের দিকে উঠে আবার নিচের দিকে চলে। চলার দু’পাশে ইংলেন্ডের ৪শ’ বছরের ইতিহাস মূর্তির মাধ্যমে প্রদর্শিত হচ্ছে। কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে। চেয়ারে বসে টেবিলে হাত রেখে সেক্সপিয়ার পালকের কলম দিয়ে লেখায় ব্যস্ত।

তার মাথা কিছু সময় পরপর নড়ছে। ক্রিস্টোফার ওয়ারেন বিল্ডিং তৈরীর কাজ তদারক করছেন। কামান হাতে সমরাস্ত্র সহ কেউ তাকিয়ে আছে। শ্রমিকরা কাজ করছে। লন্ডন মহানগরীর ভাঙ্গা-গড়ার দৃশ্য ফুটে উঠে।

এসব দেখে দেখে রাইড থেকে নামার সময় আসে। রাইড থেকে নেমে একটু হেটে ডোমের নিচে প্ল্যানে- টোরিয়াম পৌঁছি। এটি-১৯৫৮ সালে স্থাপিত হয়। উপস্থাপক এসে সবাইকে প্রাণবন্ত করার জন্য হাততালি, হাত ডানবাম, হা-হা হি-হি করান। এরপর ডোমের ¯্র‹িনে বিভিন্ন চিত্র দেখা যায়।

কিভাবে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, রাতদিন ও পৃথিবী আবর্তিত হয়। গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন। অমাবশ্যা-পূর্ণিমা চন্দ্রগ্রহণ। মহাকাশে মহাকাশযান গমন। মানুষের চন্দ্রপৃষ্টে অবতরণ।

বিস্ময়ে বিস্মিত বিচিত্র বিষয় দেখে দর্শকরা এক প্রান্থে চলে আসেন। এক্সিট এ্যারো দেখে সবাই পথ চলেন।
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।