আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উগ্র হিন্দুবাদের কবলে মুসলমানদের ইতিহাস

ফেসবুক আইডি:নাই
উপমহাদেশ বিভক্তির ঐতিহাসিক পটভূমি এবং এতে জিন্নাহ-নেহেরু-প্যাটেলের ভূমিকার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিং তার ১৫ বছরব্যাপী গবেষণামূলক বই ‘জিন্নাহ : ইন্ডিয়া পার্টিশন ইন্ডিপেন্ডেন্স' প্রকাশের পর ভারতসহ একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিকরা এতকাল ইতিহাসের নামে যে বানোয়াট কাহিনী বিশ্বাস ও প্রচার করে এসেছেন, বিশেষ করে পাকিস্তানের জনক কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে ভারতীয়রা এক নিঃশ্বাসে যেভাবে সাম্প্রদায়িক দানব বা ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছেন। যশোবন্ত সিংয়ের গবেষণামূলক তথ্য-প্রমাণ ভিত্তিক বইটি তা একেবারে উপড়ে ফেলে দিয়েছে। ফলে রাজনীতির কংগ্রেসী সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং ভারত বিভক্তির ভূমিকায় এতকালের হিন্দু মহানায়করা খলনায়কে পরিণত হয়েছেন। যশোবন্ত সিং অবশ্য ইতোমধ্যেই এমন একটি বই প্রকাশ ও তাতে নেহেরু-প্যাটেলদের খলনায়ক হিসেবে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দায়ে নিজদল বিজেপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।

এর কয়েক বছর আগে বিজেপি'র বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি পাকিস্তানের করাচীতে গিয়ে মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে অভিহিত করে নিজদলের কট্টর হিন্দুবাদি সংঘ পরিবারের ক্যাডারদের দ্বারা তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এতেও আদভানি দায়মুক্ত হতে পারেননি। সংঘ পরিবারের উগ্রবাদীরা এলকে. আদভানিকে বিজেপি সভাপতির পদ থেকেও অপসারণ করেছে। এলকে আদভানি নিজেও কট্টর হিন্দুবাদী সাম্প্রদায়িক হার্ডকোর গ্রুপের শীর্ষ নেতা। অযোধ্যার বাবরী মসজিদ ভাঙার রথযাত্রায় অন্যদের সাথে আদভানিও নেতৃত্ব দিয়েছেন।

গুজরাটের ‘কসাই' নরেন্দ্র মোদীর নৃশংস মুসলিম নিধনযজ্ঞ সত্ত্বেও আদভানিরা তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি। মুসলিম হত্যা ও নির্যাতনের পুরস্কার হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে দ্বিতীয় দফায় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বানানো হয়েছে। মহাত্মা গান্ধী ও মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উভয়েরই পূর্বপুরুষ গুজরাটের কাথিওয়ারের বাসিন্দা। বিজেপির ‘আইকন' ভারতের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলও গুজরাটি। হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক শক্তির উৎস হিসেবে গুজরাট তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সেই প্যাটেলের সাম্প্রদায়িক মুখোশ যশোবন্ত সিং খুলে দেয়ায় বিজেপি হাইকমান্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যশোবন্ত সিংকে দল থেকে বহিষ্কার ঘোষণা করেছেন। এই সিদ্ধান্ত নিতে যশোবন্ত সিংহকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেয়া হয়নি। এ থেকে মনে হয়, যশোবন্ত সিংয়ের ঐতিহাসিক তথ্য খন্ডনের কোন সুযোগ বিজেপি নেতাদের নেই। অথবা তারা যশোবন্ত সিংকে বহিষ্কারের বাহানা খুঁজছিল। বিগত নির্বাচনে বিজেপি'র হিন্দুত্বের কার্ড জনগণ প্রত্যাখ্যান করায় এমনিই বিজেপি দুর্বল ও দিশেহারা।

