আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হেফাজত! - বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।

হেফাজত! আল্লামা শফীর বিবৃতি প্রত্যাহার এবং বাবুনগরীর তথ্যে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল চট্টগ্রাম অফিস/হাটহাজারী প্রতিনিধি ॥ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হেফাজতে ইসলাম এখন নিজের হেফাজত নিয়েও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা এ সংগঠনটির অবস্থা এখন লেজেগোবরে। গত ৬ এপ্রিল ঢাকায় লংমার্চ করে এরা সাফল্যের জাবর কেটেছিল। আর ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী দিয়ে শাপলা চত্বরে বেআইনীভাবে অবস্থান করতে গিয়ে যৌথ বাহিনীর অভিযানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে সংগঠনটির কোমর ভেঙ্গে যাওয়ার অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে।

এ ঘটনার পর সংগঠনটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী গ্রেফতার হয়ে এখন রিমান্ডে যেসব তথ্য দিচ্ছে তাতে হেফাজত ও বিএনপি-জামায়াতের থলের বিড়াল বের হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এ সংগঠনটি নিয়ে যে উত্থান দেখা যায় পরবর্তীতে ঠিক অনুরূপ পতনও লক্ষণীয়। এ সংগঠনটির মূল কর্মকা- পরিচালিত হয় হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে। গত দু’মাসে হাটহাজারীতে সহিংসতা ও নাশকতার কারণে এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৬ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় ১০৮ জনকে সুনির্দিষ্ট এবং অজ্ঞাতনামা ৫৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে মাত্র ২ জন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সংগঠনের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে ওঠা হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। হেফাজতের নেতৃত্ব ও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যে, নানা ধারা উপধারা এবং মতভেদ রয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নেতাদের বক্তব্যে। আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে বাবুনগরী স্বীকার করেছেন, ৫ মের ঢাকা অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচীর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছিল না। শুধু তাই নয়, তিনি এই কর্মসূচীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অর্থায়নের বিষয়টিও স্বীকার করেছেন।

অপরদিকে হেফাজত আমির শাহ আহমাদ শফী গত বুধবার রাতে এক বিবৃতি দিয়ে তা দু’ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার করে নেন। ওই বিবৃতিতে তিনি দাবি করেছিলেনÑ হেফাজতে ইসলামের কোন নেতাকর্মীই আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলেন না। জুনায়েদ বাবুনগরীর কাছ থেকে রিমান্ডে জোর করেই এমন বিভ্রান্তিমূলক স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। কিন্তু মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে আহমাদ শফীর এ বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেয়ায় প্রশ্ন্ উঠেছেÑ সংগঠনটি আসলে কাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, হুজুগে রাতারাতি বেড়ে ওঠা একটি সংগঠনের নাম হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

নাস্তিক ও ধর্মের অবমাননাকারীদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে গত ৫ মে ঢাকা অবরোধ পালনের কর্মসূচী ছিল সংগঠনটির। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নেতারা ইচ্ছা ব্যক্ত করেন মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশের মধ্য দিয়ে কর্মসূচী শেষ করার। সরকারের অনুমতি পাওয়ায় শুরু হয় সমাবেশ। সংগঠনের আমির শাহ আহমাদ শফীর মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচী শেষ হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যার আগেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন এক অজ্ঞাত ইশারায় সভা মঞ্চ থেকে ঘোষিত হয় দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শাপলা চত্বরেই অবস্থান বজায় রাখার।

আমির আর সেই সমাবেশে এলেন না। ওই দিন বিকেলেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দল ও জোটের নেতাকর্মী এবং ঢাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানান হেফাজতের পাশে দাঁড়ানোর। এরপরই সরকার সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়। বিকেল ৪টায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতের উদ্দেশে বলেন, সমাবেশ শেষ করে সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকা ত্যাগ করুন। জবাবে হেফাজতের নেতারা হুঙ্কার ছেড়ে জানিয়ে দেন, তাঁরা অবস্থান ত্যাগ করবেন না।

সরকার পালাবার পথ খুঁজে পাবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। হেফাজতে ইসলাম নেতারা তাঁদের অবস্থানে অনড় থাকায় সরকারকে কঠোর হতে হয়। মধ্যরাতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ ফোর্স মাত্র দশ মিনিটের অভিযানে হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করে মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে। পরদিন ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসা থেকে দলের আমির শাহ আহমাদ শফীকে কড়া নিরাপত্তায় বিমানবন্দরে নিয়ে একটি ফ্লাইটে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে গ্রেফতার হন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী।

দফায় দফায় রিমান্ডে অনেক তথ্য দেয়ার পর আদালতেও তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেন। আর এতেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করে। বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয় ১৮ দলীয় জোটেও। জুনায়েদ বাবুনগরী তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেই ফেলেন যে, হেফাজতের কর্মসূচী শুরুতে অরাজনৈতিক আন্দোলন থাকলেও পরে তা রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। কর্মসূচীর ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা।

তিনি বিএনপির ঢাকা মহানগর সভাপতি সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ ১৮ দলীয় জোটের একাধিক নেতার নামও প্রকাশ করেন। তাঁর জবানবন্দীতে বেরিয়ে আসে হেফাজতে ইসলামের ১৪ নেতার নামও, যাঁরা বিএনপি-জামায়াতের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে অতি উৎসাহী হয়েছিলেন। এ আন্দোলনের পেছনে যে আর্থিক যোগান বিএনপি-জামায়াতেরই ছিল তাও পরিষ্কার হয় বাবুনগরীর স্বীকারোক্তিতে। তিনি আরও জানান, বিএনপি-জামায়াত তাদের আশ্বাস দিয়েছিল যে, সরকারের পতন হলে তাঁকে এবং হেফাজত আমির শাহ আহমাদ শফীকে মন্ত্রী বানানো হবে। হেফাজতের কর্মসূচী পুরোপুরি ১৮ দলীয় জোটের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল বলে তিনি অকপটে স্বীকার করেন।

