আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ - গ্লোবাল অর্থনীতি (১০)



আগের নয় পর্বের হদিস পেতে নিচের লিঙ্কে গিয়ে দেখে নিন। http://www.somewhereinblog.net/blog/pmunshe দশম পর্ব "১৯৪৪ সালের পর সদ্য নিউক্লিয়ার শক্তিতে বলিয়ান আমেরিকা যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ এবং পরাজিত রাষ্ট্রসমূহকে শিল্পোন্নত রফতানীমূখী দেশে পরিণত হতে দেবার সুযোগ দিয়েছে ,এই কথাটাকে এ ভাবে বলা যায় যে সেসময় সেখানের প্রিভেইলিং দক্ষ জনশক্তি,পোর্ট, পরিবেশ, নতজানূ রাজনৈতিক অবস্থা সব মিলিয়ে সে ভুখন্ড ছিল আমেরিকান পূঁজিপতিদের বিনিয়োগের জন্য স্বর্গ রাজ্য। বা আরও সহজ ভাবে বললে, কারখানা যেখানেই থাকুক না কেন এর মালিকানার সিংহ ভাগ বা নিয়ন্ত্রন থাকছে মুলতঃ আমেরিকার হাতেই। ফলশ্রুতিতে উৎপাদিত পণ্য, সে পণ্য যে ভুখন্ডেই বিক্রি হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত মুনাফার মালিক বিনিয়োগকারী, এক্ষেত্রে আমেরিকান পূঁজিপতি"। উপরের এই মন্তব্য নিক "প্লাটো"র।

আগের নবম পর্বে আমার লেখা পোষ্ট পড়ে তাঁর করা একটা সামআপের কিছু অংশ এটা। এটা এখানে তুলে এনেছি এজন্য যে এই সামআপ পড়ার পর আমার কিছু উদ্বিগ্নতা জমেছে। কারণ, এভাবে পড়লে কিছু মৌলিক ধারণায় ভুল বুঝার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। তাই সতর্কতা স্বরূপ, বিস্তারে একে স্পষ্ট করে সব পাঠকের সাথে শেয়ার করার জন্য এটাকেই এবারের পর্বে প্রসঙ্গ করেছি। "নিউক্লিয়ার শক্তিতে বলিয়ান আমেরিকা" আমেরিকা নিউক্লিয়ার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে আছে বলে সেই সাহসে "পরাজিত রাষ্ট্রসমূহকে শিল্পোন্নত রফতানীমূখী দেশে পরিণত হতে দেবার সুযোগ দিয়েছে" - এভাবে যদি বুঝা হয় তাহলে ভুল হবে।

সামরিক শক্তির ভরসায় বা লজিকে যুদ্ধের পর আমেরিকান সরকারী ও প্রাইভেট বিনিয়োগ-পুঁজি নিয়ে সেখানে হাজির হয়নি। বরং অন্য গুরুত্ত্বপূর্ণ অবজেকটিভ অবস্হা মানে, কর্তা নিরপেক্ষ বাস্তব পরিস্হিতি সেখানে হাজির হয়ে ছিল। বলতে পারেন মেঘ না চাইতেই জলের মত। কী সে অবজেকটিভ প্রসঙ্গ তা বিস্তারে বলবার দরকার আছে তবে তা করব পরের পোষ্টে একাদশ পর্বে। সে পর্ব আরও প্রসঙ্গের কারণে হবে তথ্যবহুল।

