যে কোন লড়াই শেষ পর্যন্ত লড়তে পছন্দ করি।
২৬ মার্চ ১৯৭১ যশোর শহর থেকে বের হবার সময় যে পরিকল্পনা মাথায় রেখে বন্ধুদের সংবাদ দিয়ে এসেছিলাম সেই অনুযায়ী বারো বাজার সংলগ্ন নাটুয়া পাড়া, বাদুরগাছা এবং সোনলী ডাঙ্গা গ্রামে কয়েকজন বন্ধুর ৩১ মার্চের মধ্যে এসে জড়ো হবার কথা ছিল। ২৮ মার্চ পর্যন্ত তাদের কোন সংবাদ না পেয়ে মনটা অস্থির ও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিল। এদিকে তিনটি গ্রামই যশোর-ঝিনাইদহ পাঁকা সড়কের পূর্ব পাশে। আমি যে গ্রামে এসেছি, ঘোপ, সে গ্রামটি রাস্তার পশ্চিমে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নানা রকম সংবাদ পেতে লাগলাম। সত্য, গুজব, অনুমান সবই ছিল তার মধ্যে। আমার জন্য দুঃসংবাদ যেটা ছিল তা হল পাকিস্তানী সেনাদের টহলের জন্য পাঁকা রাস্তা পার হওয়া যাচ্ছিলনা। পাঁকা রাস্তার আশে পাশে কোর মানুষ দেখলে টহলরত পাক সেনারা চলন্ত গাড়ী থেকে গুলি করছিল। খবর এলা পাঁকা রাস্তার পাশে পাক সেনাদের গুলিতে করেকজন মানুষ মারা গিয়েছে।
সঠিক কতজন মারা গিয়েছে, তারা কারা, এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য ছিল না। এই সব সংবাদ সত্বেও আমি রাস্তা পার হয়ে বাদুরগাছা গ্রামে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বন্ধু খায়রুল, সোলায়মান এবং তাদের পরিবারের অপর সদস্যগণ আমাকে একা একা ছাড়তে রাজী নয়। শেষ পর্যন্ত বেলা ১২:০০টার দিকে তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি বারো বাজারের দিকে রওনা হলাম। সোলায়মান আমাকে কিছু দুর এগিয়ে দিয়ে গেল।
কথা তিলাম সমস্যা হলে তাদের ওখানে ফিরে আসবো।
বারো বাজার মাইল দু’এক পথ। সেখান থেকে মাঝে মাঝে গুলির শব্দ ভেসে আসছিল। এক মাইল আসার পর বারো পাকিয়া গ্রামে এসে দেখলাম অনেক মানুষের জটলা। সবাই বেশ ভীত-সন্ত্রস্থ, কিন্তু উত্তেজিত।
প্রায় সবাই কথা বলছে, ভালো করে কিছু বোঝা মুশকিল! শেষ পর্যন্ত যা বুঝলাম তা হলো, কেউ কেউ পাকিস্তানী সেনাদের গালাগালি করছে এবং কিছু লোক সকলকে জটলা ভেঙ্গে সেখান থেকে চলে যেতে বলছে। কয়েকজন ভীত-সন্ত্রস্থ লোককে দেখলাম জটলা ভেঙ্গে স্থান ত্যাগ করতে। গুলির শব্দ এখান থেকে অরো জোরে এবং ভীতিকর ভাবে পাওয়া যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে ছুটন্ত গুলি (গুলির ভিতর থেকে যে অংশটি বেরিয়ে আসে) মাথার উপর দিয়ে শীষ দিতে দিতে চলে যাচ্ছিল। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ছাপ।
কয়েক জনকে দেখলাম গুলি লাগার ভয়ে রাস্তার পাশে নয়ানজুলিতে এবং একটি পুকুরের ভিতরের ঢালে বসে আছে। উঠে দাঁড়াতে সাহস করছে না। পরিবেশটি আসলেই সেই রকম ছিল। যে কোন মুহূর্তে যে কেউ গুলিবিদ্ধ হতে পারতো।
ওখানে আরো তিন-চার জন লোক ছিলেন যারা আমার মত পাঁকা রাস্তা পার হয়ে ওপারে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।
আমাকে পেয়ে তারা আর একটু সাহসী হলেন। অন্যদের বাথা-নিষেধ উপেক্ষা করে আমরা রাস্তা পার হবার উদ্দেশ্যে পাঁকা রাস্তার দিকে এগুতে থাকলাম। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত গোলা-গুলির শব্দ এখন আমরা আরো জোরে শুনতে পারছিলাম। কিছু দুর যাবার পর আমরা শস্যহীন চষা ক্ষেতে এবং ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে প্রথম রেল লাইনে পৌছতে চেষ্টা করছিলাম। কারন পাঁকা রাস্তা পার হবার আগে রেল লাইন পার হতে হবে।
সেখানেও পাক সেনাদের পাহারা বা টহল থাকতে পারে। রেল লাইনের কাছাকাছি আসতেই কয়েক জন লোককে দেখলাম। তারা ভয়ে জড়ো-সড়ো হয়ে একটি ঝোপের আড়ালে বসে আছেন। তারা বললেন রেল লাইরল যেতে হলে ক্রলিং করে যেতে হবে। তারপর তিনি ক্রলিং এর যে নমুনা দেখালেন তাতে আমার হাসি পেল।
