আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ ও বিশ্বব্যাঙ্ক আসলে কেমন প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশে বিশ্বব্যাঙ্কের এত ভুরি ভুরি সমালোচক আছে পদ্মাসেতু নিয়ে কথা-বার্তা উঠার আগে তা ঠাহর করা যায় নাই। তবে এটা বাহ্য, প্রকারান্তরে মিডিয়ার উপর শেখ হাসিনার দখল কতখানি তা বেশ অনুভব করা গেছে। এসব সমালোচনার মূল লক্ষ্য হলো, হাসিনা সরকারের দিকে দুর্নীতির উঠানো আঙ্গুল যে যেভাবে পারে সত্য-মিথ্যা, আর্ধেক বুঝা, না-বুঝা দিয়ে মুচড়ে দেয়া। আর সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে এ উসিলায় একপ্রস্থ লিখার আনন্দে অনেকে জ্ঞানের বহর খুলতে শুরু করেছেন! ষ্ট্রাটেজিটা হলো,হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ যেখান থেকে এসেছে সেই প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাঙ্কের গায়েই কালি লাগানো; এতে যার যা সাধ্যে কুলায়, এমন সমস্ত তীর ছুড়ে যতটা সম্ভব হাসিনার ইমেজ ড্যামেজ বা ক্ষতি রিপেয়ার করা। ব্যাপারটা যেন আমাদের চিরচেনা আওয়ামী লীগ-বিএনপির তর্ক; একের দুর্নীতি নিয়ে কথা তুললে বলা অন্যরাও দুর্নীতি করেছে ফলে প্রকারান্তরে তাদেরটাও জায়েজ।

সেভাবে বিশ্বব্যাঙ্কের পরিচালনার মধ্যে যে অস্বচ্ছতা আছে আর, গরীব বা ছোট অর্থনীতির দেশের বিরুদ্ধে বড় অর্থনীতির বা সেই অর্থে গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডার যারা সাজিয়ে বসেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্বে বিশ্বব্যাঙ্ক ফাংশনাল সমস্যা -এসব কথা তুলে যতটা সম্ভব হাসিনার জন্য সুবিধা বের করে আনা। এক্ষেত্রে এদের যুক্তির সারকথা হলো, আমাদের দেশের দুর্নীতিতে (যেমন হাসিনার বিরুদ্ধে তোলপাড় করা এখনকার অভিযোগ) “বিশ্বব্যাঙ্কের দায় আছে” ফলে হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মোটেই গুরুত্বপূর্ণ না। এই লাইন নিয়ে সবার আগে এগিয়ে আসতে দেখা গেল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানকে। তিনি ১লা জুলাই প্রথম আলোতে একটি সাক্ষাতকার দিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণায় মুখের ফেনা তুলতে চ্যাম্পিয়ান টিআইবি’র এই বিস্ময়কর রগড় কম উপভোগ্য নয়, সাথে আছে এই ঘটনায় সামাজিক মতামতকে উল্টাখাতে ঠেলে দেয়ার নেতৃত্বে তাঁর এগিয়ে আসা।

ইফতেখার বলছেন, “বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব এক নিরপেক্ষ মূল্যায়নে দেখা গেছে,উন্নয়নশীল দেশে যেসব প্রকল্পের সঙ্গে তারা জড়িত, সেখানে দুর্নীতির ঘটনায় বিশ্বব্যাংক নিজেও দায়মুক্ত নয়”। কথাটা এমন যেন বলা হলো,সন্তানের বখে যাওয়ার পিছনে বাবা-মার দায় আছে। কিন্তু ঘটনা হলো সন্তান বখে গেছে, ধরা যাক একটা এটেম্পট টু রেপের ঘটনা ঘটে গেছে। এখন পুলিশ কার নামে চার্জশীট লিখবে, আদালত কার বিচার করবে? সন্তানের না বাবা-মায়ের? শেখ হাসিনার কাছে ব্যাপারটা চার্জশীটের বা বিচারের সমস্যা না। তাঁর কাছে, পদ্মা ব্রিজ না হলে না হবে—সে দেখা যাবে পরে।

তাঁর জলন্ত সমস্যা, ইজ্জত বাচানো আর সামাজিক রাজনৈতিক মুখরক্ষা; তাই প্রচারণার কৌশল হিশাবে পাল্টা মুখরা হওয়া । সেই কাজের মশলা যোগানে “বাবা-মায়েরও দায় আছে” অথবা “বাবা-মায়েরও দোষ আছে” এসব কথা খুবই কাজের,ফলদায়ক। ফলত, ইফতেখারুজ্জামান এর উদ্যোগ বেশ কামিয়াব হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। মিডিয়ায় কাজটা শুরু করেছিল টিআইবির ইফতেখারের লাইনে বিডিনিউজ২৪ এর এক রিপোর্ট , পরে সেই রিপোর্টটা কপি করে ছাপায় আমাদের সময়। ওদিকে দুর্নীতি বিরোধী প্রচারের আর এক চ্যাম্পিয়ান প্রথম আলো প্রথম দুইদিন বিশ্বব্যাঙ্কের নথি থেকে জড়িত সংশ্লিষ্টদের নামধাম ছাপানো শুরু করলেও পরে মেরু বদল করে এখন কনসিস্টেন্টলি ইফতেখারুজ্জামান-এর লাইন নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে আছে।

সার বক্তব্য একটাই,বাবা-মারও দায় আছে। বাড়তি হলো সাথে এবার জড়ো করেছে বামধারার বলে পরিচিত এমন অনেকে, যেমন আনু মুহম্মদ, সিপিবির এম এম আকাশ, অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত। সাধারণভাবে প্রচলিত বামপন্থার যুক্তির সারকথা হলো, তারা পুঁজিবাদ বিরোধী” তবে এটা সাধারণ পুঁজিবাদ বিরোধীতা নয় [এরকম নানান কিসিমের বিরোধিতা হতে পারে] বরং যারা পুঁজি জিনিষটারই নিকুচি করে “সমাজতন্ত্র” বলে একটা ধারণা দিয়ে পুঁজিতন্ত্র রিপ্লেস করা যায় ধরে নিয়ে কথা বলেন। যেমন আনু মুহাম্মদ এর “পদ্মা ঋণচুক্তি ও বিশ্বব্যাংকের রোডম্যাপ” লেখাটা এই লাইনে হলেও প্রথম আলো নিজের কাজে লাগবে মনে করে ৪ জুলাই ছেপেছে। ওখানে আনু মুহাম্মদ পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি প্রসঙ্গ থুয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে কামান দাগিয়েছেন বেশি।