"নিউমারিক্যাল স্টাডি"র মৌলিক কিছু সংখ্যা-তথ্য ওখানে থাকবে তবে অবশ্যই তা নেহায়েতই সংখ্যা-তথ্য নয় ব্যাখ্যা তাৎপর্যসহ সংখ্যা-তথ্য। এখনকার জন্য সংক্ষেপে কথা এতটুকুই। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন ডিসাইসিভ, আমেরিকা ও তার মিত্রজোট পক্ষ যে জিততে যাচ্ছে তা পরিস্কার - এই পরিস্হিতি থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা জাপানে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের সিদ্ধান্তে যায় - একথা সত্য। তাহলে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের সাথে যুদ্ধ পরিস্হিতি ডিসাইসিভ দিকে নেবার কোন সম্পর্ক নাই, কারণ ওটা তার আগেই ডিসাইসিভ হয়ে ছিল। তবু কেন তাহলে বোমার এই বিসাদৃশ্য ব্যবহার? এটা যুদ্ধের ভিতর দিয়ে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠা আমেরিকার যুদ্ধ পরবর্তী জমানায় একটা বাড়তি সাপোর্ট হিসাবে সামরিক শক্তি ষ্টান্ডবাই রাখার দরকারে করেছিল।

একথা বলবার কারণ হিসাবে দুটো বড় প্রসঙ্গে যাব। ১. যুদ্ধ পরবর্তী বিনিয়োগ-পুঁজি নিয়ে আমেরিকা ইউরোপে নিজে হাজির হতে হয়নি। যুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত ইউরোপের পরিস্হিতি ছিল ভয়াবহ। স্বাভাবিক উৎপাদন, অর্থনৈতিক ব্যবস্হা আবার চালু হয়ে উঠা দুরের কথা কোথাও কোথাও দুভিক্ষের মত পরিস্হিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এই পরিস্হিতি তুলনায় অনেকটাই আমাদের মত যে কোন দেশের সাথে মিলবে হয়ত কেবল মোটা দাগের তফাৎ হবে একটাই; আমাদের মত দেশের চেয়ে ইউরোপ উন্নত উৎপাদন সক্ষমতার অভ্যস্ত দেশ।

আমেরিকা উন্নত উৎপাদন সক্ষমতার অভ্যস্ত দেশগুলোকে নিয়ে এক বিশেষ দুর্দশা পরিস্হিতির মুখোমুখি ছিল। আমরা গরীব দেশের সাথে প্রায় সমার্থক হয়ে থাকা অনুদান, এইড, সাহায্যের কথা জানি, জাপানসহ ইউরোপকে আমেরিকার কাছ থেকে এমন ভিক্ষাই চেয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল, যার সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্হ ছিল ইটালী। এরকম প্রায় দুভিক্ষ পীড়িত দুর্দশাগ্রস্হ অবস্হায় সকলের কাছে এটা মানতে তাদের কোন দ্বিধা ছিল না যে এখান থেকে মুক্তির একমাত্র ত্রাতা, লিভিং গড হলো আমেরিকার, যারই একমাত্র কিছু দেবার ক্ষমতা যুদ্ধের পরও বেঁচে আছে। এতো গেল সরাসরি ত্রাণের কথা। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ক্ষেত্রে আমেরিকান বিনিয়োগ পাওয়া ছিল ইউরোপে প্রত্যেকের এক বিরাট লোভনীয় বিষয়।

কথাটা বললাম বিনিয়োগের গ্রহিতাদের দিক থেকে। কিন্তু গ্রহিতাদের প্রবল আগ্রহ থাকলেই আমেরিকা তা দিতে রাজি হয়েছিল কেন, স্বস্তিবোধ করেছিল কেন - সে প্রশ্নের উত্তর আমরা পরবর্তী একাদশ পর্বে বুঝে পাব। আপাতত প্রশ্নটা মনে রাখব। অতএব, বোমার ভয় দেখিয়ে বা বোমার ভরসায় সাহস করে আমেরিকান বিনিয়োগ-পুঁজি ইউরোপে যেতে হয়নি। বোমা অর্থাৎ সামরিক ক্ষমতা দেখিয়ে একাজ করার বিষয়টা সত্যি না।

আমাদেরকে অবজেকটিভ বাস্তবতাটা কী ছিল, কেন এমন ছিল - এর ভিতর দিয়ে বিষয়টা বুঝবার চেষ্টা করতে হবে। ২. উপরে আমেরিকার কাছে ইউরোপের সহায়তা ভিক্ষা চাওয়ার কথা বলেছিলাম। এটা যুদ্ধের পরের ঘটনাই নয় বরং শুরু হয়েছিল ১৯৪১ সাল থেকে। তখনও আমেরিকা সিদ্ধান্ত নেইনি ইউরোপের এই যুদ্ধে কোন পক্ষ নিবে। ইতোমধ্যে ফ্রান্স হিটলারের জার্মানির দখলে।

ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধ করতে যাওয়া বৃটিশ সৈন্যরা ইংলিশ চ্যানেল ধরে পলায়নরত। এদের ধাওয়া করতে যেয়ে বৃটেনের উপর জার্মান বোমা হামলা শুরু হয়েছিল। এই পরিস্হিতিতে যুদ্ধের খরচে বেসামাল বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সাথে দেনদরবার, ভিক্ষা করতে যান। [এখানে ভিক্ষা শব্দটা ব্যবহার করেছি কোন প্রচারণামূলক অর্থে নয়, আক্ষরিক অর্থে মিন করে। ] কিন্তু রুজভেল্টের যুদ্ধ পরিকল্পনা হিসাবী মন সহজে গলছিল না।

একারণে, যুদ্ধোত্তর দুনিয়ার চেহারা কেমন দেখাবে তার কোন পরিস্কার ছবি দেখাতে না পারা পর্যন্ত চার্চিল তাকে টলাতে পারছিলেন না। আগে বলেছি, আমেরিকা তখনও সরাসরি ইউরোপের এই যুদ্ধে খোলাখুলি কোন পক্ষে নিজের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে নাই। অথচ চার্চিলের দরকার সেটাই। সভা শেষ হয় চলমান যুদ্ধকে দেখা প্রসঙ্গে এক নীতিনির্ধারণী যৌথ বক্তব্য দিয়ে; চার্চিল ও রুজভেল্টের এই "যৌথ ঘোষণা" Atlantic Charter নামে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়ে আছে। চার্চিলের সাথে রুজভেল্টের এই সভা যুদ্ধের মোড় ঘুরানোর দিক থেকে গুরুত্ত্বপূর্ণ।

এই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল আটলান্টিকের উপকুলে নোঙর করা এক আমেরিকান যুদ্ধজাহাজে বসে। ফলে নামের সাথে আটলান্টিক শব্দটা জুড়ে বসে। কিন্ত এই সভার গুরুত্ত্ব গ্লোবাল অর্থনীতি বা গ্লোবাল পুঁজির উদীয়মান স্বার্থের দিক থেকে কখনও বিচার করে দেখা হয় নাই। যদিও এপর্যন্ত দেখা ডান বাম সকল ঐতিহাসিকদের বিচারে Atlantic Charter কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন মতান্তর দেখা যায় নাই। Atlantic Charter কে তাঁরা দেখেছেন ১৯৪৪-৪৫ সালে জাতিসংঘের জন্ম নেবার একটা Prelude বা জয়ডঙ্কা বিউগুলের আওয়াজের মত।

যুদ্ধের অবজেকটিভ উৎস, কারণ ও স্বার্থগুলোকে জানাবুঝা বাদ দিয়ে আমি যুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধ মানব সভ্যতা ধ্বংস করে -ইত্যাদি বলে "শান্তির" পক্ষে খাড়া হয়ে যাবার লোক অনেক পাওয়া যায়। যেন এই না চাওয়ার বলে বিশ্বযুদ্ধের মত ঘটনা ঠেকানো যায়। এটা কখনও যায়নি। কারণ, যুদ্ধের অবজেকটিভ পরিস্হিতিগুলো, স্বার্থগুলো এমন অমীমাংসেয় ভাবে মুখোমুখি হাজির হয়ে যায় যে খোদ রাষ্ট্রনায়কদের সিদ্ধান্তে এতে কোন বদল আসে না - বরং যুদ্ধই সে অমীমাংসেয় পরিস্হিতি থেকে বের হবার, মীমাংসার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধ করার ভিতর দিয়েই "শান্তির" একটা আপাত স্হির অবস্হা তৈরি হয়।