আমরা স্কুলে স্কাউটিং করার সময় প্রতি বছর পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের প্যারেড উপলক্ষ্যে মগ-ফাইটের প্রশিক্ষন নিতাম। পারেডে পাকিস্তান আর্মির বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, বালুচ রেজিমেন্ট এবং আর্টিলারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, সিগনাল, প্রভৃতি ইউনিট অংশ নিত। তাদের সাথে আমরা এক সাথে প্যারেড করতাম। সেই সব অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে স্কাউট হিসেবে আমরা নানা ধরনের প্রশিক্ষণের সাথে ক্রলিং এর প্রশিক্ষন পেয়েছিলাম। আমরা যে রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণ করতাম সেগুলি ছিল ডামি, কাঠের তৈরী।
দেখতে অবিকল রাইফেলের মত হলেও, গুলি ভরে ফায়ার করার কোন যায়গা ছিল না।
কিন্তু আমাদের আশঙ্কা সত্যি হলো। বারোবাজার রেল স্টেশন এবং রেল লাইনের উপর পাক সেনা ও পুলিশের কঠিন পাহারা। কযেকবার এ্যাটেম নিয়ে জঙ্গলের কাঁটা গায়ে ফুটলো, জামা ছিড়লো- কিন্তু রেল লাইন ও রাস্তা পার হয়ে আমরা পাঁকা রাস্তার ওপারে যেতে পারলাম না। সেখান থেকে ফিরে গ্রামের দিকে আসার সময় আমাদের আরো বেশী নার্ভাস এবং ভীত মনে হ’ল।
আমি নিজেও বুঝতে পারলাম, ভীতি এবং হতাশা আমাকে যেন চেপে ধরেছে। আবার সেই চষা জমি আর ঝোপ-ঝাড় দিয়ে লোকালয়ের দিকে ফিরে আসা।
এবার আমরা গ্রামের পথ ধরে তারপর মাঠের ভিতর দিয়ে বারো বাজার রেল স্টেশনের উত্তর দিকে যেয়ে রেল লাইন পার হতে চেষ্টা করলাম। আমরা নাছোড় বান্দার মত বার বার রেল লাইন পার হতে চেষ্টা করছিলাম, যদি কোন মতে রেল লাইন পার হতে পারি। কিন্তু কোন ভাবেই তা পারলাম না।
তখনও থেমে থেমে রাস্তার দিক তেকে গুলির শব্দ ভেসে আসছে। এবার অমরা আরো উত্তরের দিকে এগুতে লাগলাম এবং শেষ পর্যন্ত আবার গ্রামের রাস্তায় এসে হাজির হলাম। আবার সেই হাজার হাজার মানুষের ঢল। দ্বিতীয় পর্বে বর্নিত দম বন্ধ হয়ে হৃদয় ফেটে যাবার মত সেই একই মর্মান্তিক দৃশ্য। আরো কিছু দুর যাবার পর একটি স্থানে আমরা কয়েকজন রেল লাইন পার হতে পেরেছিলাম।
গ্রামের লোকেরাই আমাদের বলেছিল যে, সেখানে কোন পাহারা নেই। রেল লাইন পার হয়ে হাটতে হাটতে যে গ্রামে গেলাম সেটি ছিল কেয়া বাগান। পাঁকা রাস্তার পাশেই একটি গ্রাম। সে গ্রামে একটি প্রাইমারী স্কুল ছিল এবং সেই স্কুলের পাশে সত্যি সত্যিই একটি কেয়া ফুলের বাগান ছিল। গ্রামটি আগেই আমার পরিচিত ছিল।
স্কুলের পাশে যে বাড়ীর লোকদের আমি চিনতাম সেই বাড়ীতে গিয়ে দেখলাম তারা কেই বাড়ীতে নাই। ঘর সব তালা দেয়া। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, রাস্তায় পাকসেনাদের আনাগোনা কমে এসেছে। আমরা রাস্তা পার হবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমার সাথে রাস্তার ওপারের পার ক্ষীরদা গ্রামের এক যুবক (নাম মনে নাই), এবং দুরের এক গ্রামের এক বাউল বৈরাগী।
চারদিকে দেখে অতি সাবধানে আমরা কেয়া বাগান গ্রামের মাঝামাঝি যায়গা দিয়ে এক দৌড়ে পাঁকা রাস্তাটি পার হলাম এবঙ রাস্তা থেকে নিরাপদ দুরত্বে না পৌছানো পর্যন্ত ক্ষেতের আ’ল ধরে দৌড়াতে লাগলাম। যখন আমাদের মনে হ’ল আমরা নিরাপদ দুরত্বে পৌছে গেছি, তখন দম নিয়ে জিড়ানোর জন্য আমরা একটি মেঠো পথের পাশে বসে প’ড়লাম। পার ক্ষীরদা গ্রামের যুবক বললো রাতে নদী পার হওয়ার জন্য গুদাড়া (খেয়া নৌকা) পাওয়া যাবেনা। তার মানে আমাদেরকে রাতে পার ক্ষীরদাতেই থাকতে হবে। যুবকের প্রস্তাবে আমরা রাতে ঐ গ্রামে যুবকের বাড়ীতে থেকে গেলাম।
টীকাঃ
