আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অর্থনীতির সহজপাঠ : জনগণের সক্ষমতার নামই উন্নয়ন চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা বড় প্রয়োজন



একবিংশ শতাব্দীতে এসেও উন্নয়ন নিয়ে মানুষের ভাবনার শেষ নেই। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার চলার পথ মসৃণ নয়। যদিও উন্নয়ন এখন অনেক দেশেই রাজনৈতিক শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। যেমন বাংলাদেশে সব সরকারের আমলেই উন্নয়নের জোয়ার (?) বইয়ে গেছে এমন দাবির অন্ত নেই। আসলে অসহায় মানুষের প্রকৃতই ভাগ্যোন্নয়ন ঘটছে কি না তা পরখ করার দাবি রাখে।

আমরা নিজেরাই নিজেদের আশপাশকে জানি। অবহেলা, অন্ন কষ্ট মানুষের মাঝে কতটা প্রকট তা সবাই কমবেশি আঁচ করতে পারছি। তথাপি উন্নয়ন বলতে কি বোঝায় সে সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করছি। উন্নয়ন অর্থে সবার ধারণা সামনে এগিয়ে যাওয়া। দু:খ-দুদর্শা ছেড়ে বেরিয়ে আসা।

আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনমান বাড়ানো। উন্নয়ন বলতে আগেকার ধারণার মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে উন্নয়ন ধারণা আরো ব্যাপকতা পেয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এখন আর উন্নয়নকে শুধু অথনৈতিক উন্নয়নের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। যে কারণে অমর্ত্য সেন বলেছেন- জনসাধারণের সক্ষমতার নামই উন্নয়ন।

তারমতে, ‘মানুষের, সক্ষমতা নির্ভর করে, তার স্বত¦াধিকারের ওপর, অর্থাৎ কি পরিমাণ দ্রব্য এবং সেবা সামগ্রীতে সে তার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তার ওপর। মাথাপিছু কতটা খাদ্য পাওয়া যাবে অথবা মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদন কতটা এ ধরনের সাদামাঠা নির্দেশকসমূহের ওপর যদি নির্ভর করি তো অনাহার, ক্ষুধা এবং বঞ্চনার সমগ্র চেহারাটা উপলব্ধির পথে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। স্বত্বাধিকার নির্ধারণ ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থায় বিভিন্ন বৃত্তিভোগী কর্মগোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের অবস্থা, এ সবের সতর্ক বিশ্লেষণ আবশ্যক। ’ অমর্ত্য সেনের মত আরো অনেকেই আজকাল উন্নয়নকে কেবল কয়েকটি সূচকের মধ্যে সীমিত না রেখে বরং সক্ষমতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ মানুষের কল্যাণকে গৌণ ভেবে কেবল উৎপাদন বৃদ্ধি ও উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

তবে আমরা অমর্ত্য সেনের কথায় যদি ফিরে আসি, তাহলে উন্নয়নকে দেখতে পাই যথার্থরূপে। তিনি বলেছেন, ‘উন্নয়ন আসলে মানুষের স্বাধীনতার চৌহদ্দি বাড়ানোর প্রক্রিয়া। মানুষ তার নিজের চাওয়া-পাওয়া কদ্দূর মেটাতে পারছে সে প্রশ্নটি উন্নয়নের সংজ্ঞায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ’ একথা ঠিক যে উন্নয়নের জন্য মানুষের চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা বড় প্রয়োজন। আমরা যদি মেনে নিই যে-সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব।

তবে সৃষ্টিশীলতার জন্য মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা দিতে হবে। অনিশ্চয়তা আর হুমকির আড়ালে রাখতে হবে তাকে। নইলে সৃষ্টির প্রেরণা আসবে কিভাবে? আবার উন্নয়ন সাধনই যথেষ্ট নয়। উন্নয়নের ধারাবাহিক গতি বা টেকসই হতে হবে। টেকসই উন্নয়নের ধারণা এসেছে মানুষকে ভবিষ্যতের জন্যেও চিন্তাহীন রাখতে।