কিন্তু সে কাজে গ্রাহাম হ্যানকক, জোসেফ স্টিগলিজ বা রবি কানবুর সহ যাদের সাক্ষী মেনেছেন এরা কেউই আনুর মতো “পুঁজি বিরোধী সমাজতন্ত্রের লোক” নন বরং গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অর্ডারের মেইন ষ্ট্রিম বা প্রধানধারার লোক; বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতি এদের সমালোচনা কিম্বা অভিযোগের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। আনু এদের ব্যবহার করেছেন সুনির্দিষ্টভাবে পদ্মা সেতু প্রসঙ্গের চেয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে কামান দাগাতে। এছাড়া আনুর মতো অনেকের বিশ্বব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে সমালোচনায় তাদের দাঁড়ানোর জায়গা হলো “পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতন্ত্রের লোক” হিসাবে। সাধারণত এ ধারা আবর্তিত হয় বিদেশি কোন বিনিয়োগ বিরোধীতা ও বিপরীতে “দেশি পুঁজির” বিনিয়োগের পক্ষে, কমবেশি সব ব্যাখ্যায় একটা “শোষণ” ধারণা থাকে ও যাবতীয় সমস্যার সমাধান ব্যক্তি মালিকানার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় মালিকানা - এসব বৈশিষ্টপূর্ণ দিককে ঘিরে। কিন্তু এদের তৎপরতায় এখনকার নগদ-কথা হলো,“পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতন্ত্রের লোক”-এর সমালোচনা হাসিনাকে রক্ষার কাজে লাগছে।

এছাড়া আরও এক মজার লক্ষণ ইদানিং দেখা যাচ্ছে - তাজউদ্দিনের আবির্ভাব বা স্মরণ। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারা (১৯৬৮-৮১) কে তাজউদ্দিন কেমন পাত্তা না দিয়ে ঘোল খাইয়েছেন সে বীরগাথার এখন ছড়াছড়ি শুরু হচ্ছে। কিন্তু তাতে আমাদের কি লাভ হয়েছে নাকি নিজেদের জন্য দুর্ভিক্ষ ডেকে এনেছি সেসবের কোন নিরাবেগ মুল্যায়ন এখানে পাওয়া যায় না। আনু তাঁর লেখাতেও একইভাবে বীরগাথার তাজউদ্দিনকে এনেছেন। কোন মুল্যায়ন ওখানে নাই।

সম্প্রতি তাজউদ্দিনকে নিয়ে এক বার্ষিকী পালনে দেখা গেল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠেছেন। তিনি জানিয়েছেন তাজউদ্দিন নাকি “গণতন্ত্রের ভিতর দিয়ে সমাজতন্ত্র করতে চেয়েছিলেন” ইত্যাদি। যদিও তাজউদ্দিনের কাজের বিশ্বস্ত মূল-সহচর বর্তমান সিপিডির রেহমান সোবহানের তাজউদ্দিন উত্থানের এইকালে কোন মন্তব্য বা মুল্যায়ন আমরা এখনও দেখিনি। মিডিয়ায় এসব নানা মাত্রিক ট্রেন্ড আমরা পদ্মা সেতু নিয়ে লক্ষ্য করছি বটে কিন্তু সবখানে একটা কমন স্ট্রাটেজি কাজ করছে, তা হলো,সন্তানের বখে যাওয়ার পিছনে বাবা-মার দায় আছে। কিন্তু সন্তান বখে গিয়ে একটা এটেম্পট টু রেপের ঘটনা ঘটিয়েছে।

এখন পুলিশ তো বাবা-মার নামে চার্জশীট লিখতে পারে না, আদালতও বাবা-মার বিচার করতে পারে না। ফলে কেস ডিসমস। এটাই যেন সারকথা। এতে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি আর আলোচনার বিষয় বস্তু থাকে নি। তারা সফলভাবে বিষয়বস্তুকে ঠেলে দিতে পেরেছে, বিশ্বব্যাঙ্ক কি, কেমন প্রতিষ্ঠান সেই দিকে।

বর্তমান ‘গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা’র লক্ষণীয় দিক পুঁজি ফেনমেনা বা পুঁজির স্বভাব কিংবা গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার-এর সমস্যাগুলো কি তা নিয়ে যেসব কথা উঠছে বিশেষত বাংলাদেশেও তা নতুন নয়, গ্লোবালি তো নয়ই। [গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার যেটাকে বলছি এর দৃশ্যমান রূপ বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হলো মুল তিনটা প্রতিষ্ঠান - জাতি সংঘ, আইএমএফ বিশ্বব্যাঙ্ক ] এই সমস্যা, অভিযোগগুলো বহু পুরানো এবং জেনুইন। এমনকি যেসব রাষ্ট্র একটা পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়বে না কবুল করে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ গড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পরে [সোভিয়েত ইউনিয়নের মত] ছাড়ান দিছে কেবল তারাই নয় বরং যারা গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার ব্যবস্থাপনার মোড়ল অথবা যারা পেশা সুত্রে বা একাডেমিক ইত্যাদি দিক থেকেও এই ধারার সাথে যুক্ত এমন সকলেই এই সমস্যা-অভিযোগগুলো মানেন, তাদের পক্ষে আর না মানার কিছু নাই। প্রতি মুহূর্তে তারা গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার-এর টিকে থাকার সমস্যাগুলোর মোকাবিলা কিভাবে করা যায় তার পথ বের করতে হিমশিম খাচ্ছেন; উঠছেন আর পড়ছেন। ফলে ব্যাপারটা ঐ জায়গায় নাই যে দুনিয়ার কেউ পুঁজি ফেনমেনা, পুঁজিবাদের স্বভাব বা গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার টিকানোর সমস্যা নিয়ে কোন সন্দেহ রাখেন না বা দ্বিমত করেন না।