এখনকার তুলনায় ১৯৭১ সালে দেশে স্কুল কলেজের সংখ্যা কম ছিল। এছাড়া যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ থাকায় বর্ষা ও শরৎ কালে বৃষ্টি, কাদা ও পানির জন্য স্কুলে যাওয়া কষ্টকর ছিল। তাই অনেক পরিবারের ছেলেরা, বিশেষ করে যাদের সামর্থ্য ছিল, শহরের স্কুলে লেখাপড়া করতো। তারা আত্মীয়দের বাড়ীতে, মেসে বা লজিং থেকে শহরে পড়াশুনা করতো। আবার ভাল স্কুলে ও কলেজে পড়ার জন্য অনেক ছেলেরা আট-দশ মাইল দুর থেকে সাইকেলে শহরে এসে পড়াশুনা করতো।
বিশেষ করে পাঁকা রাস্তার ধারে যাদের বাড়ী। এই কারণে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক গ্রামে আমাদের সহপাঠী বা বন্ধু ছিল।
যশোর শহরে এম এম কলেজের গাঁ ঘেষে আমাদের বাড়ীর পাশে কোটচাঁদপুর মেস নামে একটি মেস ছিল। ১৯৬৮-৬৯ সালে আগুনঝরা আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলিতে ঐ মেসে পোষ্টার লেখা হতো এবং দেয়ালে চিকা মারার জন্য ব্যবহার করা এক্সরে প্লেট কেটে ষ্টেনসীল বানানো হতো। উভয় কাজে আমার হাত ভালো থাকায় নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে আমি এই সব কাজে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম।
সেখানে বিভিন্ন কলেজের অনেক ছাত্র-ছাত্রী আসতেন। সাংগঠনিক সভা হতো, মিছিলের পরিকল্পনা ও দায়িত্ব বন্টন হতো, কেউ আসতেন পোস্টার এবং স্টেনসীল নিতে। সবাই আমার বয়সে বড় ছিলেন। আমার তাদের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ হয়েছিল। আন্দোলন, সংগ্রামে সক্রিয় একজন নির্ভীক কর্মী হিসেবে আমাকে তারা স্নেহ করতেন।
এরাও অনেকে জেলা শহরের বাইরে দুর-দুরান্ত থেকে আসতেন। ১৯৭০-৭১ সালে আমি জেলা শহরের বাইরে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত থাকায় এবং মিটিং মিছিলে দেখা সাক্ষাতের সুবাদে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। এই যোগাযোগ মুক্তি যুদ্ধকালীন সময়ে খুব কাজে লেগেছিল।
১৯৬৮-৬৯ এর গণ-আন্দোলন শেষে আমি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর স্কুল কমিটি ছাড়িয়ে যশোর শহর কমিটি এবং কোতয়ালী থানা (যশোর) কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়ন তিন ভাগে বিভক্ত হবার পর আমি একটি অংশের মহাকুমা ও জেলা কমিটিতে স্থান পেয়েছিলাম।
ছাত্র ইউনিয়নের এই ভাঙ্গন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কার্যতঃ ১৯৬৯ সালের মার্চ থেকে। যে কারনে তখন থেকে নতুন নতুন স্কুল কমিটি গঠন এবং সংগঠনের মধ্যে নিজেদের অবস্থান ও সমর্থন শক্তিশালী করতে পুরো জেলা চষে বেড়াতে হয়েছিল। আমি আগেই লিখেছি যে, ১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধ শুরুর সময় আমি যশোর জেলায় রাজনৈতিক মহলে মোটামুটি পরিচিত মুখ ছিলাম। সে এইসব কারণে। স্বাভাবিক ভাবে যশোর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আমার বহু বন্ধু, রাজনৈতিক সহকর্মী এবং পরিচিত লোক ছিল।
সে সময় মাঝে মাঝে স্থানীয় সাপ্তাহিক এবং জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত আমাদের সাংগঠনিক সংবাদে আমার নাম প্রকাশিত হতো। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এক দিন যশোর শহরের ষাষ্টিতলা পাড়ায় “আমরা সূর্য সেনা” ক্লাবে ছাত্র ইউনিয়নের যে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার সংবাদ দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা---এখন বস্ধ) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংবাদে ছাত্রনেতা আমজাদ হোসেন, মনিরুল হক, আবু সালেহ তোতা, আমিনুল কামাল রূমী, ধ্রুব জ্যোতি ঘোষ, সাজ্জাদুল আজিম এবং আমার নাম প্রকাশিত হয়েছিল। আমি তখন যশোর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মাতৃভূমি পত্রিকায় মাঝে মাঝে লিখতাম।
(লেখাটা আগে আমার ব্লগে প্রকাশিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।