আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিরাপদ একটু ঠাঁই , কোথাও কি নাই

পড়ি, লিখি ও গান শুনি, আড্ডা দেই..

“আপা, আমাকে এই গ্রাম থেকে অন্য কোথাও নিয়া যাবেন? অন্য কোন গ্রামে - যেখানে নদী থাকবে না , চর থাকবে না, থাকবে না মায়া মহাজন,ফজল,হারুন”- কথাগুলো বলে মনোয়ারা। মনোয়ারার খোঁজে লালমনির হাটের রাজপুর ইউনিয়নের কিং চিনাতুলি গ্রামে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার বাবা মোতালেব এর দেয়া ঠিকানা নিয়ে মীরবাগে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়। তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে একটি ঘরে দরজা আটকিয়ে বসে ছিল সে। তার সাথে কথা বলতে চাইলে প্রথমে আপত্তি জানায়।

অনেক বোঝাবুঝির পরে রাজি হয়ে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে কথা গুলো জানায়। জমিজমার বিরোধ নিয়ে প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হয় মনোয়ারা(১১)। বাবার নাম মোতালেব । প্রতিপক্ষ যুবক হারুন (২৩) তাকে অপহরন করে নিজ বাড়িতে দুই দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। হারুনের বাবার নাম ফজল।

মনোয়ারার বাবার আবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগীতায় সে বাড়ীতে ফিরে আসে। প্রতিপক্ষের শক্তির ভয়ে সে সময় প্রশাসনের কাছে মনোয়ারা ধর্ষিত হওয়ার কথা বলেনি। চোখ মুছতে মুছতে সে জানায়, ‘ধর্ষিত হয়েও গোপন করার কষ্টটা অনেক বেশী। ’ কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা ও লোক নিন্দায় সে বাড়িতে থাকতে দেয় নি । আশ্রয় নিয়েছে পাশের জেলায় দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়ীতে ।

তার নিজের গ্রামে আশ্রয় না হলেও অপহরনের সেই ভয়ঙ্কর গল্প সবার মুখে মুখে। এগারো বছরের দুরন্ত কিশোরী ছিল মনোয়ারা । প্রতিদিন বেনী দুলিয়ে , ধুলা উড়িয়ে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে ছুটে যেত তিস্তা পাড়ে। সারাদিন বালি দিয়ে ঘর বানিয়ে চলতো লুকোচুরি খেলা। ভর দুপুরে দল বেঁধে লাফিয়ে পড়তো তিস্তা নদীতে ।

তারপর বাজি ধরে সাঁতার কাটা। আবার তীরে উঠে ভেজা কাপড়েও চলতো ছুটাছুটি। খেলতে খেলতে ভূলেই যেত খাওয়া, পড়া। বিকেলে ক্লান্ত শরীরে ধুলা বালি উড়িয়ে দিয়ে চরের ফসল মাড়িয়ে দল বেঁধে ফিরে আসতো বাড়ী। দূরের ফার্ম হাউজের পাহারাদার লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতো তাদের দিকে।

ধরতে পারলে দু চারটা চড় থাপ্পর ও কানমলা নিশ্চিত হতো। পরদিন সেসব ভুলে গিয়ে সে পথে আবার পা বাড়াতো। মনোয়ারা চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছে। বাবা, মামা, নানার কাছে সে শুনেছে এই চরের অনেক জমিই আগে তাদের ছিল। সে সময় উর্বর এ জমি গুলোর ধানে গোলা ভরে যেত।

সর্বগ্রাসী তিস্তা তাদের জমি-জিরাত, বাড়ি-ঘর গিলে খায়। সর্বস্ব হারিয়ে অনেকের সাথে মনোয়ারার পরিবারও আশ্রয় নেয় পাশের বেড়ি বাঁধে। কিন্তু তিস্তা জমিজিরাত বেশী দিন ধরে রাখতে পারেনি উদরে। সাত-আট বছরেই জাগতে থাকে চরগুলো। প্রতি বছর পলি পড়ে হতে থাকে উর্বর।

আবারো সুখের দিনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ভুমিহীন পরিবারগুলো। কিন্তু হঠাৎ করে দানবের থাবা তাদের স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় । ভুমিআইনের জটিলতার মার প্যাচে ফেলে ভুয়া দলিলে জাগতে থাকা চর দখল করে নেয় পাশের গ্রামের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক মায়া। তিনি চিনাতুলী গ্রামের শক্ত সামর্থ কিছু লোক বেছে নিয়ে তাদের অর্থ ও সাহায্য দিয়ে গড়ে তোলেন লাঠিয়াল বাহিনী । ক্ষমতার দাপটে প্রশাসনকে বৃৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে দখল করে প্রায় তিন শত বিঘা জমি।

সেখানে ফার্মহাউজ করে গরু, ছাগল, ভেড়া, মাছ, সবজি, ধান, গম, পাট,আলু ইত্যাদি ফলন করে পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলছে। আর সে গুলোর ত্বত্তাবধানের দায়িত্ব দিয়েছে লাঠি^য়ালদের। লাঠিয়ালরাই শাসন ও শোষন করে চলেছে ভুমিহীন নামের ভুমির মুল মালিকদের। স্থানীয় ব্যক্তিদের মাঝে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে বিভক্ত করে ক্ষমতাহীন করে দিয়েছে আনোয়ারুল হক মায়া। নেপথ্যের নায়ক হয়ে তিনি প্রায় অদৃশ্যেই থেকে গেছেন ।

ভুমিহীনরা নিজের ভুমি ফিরে পেতে আইনের আশ্রয় চেয়েছে। ধরনা দিয়েছে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে । যখনই তারা জমি ফিরে পেতে মামলা করতে গেছে তখনই নিরীহ ভুমিহীনদের পাল্টা মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। তারাই গ্রেফতার হয়রানী হয়েছে বার বার। প্রত্যাখাত হয়ে অবশেষে ভুমির মুল মালিকরা গড়ে তুলেছে ‘ভুমি উদ্ধার কমিটি।

’ তাদের আন্দোলন সাড়া ফেলেছে পুরো দেশে। কিন্তু আইন দেয়নি তাদের স্বীকৃতি। তাই তাদের মনে মনে জ্বলছে আগুন। সেই আগুনে সহজেই পুড়ে মরছে অসহায় গরীব নারী ও শিশুরা। তারই ধারাবাহিকতার শিকার আজ মনোয়ারা ।

নিজ বাড়িতে নিজ দেশে থাকতে পারে নাই নিশ্চিন্তে। দুরের এক আত্মীয়ের বাড়িতেও পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। সে বলে, মা বাবা ভাই বোনকে দেখতে ইচ্ছে করে, সমবয়সি ব›ধু ,চর, নদী ,খোলা আকাশ সব কিছুর টান তার মনকে ক্ষত বিক্ষত করে। কিন্তু সে যে আর ফিরতে পারে না। সেই দুঃসহ স্মৃতি তার মনকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

ঘর, পরিবার, গ্রাম, নদী কিছুই আকড়ে থাকতে পারে না । তাই তো সে একটু নিরাপদ আশ্রয় চায় অন্য কোথাও,অন্য কোন খানে। মনোয়ারার বাবা মোতালেব, মা হালিমা, মামা আলম ও নানা হামিদ মনোয়ারার জন্য নিরাপদ একটু আশ্রয়ের প্রার্থনা জানান।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.