উপরন্তু দলের অন্যতম উদারনৈতিক নেতা রাজপুত যশোবন্ত সিংকে দল থেকে বহিষ্কার করায় বিজেপি আরও দুর্বল হবে। অটল বিহারী বাজপেয়ীর পর হিন্দুবাদী বিজেপিতে যশোবন্ত সিং অন্যতম উদারনৈতিক নেতা হিসেবে জাতীয়ভাবে ইমেজ গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। তাকে দল থেকে বহিষ্কার করায় বিজেপিতে কট্টর হিন্দুবাদীদেরই একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। অবশ্য বিজেপি একটি হিন্দুবাদী ফ্যাসিস্ট দল। তারা ভারতে হিটলারের মতো একজন হিন্দুবাদী একনায়ক চায়।

কয়েক বছর আগে বিজেপি বহুদলীয় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার বদলে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। যশোবন্ত সিংয়ের কয়েকশত পৃষ্ঠার বইটি হাতে পাওয়ার আগেই তা আদ্যোপান্ত পাঠ না করে কট্টরপন্থীরা তাকে দল থেকে বহিষ্কার করলো। এতে যশোবন্ত সিং রাজনৈতিকভাবে হোঁচট খেলেও তার বইয়ের কাটতি বেড়ে গেছে এবং বইয়ের বক্তব্যের প্রতি বিজেপির ভয়ঙ্কর অসহিষ্ণুতা এ বইয়ের মূল বক্তব্যের প্রতি উৎসাহ ও আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে অন্ধ হলেই যেমন প্রলয় বন্ধ হয় না, তেমনি বিজেপি হাই কমান্ড বইটি প্রত্যাখ্যান ও যশোবন্ত সিংকে দল থেকে বহিষ্কার করে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে মুছে ফেলতে চেয়ে নিজেরাই ইতিহাসের সত্যের কাছে ধরা পড়েছেন। যশোবন্ত সিংয়ের বহিষ্কারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নরেন্দ্র মোদী সরকার গুজরাটে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

তবে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিটও হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ বইটি নিয়ে বিজেপি অফিসিয়াল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও ক্ষমতাসীন কংগ্রেস কিন্তু প্রকাশ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। যদিও পন্ডিত নেহেরু ছাড়াও সর্দার বল্লভভাই-প্যাটেলকে কট্টর হিন্দুবাদী নেতা এবং ভারত বিভক্তির অন্যতম নাটের গুরু হিসেবে চিহ্নিত করায় যশোবন্ত সিংয়ের বইটি কংগ্রেসের জন্যও বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে ফেলে কংগ্রেস সরাসরি হিন্দুত্বের কার্ড হাতে নিতে পারছে না। তাছাড়া মুসলিম ভোট ব্যাংকের বিষয়টিও তাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে।

যদিও কান টানলে মাথা আসার মতোই সর্দার বল্লভভাই-প্যাটেলকে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির রাজনীতিক হিসেবে চিহ্নিত করায় কংগ্রেসের রাজনীতির আদি স্বরূপটাও বের হয়ে পড়েছে। কংগ্রেস ও বিজেপির রাজনীতি মুসলমানদের জন্য এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। সংঘ পরিবার বিজেপির নেতৃত্বে যখন অযোধ্যার বাবরী মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণের শিলান্যাস করা হয়, তখন কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসীমা রাও। কংগ্রেস সরকার যদি সেদিন বাবরী মসজিদ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সেনাবাহিনী দিয়ে প্রতিরোধ করতো তাহলে সংঘ পরিবারের পান্ডারা মসজিদ এলাকায় ঢুকে চতুর্দশ শতকের প্রাচীন মসজিদটি ভাঙতে পারতো না।

কংগ্রেস সরকার বাবরী মসজিদ পুনর্নির্মাণের ওয়াদা দিয়ে তাও রাখেনি। এটা করে তারা হিন্দুত্বের ভোটব্যাংক হারাতে চায়নি। গুজরাটে বিজেপি সংঘ পরিবারের কসাইদের নির্বিচার মুসলিম নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে কংগ্রেস তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। কংগ্রেস নেতারা বরং অসহায় মুসলমানদের ভোট-ক্যাশ হিসেবে ব্যবহারের প্রত্যাশায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। কার্যত ভারতীয় মুসলমানরা মৃতবৎ ও পরিত্যক্ত ‘লাইভস্টক' হিসেবে কোনমতে টিকে আছে।

