আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আনন্দবাজার পশ্চিমবঙ্গকে কী চিলি বানাতে চাইছে?



আনন্দবাজার পশ্চিমবঙ্গকে কী চিলি বানাতে চাইছে? ১৯৭৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, চিলিতে রাষ্ট্রপতি এল সালভাদোর আলেন্দেকে খুন করে পুতুল সরকার বানিয়েছিলো মার্কিন প্রশাসন। ১৯৫৮ থেকে ষড়যন্ত্র শুরু। সরাতে হবে কমিউনিস্ট আলেন্দেকে। ১৯৬৪-র নির্বাচনে ১০০টি আমেরিকান সংগঠন আলেন্দে-বিরোধী কাজে অংশ নিয়েছিলো। আমেরিকান কংগ্রেসের একটি রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছিলো — ‘‘চিলির সেই নির্বাচনে ২০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছিলো।

রেডিও, চলচ্চিত্র, খবরের কাগজ, চিত্রাঙ্কন প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই কুৎসামূলক প্রচার চালানো হয়েছিলো POPPINSXI-এর নামে পোস্টার, লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিলো খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে। মার্কিন কংগ্রেসের ঐ রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছিলো ‘‘১৯৬৪-র জুনের তৃতীয় সপ্তাহে তীব্র প্রচার চালানো হয়েছিলো। CIA-এর মদতপুষ্ট প্রচারকারী দলগুলি সান্টিয়াগো রেডিওতে দিনে ২০ বার প্রচার চালিয়েছিলো এবং ৪৪ বার করে প্রতিদিন চিলির প্রত্যন্ত প্রান্তের রেডিওতে প্রচার করতো। প্রতিদিন রেডিওতে ৫ বার করে ১২ মিনিটব্যাপী আলেন্দে-বিরোধী খবর সম্প্রচার করা হতো সান্টিয়াগোতে এবং ২৪টি প্রান্তীয় রেডিও স্টেশনগুলিতে। কেন এই কাজ করেছিলো CIA-কে দিয়ে মার্কিন প্রশাসন? কারণ চিলির তামার খনিগুলো চাই মার্কিন কোম্পানিগুলির।

খনিজ সম্পদে ভরপুর চিলিতে সার্বভৌম, স্বাধীন, স্বনির্ভর কমিউনিস্ট সরকার চিলির সম্পদ তুলে দিতে রাজি ছিলো আমেরিকার হাতে। এই পর্যন্ত পড়ে কিছু কি মিল পাচ্ছেন পাঠকবৃন্দ পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের সঙ্গে যার শরিক মিডিয়া নামক কুখ্যাত স্বর যন্ত্রটি। যদি এখনও মিল খুঁজতে অসুবিধা হয় তাহলে আসুন একটু ফিরে নজর দিই কতগুলি ঘটনার দিকে। বিশ্ব মিডিয়াজগতের সম্রাট, হিসাবে পরিচিত নিউজ কর্পোরেশনের মালিক রুপার্ট মার্ডক। যার সাম্রাজ্যে এখন অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল ও ম্যাগাজিন।

সরকারীভাবে তার এই ব্যবসার মুনাফার পরিমাণ ২১০০ কোটি মার্কিন ডলার। বাণিজ্য মহলে প্রচলিত কথা মারডকের মুনাফার হিসেব করতে নেই। শুধু কি তাই? তিনি নিজেকে দাবি করেন উদারনীতিবিদ হিসেবে। উদারনৈতিকতা বলতে উনি বোঝেন ‘যথা সম্ভব বেশি ব্যক্তিগত দায়িত্ব, যথা সম্ভব কম সরকার, যথা সম্ভব কম নিয়ম-কানুন। ’ এই উদারনীতির মতাদর্শ গোটা বিশ্ব মিডিয়া জগতে ব্যবহারেই তিনি মিডিয়া সম্রাট।