বরং প্রশ্নটা হলো, সমাধান কি; অন্তত তাতক্ষণিক কিছু। আবার চলতি গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার যাকে পুরানো বলছি, কারণ এটা ভেঙ্গে পড়ার আলামত স্পষ্ট হতে শুরু করেছে; এর একালে নতুন নেতা কারা উত্থিত হচ্ছে; যাদের ব্যাখ্যা করতে নতুন ক্যাটাগরি “রাইজিং” ইকোনমি শব্দ ব্যবহার শুরু হয়েছে যেমন চায়না, ইন্ডিয়া ব্রাজিল রাশিয়া ... ইত্যাদি। এদের সম্ভাব্য নেতৃত্বে একটা নতুন গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার ব্যবস্থাপনা আসন্ন সেটা সবাই বুঝতে পারছে, মানছে এবং একমতও। যদিও পুরানো বা বর্তমান গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার ব্যবস্থাপনাটা ভেঙ্গে নতুন কি আসন্ন এর সুনির্দিষ্ট রূপ, আকার বৈশিষ্ট্য এখনও পরিস্কার নয়। এসব বিষয়ের তুলনায় আমাদের আদার ব্যাপারি মতো মনে হলেও ছোট অর্থনীতির পটেনশিয়াল দেশ হিসাবে এসব আলামত থেকে ট্রেন্ড বুঝা এবং নিজেদের জন্য স্ট্রাটেজি ঠিক করাই কিন্তু আমাদের এখনকার কাজ।

চলতি ও আসন্ন গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার-এর মধ্যে আমাদের জন্য সুবিধা ও অসুবিধার দিক কি, সমস্যার দিক কি, সুযোগের দিক কি—এসব নির্ধারণই আমাদের করণীয় কাজ। কিন্তু কোনভাবেই এগুলো: ১। ক্যাপিটালিজম ভাল না সমাজতন্ত্র ভাল, একেবারেই সে বিতর্কের বিষয় নয়। ২। ক্যাপিটালিজম-এর সঙ্কট আছে কি না এটা আর অস্বীকার কেউ করছে না বরং প্রশ্ন হলো নতুন নিয়মে গ্লোবাল একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি হতে যাচ্ছে এর খোজ খবর রাখা ৩।

ক্যাপিটালিজমের চলতি গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার এর ভিতরে থাকতে চাই না ধরনের নয়; যেমন, বাংলাদেশের আইএমএফের সদস্যপদ রাখতে চাই না ধরনের ধারণা—এটা কেবল ইম্প্রাকটিক্যালই নয় এবং এই ধারণার কোন বাস্তবতা নাই। (আইএমএফ সম্পর্কে যা কিছু সমালোচনা আছে সেগুলো সত্ত্বেও) কারণ এর অর্থ হলো, আন্তর্জাতিক লেনদেন বিনিময় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ না করেই কেবল নিজ রাষ্ট্র সীমার মধ্যে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কল্পনা করে একটা গায়েবি অর্থনীতির কথা বলা হয়ে যাবে। ৪। ক্যাপিটালিজমের সমস্যা এটা মালিকানা দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করাও না, রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিলে ক্যাপিটালিজমের সব সমস্যা মিটে যাবে না, ঐতিহাসিকভাবেই দেখা গেছে যায় নাই। মন্দার ঠেলায় ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলো শয়ে শয়ে প্রাইভেট ব্যাঙ্ক ও কারখানার মালিকানা শেয়ার স্ব স্ব রাষ্ট্র নিজেই আংশিক বা পুরাপুরি কিনে নিয়েছে।

রাষ্ট্র নিজেকেই বন্ধক রেখে(সভরেন লোন) বাজার থেকে ঋণ নিয়ে একাজ করেছে। এগুলো ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধাচার বা ক্যাপিটালিজমকে একেবারেই বাতিল করে দেয়ার চিন্তা বা কর্ম নয়। এতে ক্যাপিটালিজমের চরিত্রেরও কোন বদল ঘটে নাই। ৫। ধরে নেয়া বিশ্বব্যাঙ্ক যেন কোন অর্থ লগ্নীকারি প্রতিষ্ঠান - এমন ভুল ধারণা দিয়ে শুরু করা নয়; বিনিয়োগ পুঁজি খাটিয়ে মুনাফা লাভ এই অর্থে বিশ্বব্যাঙ্ক বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান নয়।

এই মিথ্যা ও চরম অজ্ঞতার উপর বসে সমাজতন্ত্র নাম জপার কাজ এটা না। তবে ওয়াল ষ্ট্রিট সহ শয়ে শয়ে আরও যেসব বিনিয়োগী প্রতিষ্ঠান, ডেভলবমেন্ট ব্যাঙ্ক, স্পেকুলেটিভ ফান্ড, হেজ ফান্ড ইত্যাদি লগ্নীপুঁজির ব্যবসা আছে এবং অন্যদিকে বড় ব্যবসা কর্পোরেশন, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী, তেল কোম্পানী ইত্যাদি আছে তাদের ব্যবসা কারবারের শর্ত-পরিস্থিতি যাতে বাড়ে, সহায়ক হয় এমন ভাবে আমাদের মত অর্থনীতিতে অবকাঠামো তৈরি, সংস্কার করে গরীব রাষ্ট্র সমূহের নতুন আকার দেয়া জাতীয় কাজ করাই এর লক্ষ্য এবং এটাই বিশব্যাঙ্কের লিখিত বা অলিখিত ম্যান্ডেট। আমাদের আসল কাজ গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটার ফাংশনাল ভূমিকা বিচার এবং সেটা বুঝে করণীয় ঠিক করা যাতে কিভাবে এর মুখোমুখি হব, হ্যান্ডেল করব তা নির্ধারণ করা যায়। বিনিয়োগ ধারণা ও বিশ্বব্যাঙ্ক বিনিয়োগ ব্যাপারটা নিয়ে প্রগতিশীল বা বাম মহলে আজিব আজিব ধারণা আছে। ধারণা এমন বিনিয়োগ মানে মুনাফা করতে আসা, এটা পুঁজিরই কারবার এবং যেহেতু পুঁজির কারবার এরা দেখতে নারি, অতএব এটা ঘৃণ্য পরিত্যাজ্য।

