আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রাক্কালে যা না বললেই নয়



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১৮ ডিসেম্বর ভারত সফরে যাবেন। এই সফরকে ঘিরে প্রস্তুতি বেশি নিচ্ছে ভারত। সেদেশের পররাষ্ট্র সচিব নিরূপমা রাও ইতোমধ্যে ঢাকায় ঘুরে গেছেন। অনেকাংশে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গাম্ভীর্য তিনি প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দুটি বিষয়ে ব্যতিক্রমও ঘটিয়ে গেছেন তিনি।

গত এপ্রিলে তার পূর্বসুরী শিবশংকর মেনন যেখানে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সৌজন্য দেখাননি, নিরূপমা রাও সেখানে তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শিবশংকর মেনন তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু নিরূপমা রাও বর্তমান সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রকাশ্যে সাক্ষাৎ বা বৈঠক করার প্রয়োজন বোধ করেননি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জানিয়ে গেছেন, নেপালে পণ্য পরিবহনের জন্য ভারত বাংলাদেশকে রেল ট্রানজিট দেবে। প্রস্তুতির কথা অবশ্য শুধু এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতেই বলা হচ্ছে না।

ভেতরে ভেতরে আরো অনেকভাবেই চলছে ভারতের প্রস্তুতি। ঠিক এ সময়ে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কারের' জন্য মনোনীত করার বিষয়টিও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের জন্য এ এক বিরাট সম্মান, কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, মনোনয়নের কথা জানানোর পাশাপাশি ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি ‘বন্ধুত্বের হাত' বাড়িয়ে দেয়ার আহবানেরও পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। ফলে নতুন পর্যায়েও বেশ জোরেশোরেই প্রশ্ন উঠেছে, শুধু বাংলাদেশকেই কেন ‘বন্ধুত্বের হাত' বাড়িয়ে দিতে হবে? প্রশ্ন ওঠার কারণ, শুধু ‘বন্ধুত্বের হাত' বাড়িয়ে দিতে বললে চলবে না, যার উদ্দেশে এই বাড়াতে বলা, তার দিক থেকেও সমান সাড়া ও সহযোগিতা আসা দরকার। কিন্তু ভারত কি এ পর্যন্ত কখনোই তেমনভাবে সাড়া দিয়েছে? বাংলাদেশ কি না দিয়েছে ভারতকে? ভারতের কোন্ দাবি ও প্রস্তাব বাংলাদেশ অপূর্ণ রেখেছে? নিজের ক্ষতি করে হলেও বাংলাদেশ ভারতকে ফারাক্কা বাঁধ চালু করতে দিয়েছে।

একতরফা বাণিজ্যিক ফায়দা লুটতে দিয়েছে। প্রথমে ঢাকা-কোলকাতা এবং তারপর ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু করতে দিয়েছে। সবশেষে ভারতের আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী শর্ত মেনে কাঁটাতারের খাঁচার ভেতর দিয়ে রেল যোগাযোগও মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারত কিন্তু কোনো একটি ব্যাপারেই ‘বন্ধুত্বের হাত' বাড়িয়ে দেয়নি, ‘বন্ধুত্বের নিদর্শন'ও স্থাপন করেনি। ভারত বরং বাড়িয়ে চলেছে শত্রুতাপূর্ণ কার্যক্রম, সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে শুধু ক্ষতিগ্রস্তই করে চলেছে।

উদাহরণ হিসেবে প্রথমে সর্বশেষ কিছু তথ্য-পরিসংখ্যানসহ বিএসএফের হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করা যায়। এক রিপোর্টে জানা গেছে, চলতি বছর ২০০৯ সালের সাড়ে ১০ মাসে বিএসএফ ৯১ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। অন্য এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে এ পর্যন্ত বিএসএফ ৮২১ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোড়ন তুলেছে ১২ বছরের এক বালিকার হত্যাকান্ড। ৬ নভেম্বর কুড়িগ্রাম সীমান্তে মঞ্জুয়ারা খাতুন নামের বালিকাটিকে বিএসএফ হত্যা করেছে।