তবু মানুষ যুদ্ধবিরোধী হয়; ভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ মাথাওয়ালা রাষ্ট্র নায়কদের সৎ উদ্যোগের কারণেই দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে, জাতিসংঘ হয়েছে, আর তার পূর্ব জয়ডঙ্কা হলো Atlantic Charter ১৯৪১; "শান্তির" জন্য বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কোচিত কান্ড একখানা করতে পেরেছিল বলে চার্চিলের নামে ধন্য ধন্য রব উঠে। এসব নাদান ভাবনা থেকে বেরিয়ে Atlantic Charter পড়বার সময় হয়েছে। কী আছে বা ছিল Atlantic Charter এ? Atlantic Charter কে চার্চিল ও রুজভেল্টের একটা ডিল অর্থাৎ কিছু দেবার বিনিময়ে কিছু পাওয়ার ব্যাপার হিসাবে দেখি, তবে বলা যায়, চার্চিল নিজ শত্রু "নাজী নিষ্ঠুরতার চুড়ান্ত ধ্বংসের" পক্ষে আমেরিকাকে পাওয়ার বিনিময়ে রুজভেল্টকে আগামি দুনিয়ার ছবি হিসাবে, যুদ্ধ আর করতে না হয় একাজের সহায় হিসাবে তখনও কলোনি মাষ্টার হওয়া সত্ত্বেও প্রকারন্তরে "কোন জনগোষ্ঠির আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার ন্যায়সঙ্গত" একথা নীতিগতভাবে স্বীকার করে নেয়। ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্হিতি থেকে আমেরিকাকে দুরে রাখা সম্ভব হবে না এটা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। ফলে এড়ানো সম্ভব না এমন পরিস্হিতিতে পরিকল্পনা করে জড়ানোই ভাল; যুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ার চিত্র আগে এঁকে নিয়ে এরপর আগানোর সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা।

এজন্য রুজভেল্ট চার্চিলকে দেখাতে বলছিলেন, যুদ্ধে হিটলারের জার্মানিকে পরাস্ত করার পরের দুনিয়াটা দেখতে কেমন লাগবে। Atlantic Charter কে চার্চিলের কৃতিত্ত্ব হিসাবে যারা দেখেন তারা সবাই একটা কথা ভুলে যায়, বৃটেনের চার্চিল তখনও ভাল তবিয়তে সবচেয়ে বড় কলোনি মাষ্টার রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী; কলোনি মাষ্টারের ছড়ি তখনও তাঁর হাতে ঘুরছিল। আমাদের ভু-ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের পতাকা পতপত করে উড়ছিল। চার্চিল রুজভেল্টের কাছে আসার সময়ে পিছনের বিশ বছরের পটভুমি হলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) পর থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হা ভেঙ্গে পড়েছে। বাণিজ্য লেনদেন বন্ধ।

কারণ কারও মুদ্রা মানের উপরে কারও আস্হা নাই; যুদ্ধের খরচ যোগাতে দেদারসে ব্যয়, মুদ্রা ছাপানো সেই মুদ্রাস্ফীতি সামলাতে আবার প্রত্যেকে নিজ নিজ মুদ্রার ডিভ্যালুয়েশন ঘোষণা দিয়ে অন্যের উপর সুবিধা নিতে গিয়ে ১৯৩০ এর বিশ্বমন্দা ডেকে আনা, এর উপর জার্মানির পাল্টা কামড়ে হিটলারের যুদ্ধ - এই ভয়াবহ পরিস্হিতিতে সবচেয়ে বিপদজনক সময়ে প্রায় দেউলিয়া অবস্হায় পড়ে চার্চিল রুজভেল্টের কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছেন। পাঠক আমরা অনুমান করতে পারি, ঐ পরিস্হিতি পড়লে সবাই প্রাণভিক্ষার বিনিময়ে সবকিছু করতে রাজি হয়। সেটাই ঘটেছিল। কলোনি মাষ্টার চার্চিল যে তখনও অন্যের দেশ দখল করে আছে, তা সত্ত্বেও রুজভেল্টের সাথে যৌথ ঘোষণায় সে বলেছে “the right of all peoples to choose the form of government under which they will live” - এই নীতিতে আগামি দুনিয়া চলবে। অর্থাৎ কথার মানে দাঁড়াল, কলোনি মাষ্টার নীতিগত ভাবে মানছে, অবিভক্ত ভারত ভারতীয়দের দ্বারা তাদের পছন্দমত রাষ্ট্র গড়ে চলবে।