সংক্ষেপে বললে, সারপ্লাস ভ্যালু বলে কথাটা আমরা অনেকেই শুনেছি, সুযোগ পেলেই তা আওড়াই। যে কোন উৎপাদনের কারবারে যা শ্রম লাগাবো ফলাফলে তাতে উৎপাদিত পণ্যের যে টোটাল নতুন মূল্য (ভ্যালু) তৈরি হবে তা থেকে উপস্থিত বিচারে যার যা পাওনা মুল্য তা মিটিয়ে দেবার পরও বাড়তি বহুগুণ ভ্যালু হাতে থেকে যাবেই। এটাকে সারপ্লাস মূল্য, একুমুলেটেড সম্পদ, সঞ্চিত শ্রম এমন অনেক নামে ডাকতে পারি। আদর্শ পরিস্থিতিতে এটাই আবার নতুন উৎপাদনের কারবারে বিনিয়োগ, পুঁজি - নতুন উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। দুনিয়াতে উৎপাদনগুলো এভাবে আদর্শ পরিস্থিতি মেনে বাস্তবে ঘটে নাই।

গেল পাচশ’ বছরের হিসাব যদি ধরি তাহলে আমাদের মতো দেশ থেকে এই একুমুলেটেড সম্পদ্গুলো কলোনী ইত্যাদির মাধ্যমে পাচার হয়েই থামেনি, মালিকানাও হাত ছাড়া হয়ে গেছে আর নানান মালিকানার নামে এগুলোই আবার পশ্চিমের নানান কোণে বিনিয়োগ পুঁজির দোকান [ওয়াল ষ্ট্রিট] হয়ে বসে আছে। কলোনী যুগে এগুলো যতকিঞ্চিত আমাদের দেশেই ব্যবহার হয়েছে তবে বেশির ভাগটাই হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর উৎপাদনের কারবারে, এতে একুমুলেটেড সম্পদ আরও বেড়েছে। যে কথা বলছিলাম, নতুন উৎপাদনের কারবারের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো বিনিয়োগ। আমরা তখন থেকে ক্রমান্বয়ে যা বিনিয়োগ হারিয়ে চলছি। এমনকি যদি ঐ লুট করা একুমুলেটেড সম্পদ বা বিনিয়োগ নিয়ে আবার আমরা সুদ সহ ফেরত দিব এই কমিটমেন্টও করি তবু একটা সময় পর্যন্ত এই বিনিয়োগ ফিরে আসে নাই।

অনেক কারণ আছে, আমাদের চেয়ে তুলনায় পশ্চিমের দেশ বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় এই কারণের চেয়েও বড় কারণ হলো আস্থা। যদি আমরা নিয়ে এসে ফেরত না দেই, নিজ দেশে আইন জারি করে আটকে ফেলি [যেমন, জাতীয়করণ]। কলোনী যুগের শেষে যদি পঞ্চাশের দশক ভাবি তবে তখন মূল মনোযোগ ছিল যুদ্ধবিদ্ধস্ত জাপান ও ইউরোপকে যুদ্ধের পর আবার গড়ে তোলা, আর আমরা ছিলাম বিবেচনার একেবারেই বাইরে। এভাবে ১৯৬০ সালের দিকে ইউরোপ বিনিয়োগে স্যাচুরেটেড হবার পর আমরা নজরে পড়েছি, এরপর আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের এশিয়ার যাবার আগে কি পরিকল্পনা, নতুন নিয়ম-কানুন আইন ঠিক করতে করতে ততদিনে সত্তরের দশক এসে গেছে। এবার প্রথম বিশ্বব্যাঙ্ক ইউরোপের বাইরে এশিয়া বা আফ্রিকার দিকে বিনিয়োগমূলক কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এটাই বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারার (১৯৬৮-৮১) আমল। আগেই বলেছি বিনিয়োগ ব্যবসায়ীদের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে ক্ষেত্রে প্রস্তুত করতে-অবকাঠামোগত বিনিয়োগের (সুদ ১% এরও কম সাধারণত ০.৫ -০.৭৫%) কাজে লাগা বিশ্বব্যাঙ্কের অন্যতম কাজ। যেখানে বিনিয়োগ বা কারবারী পুঁজি ব্যক্তি বা কোম্পানী এর বাণিজ্যিক কারবারের সুদ গড়ে ৫-৬% এর নীচে না। পুঁজি শব্দটার নানা অর্থ আছে। যে শ্রমিক সে তাঁর শ্রমের মালিক, এই অর্থে উৎপাদনকে যদি পুঁজি মালিকদের সমবেত হওয়া ও সবাই মিলে এক কারবারে জড়ানো বলে বুঝি তবে টাকা অর্থে পুঁজি মালিকদের সাথে শ্রম অর্থে পুঁজের মালিক হয়ে শ্রমিকও [শ্রমপুঁজি হয়ে তবে ছোট তরফে] এই কারবারে জড়ায়।