অথচ ‘বন্ধুত্বের হাত' বাড়ানোর উদ্দেশ্য থাকলে বিএসএফের উচিত ছিল তাকে আটক করা এবং পরে বিডিআরের কাছে ফেরৎ দেয়া। উল্লেখ্য, বিএসএফের হত্যাকান্ড বেড়ে চললেও এ সময়ে কোনো ভারতীয় নাগরিক বিডিআরের গুলীতে মারা যায়নি। দু' দেশের বাণিজ্যের কথাও উল্লেখ করা দরকার। তিন-তিনটি যুগ অতিক্রান্ত হলেও প্রথম থেকেই বাংলাদেশকে বিপুল ঘাটতির মধ্যে রেখেছে ভারত। এই ঘাটতি কমবার সামান্য সম্ভাবনা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

কোনো কোনো অর্থ বছরে তার পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ভারতে রফতানির পরিমাণ কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভেতরে নিজেদের পণ্য ঠেলে দেয়ার ব্যাপারেই বেশি ব্যস্ত থাকে- অনেক বেশি পণ্য পাঠায় তারা চোরাচালানের অবৈধ পথে। আমদানির ক্ষেত্রেও ভারতীয়রা একই নীতি-মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। যেমন ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ২৫ ক্যাটাগরির বাংলাদেশী পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। চারদিকে তখন ধন্য ধন্য পড়ে গিয়েছিল।

কিন্তু আজও- ২০০৯ সালে এসেও সে ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি। ভারতীয়রা একের পর এক শুধু পূর্বশর্ত হাজির করেছে। কিন্তু সেগুলো পূরণ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রফতানি বাড়ানোর সুযোগ পায়নি। ভারত কিভাবে বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে সে সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে পানির কথা উল্লেখ করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয়দের মনোভাব রীতিমতো শত্রুতাপূর্ণ।

উজানের দেশ হওয়ার সুবিধাকে ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশকে মরুভূমি বানানোর দীর্ঘমেয়াদী ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের উজানে একের পর এক বিভিন্ন নদীর মুখে বাঁধ নির্মাণ করেছে। ফারাক্কা বাঁধের নাম যত কম স্মরণ করা যায় ততই ভালো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো মওসুমেই বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। বন্যার সময় একই ভারত সব বাঁধের গেট খুলে দেয়।

ফারাক্কার পাশাপাশি ছোট-বড় অসংখ্য বাঁধের মাধ্যমে ভারত পানি প্রত্যাহার ও পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করায় অভিন্ন ৫৪টির মধ্যে ৪০টি নদ-নদী শুষ্ক মওসুম শুরু হওয়ার আগেই এখন পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের শতাধিক নদ-নদী এরই মাঝে হারিয়ে গেছে। অনেক নদ-নদী খালে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে এসেছে টিপাইমুখ বাঁধ। এই বাঁধ নির্মিত হলে বৃহত্তর সিলেটের পাশাপাশি মেঘনা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

দেশের সকল অঞ্চলে অতি দ্রুত ঘটতে থাকবে মরুকরণ প্রক্রিয়া। পরিণতিতে ঘটবে মহাবিপর্যয়। কিন্তু ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ থেকে সরে আসেনি। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি চরম অবমাননা দেখাতেও দ্বিধা করছে না ভারত। দেশটি আমাদের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা এলাকাসহ সমুদ্র সীমার ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার অমীমাংসিত এলাকার ভেতরে ঢুকে তেল ও গ্যাসের জন্য অনুসন্ধান কাজে হাত দিয়েছে।

ফলে লুন্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। ২০০৪ সালের আগস্টে জানা গিয়েছিল এ ধরনেরই আরো একটি অত্যন্ত আশংকাজনক খবর। বাংলাদেশ-ত্রিপুরা সীমান্তের পাহাড়ী এলাকায় ভারত প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণ করেছে, যা দু' দেশের সীমান্তের শূন্য রেখা বরাবর শুধু নয়, অনেকস্থানে বাংলাদেশের ভেতর দিয়েও গেছে। খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার ভেতর দিয়ে নেয়া এই সড়কটির নির্মাণ কাজ ভারত শেষ করেছিল বাংলাদেশকে না জানিয়েই। সড়কটিকে ভারত অনেক কাজে ব্যবহার করেছে।