গুডল্যান্ড এবং লিডকের মতে, ‘টেকসই উন্নয়নকে সামাজিক এবং কাঠামোগত অর্থনৈতিক রূপান্তরের ধারা বা উন্নয়ন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। যা বর্তমানের সহজলভ্য অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুবিধাসমূহের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি সাধন ঘটায় এবং ভবিষ্যতের জন্য তাকে বিপদাপন্ন করে তোলে না। ’ এবারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে আলোচনায় আসি। উন্নয়ন বলতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। অর্থনীতিবিদরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে বুঝিয়েছেন অর্থনৈতিক স্তরের পরিবর্তন।

কোন কোন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে দেশটিকে এগিয়ে নেয়া বা সামনের স্তরে, অগ্রসর করা। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, উৎপাদন ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি। অধ্যাপক রস্টোর মতে, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, উৎপাদনের নতুন কলাকৌশল ও যন্ত্রপাতির আবিষ্কার, মানুষের নিরবচ্ছিন্ন উদ্যম, মূলধন গঠন ও সন্তান-সন্তুতি লাভের প্রবণতার মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল উপাদানগুলো নিহিত হয়েছে। তার এ বক্তব্য ধরে নিলে সামাজিক স্থিরতার বিষয়টি চলে আসে। অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিও চলে আসে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে আর্থার লুইস বলেছেন, ঘন্টা প্রতি কাজের জন্য যদি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় তাহলে বুঝতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। অধ্যাপক সুইডারের মতে, দীর্ঘকালব্যাপী মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা হয়। অধ্যাপক উইলিয়াম ও বাট্টিক বলেছেন, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন দেশের প্রাপ্ত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রব্য ও সেবাকর্মের মাথাপিছু উৎপাদন স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি পায় তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে। এই সংজ্ঞায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুষম বণ্টন ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কোন দেশে কেবল উৎপাদন বা আয় বাড়লেই হবে না, আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।

ধনী গরীব নির্বিশেষে আয়ের সুফল পেতে হবে। কিন্তু কতিপয় লোকের হাতে কুক্ষিগত থাকলে প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বলা যাবে না। উদাহরণ স্বরূপ, বাংলাদেশের কথা বলা যায়। প্রায়ই খবরের কাগজে শিরোনাম হয় বাংলাদেশে ধনী গরীব বৈষম্য বেড়েছে। কিংবা ধনিক শ্রেণী আরো ধনী হচ্ছে।

গরীবরা গরীব হচ্ছে। এটা আয়ের সুষম বণ্টন না থাকার কারণেই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রথাগত কয়েকটি সূচক হচ্ছে জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কল্যাণ। কোন দেশের জাতীয় আয় বাড়তে থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। যদিও জাতীয় আয় বৃদ্ধির তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হলে মাথাপিছু আয়ও জনগণের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।

যে কারণে অধ্যাপক মেয়ার মাথাপিছু আয়কে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তারমতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অপেক্ষা জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার অধিক হলেই তাকে উন্নয়ন বলা যায়। জাতীয় আয়কে দেশের জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে প্রকৃত মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মাপকাঠি মানব উন্নয়ন সূচক। জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মানব উন্নয়ন পর্যালোচনা করে মানব উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশ করে।

মানব উন্নয়ন সূচকে মানুষের শিক্ষা, আয়ুষ্কাল, ক্রয়ক্ষমতা প্রভৃতি বিবেচনা করা হয়। তবে এই সূচকে জাতীয়ভাবে তথ্য নেয়া হয়। কিন্তু ধনী-গরীব বৈষম্য, আঞ্চলিক বা গ্রাম শহরের বৈষম্য আমলে নেয়া হয় না। ফলে এই সূচকে প্রকৃত উন্নয়ন বোঝা যায় না। অনুরূপ কথা প্রযোজ্য অর্থনৈতিক কল্যাণের ক্ষেত্রেও।

ভোগবাদী ধারণাকে এখানে গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে ভোগের বিষয়টি মানসিক এবং একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। তাই ভোগ বিলাস পূরণের মাধ্যমে কল্যাণের কোন সঠিক পরিমাপ হয় না। তবে সাধারণত মানুষ তার ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে-এমনটি হলেই হয়। সন্তুষ্টি অর্জন শুধু বর্তমানের জন্য নয়, ভবিষ্যতেরও নিশ্চয়তা থাকতে হবে।

নইলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। জামাল উদ্দীন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.