কিন্তু এই আলোচনায় ফোকাস রাখব টাকা অর্থে পুঁজি মালিকদের উপর এবং এর নানা রকমফেরের উপর। মোটা দাগে টাকা অর্থে পুঁজি মালিকদের ধরণগুলো হলো, বিনিয়োগ পুঁজি (বিনিয়োগী প্রতিষ্ঠান, ডেভলবমেন্ট ব্যাঙ্ক, স্পেকুলেটিভ ফান্ড, হেজ ফান্ড ও সব ধরণের ব্যাঙ্ক), কারখানা বা ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পুঁজি আর বণিক পুঁজি (পণ্য উৎপাদনের পর পাড়ার পণ্য পৌছে দেবার কাজে টংয়ের দোকান বা গ্রামের হাট বাজার পর্যন্ত ভোক্তার কা্জে যারা বণিক-ব্যবসায়ী)। পুঁজির এই নানান রকমফের থাকলেও [শ্রমপুঁজি-সহ] পুঁজির সব রূপের উপর কর্তৃত্ব করে দাঁড়িয়ে গেছে বিনিয়োগ পুঁজি। এতে পুঁজির বিনিয়োগ পুঁজিরূপের দুনিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে ফেলেছে। আমাদের মত দেশে গ্লোবাল বিনিয়োগ পুঁজির তাহলে সারপ্লাস ভ্যালু বা একুমুলেটেড সম্পদ ধারণাটা বুঝা নৈতিকতার মামলা নয়।

আমাদের প্রতি অন্যায় হয়েছে এটা আমরা জানতে বুঝতে পারি। কিন্তু খেয়ে পড়ে সবাইকে কাজ দিয়ে বেচে থাকতে গেলে আমাদের অর্থনীতিতে বিনিয়োগের যে বিরাট গ্যাপ হয়ে আছে ওকে পুরা ফেরত না হলেও সে গ্যাপ কি করে কমিয়ে আনবো এটাই আমাদের জন্য মুখ্য বিষয়। তবে একটা বিশ্বযুদ্ধ বাধায়ে দিলেও ঐ একুমুলেটেড সম্পদ বা বিনিয়োগ মালিকানা আমাদের হস্তগত হবে এমন ভাবার কোনও কারণ নাই। আবার বিনিয়োগ ব্যাপারটা আলাদিনের চেরাগ থেকে পাওয়া দৈত্যের মত, ওকে বসিয়ে রাখা যায় না, সবসময় কাজ-কারবারে লাগায় রাখতে হবে। পকেটে পুরে আরামে ঘুমিয়ে থাকার জিনিষ না এটা, কাউকে রাখতে দেবার জিনিষও না।

ফলে যতটুকু কাজে লাগানোর সামর্থ আমাদের জন্য সম্ভব ততটুকুই দরকার। নিয়ে বেঘোরে যথেচ্ছ ব্যবহার করলে শুকিয়ে সুদ আসল সহ মরবে, তখন উল্টো এর দায় বইতে হবে। মূল ব্যাপারটা হলো,আগেই পরিকল্পিত ভাবে কি কাজে লাগাতে পারব তা স্পষ্ট করে জানা এবং সে অনুযায়ী বিনিয়োগ ফেরত আনা। ফেরত আনা মানে সুদ দিয়ে ফেরত আনা, গায়ের জোরে না, সে বাস্তবতা নাই। কিন্তু মূল কথা হলো বিনিয়োগ লাগবেই।

কারণ একুমুলেটেড সম্পদের যে ঘাটতিটা তৈরি হয়ে গেছে শয়ে শয়ে বছর ধরে সেটা মোকাবিলার এটাই একমাত্র উপস্থিত পথ। আমাদের জনসম্পদ আর বিনিয়োগ চাহিদার মধ্যে এক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়ে আছে। কাজ সৃষ্টির উদ্যোগ না নিয়ে আমরা সমাজতন্ত্রী বলে শ্লোগান দিয়ে অথবা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায় হয়েছে এই নৈতিকতার চিৎকার কোন কাজে আসবে না। পাচার হয়ে একুমুলেটেড সম্পদ পশ্চিমে গেছে কাজেই ক্যাপিটালিজম কত খারাপ এটা জানানো বা প্রচার করেও কোন লাভ নাই। অনেকের ধারণা, আমাদের স্থানীয় টাকায় একুমুলেটেড সম্পদ বা সে বিনিয়োগ সক্ষমতা এখন যা তৈরি হচ্ছে,এটা ব্যবহার করলেই তো হয়, বাইরের বিনিয়োগ দরকার কি? বৈদেশিক মুদ্রার বিনিয়োগ আর দেশি মুদ্রার বিনিয়োগ সক্ষমতা এক কথা নয়।

একটা বিনিয়োগ কেবল টাকা মুদ্রার বিনিয়োগ ক্ষমতা দিয়ে করা যায় না। বিনিয়োগ প্রজেক্টে যে ক্যাপিটাল মেশিনারী,কাচামালের আমদানী অংশ, বিদেশী টেকনোলজি ও (টেকনিক্যাল ও ম্যানেজমেন্ট) কনসালটেন্ট ইত্যাদি মিলিয়ে যা যা স্থানীয়ভাবে কিনতে পাওয়া যাবে না এর সবই যোগাড় করতে বৈদেশিক মুদ্রার দরকার পড়ে। এই প্রয়োজন দেশি মুদ্রা দিয়ে মিটানো যায় না। এছাড়া এসবের উপরে সবচেয়ে বেশি দরকার বিদেশি ঠিকাদার হান্ডেল করা, একটা নিজস্ব প্রজেক্ট বুঝে নিবার ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক দক্ষতা, নিজস্ব দক্ষ ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। যারা বিনিয়োগ বিরোধী এরা মূলত গ্লোবাল ক্যাপিটালিস্ট সম্পর্কের বাইরে এক দ্বীপ অর্থনীতির স্বপ্নে বিভোর।

