আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি আর্ন্তজাতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিছু কথা



আমি বাংলাদেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে নেদারল্যান্ডের একটি আর্ন্তজাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি বিশেষ কোর্স করতে এখানে এসেছি। গত দুই মাস ধরে ক্লাস করলাম। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশ। আমি যে কোর্স করতে এসেছি সেখানে পনের টি দেশ থেকে সাতাশ জন শিক্ষার্থী আছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যখন আমি আমার দেশের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনা করি, কখন অবাক হয়ে যাই।

এখানে পড়তে না আসলে হয়তো কোন দিন জানতামও আমরা আসলে কতটা পিছিয়ে আছি। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদন্ড। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা খাতটিকে যতটা গুরুত্ব দেয় উচিত ততটা দেয়া হয়না। \ এক \ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সময় যখন আবেদনপত্র পুরোন করে পাঠিয়েছি তখন আমাকে আমার সর্বশেষ সনদপত্র, পাসপোর্ট এর স্কান কপি এবং একটি ফটো মেইল করে দিতে হয়েছে। সত্যায়িত কিছুই পাঠাতে হয়নি।

অথচ এখনও বাংলাদেশে প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক কাগজপত্র (সকল সনদপত্র, নম্বরপত্র, নাগরিকত্ব, প্রশংসাপত্র, চারিত্রিক সদনপত্র, তিন/চার টি ছবি ইত্যাদি) সত্যায়িত করে জমা দিতে হয়। যদিও আমার জানামতে অধিকাংশ সত্যায়িত সঠিক ভাবে করা হয় না। আমি এখনও বুঝতে পারিনা, এই সত্যায়িত কাগজগুলি ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য কতটুকু প্রয়োজন বা গুরুত্বপূর্ন। আমার মনে হয় এই সত্যায়িত কাগজপত্র জমা দেয়ার পদ্ধতি বাতিল করা ভালো। কারণ যদি কেউ ভর্তির সুযোগ পায় তবে সে আসল কপি দেখিয়েই ভর্তি হতে পারে।

\ দুই \ আমি যখন বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসার বিষয়ে নিশ্চিত হলাম তখন এই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা আমাকে কিছু তথ্য পাঠিয়ে দিলেন। আমি কিভাবে কম খরচে এই খানে আসতে পারবো। এবং এইখানে আসার পর আমাকে একটি খাম দেয়া হল। পরের দিন আমাকে কি কি করতে হবে তার একটি তালিকা। সেই তালিকায় যা যা করতে হয়েছে, একই ধরনের ফরমালিটি আমাদের দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রেজিষ্ট্রেশনের সময় করতে হয়।

তবে পার্থক্য হচ্ছে আমাদের দেশে এত গোছানো তথ্য সরবরাহ করা হয় না। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এখানে রেজিষ্ট্রেশন এর কাজ করার জন্য আমাকে বিভিন্ন রুমে রুমে দৌড়াতে হয়নি। বিভিন্ন দপ্তরের একজন করে প্রতিনিধি আমাদের রুমে এসে সকল কাগজপত্র জমা নিয়ে তাদের ফরমালিটি সম্পন্ন করেছে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস এর মতো। আমাদের দেশে এটা কল্পনাই করা যায় না।

আমাদের দেশে হলে ছাত্রকেই বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে গিয়ে এই সব কাজ সম্পন্ন করতে হয়। এতে মনে হতে পারে একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে কাজ করানোর ফলে একটা অভিজ্ঞতা হয়, কিন্তু এদের যুক্তিটা একটু আলাদা। তাদের মতে এখানে একটি শিক্ষার্থী পড়াশুনা করতে আসে। অন্য কাজে তার মেধা ও শ্রম ব্যায় না করিয়ে লেখাপড়া সম্পর্কিত বিষয়ে তার মেধা ও শ্রম ব্যায় করতে দেয়া উচিত। \ তিন \ এখানে পনেরটি দেশ থেকে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে এসেছে।

আমাদের দেশেও তেমনি বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। আমরা আসার পরদিন সকল ছাত্রছাত্রী নিয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করলো। অনুষ্ঠানটি হলো শিক্ষাবর্ষ শুরু অনুষ্ঠান ২০০৯। এই অনুষ্ঠানের কয়েকটি বিষয় আমার ভালো লেগেছে। প্রথম বিষয় এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করা হয়, যা অন্য নতুন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রানিত করে।

