আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শওকত ওসমান: বাংলাদেশের অন্যতম কথাসাহিত্যিক

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

শওকত ওসমান বাংলাদেশের একজন সব্যসাচী লেখক। তিনি ছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির সমর্থক আর স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ। রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও রাজনৈতিক মতামত প্রকাশে তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী। নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রস-রচনা, রাজনৈতিক লেখা, শিশু-কিশোর সাহিত্য সর্বত্র তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তিনি ছিলেন এক উচচকিত কন্ঠের অধিকারী। শওকত ওসমানের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সবলসিংহপুর গ্রামে। তার প্রকৃত নাম শেখ আজিজুর রহমান। ‘শওকত ওসমান’ তার সাহিত্যিক নাম।

তাঁর বাবা শেখ মোহাম্মদ এহিয়া। আর মা গুলজান বেগম। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালা ও মক্তব। এরপর তিনি ভর্তি হন কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায়।

শওকত ওসমান এই মাদ্রাসা থেকে ১৯৩৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৩৬ সালে আইএ ও বিএ ১৯৩৯ সালে বিএ পাশ করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলায় এমএ (১৯৪১) পাস করেন।

আইএ পাস করার পর তিনি কিছুদিন কলকাতা করপোরেশন চাকুরি করেন। তারপর বাংলা সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন। এমএ পাস করার পর তিনি ১৯৪১ সালে গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ অফ কমার্সে যোগ দেন। ১৯৫৯ সাল থেকে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।

এখানে তিনি ১৯৭২ সালে পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ওই বছরের শেষের দিকে তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যান। চাকরি জীবনের প্রথমদিকে প্রায় ৩ বছর তিনি ‘কৃষক’ পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেন। মূলতঃ উপন্যাস ও গল্প রচয়িতা হিসেবেই শওকত ওসমান আমাদের কাছে পরিচিত। তবে প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা, স্মৃতিকথা ও শিশুতোষ গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন।

বিদেশি ভাষার অনেক উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটক তিনি বাংলা ভাষায় ভাষান্তর করেছেন। গ্রন্থ সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা: উপন্যাসঃ জননী (১৯৫৮), ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২), সমাগম (১৯৬৭), চৌরসন্ধি (১৯৬৮), রাজা উপাখ্যান (১৯৭১), জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), দুই সৈনিক (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩), আর্তনাদ (১৯৮৫), রাজপুরুষ (১৯৯২); গল্পগ্রন্থÑ জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২), মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬), ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০); প্রবন্ধগ্রন্থÑ ভাব ভাষা ভাবনা (১৯৭৪), সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই (১৯৮৫), মুসলিম মানুষের রূপান্তর (১৯৮৬); নাটকÑ আমলার মামলা (১৯৪৯), পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৯০); শিশুতোষ গ্রন্থÑ ওটেন সাহেবের বাংলো (১৯৪৪), মস্কুইটোফোন (১৯৫৭), ক্ষুদে সোশালিস্ট (১৯৭৩), পঞ্চসঙ্গী (১৯৮৭); রম্যরচনাÑ নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত (১৯৮২) ইত্যাদি। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ ‘জননী’ ও ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাস দুটি উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। ‘জননী’তে সামাজিক জীবন এবং ‘ক্রীতদাসের হাসি’তে রাজনৈতিক জীবনের কিছু অন্ধকার দিক উন্মোচিত হয়েছে।

প্রাচীন কাহিনী, ঘটনা ও চরিত্রের রূপকে লেখক সমকালীন রাজনীতিতে স্বৈরাচারী চরিত্র ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। ‘জননী’তে গ্রাম ও নগরজীবনের সংঘাতে একটি পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থার বিবরণ আছে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত ‘নেকড়ে অরণ্য’ গ্রন্থে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলার নরনারীর নির্যাতনের করুণ বিবরণ আছে। স্মৃতিকথামূলক কয়েকটি গ্রন্থ : স্বজন সংগ্রাম (১৯৮৬), কালরাত্রি খ-চিত্র (১৯৮৬), অনেক কথন (১৯৯১), গুড বাই জাস্টিস মাসুদ (১৯৯৩), মুজিবনগর (১৯৯৩), অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ (১৯৯৪), সোদরের খোঁজে স্বদেশের সন্ধানে (১৯৯৫), মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা (১৯৯৬), আর এক ধারাভাষ্য (১৯৯৬) ইত্যাদি। স্বজন সংগ্রামে তার ব্যক্তিগত জীবন-সংগ্রামের অনেক কথা বর্ণিত হয়েছে।

অনূদিত গ্রন্থ: নিশো (১৯৪৮-৪৯), লুকনিতশি (১৯৪৮), বাগদাদের কবি (১৯৫৩), টাইম মেশিন (১৯৫৯), পাঁচটি কাহিনী (লিও টলস্টয়, ১৯৫৯), স্পেনের ছোটগল্প (১৯৬৫), পাঁচটি নাটক (মলিয়ার, ১৯৭২), ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা (১৯৭৩), পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ (১৯৮৫), সন্তানের স্বীকারোক্তি (১৯৮৫) ইত্যাদি। পুরস্কারঃ বংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬), পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক (১৯৮৩), মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৩), মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) ও আলাওল সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতিতে ভূষিত হন। তিনি১৯৯৮ সালের ১৪ মে ঢাকায় মারা যান।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।