‘আত্মঘাতী বাঙালি'র রূপকার নীরোদ চৌধুরী তদানীন্তন পূর্ববাংলার মুসলমানদের লাইভস্টক বা গবাদিপশুর সাথে তুলনা করেছিলেন। আধুনিক সেক্যুলার ডেমোক্রেটিক ভারতের মুসলমানদের অবস্থা ৬২ বছর পরেও বিভাগ-পূর্বকালের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। পাকিস্তানে না এসে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় মুসলমান ভারতে রয়ে গেলেও কংগ্রেস বা বিজেপি সরকারের কাছে তারা মর্যাদা ও অর্থনৈতিক মুক্তি পায়নি। ভারত সরকার গঠিত বিচারপতি সাচার কমিটির রিপোর্টেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা পাকিস্তানের জন্য ভারতের মুসলমানরা কেন আজও দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিবে? অবিভক্ত ভারতে গান্ধী-নেহেরু প্যাটেলরা ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানসহ সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব দাবি করে এসেছেন।

পন্ডিত নেহেরু বলতেন, ভারতে দুটি পক্ষ। একটি বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকার এবং অন্যটি কংগ্রেস। তবে জিন্নাহ সাহেব হুংকার দিয়ে উঠে বলেছেন, ভারতে আর একটি পক্ষ রয়েছে- সেটি মুসলিম লীগ। কিন্তু স্বাধীনতার পর ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই তারা বঞ্চিত ও পরিত্যক্ত হয়ে আসছেন। ভারত সরকার সেখানকার মুসলমানদের এমন কোন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দিতে ইচ্ছুক নয়, যা তাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে সুযোগ দিবে।

ভারতে হাজার বছরের মুসলিম শাসনের ভীতি কংগ্রেস নেতাদের আতংকিত করে রেখেছে। ইংরেজরা হিন্দুদের যোগসাজশে ভারতের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়াপত্তন করে। বৃটিশ শাসকরা মুসলিম শাসকদের নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। পলাশীতে সামরিক বাহিনীর প্রধান মীরজাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাকতায় নবাব সিরাজের পরাজয় এবং নির্মম হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতায় ভারতে মুসলিম শাসনের অবক্ষয়ের যে সূচনা হয়, তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে সিপাহী-বিদ্রোহের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে। দিল্লীর শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুরশাহ জাফরের রেঙ্গুনে নির্বাসন এবং বৃটিশ রাণী ভিক্টোরিয়ার সরাসরি দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে ভারতে মুসলিম শাসনের ওপর বৃটিশ ঔপনিবেশবাদী আগ্রাসী শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭-এর একশ' বছর ভারতের হিন্দুরা শুধু ইংরেজ শাসকদের পদলেহনই করেনি, তারা মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রশক্তি ফিরে পাবার প্রতিটি ক্ষেত্রে হিংসা-প্রতিহিংসার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তাদের এই ধারা ১৯৪৭ সালের বৃটিশ শাসনের অবসানকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কার্যত: এ উপমহাদেশের নয়া রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হিন্দুদের উত্থানের পেছনে কোন ক্ষাত্রশক্তির শৌর্য-বীর্য কাজ করেনি। নবাবের অমাত্য-দেশীয় রাজন্যবর্গ ও ধনাঢ্য হিন্দুদের ষড়যন্ত্র এবং ইংরেজ শাসকদের অনুগ্রহে হিন্দুদের উত্থান। তারই ধারাবাহিকতা বহন করেছেন আধুনিক ভারতের নির্মাতা ইংরেজী শিক্ষিত পন্ডিত জওহের লাল নেহেরু পর্যন্ত।