এশিয়ায় তার সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যম স্টার টিভি। স্টার টিভি এশিয়ার প্রথম আঞ্চলিক উপগ্রহ টেলিভিশন। ১৯৯১ সালে হঙকঙে শুরু। স্টার-এর মালিকানার শেয়ার কেনার মধ্য দিয়ে এশিয়ায় প্রবেশ। এশিয়ার স্টারকেও নিজের মহিমায় বাজার, উদারনীতির মতাদর্শে পরিচালিত করেন তিনি।

ভারতে স্টার টিভি’র রমরমা ১৯৯৪ সালে। ২০০৩ পর্যন্ত স্টার সামলাচ্ছিলো নিউ দিল্লি টেলিভিশন। সেই সম্পর্ক ভেঙে যাবার পর স্টার নিজেই সংবাদ চ্যানেল শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারী বিধি নিষেধ, সরকারী অংশীদারিত্ব ৫০ শতাংশের বেশি থাকলে সংবাদ চ্যানেল তৈরি করা যেত না। বহু টানাপড়েনের পর রুপার্ট মার্ডককে খুঁজতে হয়, এমন একজন অংশীদার ভারতীয় হিসাবে যার অধিকাংশ শেয়ার থাকবে।

অথচ চিন্তায়, মননে, কর্মপদ্ধতিতে মার্ডকের পথেরই তিনি শরিক খুঁজে পেলেন আনন্দবাজার পত্রিকা লিমিটেডকেই। বিশ্ব মিডিয়া জগতের সম্রাটের কলকাতার পার্টনার। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাসের একটি ছোট ঘটনা মনে করিয়ে দিতেই হচ্ছে। আনন্দবাজার পত্রিকার ৭৫তম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে মালিক তথা সম্পাদক অভীক সরকারের সদম্ভ বক্তব্য ছিলো — ‘আমরা পুঁজিবাদে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি মুক্ত বাজারে।

সমষ্টির প্রত্যাশায় নয়, আমরা বিশ্বাস করি ব্যক্তি আকাঙ্ক্ষায়। আমরা যে নীতি নিয়ে চলি, তা সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিও কনজারভেটিভ বা নব্যরক্ষণশীলদের নীতি বলে পরিচিত। ’ ফলে তাঁর সেদিনের আর একটি বাক্য আমাদের মনে সামান্য বিশ্বাস উদ্রেকের অবকাশ রাখে না। তিনি বলেন, ‘‘জ্যোতিবাবুর সরকারের অনেক নীতিই আমরা সমর্থন করি না। যেমন শিক্ষা, শ্রম, ভূমিসংস্কার এবং পঞ্চায়েত।

’’ তিনি আরও জানান — ‘তাঁদের পত্রিকা শুধু এক বৃহৎ সংবাদপত্র নয়, এক বৃহৎ বাজার। ’ শুধু আনন্দবাজার নয়, রাজ্যে তথা দেশের সিংহভাগ সংবাদপত্র এবং সংবাদমাধ্যম এই দর্শনেরই অনুসারী। তারা খবর বেচে, টাইমস্লট বেচে। ফলে যে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনা করে, যেখানে ভূমিসংস্কারকে উন্নয়নের ভিত্তি ধরা হয়, পঞ্চায়েতকে গ্রামের সরকারী বলা হয়, শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা যে সরকারের অন্যতম পথও, যে রাজ্যে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক, যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দশূন্য করার পরও কয়েক হাজার শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের যাবতীয় ভার রাজ্য সরকার বহন করে, যে রাজ্যে আরও আরও কাজের সুযোগ সৃষ্টিই শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য — সেই রাজ্যে মুক্ত বাজারের ধ্বজাধারী মাধ্যম মালিকরা বামফ্রন্টকে সমর্থন করতে পারেন না। তারা রাজ্যের ছাত্র-যুব-মহিলাদের সত্তা অথবা মিছিল কিংবা কোন ধর্মঘটে বিরক্ত, সমালোচনায় সোচ্চার হতে পারে।