এসবের মধ্যে রয়েছে বিএসএফ ও সেনাবাহিনীর টহল ও ভারি যানবাহনযোগে সমরাস্ত্রসহ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচল এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী শান্তিবাহিনীকে সহায়তাদান। ভারতের পক্ষ থেকে চোরাচালানীদেরকেও উৎসাহ যোগানো হয়েছে- যারা বিশেষ করে শান্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র সরবরাহ করে। উল্লেখ্য, এই সড়কের অদূরেই শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা নামমাত্র কিছু অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণের অভিনয় করেছিল। কিন্তু সব জানলেও আওয়ামী লীগ সরকার তখন টু শব্দটিও করেনি। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেয়া এবং প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করাসহ আরো অনেকভাবেই ভারত বাংলাদেশের ক্ষতি করে চলেছে।

সেসব দিকে যাওয়ার পরিবর্তে এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ট্রেন সার্ভিস এবং বাংলাদেশের আকাশ দিয়ে কার্গো বিমান চলাচল প্রসঙ্গে বলা দরকার। বাংলাদেশের কর্তা ব্যক্তিরা যতোই ‘বন্ধুত্বের' কথা বলুন না কেন, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সামান্যও উপকৃত বা লাভবান হতে পারবে। পারবে না মূলত ভারতের মনোভাব ও অবন্ধুসুলভ কর্মকান্ডের কারণে। কথা আরো আছে। বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার এবং নিজের বাজার বানানোর পাশাপাশি ভারতের আরেক প্রধান উদ্দেশ্য কিন্তু অন্য রকম।

সেটা আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের দূরত্ব কমিয়ে আনা। রাজ্যগুলোকে ‘সেভেন সিস্টার্স' বা সাত বোন বলা হয়। পশ্চিম বঙ্গ হয়ে এই অঞ্চলে যেতে হলে বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করতে হয়। নাহলে ঘুরে যেতে হয় দেড়-দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি। এত বেশি দূরত্বের কারণে একদিকে রাজ্য সাতটি অবহেলিত হয়ে আসছে, অন্যদিকে সেখানে চলছে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ।

ভারতও সে কারণে করিডোর ও ট্রানজিটের নামে যে কোনোভাবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাতায়াতের সুযোগ চেয়ে এসেছে। কিন্তু এর সঙ্গে বাংলাদেশের নিজের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত রয়েছে বলে অতীতের কোনো সরকারই করিডোর ও ট্রানজিট দেয়নি। সাপ্রতিক সময়ে সে কাজটিরই সূচনা করে গেছে উদ্দিন সাহেবদের অনির্বাচিত সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারও এশিয়ান হাইওয়ের ধোঁয়া তুলে ভারতের ইচ্ছা পূরণের জন্য পা বাড়িয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে ‘সেভেন সিস্টার্স'-এর মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে।

সশস্ত্র স্বাধীনতাকামীরা এর পর ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ চালাবে। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর দোহাই দিয়ে ভারতের সেনাবাহিনী এসে অবস্থান নিতে পারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। আর সত্যি যদি একবার ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ার সুযোগ পায় তাহলে বাংলাদেশের পরিণতি হবে ভয়ংকর। কথাটা বলার কারণ, ভারতীয় রাজনীতিকরা এমনিতেই মাঝে-মধ্যে বলে থাকেন, ভারতের জন্য বাংলাদেশ দখল করে নেয়া নাকি ‘কয়েক ঘন্টার ব্যাপার'! সকাল ১০টায় কোলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করলে তারা নাকি বিকেল চারটায় ঢাকায় বসে চা খেতে পারবেন! ‘বন্ধুত্বের হাত' বাড়িয়ে দেয়ার নামে দেশকে অমন এক পরিণতির দিকেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ও পানি আগ্রাসন বন্ধ করার মতো বিভিন্ন প্রশ্নে দরকষাকষি করার যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ সরকার কিন্তু তেমন চেষ্টা করেনি।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পর ৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরে এসেছিলেন। কিন্তু তার কাছে পানি সমস্যার কথাটাই তোলা হয়নি। উল্টো পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন তখন বলে বসেছিলেন, ভারতের বদৌলতে কিছু পরিমাণে হলেও পানি যে পাওয়া যাচ্ছে সেটাই আমাদের ‘সৌভাগ্য' এবং এতেই আমাদের খুশি থাকা উচিত! মন্ত্রী ভারতের পক্ষে সাফাইও গেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভারত নাকি উজানে পানি প্রত্যাহার করছে না! জঙ্গিদের নিয়ে শোরগোলে তোলার বিষয়টিকেও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া দরকার। অন্তরালে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা থাকায় জঙ্গিদের বিষয়টিকে সাপ্রতিককালে সুচিন্তিতভাবেই প্রাধান্যে আনা হয়েছে।