ভারতের সর্বশেষ ইংরেজ শাসক মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিগত সুহৃদ এবং তার সুন্দরী স্ত্রী এডুইনার প্রেমিক হিসেবে নেহেরু যে অতিরিক্ত আনুকূল্য পেয়েছেন, তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, মুঘলদের থেকে বেদখল করা দিল্লীর শাসনকেন্দ্রে ইংরেজরা তাদের বেনিফিসিয়ারী ও গুণগ্রাহী- তাঁবেদারদের স্থলাভিষিক্ত করে গেছে। ইংরেজ শাসনের পুরো পৌনে দুশো বছর তারা ভারতে তাদের অনুগত-সহযোগী মুৎসুদ্দী গোষ্ঠী হিসেবে হিন্দুশক্তির যে নিঃশর্ত ও অব্যাহত সমর্থন পেয়েছে, প্রতিপক্ষ মুসলমানদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক ভিত্তি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে হিন্দুদের যে নিষ্ঠাপূর্ণ সহযোগিতা ইংরেজ শাসকরা পেয়েছেন, তার প্রতিদান তারা কংগ্রেসের মাধ্যমে ভারত বিভক্তির সময় দিয়ে গেছে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ-র প্রতি ব্যক্তিগতভাবে বৈরীতা এবং মুসলমানদেরকে রাজনৈতিকভাবে হীনবল করার ষড়যন্ত্রমূলক ভিত্তি তৈরীতে পারঙ্গম লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ও সীমানা নির্ধারক স্যার সিরিল র্যা ডক্লিফের যুথবদ্ধ চক্রান্তের মধ্য দিয়ে একটি ‘পোকায় খাওয়া' পাকিস্তান দেওয়া হয়েছে। জিন্নাহ সাহেব স্বাধীনতার পর একদিনের জন্যও অন্তর্বর্তী-সরকারের লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে গভর্নর হিসেবে মেনে নিতে চাননি। অথচ ভারত তাকেই প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে মেনে নেয়।

কাশ্মীর নিয়ে সংকট সৃষ্টিতে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ মাউন্ট ব্যাটেনের কূটচালের সূত্রটা এখানেই। ১৯৪৭-এর পর আজ অবধি কাশ্মীরে জাতিসংঘের অধীনে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাবটি যতোবার উঠানো হয়েছে, ততেবোরই বৃটেন ভারতের পক্ষে ‘ভেটো' দিয়ে সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী করছে। কাশ্মীর ইস্যুতে বৃটেনের এই বিশ্বাসঘাতকতার ভিত্তি তৈরী হয়েছিল ১৯৪৭-এ লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও পন্ডিত নেহেরুর মধ্যকার অশুভ আতাঁতের মধ্য দিয়ে। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে এসত্যই উঠে আসে যে, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে পাকিস্তান যাতে টিকে থাকতে না পারে, আবার ভারতের সাথে মিশে যেতে বাধ্য হয়, অথবা একটি স্বনির্ভর দেশ হিসেবে টিকে থাকতে না পারে, লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন-নেহেরুর মধ্যে সে ব্যাপারে একটি অলিখিত আতাঁত ছিল। এমনকি সবগুলো অভিন্ন-নদীর প্রাকৃতিক উৎস-মুখ ভারতে পড়ার সুবিধাজনক দিকটি উল্লেখ করেও মাউন্ট ব্যাটেন পন্ডিত নেহেরুকে ভবিষ্যৎ ভারতের সুদিনের ইংগিত দিয়েছেন।

গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধসহ সবগুলো অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহের উৎসমুখে ভারত বাঁধ দিয়ে যে পানি আগ্রাসন চালিয়ে আসছে, তার দীক্ষা তারা নিয়েছেন ঔপনিবেশিক বৃটিশ রাজনীতিক-আমলাদের থেকে। পন্ডিত নেহেরু তার রাজনৈতিক সমীকরণে ভারতে মাত্র দুটি শক্তির স্বীকৃতি দিয়েছেন। একটি ইংরেজ, রাজশক্তি, অপরটি কংগ্রেস। তবে এখানেই মুহম্মদ আলী জিন্নাহ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়ে মুসলমানদের স্বীকৃতি আদায় করে ভারতে একটি নতুন রাজনীতি ও রাষ্ট্রশক্তির অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন। যশোবন্ত সিং তাই লিখেছেন: ‘‘Jinnah created something out of nothing and single handedly stood against the might of congress party and against the British:- কোন কিছু না থাকলেও এক প্রকার শূন্যহাতে জিন্নাহ বিশাল কিছু সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন এবং তিনি কংগ্রেস পার্টি ও বৃটিশদের প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