বাবুনগরীর স্বীকারোক্তিতে চুপসে যাওয়া অবস্থা হেফাজতে ইসলামীর। বিশেষ করে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় দলের কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। গ্রেফতার এড়াতে পলাতক রয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। যে হেফাজত হঠাৎ করে আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল সেই সংগঠনটি এখন একেবারে গৃহকোণে। কওমি মাদ্রাসার বাইরে কোন কর্মসূচী এখন আর নেই।

তবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং নানা ধারা-উপধারা যে রয়েছে সেটি আর ধামাচাপা থাকছে না। বিশেষ করে গত বুধবার দলের আমির শাহ আহমাদ শফীর একটি বিবৃতি মাত্র দু’ঘণ্টার ব্যবধানে প্রত্যাহার করে নেয়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মহাসচিব বাবুনগরী তার জবানবন্দীতে জানিয়েছেন, আমির আহমাদ শফী চোখে ভাল দেখেন না। তাহলে প্রশ্নÑ কারা এই বিবৃতি তৈরি করে দিয়েছিলেন, আবার কাদের ইঙ্গিতে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হলো? হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমাদ শফী গত বুধবার রাতে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রেরিত বিবৃতিতে বলেছেন, জুনায়েদ বাবুনগরীর ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দীকে উদ্ধৃত করে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা সত্য নয়। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন বা কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানো বা বসানোর জন্য ঢাকা অবরোধ করেনি।

কারণ হেফাজতে ইসলাম ঈমান-আকিদাভিত্তিক সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ১৩ দফা দাবি আদায়ই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। সরকার পতনের আশা করার অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়। বিবৃতিতে তিনি দাবি করেনÑ আলেম সমাজ ও তৌহিদী জনতা নিজ নিজ উদ্যোগেই কর্মসূচীতে শরিক হয়ে থাকেন। সুতরাং আঠারোদলীয় জোট বা অন্য কোন দল থেকে অর্থ যোগান নেয়ার দাবিও ভিত্তিহীন।

তিনি আরও বলেন, অবরোধ-পরবর্তী মহাসমাবেশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করার বিষয়টি ঠিক করা ছিল। কিন্তু ৫ মে দুপুর ২টার পর হেফাজতকর্মীরা রাজধানীতে সন্ত্রাসী হামলার ও হতাহতের শিকার হওয়ার পর যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে নিরাপত্তাহীনতার কারণে সেদিন আমার পক্ষে মহাসমাবেশে শরিক হওয়া সম্ভব হয়নি। ভোরেই সমাবেশস্থলে গিয়ে মোনাজাতের মাধ্যমে কর্মসূচী সমাপ্ত ঘোষণা করার কথা ছিল বলে বিবৃতিতে হেফাজত আমির উল্লেখ করেন। একই বিবৃতিতে তিনি বলেন, বিএনপি নেতা ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার খাবার সরবরাহ করার খবর অমূলক। এছাড়া ঢাকায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের সঙ্গে হেফাজতের জড়িত থাকার অভিযোগও অস্বীকার করেন।

হেফাজতে ইসলামের কোন নেতাকর্মীই তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলেন না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাকে অবহিত করা ছাড়া কোন কর্মসূচী নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা কাউকে দেয়া হয়নি। জুনায়েদ বাবুনগরীর কাছ থেকে রিমান্ডে জোর করে বিভ্রান্তিমূলক স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। হেফাজত আমির শাহ আহমাদ শফীর বিবৃতিতে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবি জানানো হয়। বুধবার রাত ৯টায় এই বিবৃতি প্রদানের প্রায় দু’ঘণ্টা পর তা প্রত্যাহার করে নেয় হেফাজতে ইসলাম। আমির শাহ আহমাদ শফীর প্রেস সচিব মনির আহমেদ গণমাধ্যম অফিসগুলোতে ফোন করে বিবৃতি প্রত্যাহারের কথা জানান।

তিনি বিবৃতিটি প্রকাশ না করার অনুরোধও জানান। কিন্তু কেনইবা বিবৃতি দেয়া হলো আবার তা প্রত্যাহার হলো সে ব্যাপারে কিছুই জানাননি আমিরের প্রেস সচিব। ফলে প্রশ্ন উঠেছে- কারা এ বিবৃতি প্রচার করেছিল। কারণ জুনায়েদ বাবুনগরী তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছেন, আমির (বড় হুজুর) চোখে ভাল দেখেন না। ফলে কেউ বিবৃতি তৈরি করে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিল কিনা সে সংশয় এখন বেশ জোরালো।

উল্লেখ্য, গত ৬ এপ্রিল লংমার্চ, ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে মহাসমাবেশ এবং ঐদিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নেতা ও জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের খতিব মাওলানা জালাল উদ্দিন আল কাদেরীকে লাঞ্ছিত করা, হাটহাজারীতে শেরে বাংলা (র) মাজার ভাংচুর, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ওপর হামলা, ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীর পরদিন নারায়ণগঞ্জে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বিজিবি ও পুলিশসহ ৭ জন নিহতের ঘটনা এবং ৬ মে বিকেলে হাটহাজারীতে পুলিশের ওপর হামলাসহ নৃশংসতায় ৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় হেফাজতে ইসলাম নামের এ সংগঠনটি কার্যত সারাদেশে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। সুত্র

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.