আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাহাত্তরের সংবিধানের পটভুমি



১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল Legal Framework Order, ১৯৭০ অনুসারে। এতে দেয়া ছিল পাকিস্তানের সংবিধান কেমন হতে হবে তার রূপরেখা। আর আওয়ামী লীগ নির্বাচন কয়েছিল এই রূপরেখাতে সম্মত হয়েই। খবমধষ ঋৎধসবড়িৎশ ঙৎফবৎ, ১৯৭০ এ ধারার ২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল-(A) Islamic ideologz which is the basis for the creation of Pakistan shall be preserved; and (b) the Head of the state shall be a Muslim. (ক) ইসলামী আদর্শকে বজায় রাখতে হবে। কারণ, তা হলো পাকিস্তান সৃষ্টির ভিত্তি এবং (খ) পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হতে হবে মুসলমান।

অর্থাৎ যে মুলনীতি মেনে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে ছিল না ধর্মনিরপেড়্গতাবাদ। আওয়ামী লীগ তখন ধর্মনিরপেড়্গতাবাদের পড়্গ নিয়ে কোনো কথা বলেনি। আর স্বীকার করে নিয়েছে ইসলামী মতাদর্শকে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদান করেছিল ছয় দফা। এর কোনো দফাতেই ছিল না ধর্মনিরপেতার কথা।

ছিল না বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের কথাও। কিন্তু ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যে সংবিধান রচনা করে তাতে চারটি মুলনীতি স্বীকৃতি পায়। এগুলো হলোঃ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সংসদীয় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেতা। ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয়েছিল এই চার নীতিকে ভিত্তি না করেই। সে সময় যদি এই চার নীতির কথা আওয়ামী লীগ বলত তবে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া তার প েসম্ভব হতো কিনা সন্দেহ।

আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত M.N.A রাই রচনা করেন ১৯৭২ সালের সংবিধান। যদিও তারা নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করার জন্যে (MNA=Member of the National Assemblz); স্বাধীন পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করার জন্য নয়। তাই প্রশ্ন তোলা যায়, পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংবিধান রচনার দায়িত্ব তারা কীভাবে পেতে পেরেছিলেন? কারণ, দেশের মানুষ তাদের বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করার জন্য নির্বাচিত করেছিল না। তারা নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য। শেখ মুজিব সম্ভবত এটা কিছুটা উপলব্ধি করেছিলেন।

তাই তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে কিছুটা সম্পর্ক বজায় রাখতে। সাংবাদিক Anthonz Mascarenhas তার বহুল পঠিত Bangladesh A Legacz of Blood বইতে দাবি করেছেন, শেখ মুজিব তাকে লন্ডনে বলেন `I have a big scoop for you, we are going to keep some link with Pakistan but I can’t say anzthing more till I have talked it over with the others. And for God’s sake don’t you write anything till I tell you’. অর্থাৎ শেখ মুজিব চেয়েছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের সঙ্গে একটা বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখতে। একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না। কিন্তু তার চিন্তা-চেতনার ধারা পাল্টে যায় পরে। তার এই চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটেছিল স্বেচ্ছায় না বিদেশি শক্তির চাপে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয় ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে।

মনে হয় তিনি হয়ে পড়েছিলেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের চাপে বিব্রত। তিনি হয়ে পড়েন বিশেষ পরিস্হিতির শিকার। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলতেন তার দল কংগ্রেসের মুলনীতি হলো চারটিঃ জাতীয়তাবাদ, সংসদীয় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেড়্গতা। আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালে কার্যত গ্রহণ করে ভারতীয় কংগ্রেসের এই চার নীতিকে। কেবল কংগ্রেস যেখানে বলেছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কথা, সেখানে আওয়ামী লীগ বলেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা।

এই একটিমাত্র পার্থক্য লড়্গ্য করা যায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের নীতির সঙ্গে, আর কোনো কিছুতে নয়। ইন্দিরা গান্ধী যে ধরনের সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন, তার ধারণা তিনি লাভ করেন বিলাতের লেবার পার্টির কাছ থেকে। শিল্প-কলকারখানার জাতীয়করণ (Nationalisation of Industrz) ছিল যার অন্যতম মুলকথা। সমাজতন্ত্র বলতে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে এই জাতীয়করণের ধারণা। ১৯৭২-এর মার্চে আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ করে একটা ব্যাপক জাতীয়করণ নীতি।

এই নীতির ফলে সব চটকল, বস্ত্র, সুতাকল, চিনিকল, বিমান ও জাহাজ চলাচল এসে যায় সরকারি মালিকানায়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এদের পারে না উপযুক্তভাবে পরিচালনা করতে। সে দতা ও অভিজ্ঞতা সরকারি কর্মচারীদের ছিল না। তাদের মধ্যে ছিল সততারও অভাব। ফলে দেশের অর্থনীতি তিগ্রস্ত হয়।

বিশেষ করে পাটশিল্প হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। বিনা প্রস্তুতিতে জাতীয়করণ নীতি কোনো সুফলই বহন করে আনতে পারেনি। শেখ মুজিব চিরকাল চেয়েছেন গণতন্ত্র। ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্র একসময় ছিল তার আদর্শ। আওয়ামী লীগের ছয় দফার প্রথম দফাতেই বলা হয়েছিল, সংবিধান হতে হবে সংসদীয় গণতন্ত্রভিত্তিক।