এর বাস্তবতা আছে কি না, কতটুকু - সে অনুসন্ধানে না নেমেই তারা স্বপ্নচারী হয়, এজন্য তা শেষতক স্বপ্নের মধ্যেই থেকে যায়। এদের আর এক বৈশিষ্ট্য হলো,আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের সাথে সম্পর্ক না রাখার দাবি-দাওয়া সর্বস্ব বিরোধীতা (আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের অনেক ভাবে বিরোধিতা বা ক্রিটিক করা যায় এটা এগুলোর মধ্যে বিশেষ এক ধরণ) - এই অবস্থানে থেকে যুক্তি তোলার চেষ্টা করা। সেখান থেকেই আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের বিরোধিতাটাও তারা করে এক ধরনের নৈতিক জায়গা থেকে। যেটা বলছিলাম, গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার-এর মধ্যে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক কিভাবে কাজ করে আর কি ভূমিকা রেখে ফাংশনাল আছে এটা বুঝবার দায় থেকে পুঁজির খারাপ ভাল দিক বুঝা এবং করণীয় কৌশলের পক্ষে দাঁড়ানোকে তাঁরা কাজ মনে করে না। প্রথম আলোতে আনুর লেখাটা সাধারণভাবে গ্লোবাল ক্যাপিটালিস্ট সম্পর্কের বাইরে থাকার যুক্তি থেকে জাত বিশ্বব্যাঙ্কের সাথে কোন সম্পর্ক না রাখার তাঁর যে অবস্থান সেখানে দাঁড়িয়ে লেখা।

কার্যত এর সারাংশটাই হাসিনাকে একটা কুশন হিসাবে বসবার জায়গা করে দিয়েছে। ফলে তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো “বিশ্বব্যাঙ্কই দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান” বলে পাল্টা আঙ্গুল তুলে নিজের পক্ষে ডিফেন্স গড়ে নিয়েছেন। আনুর লেখায় বিশ্বব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে যা অভিযোগ এটা ঠিক দুর্নীতির না, মূল অভিযোগ হলো পলিটিক্যাল; যেটাকে অনেকে সাম্রাজ্যবাদ ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। অন্যভাবে বলা যায়, পশ্চিমের দেশগুলোর পুবের দেশগুলোর উপর চড়াও হয়ে সুবিধা নেবার কাজ আর এ কাজের জন্য সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্বব্যঙ্ক। বিনিয়োগী প্রতিষ্ঠান, ডেভলাপমেন্ট ব্যাঙ্ক, স্পেকুলেটিভ ফান্ড,হেজ ফান্ড ইত্যাদি ফিনান্স বা লগ্নীর ব্যবসাকে প্রতীকীভাবে যদি আমেরিকান পুঁজিবাজার ওয়াল ষ্ট্রিট এর নামে ডাকি তবে ওয়াল ষ্ট্রিটের পক্ষে আমাদের উপর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি—এই কাজের টুল হলো বিশ্বব্যাঙ্ক।

এইসব অর্থে আনুর বিশ্বব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযোগকে পলিটিক্যাল বলছি। তবে আনুর অভিযোগগুলো একটা মরাল বা নৈতিক জায়গা থেকে তোলার চেষ্টা থাকে সবসময়। যদিও বিষয়টা নৈতিকতা বা অনৈতিকতার প্রশ্ন মোটেও নয়। রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে একটা দুর্দময়ণীয় স্বার্থ, গায়ের জোর। এটা নৈতিক বা অনৈতিক যাই হোক এর বিরোধিতা আমাদের মধ্যে থাকবে।

নৈতিকতার প্রশ্ন ছেড়ে কেন এটা আমাদের স্বার্থের বিরোধী তা তুলে ধরেই আমাদেরকে বিরোধিতা করতে হবে। দ্বিতীয়ত,আনু একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করেন যে প্রজেক্ট গছিয়ে দিয়ে আমাদের ঋণগ্রস্থ করে ফেলা যেন বিশ্বব্যাঙ্কের কাজের লক্ষ্য। আনু আগাম ধরে নিয়েছেন, বিশ্বব্যাঙ্ক যেন বিনিয়োগ ব্যাঙ্ক ধরনের লগ্নীর ব্যবসায়ী ফলে বিনিয়োগ থেকে সরাসরি মুনাফা তুলে আনা ওর লক্ষ্য। কিন্তু সুদের হার (০.৫-০.৭৫%) আর চল্লিশ বছর সময় পর্বে পরিশোধের শর্ত দেখলে অন্তত এটা যে বিনিয়োগ-মুনাফার ব্যবসা নয় তা মানতে হবে। না মানাটা হবে পাহাড় প্রমাণ অজ্ঞতা ঢাকার চেষ্ঠা।

তাহলে বিশ্বব্যাঙ্কের লক্ষ্য কি, কি ধরনের প্রতিষ্ঠান সেটা বুঝার দায় আমাদের আছে। তবে একথা ঠিক “দারিদ্র দূরীকরণ” গত কয়েক দশক ওর লক্ষ্য বলে দাবি করলেও বিশ্বব্যাঙ্ক নিজেই জানে এটা ওর আদত লক্ষ্য নয়; এমনকি ওর মূল (১৯৪৪ সালের) ঘোষিত ম্যান্ডেটও নয়। আমাদের মত দেশে ফলে আনু যেভাবে দাবি করেছেন,“বিশ্বব্যাংক সব সময়ই বৃহৎ প্রকল্প পছন্দ করে”, অথবা দেশের মন্ত্রী,সিনিয়র আমলা,ব্যবসায়ী ও কনসালট্যান্টদের মাধ্যমে দুর্নীতির বিস্তার করে টাকা নয়ছয় করে—এভাবেই কোন মতে ঋণ গছিয়ে দেয়া এটা বিশ্বব্যাঙ্কের লক্ষ্য বা কাজ নয়। একটা বড় এমাউন্টের প্রজেক্টে এর সার্ভিস কারা দিবে মালামাল কারা সরবরাহ করবে সেটা নিয়ে লবিষ্ট, প্রতিযোগিতা, ঘুষ দেয়া, কাজ বাগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ দেখতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক; এটা বিশ্বব্যাঙ্ক বলে নয়, সরকারি বা প্রাইভেট ফার্ম যারই প্রজেক্ট হোক সবার বেলায় এসব আমরা দেখতে পাব। মূল প্রশ্ন হলো, আমাদের কি দরকার, কি করতে চাই, কেন চাই, কি লাভ হবে—সেই পরিকল্পনাও যদি বিশ্বব্যাঙ্ক বা অন্যেরা করে দেয়,আমাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কোন কর্মসূচী পরিকল্পনা বলে যদি কিছুই না থাকে এমন যদি হয় আমাদের রাজনৈতিক দল-ব্যবস্থা; তবে তো বিশ্বব্যাঙ্কের প্রজেক্টে অর্থের অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ইত্যাদি ঘটার ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব অযোগ্যতাই অনেক বিষয়ের নির্ধারক হবে।

