আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিন্তা করি-১

সমাজতন্ত্রী

আপাতত হাই সাহেব তার ঘরের অনেকগুলি কাঠের চেয়ারের একটায় বসে সিগারেট খাচ্ছেন। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু চিন্তা। সোনামুড়ি এলাকাটা মোটামুটি বিশাল না হলেও খুব একটা ছোট নয়। এখানে মানুষজনের বসবাস অবশ্য খুব কম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলো ঘর-বাড়ী পুরো এলাকাটাকে একটা আদর্শ আবাসিক এলাকা হিসেবে উৎকটভাবে উপস্থাপন করছে।

এখানে আধপাকা বাড়ীগুলোর বারান্দায় আর উঠোনে এবং কাঁচা বাড়ীগুলোর উঠোনে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে এখানকার রান্নাঘরগুলোতে লাকড়ি জ্বলে ভাত আর আলুভর্তা-সবজী রান্না করার জন্য। এখানকার বাড়ীগুলোর কর্তা পুরুষেরা নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় বাজারে যান সাপ্তাহিক বাজার করার জন্য। মাঝে মাঝে আধলিটার কেরোসিন বা সয়াবিন কেনার জন্য গৃহিনীরা বাড়ীর ছোট ছেলেকে দোকানে পাঠান একটা গলায় দড়ি বাধা কাঁচের বোতল অথবা একটা পুরানো তেল চিটচিটে কোকাকোলা বা আর সি কোলার প্লাষ্টিকের বোটল হাতে ধরিয়ে দিয়ে। গ্রামও নয় আবার মফস্বলও নয় এমন এক উৎপরবর্তনশীল অবস্থায় এই এলাকার অবস্থান।

হাই সাহেবের দুটো মেয়ে। বড় মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ে আর ছোট মেয়েটা ক্লাস ফোরে পড়ে। হাই সাহেবের গৃহিনী একজন আটপৌরে রান্না ঘরে হাড়ি ঠেলা ও ঘর ঝাড় মোছার কাছে নিয়োজিত একজন সহজ সরল মহিলা। উনার জীবনের আশা আকাংখা বলতে খুব বেশীকিছু নেই। প্রতিদিন ঘরকন্নার কাজের চাপে বেশী কিছু চিন্তার সুযোগও তার নেই।

ঘরের কাজ শেষ হলে উনি খুজে খুজে আরও কাজ বের করেন যাতে কখনও বসে থাকতে না হয়। কাজ করতে করতে উনার অবস্থা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কখনও কোন কাজশূণ্য অবস্থায় পড়লে উনার অস্বস্থি শুরু হয়। বিনোদন বলতে উনি উনি বোঝেন রাত্রে সবাইকে খাইয়ে দিয়ে বিটিভির নাটক দেখতে বসা। পশ্চাদপৎ এলাকা হিসেবে এখানে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছালেও আকাশসংস্কৃতির তার এসে পৌছায়নি। তাই উনি মোটামুটি হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাব থেকে মুক্ত একটা কর্মময় জীবন যাপন করছেন।

শুক্রবারে বিটিভির বাংলা চলচ্চিত্র উনার সাপ্তাহিক বড় বিনোদন। শুক্রবার এই জন্য উনি তাড়াতাড়ি সব কাজ সারেন এবং সবাইকে দুপুরের খাবার দিয়ে সবার সাথে সপরিবারে সিনেমা দেখতে বসেন। শুক্রবারে, আশেপাশের অনেক বাড়ী থেকে, যাদের বাড়ীতে টেলিভিশন নেই তারা জড়ো হয় হাই সাহেবের বাড়ীর টেলিভিশনের ঘরটায়। বাচ্চা ছেলেপেলেদের সংখ্যাই বেশী থাকে। চলচ্চিত্রে সকলেই মননিবেশ করেন এবং কিচুক্ষণ পর পর দশ মিনিটের বিজ্ঞাপন বিরতিতে সকলে হালকা খোশ গল্প করেন।

এ সময়টা বাচ্চারা দশ মিনিটের জন্য বাড়ীর উঠোনে বা বাড়ী সংলগ্ন রাস্তায় খন্ডকালীন খেলাধুলায় মেতে উঠে। এরপর হয়তো ঘর হতে কেউ ডাক দেয়, "ঐ ছবি শুরু হইয়া গেছে"। ব্যাস সকলে পড়িমড়ি করে ছুটে আসে টেলিভিশনের ঘরে। মুগ্ধ নয়নে সকলে দেখে চলচ্চিত্রের কারিশমা। তারা দুঃখিত হয় নায়ক নায়িকার দুঃখময় জীবনে, আনন্দিত হয় ভিলেনের মার খাওয়াতে এবং প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করে ভিলেনের চরম শাস্তির, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নায়কের হাতে ভিলেনের মৃত্যুই সবচেয়ে সুন্দর পরিণতি হিসেবে মনে করে।

একসময় সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে। চলচ্চিত্রেরো পাট শেষ হয়। সকলে যার যার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। স্কুলে পড়ুয়ারা চিন্তা করতে থাকে,"আহা, যদি সারাজীবন বিজ্ঞাপনবিহীনভাবে একটানা চলচ্চিত্র দেখে যেতে পারতাম। যদি কালকে শনিবার স্কুলে যাওয়া না লাগত।

যদি পুরো জীবনটাই চলচ্চিত্রময় হত। কতই না ভালো হত। " মহিলারা চিন্তা করেন, "যাক ভাল ভাবে সময়টা কাটল। " এইটুকু ভেবেই তারা ঘর ঝাড়ু দিতে এবং প্রতি ঘরে বাতি জ্বালাতে ব্যাস্ত হয়ে ওঠেন। তারপর তারা লেগে যান, রান্না ঘরের হাঁড়ি ঠেলতে।

রাতের খাবার রান্নাই তখন হয়ে ওঠে তাদের পরবর্তী জীবনকর্ম। .....................

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।