এবং এটা নাকি আবার, right of all peoples । এককথায়, কোন জনগোষ্ঠির আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকার করে নেয়া। তবে, "তবে" বলে একটা জুড়ে দেওয়া আছে ওতে “after the final destruction of Nazi tyranny.” নাজী নিষ্ঠুরতার চুড়ান্ত ধ্বংসের পর। কারণ, ওটাই চার্চিলের প্রাণভিক্ষা অংশ। প্রশ্ন হতে পারে রুজভেল্ট কেন যৌথ ঘোষণায় এই জবানবন্দী সাফকবলা করাল করে নিতে চাচ্ছেন? রুজভেল্ট কী কলোনি ঘৃণা করেন, দেখতে পারেন না? আমরা যারা কলোনি শাসনে নিষ্পেষিত হয়েছিলাম তাদের ত্রাতা, মুক্তিদুত? ভেবে এরসাথে একমত হওয়া যায় না, মেলে না।

তাহলে আসলে কী? এর আগের অষ্টম পর্বে বলেছিলাম, "পুঁজির গ্লোবাল হয়ে উঠার পথে পুরনো কলোনি সম্পর্কই ছিল সবচেয়ে বড় বাঁধা; কলোনি সম্পর্ক অর্থাৎ কলোনি মাষ্টার ও কলোনিকৃত দেশের (যেমন বৃটেন ও তার কলোনি বৃটিশ-ভারত) মধ্যে সীমাবদ্ধ আন্তঃ-লেনদেন ব্যবসা বিনিময় বাণিজ্যের মধ্য পুঁজির চলাচল (Circulation) আত্মস্ফীতি। দুদুটো বিশ্বযুদ্ধ ছিল এই সীমাবদ্ধ কলোনি সম্পর্কের মধ্যে পূঁজির বিচরণের অর্গল মুক্ত হবার যুদ্ধ। যুদ্ধের ফলাফলে পুঁজি তাই শুধু গ্লোবাল হয়েই উঠেনি বরং আগের মত আর যে কোন জাতি-রাষ্ট্রের অধীনে না থেকে উল্টা জাতি-রাষ্ট্রগুলোকে পুঁজি নিজের গ্লোবাল স্বার্থের অধীনে নিয়ে আসে"। কথাগুলো তখন অনেক বিমুর্তভাবে, কর্তা খুঁজে পাওয়া যায় না এমন ভাবে বলা। এখন বলা যায়, রুজভেল্ট পুঁজিকে সীমাবদ্ধ কলোনি-সম্পর্কের মধ্যে না রেখে অর্গলমুক্ত করে গ্লোবাল হয়ে উঠার পথ করা - এই কাজের কর্তাস্বত্ত্বার ভুমিকা পালন করেছিলেন।

এতে কলোনি রাখা ভাল কী মন্দ, ন্যায় কী অন্যায় - সেগুলো তার কাছে অবান্তর প্রশ্ন। বিশ্বব্যাঙ্কের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট McCloy কথা বলেছিলাম আগের মুল পোষ্টে। আমেরিকান যুদ্ধ পরিকল্পনা যেটার পাটাতনে দাড়িয়ে রুজভেল্ট চার্চিলের সাথে কথা বলেছিলেন, সেই পরিক্ল্পনা প্রণেতাদের গুরুত্ত্বপূর্ণ একজন হলেন McCloy। তাঁর পরিচয় তুলে ধরার ভিতর দিয়ে কথা গুছাব। আমেরিকান যুদ্ধ পরিকল্পনা কোন নেহায়েতই সামরিক পরিকল্পনা ছিল না যা কোনদিক থেকে আক্রমণ করলে বেশি নাজী সৈন্য মারা যাবে - এই জাতীয়।