বাংলাদেশে আজকাল শুধু পাকিস্তানের ‘লস্কর'রা নয়, ভারতের কথিত ‘মোস্ট ওয়ান্টেড'রাও ধরা পড়ছে। অন্যদিকে সত্য হলো, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বলতে যা বোঝায় ভারতের তুলনায় তার কিছুই নেই বাংলাদেশে। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে সংসদ নির্বাচনের সময়। বস্তুত, চার দলীয় জোট সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নেয়ায় ৬৪ জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণের মতো আর কোনো ঘটনা দেশে ঘটেনি। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইসহ জঙ্গি নেতাদের জোট সরকারই গ্রেফতার করেছিল।

জোট সরকারের এই কঠোর ভূমিকার কারণে আর কখনো সুসংগঠিত সন্ত্রাসী তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘জঙ্গি জঙ্গি' বলে পাড়া মাতানোর ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতায় আসার পর কিছুদিন পর্যন্ত দক্ষিণ এশীয় টাস্কফোর্স গঠনের নামে হৈ-চৈ করার পাশাপাশি সরকার জঙ্গি দমনের জন্য ভারতের সাহায্য নেয়ার ঘোষণাও দিয়েছিল। এর পরপরই পিলখানা হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। এই হত্যাকান্ডকে অজুহাত বানিয়ে সরকার বিডিআরের বিলুপ্তি ঘটানোর এবং সমগ্র প্রক্রিয়ায় ভারতের সাহায্য নেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে।

এর ফলে বিশেষ কিছু কারণে দেশপ্রেমিকদের মনে গভীর সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান কারণ হলো, ভারত নিজেই ‘হাজার ধরনের' সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের কর্মকান্ডে দিশেহারা অবস্থায় রয়েছে। বস্তুত ভারতের সন্ত্রাস পরিস্থিতি এক কথায় ভীতিকর। দেশটির ৬০৮টি জেলার মধ্যে ২৩১টি জেলায় অর্থাৎ দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকাতেই জঙ্গিরা হত্যা-সন্ত্রাস চালাচ্ছে। ভারতে বড় ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠির সংখ্যা ২৭০টি।

হত্যা-সন্ত্রাসের কারণে ভারতের প্রধান আটটি রাজ্যকেই ‘লাল অঞ্চল' হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়েছে। রাজ্যগুলো হলো- মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, অন্ধ্র প্রদেশ ও পশ্চিম বঙ্গ। সন্ত্রাসী হামলায় ভারতে মৃত্যুর সংখ্যাও চমকে দেয়ার মতো। ১৯৯৪ থেকে ২০০৮ সালের নবেম্বর পর্যন্ত সেনা ও পুলিশসহ ৫৪ হাজার ৯৬৯ জন সন্ত্রাসী হামলায় মারা গেছে। এত বেশি হত্যাকান্ডের কথা বিশ্বের কোনো দেশে কল্পনাও করা যায় না।

শিব সেনা, বজরঙ্গ দল, আরএসএস এবং ভিএসপি বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে ভারতে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের বিকাশ ঘটেছে আশংকাজনকভাবে। এগুলোর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ সন্ত্রাসে ভারত নিজেই যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে। অমন একটি দেশের কাছে জঙ্গি দমনের জন্য সরকার সাহায্য চেয়েছে বলেই দেশপ্রেমিকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা মনে করেন, উদ্দেশ্য আসলে বাংলাদেশের কথিত জঙ্গিদের দমন করা নয়।

এর পেছনে রয়েছে ভারতের প্ররোচনা। জঙ্গি দমনের আড়াল নিয়ে ভারত একদিকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্বাধীনতার জন্য চলমান সশস্ত্র সংগ্রামকে দমন করতে চায়, অন্যদিকে চায় নিজের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে। কারণ, জঙ্গি দমনের নামে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার সুযোগ দেয়া হলে বাংলাদেশ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হবে। তখন ভারতের রণাঙ্গন চলে আসবে বাংলাদেশে। আর ভারতের সেনাবাহিনী একবার কোনোভাবে ঢুকে পড়ার সুযোগ পেলে তাদের ফেরৎ পাঠানো কখনো সম্ভব হবে না।