কিন্তু সেই আওয়ামী লীগকেই দেখা গেল গণতান্ত্রিক সংবিধান পাল্টে একদলীয় বাকশাল গঠন করতে। আওয়ামী লীগ এটা করে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে। প্রধানত তখনকার মস্কোপন্হী কম্যুনিষ্টদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাকশাল গঠন ছিল একটা বড় রকমের ভুল। আজ জানি এই বিতর্কের কোনো অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে।

রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বহুদলীয় গণতন্ত্র। সেখানে দুঃখী মানুষের, সর্বহারাদের গণতন্ত্রের নামে একদলের রাজত্ব আর চাচ্ছে না। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের নামে একদলের রাজত্ব কায়েম করলে মানুষের আয় বৈষম্য কমে না। সমাজ শ্রেণীবিহীনও হয় না এবং সৃষ্টি হতে দেখা যায় একটা বিশেষ উচ্চ বেতনের বিশেষ সুবিধাভোগী প্রশাসনিক শ্রেণীর।

যারা এক পর্যায়ে হয়ে উঠতে চায় স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ। দেশের মানুষ যাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়া থেকে যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে এখনও যথেষ্ট বাকশালপন্হী আছেন, যারা চাচ্ছেন একদলেরই রাজত্ব। সেটা হয়ে উঠেছে সংস্কারকরণ।

বর্তমানে ধনতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা দিয়েছে প্রবল বাণিজ্য মন্দা। কিন্তু এই সঙ্কট কাটানোর জন্য কোনো রাষ্ট্রই ভাবছে না একদলীয় শাসন ব্যবস্হা প্রতিষ্ঠার কথা। এসব রাষ্ট্র চাচ্ছে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় আইন করে বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটকে কাটিয়ে উঠতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনমত ঝুঁকছে নিয়ন্ত্রণসহ মিশ্র অর্থ-ব্যবস্হার (গরীবফ ঊপড়হড়সু রিঃয পড়হঃৎড়ষ) প্রতি। বাংলাদেশ একটি ধনতান্ত্রিক দেশ নয়।

মুলত সাবেক কৃষি অর্থনীতিভিত্তিক দেশ। আমাদের দেশে দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলে বাড়াতে হবে উৎপাদন। এখনও আমাদের সমস্যা প্রধানত হলো উৎপাদনী শক্তি বিকাশের সমস্যা। উৎপাদন সম্পর্ক বদলানোর সমস্যা সেভাবে নয়। ১৯৭২-এর সংবিধানে প্রেসিডেন্ট জিয়া কিছু পরিবর্তন আনেন।

তিনি চেয়েছিলেন উৎপাদন বাড়িয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ প্রশস্ত করতে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্হলে তিনি রাজনীতিতে সমর্থন দেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণাকে। কারণ, বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তারা সবাই বাঙালি। কিন্তু সব বাঙালি এখন বাংলাদেশে বাস করে না। বাংলা যাদের মাতৃভাষা তাদের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগই বাস করে ভারতে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ চাচ্ছে পুরনো বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ধরে রাখতে, যা এদেশের জাতিসত্তার চেতনাকে বিশেষভাবে বিভ্রান্ত করে তুলবে। সংবিধান থাকা আর সংবিধান মানা এক কথা নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্হা গ্রহণ করা হয়েছিল অবাধ ও নিরপে নির্বাচন করার লøে। কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় সংবিধান লড়ঘন করে। এই সংবিধান লড়ঘনকে রোধ করা সম্ভব হয়নি।

আমার এক বাল্যবন্ধু মার্কিন নাগরিক। সে একসময় চাকরি করত পেন্টাগনে। এরকমই শুনেছি। সে মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসে। এদেশে এলে সে আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে।

আমার কাছে এসে সে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ফখরুদ্দীন সাহেবের কার্যকলাপের খুব প্রশংসা করেছিল। কেন সে ওভাবে প্রশংসা করেছিল আমি তা বলতে পারি না। হতে পারে আমার এই বাল্যবন্ধু চাচ্ছিল আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হয়ে কিছু লিখি। কিন্তু আমি সেটা করিনি। থেকেছি নীরব।

পরে কারও মুখে শুনেছিলাম, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানও নাকি আমার বাল্যবন্ধুর মতো মার্কিন নাগরিক। বিষয়টি সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু ঘটনা যদি আসলেই তাই হয় তবে বলতে হবে, আমরা যেমন সংবিধানই রচনা করি না কেন, বিদেশি শক্তির চাপে নানাভাবে তা বাস্তবে হয়ে উঠতে চাবে অকার্যকর। আমাদের অর্জন করতে হবে বিদেশি শক্তির চাপ অগ্রাহ্য করার মতা। আমার আলোচনা আরম্ভ করেছিলাম বাহাত্তরের সংবিধান রচনার পটভুমি নিয়ে।

আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল বিশেষ আইন কাঠামোকে মেনে নিয়ে যা পরে সে আর মানতে চায়নি। গ্রহণ করেছে সম্পুর্ণ ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। সেটার একটা অংশ এসেছিল ভারতের কাছ থেকে। আর একটা অংশ এসেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতির ধারা পাল্টাচ্ছে।

ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন করছে এক অ েঅবস্হান। এর প্রভাব দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপর না পড়েই পারে না। আওয়ামী লীগ এখন বিশেষভাবেই প্রমাণ করতে চাইবে সে একটা ধর্মনিরপে দল এবং কোনো ধরনের ইসলামিক ভাবাদর্শের সঙ্গে সে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। কারণ বর্তমান বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামকে মনে করছে তার প্রতিকুল শক্তি। সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ (০২•১২•২০০৯) লেখকঃ এবনে গোলাম সামাদ View this link


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।