বরং যুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়াটা অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিস্হতির দিক থেকে কেমন দেখাবে তার একটা visionary ছবিসহ এই পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল ১৯৪০-৪১ সাল থেকেই। এই পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম McCloy ছিলেন যুদ্ধ পরিক্ল্পনা বিষয়ক উপমন্ত্রী। পারমাণবিক বোমা তৈরি ও ব্যবহারের আইডিয়ার উদ্ভাবক তিনিই। এক অদ্ভুত কম্বিনিশনের লোক ইনি; চিন্তায় কনজারভেটিভ রিপাবলিকান হওয়া সত্ত্বেও আবার Internationalist, ওয়ালষ্ট্রিট বিনিয়োগ পাড়ার বন্ধু, ওয়ার ষ্ট্রাটেজিষ্ট, যুদ্ধের পরে জর্মান, জাপানে দখলীনীতি কি হবে তার নির্ধারক, আবার কেমন বিশ্বব্যাঙ্ক হওয়া উচিত তার আভ্যন্তরীণ কাঠামো তৈরি, ওয়ালষ্ট্রিট থেকে বন্ড বেচে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রাথমিক মুলধন সংগ্রহ এককথায় বিশ্বব্যাঙ্ক আদল পেয়েছে তাঁর হাতে। এই সবকিছুই হওয়া তাঁর সম্ভব হয়েছে কারণ যুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ায় নতুন international order বিন্যাসে আমেরিকার ভুমিকা কোথায় এটা দেখতে চেষ্টা করাই ছিল তার মূল বিষয়।

"মালিকানার সিংহ ভাগ বা নিয়ন্ত্রণ থাকছে মুলতঃ আমেরিকার হাতে" বিনিয়োগ-পুঁজির মালিকানা, নিয়ন্ত্রণের ভার সামরিক শক্তি বা বিষয়াবলীতে নয় - এভাবে ভাবা ভুল হবে। এই ভার আইএমএফের হাতে; সামরিক ক্ষমতার সাহসে নয় প্রথমত ও প্রধানত আইনী শক্তিতে। তবে ভাবনাটা এমন, আইনী প্রক্রিয়া নিঃশেষ হয়ে গেলে আইনী প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গার অজুহাত দিয়ে তখন শেষ অস্ত্র সামরিক বিষয়। তবে এপর্যন্ত এটার ব্যবহার নাই বললেই চলে। বিনিয়োগ-পুঁজি রক্ষা বিষয়ক অনেক আইন আছে।

এর একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, আইএমএফের মুসাবিদায় বিখ্যাত Foreign Investment Promotion & Protection Act বলে সদস্যদেশের জন্য একটা ছাঁচ (template) করে রাখা আইন আছে। আইনের নাম শুনেই নিশ্চয় বুঝে গেছেন কাম কী। এটা প্রয়োগের ষ্টাইলটা বড়ই ইনটেলিজেন্ট। প্রথমত ঋণ গ্রহিতা দেশের ঋণ পাবার প্রাথমিক শর্ত এটা। ফলে মান্য করা বাধ্যতামূলক।

দ্বিতীয়ত, শর্ত মেনে ঋণচুক্তি আইএমএফের সাথে করে নিয়ে চলে গেলে হবে না। দেয়া একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর ঋণ গ্রহিতা দেশের আইন প্রণেতাদের দিয়ে একই ছাঁচে (template) সংসদে একটা আইন পাশ করে ফেলতে হবে। তাহলে কী দাঁড়াল, ওটা আর তখন শুধুই বাইরের একটা ঋণচুক্তি, মন্ত্রী কিসে না কিসে সই করেছে এমন থাকলো না, বরং ঋণগ্রহিতা দেশ খোদ নিজের দেশেরই আইনের মধ্যে নিজেই আটকে থাকলো। কোন বিবাদ দেখা দিলে ঋণগ্রহিতা দেশের আদালত ঐ আইনকে আমলে নিতে বাধ্য থেকে, ঐ আইনের ভিত্তিতে বিচারকাজ সমাধা করবেন। এতে, মন্ত্রী ওধরণের চুক্তি করতে পারেন কী পারেন না সেই আইনি বিতর্ক ঝামেলার মাথা মুড়ে দেয়া গেল।

বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে জিয়ার আমলে Foreign Investment Promotion & Protection Act, ১৯৮০ নামে সংসদে এই আইন পাশ করেছে। এই আইন বলে বিনিয়োগকারী সুদসহ তাঁর আসল বিনিয়োগ দেশ ত্যাগে তুলে নিয়ে যেতে সুরক্ষিত থাকেন। তবে বিনিয়োগ-পুঁজির এধরণের আইনী পথে সুরক্ষিত থাকতে চাওয়ার আরও গুরুতর কারণ আছে; কলোনি বিষয়ক কিছু অভিজ্ঞতায় তাঁর দুঃস্বপ্নের কিছু স্মৃতি আছে তাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত দলে দলে কলোনি শাসন মুক্তিলাভের একটা বড় পর্বকাল গিয়েছিল। এতে কলোনি মাষ্টার বা প্রভু দৃশ্যত কলোনি ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল; কলোনি শাসিত দেশে নামে হলেও একটা জাতিরাষ্ট্র কায়েম হয়েছে।

কিন্তু যত সহজে দুই লাইনে বলে ফেললাম ব্যাপারটা অত সহজ না। কারণ, প্রভুর কলোনি ত্যাগ করার আবার রকম ফের আছে। ১৯৪৭ এর বৃটিশ-ভারতের মত যদি একটা ঘরের মধ্যে বসে আলাপ করতে করতে এক সময় প্রভু বিদায় নিয়েছেন তাহলে বড় কোন সমস্যা নাই। কিন্তু প্রভুকে যদি যুদ্ধের ভিতর দিয়ে কলোনি ত্যাগে বাধ্য করানোর ঘটনা ঘটানো গেছে তাহলে সে দৃশ্যপট একেবারেই ভিন্ন। কারণ এইবার কলোনি রাষ্ট্রের মালিকানায় বা ব্যক্তি মালিকানায় যেসব সম্পত্তি বা কোম্পানী ছিল সেগুলোর কী হবে সেই প্রশ্নে এবার ঘরে বসে আলাপ আলোচনায় ভাগবাটোয়ারের আর বালাই থাকছে না।

নতুন জাতিরাষ্ট্রের কেবল একটা অধ্যাদেশ জারি করে একথা বলাই যথেষ্ট যে, আজ থেকে ঐসব সম্পত্তি বা কোম্পানী নতুন গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের পক্ষে বায়োজাপ্ত ঘোষণা করা হলো। সুয়েজ খাল নিয়ে ইজিপ্টের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছিল। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানী মালিকানাধীন সম্পত্তি বা কোম্পানীগুলোকে নিয়ে আমরাও বায়োজাপ্ত করে নিয়েছিলাম। সেটা নিয়ে অবশ্য এটা "সমাজতন্ত্র" করা হয়েছে বা হয়নি বলে এক খামোখা তর্ক ছিল, যেটা এখন নিজগুণে শুকিয়ে মারা গেছে। আর এর সর্বশেষ ঠাট্টামশকরাটা দেখা গেছে সাউথ আফ্রিকায় ১৯৯৪ সালে।