অন্যদিকে একটা প্রজেক্টের কাজ বুঝে নেয়ার জন্য টেকনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা যদি আমাদের না থাকে,তার বদলে যদি দায়িত্বপূর্ণ আমাদের লোকেদের বিচার বিবেচনার মাপকাঠি হয় ব্যক্তিগত লাভালাভ তাহলে তো সেটা বিশ্বব্যাঙ্কের দোষ বলে চালিয়ে দেয়া যায় না। এইদিকটা গুরুত্ব না দিয়ে যদি দাবি করি বিশ্বব্যাঙ্কের লক্ষ্য হলো আমাদের সমাজে দুর্নীতি ছড়ানো, এমন একটা আপতিক অর্থ হয়ত সাময়িক দাড় করানো যাবে কিন্তু এই বিচার যথার্থ হবে না। বিশ্বব্যাঙ্কের কাজই হলো আমাদের সমাজে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেয়া—এরকম ধারণা তৈরি করে কথা বলার ভিত্তিটাই আনক্রিটিকাল। যেমন, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে দেশীয় ব্যাঙ্ক সহ সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর নিয়ন্ত্রণ আদেশ নির্দেশে যতটুকু কর্তৃত্ব কায়েম করতে পেরেছে তা হয়েছে বিশ্বব্যাঙ্কের চাপে ও শর্তের কারণে। অথচ এগুলো দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের রাজনৈতিক স্বপ্ন উদ্যোগ পরিকল্পনা থেকে আসার কথা, একটা ন্যূনতম ফাংশনাল রাষ্ট্র কি তা যদি আমাদের রাজনৈতিকবোধের বা Polity-এর মধ্যে থাকে তবে এটা সমাজের ভিতর থেকেই আসার কথা।

বাস্তবে আমাদের রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হয়ে উঠার গঠনমূলক কাজের বদলে বরং নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হবার সুবাদে ক্ষমতাকে কি করে বেচাবিক্রি করে নিজে লাভবান হওয়া যায় তাতে ব্যস্ত। বিশ্বব্যাঙ্কের কাজই হলো আমাদের সমাজে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেয়া এরকম ধারণা ভিত্তিহীন এজন্য যে এতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা প্রতিষ্ঠান আকারে সচল বা ফাংশনাল না থাকার কারণে আমরা সবাই জাহান্নামে যেতে পারি কিন্তু এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে অন্তত বিদেশি যাদের বিনিয়োগ ব্যবসা বাংলাদেশে আছে এরা; যারা ক্ষতিগ্রস্থ হতে চাইতে পারে না। বরং বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবসা, যাদের জন্য বাংলাদেশ একটা বাড়ন্ত বাজার—অন্তত এই স্বার্থটাই সফলভাবে পূরণ করার জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক দায়িত্বপ্রাপ্ত। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাঙ্কের এই জবাবদীহিতা আমাদের কাছে না থাকলেও তাদের কাছে আছে। ফলে আনুর প্রপোজিশনটাই অবাস্তব, যদিও এর প্রচার মূল্য আছে।

কিন্তু এসব বলার মানে এমন না যে বিশ্বব্যাঙ্কের কাজের মধ্যে দুর্নীতি ঘটবার ব্যবস্থা নাই। যেটা বলছি তা হলো,দুর্নীতি ছড়ানোর ডেলিবারেট লক্ষ্য বিশ্বব্যাঙ্কের কাজ নয়। আর এই প্রতিষ্ঠানের মূল আনুগত্য বা কমিটমেন্ট তা বাংলাদেশের চেয়েও গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডারটা যারা আগলে বসে আছে তাদের প্রতি। ফলে বাংলাদেশের স্বার্থের সাথে মৌলিক স্বার্থের সংঘাত এখানে আছে—ঠিক এই সত্যতার মাঝেই আবার একটা সম্পর্ক এখানে কাজও করছে। আনু বিশ্বব্যাঙ্ককে জড়িয়ে যেকথাগুলো লিখেছেন তা হলো এই পলিটিক্যাল স্বার্থ বিরোধের কথাই।

বহুলাংশে তা সঠিকও। কিন্তু এখান থেকে তিনি সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন যে বিশ্বব্যাঙ্ক একটা দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান, যেন বাংলাদেশে দুর্নীতি ছড়নোই এর মিশন। এই ভাষ্যটাই পদ্মা সেতু ইস্যুকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার দিকে দুর্নীতির যে আঙ্গুল উঠেছে তার পাল্টা প্রচারের কৌশল হিসাবে হাসিনা বিশ্বব্যাঙ্ককেই একটা দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান আখ্যা দিয়ে নিজের ইমেজ ঠিক করার কাজের রসদ হতে পেরেছে। মালয়েশিয়া, বিওটি ইত্যাদি শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নিজের সরকারের মেয়াদকালে শুরু করবেই এমন একটা কথা এখন নিজেই দাবি করছেন। সংসদের বক্তৃতাতেই জোর দিয়ে বলছেন।

এককথায় বললে এটা হাসিনার রাজনৈতিক মুখরক্ষার সংগ্রাম ও প্রোগাম। বাংলাদেশের স্বার্থ অর্থনৈতিক বিবেচনার দিক থেকে বললে একাজ আর একটা আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। প্রথম কারণ, লোনের সুদের হার ও শর্ত। বিশ্বব্যাঙ্কের কাছ থেকে আমরা যে লোন পাই এগুলো বিশ্বব্যাঙ্কের লোন-প্যাকেজের হিসাবে কনসেশনাল লোন। এলডিসি বা কম উন্নত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ এই ক্যাটাগরির লোন পাবার যোগ্য।