এখান থেকেই বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নটি প্রাধান্যে এসেছে। বাংলাদেশে কখনো ট্রেনে আগুন দেয়ার কিংবা একই সঙ্গে শত শত মানুষ হত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটেনি। অতীতে বিচ্ছিন্ন যেসব ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর পেছনে ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনা- ছিল বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে কুখ্যাতি দিয়ে ফায়দা হাসিল করার উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলাদেশকে কলংকিত করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ বরং সন্ত্রাসহীন শান্তির দেশ হিসেবেই টিকে রয়েছে।

এতেই জ্বালা ধরেছে বাংলাদেশ বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর। শুরু হয়েছে কল্পিত সন্ত্রাস ও জঙ্গি গোষ্ঠী সম্পর্কিত কেচ্ছা-কাহিনী। এমন কিছু একটা করার চেষ্টা যে চালানো হবে সেকথা বোঝা গিয়েছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। সরকার অকারণে টাস্কফোর্স গঠনের জন্য উতলা হয়ে ওঠেনি। এর পর পর ঘটেছে পিলখানা হত্যাকান্ড।

হত্যাকান্ডের পেছনে ঠিক কোন দেশ ছিল সে রহস্য উদঘাটিত হতে সময় লাগেনি। ভারতীয়দের অনেকেও এ ব্যাপারে জানান দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরীর একটি মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ বারবার নয়াদিল্লির ‘রাডার' থেকে সরে যায়। কিন্তু তা আর হতে দেয়া যাবে না।

অর্থাৎ ভারতের সেনাবাহিনীকেই বাংলাদেশের ‘হাল' ধরতে হবে, দেশটি যাতে নয়াদিল্লির ‘রাডার' থেকে সরে যেতে না পারে। উদ্বেগের কারণ হলো, জঙ্গি দমনে সাহায্য নেয়ার নামে এখনো সে পথেই পা বাড়াতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের প্রকৃত মনোভাব সম্পর্কে জানার পরও অনেকে বোঝাতে চান, ভারতীয়দের নীতি, কৌশল ও মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। এ জন্যই ভারতের প্রতি ‘বন্ধুত্বের হাত' বাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে কারো কারো মধ্যে আগ্রহ অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিরাও আবেগের বশে মাঝে-মধ্যে ‘দুই বাংলা' বলে বসছেন।

ভারতও কৌশল নিতে ভুল করছে না। যেমন শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার জন্য দুই ‘বাঙালী' মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অতি আগ্রহীরা কিন্তু বুঝতেই পারছেন না যে, বিরাট দেশ ভারত শুধু বাঙালীদের দেশ নয়। পশ্চিম বঙ্গ ভারতের একটি সাধারণ রাজ্য মাত্র। সেখানে বাঙালীরা বাস্তবে শোষিত-অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সম্ভাবনার সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই তথাকথিত বাঙালীপনার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বার্থ আদায়ের ব্যাপারে সততার সঙ্গে চেষ্টা চালাতে হবে। পানির হিস্যা, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে সমতা, সমুদ্র সীমা, সীমান্ত সমস্যা, বিএসএফের হত্যাকান্ড এবং নেপাল ও ভুটানে যাতায়াতের জন্য ট্রানজিট আদায়সহ প্রতিটি বিষয়ে সমাধান অর্জন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে, বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র যেমন নয়, ভারতও তেমনি নয় একমাত্র বৃহৎ রাষ্ট্র। বিশ্বের কোনো অঞ্চলেই এমন কোনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করাও কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয়নি- যেখানে নির্বাচিত ও দেশপ্রেমিক সরকার রয়েছে।

এসব বিষয়ে বেশি দরকার আসলে দেশপ্রেমে চালিত হওয়া। দেশের স্বার্থে অবদান রাখতে পারলেই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে স্বাগত জানাবে জনগণ। ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার' নিয়েও তারা তখন গর্বিত বোধ করবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.