কলোনি রাষ্ট্রের মালিকানায় বা প্রাইভেট মালিকানায় কোন সম্পত্তি বা কোম্পানীর গায়ে একটা আঁচরও না দিয়ে নেলসেন ম্যান্ডেলা বিপ্লব করেছেন বলে বিখ্যাত হয়ে আছেন; সাদাদের ঘৃণ্য বর্ণ শাসনের হাত থেকে কালোদের মুক্তির মহিমা হয়ে আছেন। আইএমএফের টেমপ্লেটেড Foreign Investment Promotion & Protection Act এর কারণে "রাষ্ট্রের পক্ষে বায়োজাপ্ত ঘোষণা করা হলো" বলে একটা বিনিয়োগ সম্পত্তি বায়োজাপ্ত হয়ে যাবার বিরুদ্ধে একধরণের রক্ষাকবচ বটে। যেকথা থেকে প্রসঙ্গের সুত্রপাত, "মালিকানার সিংহ ভাগ বা নিয়ন্ত্রণ থাকছে মুলতঃ আমেরিকার হাতে" সেখানে ফিরে যাই। যে দেশরাষ্ট্র থেকে বিনিয়োগ-পুঁজি এসেছে সেখানেই আবার ফিরে যাবার তাগিদ কী এরপর থাকছে? জরুরি সেটা? বিনিয়োগ-পুঁজি যেখানেই নিয়োজিত থাক উৎসে ফিরে না গেলেও মালিকানা ঘটিত কোন সমস্যা নাই। শক্ত আইন বলে পুঁজি খাটানো দেশে মালিকানা ভাল তবিয়তে থাকতে পারে, কোন সমস্যা নাই; তবুও আইনের দরকার আছে, মুক্ত চলাফেরার জন্য দরকার হয়।

দরকার হবে কি না এটা নির্ভর করে, কোথায় কি সুবিধা বেশি, আইন, ইনফ্রাষ্টাকচার ভালো, মুনাফা বেশি বা দ্রুত, বাজার সুবিধা, আদর আগ্রহ বেশি পাওয়া - এসবের এক তুলনামুলক মহা-হিসাব কষে শেষ ফলে একটা পছন্দের ফেবারেবল জায়গায় বিনিয়োগ-পুঁজি সাময়িক থিতু হয়ে বসে, আবার চলেও যায়। এভাবেই দেশ, রাষ্ট্র, বাউন্ডারির উর্ধে পুঁজি বিরাজ করে। "শিল্পোন্নত রফতানীমূখী দেশে পরিণত হতে দেবার সুযোগ দিয়েছে" শিল্পোন্নত ও রপ্তানীমুখী। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউরোপ এবং পরাজিত রাস্ট্রসমূহ যুদ্ধের আগে থেকেই শিল্পোন্নত ছিল। জাপান বা জর্মানের কথাই ধরুন।

হিটলারের শাসন আমলে তো বটেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল থেকেই সে বৃটেন বা ফ্রান্সের সমকক্ষ শিল্পোন্নত। ইউ-বোট বা সাবমেরিনের শ্রেষ্টত্ত্ব থেকেই বৃটিশ কলোনি সাম্রাজ্যের নৌবাহিনী নিয়ে বড়াই শ্রেষ্টত্ত্বকে পর্যদুস্হ করা দিয়েই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। যে দেশ একবার শিল্পোন্নতের শিখরে পা দিয়ে ফেলতে পারে যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ায় ইনফ্রাষ্টাকচার ভেঙ্গে পড়লেও জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞ দক্ষ জনশক্তি সহসা হারায় না। বিধ্বস্ত হয়ে পড়া ইনফ্রাষ্টাকচারে বিনিয়োগ-পুঁজির তেল-মবিল ঢাললে এটা সহজেই আবার আগের পরিস্হিতিতে ভালভাবে ফিরে আসতে পারে। একাজে জার্মান বা জাপানের গ্রোথ রেট, মার্কেট শেয়ার বৃটেন বা ফ্রান্সের চেয়ে ভালো।

আর রপ্তানিমুখীর ব্যাপারে বিনিয়োগ পুঁজির মাথাব্যাথা নাই। আগেই বলেছি এটা নিজ উৎস দেশের একই পণ্যের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও সে নির্বিকার। কারণ তার স্বার্থ মুনাফায় দেশপ্রেমের আবেগে নয়। আগে বলেছি, "জাতীয় অর্থনীতি" বা "জাতিরাষ্ট্রের" পুরানো সহজ ভাবনার জায়গায় দাড়িয়ে কিছুরই ব্যাখ্যা করা যাবে না, ব্যাখ্যা মিলবে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.