কিন্তু ‘বিদ্বজ্জন’, ‘স্বজন’-এর মিছিলের পরিপ্রেক্ষিতে তারাই সম্পাদকীয় লিখতে পারেন — সেই সম্পাদকীয় আমরা পেয়ে যেতে পারি Politics of apolitics — শাসকশ্রেণীর বহু পরিচিত গোপন, আপাত নিরীহ কিন্তু জঘন্য অস্ত্র ২০০৭-এর মার্চ এরপর সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে লেখা হয় — ‘(এই) মহামিছিলে সম্ভবত তেমনই এক সন্ধিক্ষণ। এমন স্বতঃস্ফূর্ত বিশাল রাজনৈতিক প্রভাব বিবর্জিত নাগরিক মিছিল কলকাতা শহর আগে দেখে নাই। ’ খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই দেশ পত্রিকা সাম্রাজ্যবাদ, বাজার অর্থনীতি, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শ্রমিকশ্রেণীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে ‘শিল্প বিপ্লবের সময় শোষিত হয়েছে সেই শ্রমিক। তখন প্রয়োজন ছিলো আইন দ্বারা নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির, প্রয়োজন ছিলো ধর্মঘটের। ২৪ ঘণ্টা নাগরিকের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীলতার যুগে তা কি আর চলতে পারে।

’ বামফ্রন্ট এবং রাজ্যের বামপন্থী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্পর্কে অপপ্রচারের উদাহরণ অসংখ্য এবং সেই কাজের স্বার্থে নৈরাজ্যবাদী নকশালপন্থী, বি জে পি, তৃণমূল, জামাতে উলেমা হিন্দ — কারোকে সমর্থন করতে পিছপা হয়নি সংবাদপত্র কিংবা সংবাদমাধ্যম। উদাহরণ হিসাবে নকশালবাড়ি থেকে নন্দীগ্রামের সময় পর্বের যে কোন ঘটনাকে বিচার করা যেতে পারে মরিচঝাঁপি, নকশালবাড়ি, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসু খুন, বিজন সেতুতে আনন্দমার্গীদের মৃত্যু, কাশীপুর, বরানগর গণহত্যা, বানতলার ধর্ষণের ঘটনা, ভাঙড়ের অশ্বত্থবেড়িয়া গ্রামে চম্পলা সর্দারের ঘটনা, কেশপুর-গড়বেতা-সবং-পিংলা-খানাকুলে তৃণমূলের সন্ত্রাস, আমলাশোল কিংবা নন্দীগ্রাম ১১ মাস — একের পর এক ঘটনা সাক্ষী মিডিয়ার নির্লজ্জতার প্রতিটি ঘটনার সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণে বসলে রচনা দীর্ঘ হবে। আমার লক্ষ্য তা নয়, বলাই বাহুল্য। তাই আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কর্ণধারের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ৬০-এর দশকে গ্রিসের রাষ্ট্রদূতকে বলেন ‘‘Then listen to me Mr. Ambassador, fuck your parliament and your constitution. America is an elephant. Cyprus is a flea. If these two fleas continue itiching the elephant, they may just whacked by elephants trunk, …we pay good American dollars to the Greeks, Mr. Ambassador. If your Prime Minister gives me talk about Democracy, Parliament and Constitution, he, his Parliament and his Constitution may not very long. ’’ ‘‘এই যে রাষ্ট্রদূত — আপনার সংবাদ এবং সংবিধান বাদ দিন (অশ্লীল শব্দ)। আমেরিকা হলো একটি হাতি আর সাইপ্রাস হলো একটা মাছি।

আপনারা যদি দুটো মাছি যদি হাতিকে চুলকান, তাহলে শুঁড় দিয়ে তুলে আছাড় মারবো....। আমরা গ্রিকদের অনেক টাকা দিই। যদি তোমার প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্র, সংসদ এবং সংবিধান নিয়ে আমাকে ভাষণ দেন, তাহলে তিনি এবং তাঁর সংবিধান বেশি দিন টিকবে না। ’ (তথ্য সূত্র Willing hope নামক গ্রন্থ লেখক উইলিয়াম ব্লাম) সেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে বণিকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ড রূপে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন কেন জানি না। বামফ্রন্ট সরকার চলে গেলে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর অফিসের ভাঁড়ার হয়তো পূর্ণ হবে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের গরিব-গুর্বো খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ কিন্তু বন্ধক রাখতে হবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভাঁড়াড়ে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.