‘ভারত থেকে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিদায়ের আগে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যদি হিন্দু মুসলমানের রাজনৈতিক বিরোধের নিত্তি নিজেরাই করতে পারতেন, তাহলে উপমহাদেশবাসীকে ধূর্ত ইংরেজদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল' পলিসির বানরের পিঠাভাগের ফাঁকে পড়তে হতো না। নেহেরু প্যাটেলরা ঔপনিবেশিক শাসনের শেষদিন পর্যন্ত ইংরেজদের সাথে কলাবরেশন করে মুসলমানদের ঠকিয়েছেন। রাজনৈতিক বিচার এবং ন্যায়শাস্ত্রের নিয়মে ইংরেজদের ভারতীয় মুসলমানদের হাতেই ভারতের শাসনভার ন্যস্ত করে দিয়ে যাবার কথা। ১৭৫৭ পূর্বকালে এ উপমহাদেশে হিন্দুরা কোন রাজনৈতিক শক্তির পরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রীয় পরিচিতি অর্জন করতে পারেনি। ইংরেজ শাসনের পৌনে দুশো বছরে তারা ইংরেজ শাসকদের সার্বিক পদলেহন, আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মুসলিম রাজশক্তির বিকল্প শক্তি হয়ে উঠেছে।

ভারতে মুসলিম রাষ্ট্রশক্তি ধ্বংসে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি হিন্দুদেরকে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে তৈরি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে কোন অমুসলিম প্রতিপক্ষ না থাকায় ইংরেজরা কেন্দ্রীয় তুর্কী খেলাফতের বিরুদ্ধে স্থানীয়দেরকে ভাষা ও গোষ্ঠীভিত্তিক চেতনায় প্ররোচিত ও সংগঠিত করে তুর্কি শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিস্তার ঘটিয়েছে। ভারতে তারা হিন্দুদের মুসলিম বিদ্বেষ ও তাদের প্রভু শক্তির ওপর আধিপত্য বিস্তারের গোপন অভিলাষকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ দাঁড় করিয়েছে। আজও এ উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অর্জন দুর্বল ও ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ইঙ্গ-মার্কিন চক্র ভারতের অন্তর্ঘাতী ষড়যন্ত্রে দোসরের ভূমিকায়। একে আরও সর্বগ্রাসী ও বেগবান করার জন্য পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মুসলমানদের আজন্ম প্রতিপক্ষ আন্তর্জাতিক যায়নবাদী ইসরাইল।

বাংলাদেশে বিগত ১/১১-এর যে অভিঘাত এসেছে, তার পেছনে ব্রিটেন-ভারতের যূথবদ্ধ উস্কানি ও তৎপরতায়ও তার প্রমাণ রয়েছে। ইতিহাসের বিচারে ১/১১-এর ষড়যন্ত্র এদেশের মানুষের জন্য আর একটি পলাশীর বিপর্যয়। এখানেও সেনাপ্রধান দেশের বিপক্ষে বিদেশী চক্রান্তের নাটের গুরু পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে মীরজাফরী ধারায় একটি তাঁবেদার সরকারকে ক্ষমতার দৃশ্যপটে আনা হয়েছে। ব্রিটিশ কূটনীতিক আনোয়ার চৌধুরী এবং ভারতীয় কূটনীতিক পিনাক রঞ্জনরা যা চেয়েছেন, বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতি সেভাবেই বিন্যাস হয়েছে।