আমাদের দেশে সাধারণত অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কাজটি শুধূমাত্র নোটিশ এর মাধ্যমে করা হয়। তবে ইদানিং প্রথমআলো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এপ্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সম্মান দিতে বিভিন্ন জেলায় জেলায় একটি অনুষ্ঠান করছে। দ্বিতীয় বিষয় হলো এই উদ্বোধনী দিনে শহরের মেয়র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান সহ এই শহরের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা সবাই উপস্থিত ছিলেন এবং নতুন শিক্ষার্থীদের কে তাদের শহরে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসার জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে পার্টি দিয়েছেন। আমাদের দেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষ শুরুর দিনটি অনুষ্ঠান করে উৎযাপন করা হয় বলে আমার জানা নেই। তবে দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়।

তৃতীয়ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বাসে করে পুরো শহর এবং শহরের আশেপাশে ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ঐতিহ্য ইত্যাদি দেখিয়েছে। যেটার প্রচলনও আমাদের দেশে নেই। তবে আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই বাস আছে আমরা ইচ্ছে করলেই এটি করতে পারি। \ চার \ এই বিষয়টি আসলেই আমাকে চমৎকৃত করেছে। সেটি হলো ইলেকট্রনিক বোর্ড।

প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর একটি করে ইমেইল দেয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই ইমেইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাথে সকল ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করে। একটি এসাইমেন্ট বা রিপোর্ট করতে দিলে সেটিও তাদের কে ইমেইল এর মাধ্যমে জমা দিতে হয়। এতে রিপোর্ট হারানোর ভয়ও নেই আবার কে কখন জমা দিল তার সময় সহ তথ্য থাকে শিক্ষকদের কাছে। বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলেয়ে চলতে বা সর্বশেষ ও আধূনিক তথ্য-প্রযুক্তির খবর রাখতে ইন্টারনেট এর বিকল্প নেই।

যতদিন আমাদের দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট এর সুব্যবস্থা করতে পারনো না, ততদিন আমরা শেখার ক্ষেত্রেও পিছিয়েই থাকবে। এই ইলেকট্রনিক বোর্ডে সকল ক্লাস লেকচার, রুটিন/সময়সুচী, নোটিশ, পরীক্ষার তথ্য, এছাড়াও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বই, ডকুমেন্ট, জার্নাল পেপার ইত্যাদি দেয়া থাকে। এগুলি একজন শিক্ষার্থীর জন্য কতটা প্রয়োজনীয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। যা খুব সহজেই আমাদের দেশেও আমরা করতে পারি। আমাদের দেশেও দু-একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের সুবিধা কিছুটা আছে বলে শুনেছি।

কিন্তু কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। \ পাঁচ \ এটিও আমার কাছে মজার বিষয় মনে হয়েছে। সেটি হলো এখানকার পরীক্ষার পদ্ধতি। আমাদের দেশে প্রথম শ্রেনী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেভাবে পরীক্ষা নেয়া হয় তাতে মুখস্তবিদ্যার মূল্যায়ন বেশি হয়। কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ উল্টো।

এখানে কোন কিছু মুখস্ত করতে হয় না। সবকিছু বুঝে বুদ্ধি খাটিয়ে উত্তর দিতে হয়। এতে মেধার চর্চা হয় কিন্তু আমাদের দেশে তোতাপাখির মত মুখস্ত করে উত্তর দিতে হয়। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা যদি মনে করেন যে এই ধরনের মেধার চর্চা করার পরিবেশ আমাদের দেশেও করা যেতে পারে, তবে অসম্ভব কিছু না। আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিছুটা চেষ্টা করেন কিন্তু সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োম (যেমনঃ প্রশ্ন মডারেশন, গতানুগতিক ধারা অব্যহত রাখা) এর কারনে করা সম্ভব হয় না।

তবে মেধার চর্চার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরী একটা বিষয় শিক্ষার ক্ষেত্রে। তা না হলে পুথিগত বিদ্যা পুথিতেই থেকে যাবে। \ ছয় \ শেষ যে বিষয়টি সম্পর্কে বলতে যাচ্ছি সেটা অনেক কঠিন একটি বিষয় যা আমাদের দেশে কখনও সম্ভব হবে কিনা কে জানে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারক সর্বোচ্চ কমিটির সদস্য হচ্ছে মোট ১০ জন। এর মধ্যে ৫ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা এবং ৫ জন শিক্ষার্থী।

এই ১০ জন লোক এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে। এবং এরা সবাই শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভোটে নির্বাচিত হন। আমাদের দেশে এটি কল্পনা করাও অসম্ভব একটা বিষয়। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান সম্পর্কিত বিষয়েই কিছু বলার অধিকার থাকে সেখানে নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় আসার তো প্রশ্নই আসে না। এই লেখায় মাত্র ছয়টি বিষয়ে কিছু তুলনা করেছি।

আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলি তুলনা করে শুধূ লেখাই দীর্ঘ হবে। আশা করছি আমাদের দেশেও একদিন মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে। বিভিন্ন দেশ থেকে পড়তে আসবে। আশায় আছি আশায় থাকবো।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.