আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘জিনের বাদশা’

ফেসবুক আইডি:নাই

আজমল, আফজাল, জহুরুল, হাবিবুর, মোনতাজ, সাবান, কুদ্দুস-এরা সবাই জিনের বাদশা। এক সময়ে ভ্যান, রিকশা, দিনমজুরি, ইট ভাঙা, চাতাল শ্রমিক এবং অন্যের জমিতে ধান ও মাটি কাটার কাজ করতো। এখন জিনের বাদশা সেজে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। শতাধিক জিনের বাদশার নামে হত্যা, প্রতারণা ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের ডজন ডজন মামলা থাকলেও এরা পুলিশের হাতে ধরা পরে না। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখাল বুরুজ, তালুক কানুপুর, নাকাইহাট, বিশ্বনাথপুর, বালুয়া, কালিতলা, শাকপালা, কোমরপুর, হাঁসপাড়া, রামনাথপুর, গোঁসাইবাড়ি, গন্ধর্ববাড়ি, চৌধুরী বাড়ি, বিশুবাড়িসহ বিশাল এলাকাজুড়ে জিনের বাদশাদের রাজত্ব।

তাদের দলের সদস্যরা কেউ পড়ালেখা জানে না। তারপরও নিজেরা প্রতারণার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। দরবস্ত ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামের আজমল নামে এক ব্যক্তি প্রথম দিকে জাল স্বর্ণ মুদ্রা, অলঙ্কার, কষ্টিপাথরের মূর্তিসহ বিভিন্ন জিনিসের লোভ দেখিয়ে প্রতারণা শুরু করে। পরে সহজ পদ্ধতিতে অনেক টাকার মালিক বনে যাওয়া যায় বলে নিজস্ব নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে দেশজুড়ে। ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে শুরু হয় ‘জিনের বাদশা’র বাণিজ্য।

জিনের বাদশা আজমল ও জহুরুল বাহিনীর সদস্যরা মাটি কাটা, ধান কাটাসহ বিভিন্ন কাজের দিনমজুর সেজে ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঢাকা, বগুড়া, খুলনা, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের সর্বত্র। প্রথমে এরা দিনমজুর হয়ে ওইসব এলাকার বিত্তবানদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে কাজ করতে থাকে। তারপর বাড়ির মালিকদের কাছে স্বর্ণ মুদ্রা, অলৌকিকভাবে ধন সম্পদ হাসিলের কথা বলে আস্থা অর্জন করে। সহজ সরল ভেবে বিত্তবানরা এদের ফাঁদে পা দেন। দেশব্যাপী একটি বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে টার্গেটকৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে ভীতিকর পরিণতি, কোটি কোটি টাকা প্রাপ্তির সম্ভাবনা, দুরারোগ্য অসুখ ভাল করে দেয়া- এসব বিষয়কে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অদ্ভুত কণ্ঠে উপস্থাপন করা হয়।

টার্গেট করা লোকদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য প্রতারকরা লোক লাগিয়ে কিছু কিছু ঘটনাও ঘটায়। এরপর তাদের গোবিন্দগঞ্জের গোপন আস্তানায় আমন্ত্রণ জানায়। জিনের বাদশাদের ফাঁদে পা দিয়ে রাতারাতি সম্পদশালী হওয়া, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি এবং ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তারা চলে আসে আস্তানায়। তারপর বিপদের মুখে পড়েন আগত ব্যক্তিরা। এভাবে গত দুই বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জিনের বাদশাদের ফাঁদে পড়ে ৫ জন মহিলা তাদের সম্ভ্রম এবং তাদের কাছে থাকা স্বর্ণালঙ্কারসহ অর্থ হারিয়ে বিদায় নিয়েছেন।

জিনের বাদশাদের রোষানলে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কয়েকজন গৃহবধূ তাদের পারিবারিক সমস্যার সমাধান নিতে এসে ধর্ষণের পর খুন হয়েছেন। পরদিন তাদের লাশ পাওয়া গেছে জিনের বাদশাদের এলাকায়। কণ্ঠস্বর বিকৃত করে ‘জিনের বাদশা’রা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই প্রতারণার জাল বিছিয়ে চলেছে। এদের সম্মোহনী ক্ষমতায় স্থানীয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সহজ সরল নারী-পুরুষ চলে আসছেন তাদের আখড়ায়।

আর এক সময় অর্থ, স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব মানুষে পরিণত হচ্ছেন। নারীদের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, এলাকার প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় এরা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। জয়পুরহাটের র‌্যাব ৫-এর সদস্যদের হাতে এই চক্রের ছোট দুর্গাপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান (৪০) ও একই গ্রামের মিন্টু মিয়া (২৫) ধরা পড়েছে। এরা ছোট দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নওগাঁ থেকে আসা ফজলুর রহমান নামের এক ব্যক্তিকে প্রতারণা করে ১০ হাজার টাকা ও একটি মূল্যবান মোবাইল সেট নিতে এসে র‌্যাবের জালে ধরা পড়ে।