এ উপমহাদেশের অপর মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানও ইঙ্গ-ইসরাইলী চক্রের ষড়যন্ত্র অন্তর্ঘাতের শিকার। আমেরিকানরা পাকিস্তানের জ্বলন্ত আগুনে খৈ ভাজা খাচ্ছে। ভারত বিভক্তির জন্য জিন্নাহ, মুসলিম লীগ বা মুসলমানরা দায়ী নন, এটা ইতিহাসের স্বীকৃত সত্য। ভারত বিভাগের পূর্বাপর ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের যে কোন বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নে এটা প্রতিষ্ঠিত হবে। কেবলমাত্র হিন্দুত্বের গরিমাধারী কংগ্রেস ও বিজেপি নেতারা এটা অস্বীকার করে জিন্নাহ ও মুসলিম লীগকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উদ্ভাবক ও ভারত বিভক্তির দায়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আসছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ উপমহাদেশের কমিউনিস্ট প্রগতিশীল অাঁতেল রাজনীতিকরা পর্যন্ত কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা আরএসএস-এর প্রোপাগান্ডার চুঙ্গাবাজ হিসেবে তাদের বিবেক বিক্রি করে এসেছে। কংগ্রেসই ভারত বিভক্তিকে অনিবার্য করেছে এবং কংগ্রেস এক কুটিল প্রত্যাশায় ভারত বিভক্তির ‘সাময়িক বিপর্যয়' মেনে নিয়েছিল। তাদের স্থির প্রত্যয় ছিল, পাকিস্তান টিকবে না এবং টিকতে দেয়া হবে না। পন্ডিত নেহেরু নিজে বলেছেন, সিকি শতাব্দীর মধ্যে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। ভারত বিভক্তির সিদ্ধান্ত মূল্যায়ন করে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তাতে তারা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন যে, সাময়িকভাবে কৌশলগত কারণে ভবিষ্যতে আরও ‘বৃহত্তর' ভারত নির্মাণের লক্ষ্যে তারা ভারত বিভাগ মেনে নিচ্ছেন।

কুমিল্লার জমিদার প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী ভারত ভাগ মেনে নেয়ার কারণ জানতে চেয়ে পন্ডিত নেহেরুর কাছে যে চিঠি দিয়েছেন, তার জবাবেও পন্ডিত নেহেরু ভারত বিভক্তিকে সাময়িকভাবে মেনে নেবার কথা স্বীকার করেছেন। ১৯৪৭-এর ১৪-১৫ আগস্টের অনেক আগেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্তিকে অনিবার্য করে ভারতভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করে। যশোবন্ত সিং লিখেছেন : ‘১৯৪৭ সালের ৮ মার্চ জওয়াহের লাল নেহেরু ও বল্লভভাই-প্যাটেলের পূর্ণ সমর্থনে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একটি প্রস্তাব পাস করে, যাতে অন্য বিষয়ের সঙ্গে বলা হয়, পাঞ্জাবের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা প্রমাণ করে যে, হিংসা ও জবরদস্তি দিয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। সবচেয়ে কম জবরদস্তির পথটিই বেছে নিতে হবে। তার অর্থ এই যে, পাঞ্জাবকে দু'ভাগে ভাগ করতে হবে।

যাতে প্রধানত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি অমুসলিম অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধী তখন বিহারে আর্তমানুষদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাওলানা আবুল কালাম অসুস্থ। প্যাটেল ও নেহেরু ভালোই জানতেন, ওই দুই ব্যক্তি উপস্থিত থাকলে এ প্রস্তাবে আপত্তি জানাতেন। '' ৩০ বছর আগে যে হিন্দু রাজনীতিক বুদ্ধিজীবী বঙ্গভঙ্গ রদ করার সহিংস আন্দোলনে জয়ী হয়েছিলেন, তারাই ১৯৪৬-৪৭-এ উগ্রহিন্দুবাদী নেতা শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে বাংলা বিভাগের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে খন্ডিত বাংলা নিয়ে ভারতীয় নাগরিক হয়ে নির্বাণ লাভ করলেন।

যশোবন্ত সিং লিখেছেন : ‘ভারতে জিন্নাহ সম্পর্কে প্রচলিত দানবীয় ভাবমূর্তিতে আমি বিশ্বাস করি না। আমি জিন্নাহ'র চরিত্র দ্বারা আকর্ষিত হয়েছি এবং তাঁর সম্পর্কে এই পুস্তক রচনা করেছি। এই পুস্তকটি কখনোই লিখতাম না, যদি না আমি তাঁর ব্যক্তিত্ব দ্বারা আকর্ষিত হতাম। জিন্নাহ'র চরিত্র বেশ দুর্বোধ্য, তাঁর ছিল জটিল ব্যক্তিত্ব। জিন্নাহর ছিল এক মহৎ চরিত্র, ছিল সংকল্পের দৃঢ়তা।