কনসেশনাল মানে এটা কমর্শিয়াল লোন নয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ লোন (বড় অঙ্কের সরকারি বা বেসরকারি প্রজেক্টে বিনিয়োগ) এর সুদ গড়ে ৫-৬% এর নীচে হয় না। আর এটা নির্ভর করে কে এবং কি কাজের লোন এর উপরেও। যেমন আমেরিকান রাষ্ট্র নিজে প্রতিষ্ঠান হিসাবে সভরেন লোন (দেশের কোন ব্যক্তি নয়) ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার লোনের দেনায় আছে। তা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে নিজে বন্ড ছেপে (বন্ড মানে রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি দেয়া একটা নোট) সেই বন্ড পুঁজিবাজারে যারা কিনছে তাদেরকে ০১.৭৬% সুদ (১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ক্ষেত্রে) দিবে এই প্রতিশ্রুতিতে রাষ্ট্র ফান্ড যোগাড় করতে পারছে।

এই অর্থে এটাই খাতক আমেরিকান রাষ্ট্রের জন্য সুদ হার, বাজার বিশ্বাসযোগ্যতা। আবার স্পেন রাষ্ট্র একই কাজে বন্ড ছাড়ার বেলায় ওর সুদ হার উঠেছে প্রায় ৭% কারণ অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ, নিজস্ব ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেউলিয়া অবস্থা, ২৫% সক্ষম জনসংখ্যা বেকার, স্পেনের নিজস্ব অর্থনৈতিক সাইজ, বিশ্ব-অর্থনীতিতে অবস্থান, লোন পরিশোধের সক্ষমতা সম্ভাবনা ইত্যাদি ফ্যাক্টর এখানে আছে তাই। খোদ রাষ্ট্রই অর্থনৈতিকভাবে আক্ষরিক অর্থেই দেউলিয়া হয়ে যাবার সম্ভাবনা কতটুকু এটা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় আসে। রিক্স ফ্যাক্টর যত বেশি সে অনুপাতে ওর বাজার সুদ হার তত বেশি দিয়ে লোন পেতে হবে—এই হলো সারকথা। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশ পদ্মা সেতু বলে কোন প্রজেক্টে আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারের কমার্সিয়াল লোনের গড় সুদ হার ৫.৫% এর কমে পাবার সম্ভাবনা নাই।

এই বিবেচনায় কমার্সিয়াল লোনের বদলে বিশ্বব্যাঙ্কের লোনের এই তুলনামূলক সুবিধার দিক আছে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে আগেই নানান শর্তে বন্ধক পরে আছে, এই দিক যদি বিবেচনা করি তাহলে ব্যাপারটা এমন যে যা অবস্থায় আমরা এখন পড়ে আছি পদ্মা সেতুর লোনের জন্য তাতে বাড়তি কিছু বন্ধক হবার সম্ভাবনা দেখছি না, কথাটা এভাবে বলা যায়। এখন কমার্সিয়াল লোনের উচ্চ সুদ হারে যদি লোন নেই তবে এর মানে কি? মানে হবে সরাসরি ট্রাক পিছু পারাপারের টোল এমন দাঁড়াবে কি না যেটা খোদ সেতু ব্যবহারকেই অর্থনৈতিকভাবে অসহনীয় করে তুলবে; এখনকার টোল হারের চেয়ে এটা কমপক্ষে দ্বিগুণ হয়ে যাবার সম্ভাবনা। আবার এই হার যদি জোর করে কম রাখতে চাই তবে সে অনুপাতে হয়ত ৪০ বছরের জায়গায় ৭০ বছর ধরে সুদ গুণতে হবে। এই ধারণাগুলো মালয়েশিয়ার সম্ভাব্য প্রজেক্টের হিসাব থেকে পাওয়া।

সেই সাথে অন্য শর্ত সেখানে আছে যেমন, আগামী ৪০ বছরে নতুন আর একটা ব্রিজের চাহিদা আমাদের তৈরি হয়ে গেলেও সে উদ্যোগ নেয়া যাবে না, কারণ এতে পুরানা ব্রিজে পরিবহন ট্রাফিক কমে ওর রাজস্ব আয় কমে যাবে সে প্রভাবের কারণে। আসলে মূল ব্যাপারটা হলো কমার্সিয়াল লোন নিয়ে কিছু করার সাথে জড়িত এসব বাস্তব সমস্যার কারণে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ এধরনের কোন প্রজেক্টে কখনই যেতে পারেনি। অন্যভাষায় বললে এই বাস্তবতা আজকের ঘটনা নয়। এই দিকটা বিবেচনা করেই গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডার শৃঙ্খলার অঙ্গ হিসাবে বিশ্বব্যাঙ্কের মত প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল, এটাই বিশ্বব্যাঙ্কের জন্মের শর্ত। বিশ্বব্যাঙ্কের জন্মের শুরুতে ওর তহবিলের একটা বড় অংশ যোগাড় করা হয়েছিল ওয়াল ষ্ট্রিট থেকে।

রীতিমত সভা সেমিনার করে ওয়াল ষ্ট্রিটের দোকান মালিকদের বুঝিয়ে। বুঝানো হয়েছিল ওয়াল ষ্ট্রিটে কারবার হওয়া টোটাল পুঁজির একটা অংশ নামমাত্র সুদে (০.৫% এরও কমে হতে হবে) বিশ্বব্যাঙ্কের (যেচে বন্ড কেনায়) মাধ্যমে দিয়ে দিতে হবে। এতে বিশ্বব্যাঙ্কের যে নিজস্ব ফান্ড সৃষ্টি হবে এটাই বিভিন্ন দেশে কনসেশনাল সুদে (কর্মাসিয়াল পুঁজিবাজারের সুদে নয়) না দিলে আমাদের মতো দেশে ব্রিজ বা রাস্তাঘ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.