বিক্রমপুরের এক ব্যক্তি হঠাৎ মাস কয়েক আগে গভীর রাতে মোবাইল ফোনে একটি অদ্ভুত কণ্ঠ শুনতে পান। নাকি কণ্ঠে নিজেকে ‘জিনের বাদশা’ পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি জানায়, আমরা ‘জিন জাতি’-দ্যাখ এখনিই তোর বাড়িতে আপেলের বৃষ্টি হবে। ঘর থেকে বের হয়ে তিনি দেখেন সত্যিই আঙিনায় আপেল পড়ে আছে। এরপর ফ্লেঙি করে ৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়। না দেয়ায় জিনের কথা অনুযায়ী ওই ব্যক্তির ৫টি রামছাগলের একটি মারা যায়।

পরিবারের ৩ জন অসুস্থ হবে- এই ভবিষ্যদ্বাণী শুনে তিনি কথিত জিনের কথা অনুযায়ী নিজের ছোট মেয়েকে নিয়ে গোবিন্দগঞ্জের একটি গ্রামে আসেন। নানা অপ্রীতিকর ঘটনার পর বিষয়টি সুরাহা হয় এবং ‘জিনের বাদশা’ নামধারী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরে জানা গেছে, কাজের মেয়ের মাধ্যমে ওই ঘটনাগুলো ঘটানো হয়। একইভাবে এদের হাতেই প্রতারিত হন সিলেট থেকে আসা মা ও ছেলে। গত দু’মাস আগে মোবাইল ফোনে এক ‘জিনের বাদশা’ ওই ছেলেটির রোগ ভাল করে দেবে বলে গোবিন্দগঞ্জে ডেকে এনে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়।

এভাবে বিভিন্ন কৌশলে দূর-দূরান্ত থেকে আগত লোকজনের কাছ থেকে প্রতারণা ও জোরপূর্বক স্বর্ণালঙ্কার টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়। জিনের বাদশা দলের যে সদস্যরা সারাজীবন অন্যের জমিতে কাজ করতো তারা এখন কোটিপতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। টিনের ছাপড়া ঘর ফেলে দিয়ে বিশাল অট্টালিকা গড়ে তুলেছে জিনের বাদশা আজমল ও জহুরুলসহ কয়েক জন। কেউ হয়েছে ধান-চাল কলের মালিক, কেউ হয়েছে ডিশ লাইনের ব্যবসায়ী। তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে স্থানীয় থানা পুলিশ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা পর্যন্ত অনেকের।

এ কারণে জিনের বাদশারা বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় যুব সমাজ জিনের বাদশাদের প্রতারণার কবল থেকে মানুষকে রক্ষা করতে নাগরিক কমিটি গঠন করে প্রতিবাদ সমাবেশ, সুধী সমাবেশ ও মিছিল সমাবেশ করেছে। পুলিশের বড় কর্মকর্তারা একাধিকবার সচেতনতামূলক সমাবেশের আয়োজন করেও ব্যর্থ হয়েছে। জিনের বাদশা নামের প্রতারক চক্রের সদস্যদের নামে গাইবান্ধার সাত উপজেলার থানায় কমপক্ষে অর্ধশত মামলা দায়ের করা হয়েছে। ধর্ষণ, হত্যা, প্রতারণা, মারপিট, অপহরণ মামলার মতো অপরাধ মামলার সঙ্গে তারা জড়িত।

ইতিমধ্যে র‌্যাব ও পুলিশের হাতেও ধরা পড়েছে কমপক্ষে শতাধিক জিনের বাদশা। দরবস্ত ইউনিয়নের এক ‘জিনের বাদশা’ জানায়, এই পেশায় প্রচুর লাভ আছে-এই প্রলোভন দেখিয়ে আজমল তাকে ‘জিনের বাদশা’ বানায়। এই কাজ করতে হলে একটি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে হয় এবং কথা বলার ভঙ্গিও রপ্ত করতে হয়। তবে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে কেউই ব্যাপারটি পছন্দ না করায় লজ্জায় এবং অপমানে সে ওই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে এসেছে। তালুককানুপুর ইউনিয়নের দুই সন্তানের জননী (২৭) এক মহিলা জানান, স্বামী ‘জিনের বাদশা’ হওয়ায় লোকলজ্জায় তিনি ঘর থেকে বের হতে পারতেন না।

প্রতিবাদ করায় গত ৭ দিন আগে স্বামী তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। স্বামী ওই পেশা না ছাড়লে তিনি আর তার ঘরে ফিরে যাবেন না বলে জানান। গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরহাদ ইমরুল কায়েস জানান, পুলিশি তৎপরতার মুখে ‘জিনের বাদশা’ প্রতারকরা তাদের হাত গোটাতে বাধ্য হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। সামাজিক প্রতিরোধও এক্ষেত্রে অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, গত ৬ মাসে এদের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা হয়েছে।

পলাতক প্রতারকের মালামালও ক্রোক করে আনা হয়েছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।