' মহাত্মা গান্ধীর উদ্ধৃতি দিয়ে যশোবন্ত সিং বলেছেন জিন্নাহ ছিলেন ‘এক মহান ভারতীয়'। ‘‘তাহলে কেন আমরা এই বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেবো না?’’ গড়পড়তা ভারতীয়রা বিশ্বাস করেন ও প্রচার করে থাকেন যে, ‘জিন্নাহ ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক এবং ভারত বিভাগের জন্য তিনিই দায়ী। ' যশোবন্ত সিং এই অপপ্রচার ঐতিহাসিক গবেষণায় মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। তবে এককালীন কংগ্রেস সভাপতি এবং আজাদী আন্দোলনে দিকপাল মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর লেখা ‘ইন্ডিয়া উইন্স্ ফ্রীডম' বইয়েও ভারত বিভাগ ঠেকাতে ব্যর্থতার দায় নেহেরু-প্যাটেলদের ওপর চাপিয়েছেন। কংগ্রেস রাজনীতির অথোরিটি এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের কিংবদন্তী পুরুষ মাওলানা আজাদের এই মূল্যায়নকেই যশোবন্ত সিং আবার সত্য প্রমাণ করলেন।

এদিকে বিজেপি থেকে যশোবন্ত সিংয়ের বহিষ্কারে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় তাদের পুরনো অবস্থান ধরে রাখার প্রয়াস লক্ষণীয়। প্রকৃত ইতিহাস যাই থাকুক, বিজেপি সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের ব্যাপারে নতুন কোন কথা শুনবে না। কিন্তু কংগ্রেস কী এই রাজনৈতিক মিথ্যাচারের গোঁড়ামী থেকে বের হতে পেরেছে? বিলম্বে হলেও যশোবন্ত সিংয়ের নয়া মূল্যায়ন নিয়ে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জী মুখ খুলছেন। প্রণব মুখার্জী বলেছেন, ভারত ভাগের জন্য জওহেরলাল নেহেরু দায়ী বলে মন্তব্য করার মাধ্যমে তার অবমাননা হয়েছে। ভারতের বেসরকারি টিভি চ্যানেল জি-নিউজ-এ তথ্য জানিয়েছে।

জিন্নাহ এবং হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর ভারত বিভক্তিতে কোনো ভূমিকা নেই বলে যশোবন্ত সিংয়ের মন্তব্যকে প্রণব মুখার্জী- কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এটাকে তিনি ইতিহাসের বিকৃতি বলে মন্তব্য করেছেন। যশোবন্ত সিংয়ের বইয়ের লেখা প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জী বলেছেন, ভারত ভাগের জন্য নেহেরুসহ কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা দায়ী বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে' তাতে বিজেপি নেতাদের ব্যাখ্যা করা উচিৎ কেন আদভানী পাকিস্তানে গেলেন এবং আবিষ্কার করলেন যে, জিন্নাহ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, অন্যদিকে যশোবন্ত সিং হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে বসলেন যে, জিন্নাহ ভারত বিভক্তির জন্য দায়ী নন। তাদের এসবকথা ইতিহাসের আলোকে সঠিক নয় বলে প্রণব মুখার্জী মনে করেন। শ্যামা প্রসাদ সম্পর্কে যশোবন্ত সিংয়ের মন্তব্য প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জী বলেন, সে সময় উগ্র হিন্দুবাদী দল হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন।

তিনি কেবল ভারত বিভক্তিকে মেনে নেননি। বরং বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে যথাক্রমে হিন্দু-মুসলমান এবং হিন্দু-শিখ-মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে ভাগ করার দাবি করেছিলেন। দেখা যাচ্ছে ভারত বিভক্তি ও জিন্নাহর পুনর্মূল্যায়নে বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ই বিরোধী। সুতরাং যশোবন্ত সিংয়ের সাড়া জাগানো বইটি রাজনীতির পাঠকদের জন্য ইতিহাসের আকরগ্রন্থ হিসেবে আলোচিত হবে। ১৯৪৭ সালের ৮ মার্চ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে রাজনৈতিক মীমাংসার ক্ষেত্রে ‘হিংসা ও জবরদস্তি'র নীতি পরিহারের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

কিন্তু ভারত জম্মু-কাশ্মীরসহ সবগুলো দেশীয় রাজ্য দখলের ক্ষেত্রে জবরদস্তি ও শক্তির ব্যবহার করেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের সাথে ভারত জবরদস্তি ও হিংসার আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। প্রতিবেশীদের সাথেও হিংসা, অন্তর্ঘাত ও শক্তিপ্রয়োগের মধ্যযুগীয় নীতি অনুসরণ করে ভারত ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এ স্থিরিকৃত রাজনৈতিক মীমাংসা এবং রাষ্ট্রাচারের সীমানা উপড়ে ফেলতে চায়। বাংলাদেশের বন্দর, প্রাকৃতিক সম্পদ, করিডোর পাবার জন্য ভারত তাঁবেদার সরকার ব্যবহার করছে। এতে সফল না হলে তারা ভিন্নপথে অগ্রসর হবে।

যশোবন্ত সিংয়ের বইয়ের নবমূল্যায়নকে ভারতের সরকারি দল-কংগ্রেস ও বিরোধী দল বিজেপি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলে এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও সহাবস্থান বিরোধী যে অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তেজনা ও অস্থিতির অনল প্রবাহ জনমানসকে বিপন্ন করে রেখেছে, তার অবসান ঘটতো। ভারতীয় মুসলমানদের ‘পরিত্যক্ত লাইভস্টক' মনে করে বিভাগ-পূর্বকালে নেহেরু-প্যাটেলরা যে হিন্দুস্থানী আজাদী এসেছিলেন, তাতে করে ভারতের মুসলমানরা আজও সমনাগরিক মর্যাদায় উঠে আসতে পারেনি। অর্থাৎ ভারত বিভক্তি সাম্প্রদায়িক সমস্যার নিষ্পত্তি করতে পারেনি। যশোবন্ত সিংয়ের আলোচনার ইংগিত এ রকমই। তিনি ভারতীয় মুসলমানদের দুর্গতির কথা উল্লেখ করেছেন।

আবার ১৯৭১-এর ভারতের সাথে মিলে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান ভাংগার মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেও ভারতের কাছে সার্বভৌম সরকার সদাচার পাচ্ছে না। ভারতের মুসলমানের কংগ্রেসের প্রতি আস্থা স্থাপন করে সেকুল্যার ভারতের পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা ও জীবন-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিয়ে কেন বাঁচতে পারছেন না? যশোবন্ত সিং তাই ভারতীয় মুসলমানদের অস্তিত্বের জন্য তৃতীয় দফা পার্টিশনের দাবি ওঠার কথাও বলেছেন। মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা ও বঞ্চনার প্রতিকারে ভারতের যে বিচারপতি সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন না হলে ভারতের ২০/২৫ কোটি মুসলমান তাদের অবস্থানে বদল করতে বাধ্য হবেন। দেশ বিভক্তি যদি রাজনৈতিক নিত্তি ও শান্তিপূর্ণ আঞ্চলিক সহাবস্থানের গ্যারান্টি না হয়, তাহলে বিকল্প কী? যশোবন্ত সিং জড়তার সাথে বিভক্তি-রেখা মুছে ফেলার সম্ভাব্যতারও ইংগিত দিয়েছেন। কিন্তু কার সাথে রি-ইউনিফিকেশন? ভারত তো শক্তিতে আচরণে, মানসিকতায় ১৯৪৭-পূর্বকালের চেয়েও ভয়ঙ্কর মুসলিম বিদ্বেষী দানব হয়ে উঠেছে।

ভারতীয় মুসলমানরাই যেখানে ভারতে মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। সেখানে আর কে তাদের মৃত্যু-গহবরে ঢুকতে যাবে? মীরজাফরের উত্তরসূরিরাই কেবল হিন্দু ভারতের শৃক্মখলে বন্দী হবার স্বপ্ন দেখতে পারে। ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর বিভাজন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতাবস্থা মেনে নিয়ে ভারত যদি তার ভেতরের জাতি-গোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিয়ে নতুন এক ভারত নির্মাণ করতে পারে, তাহলেই এ অঞ্চলে শংকার বদলে স্বস্তি ফিরে আসবে। একই সাথে ভারতকে প্রতিবেশীদের সাথে সার্বভৌম সমতার নীতি অনুসরণ করতে হবে।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.