আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী: নারী জাগরণের বিস্মৃতপ্রায় আরেক অগ্নিকন্যা...!

দ্য ইনভিজিবল

ভারতবর্ষে তখন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিদ্যমান। তৎকালিন কুমিল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি: ডগলাস একটি জনহিতকর কাজে হাত দিয়ে অর্থাভাবে বিপাকে পড়েন। তখনকার অনেক বিত্তশালীদের কাছে অর্থ সহায়তা চেয়ে তিনি নিরাশ হ'ন। এমতাবস্থায় সেই সময়কার হোসনাবাদ পরগনার জমিদার ফয়জুন্নেসা ডগলাসের জনহিতকর পরিকল্পনাটি সর্ম্পকে বিস্তারিত অবগত হন। এবং অর্থাভাবের সংবাদটিও তাঁর কর্ণগোচর হয়।

তখন ফয়জুন্নেসা ডগলাসের পরিকল্পনাটি নিরীক্ষণ করে এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জনসাধারণের বৃহত্তর কল্যাণের বিবেচনায় চাহিত অর্থ প্রদান করতে সম্মত হন। তবে শর্ত থাকে যে বৃটিশ নিযুক্ত ম্যাজিষ্ট্রেট উক্ত অর্থ কর্জ হিসেবে নয়; বরং দান হিসেবে গ্রহণ করবেন। সে সময় সমগ্র ভারতের ন্যায় বাঙালী মুসলমান সমাজ সব ক্ষেত্রেই বৃটিশদেরকে সন্দেহ ও ঘৃণার চোখে দেখতো। বিষয়টি নিশ্চয় ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের অজানা ছিলনা। তথাপি ফয়জুন্নেসার মত একজন বিদূষী রমণী'র এই অপ্রত্যাশিত দান মি: ডগলাসকে হতবাক করে দেয়।

ফয়জুন্নেসার এমন অভাবনীয় উদারতায় মুগ্ধ হয়ে মি: ডগলাস বিষয়টি মহারাণী ভিক্টরিয়াকে অবহিত করেন। রাণী ভিক্টরিয়াও বিষয়টি অবগত হয়ে অত্যন্ত খুশি হন। এবং ফয়জু্ন্নেসার প্রতি প্রীত হয়ে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন, সরকারিভাবে যেন তাঁকে সম্মানিত করার জন্য 'বেগম' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। খবরটি শুনে ফয়জুন্নেসা বিনীতভাবে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, ইতোমধ্যে জমিদারেরন তনয়া এবং আরেক জমিদারের সহধর্মীনি হিসেবে তিনি 'বেগম' হিসেবে সবার কাছে সমধিক পরিচিত।

তাই নতুন করে 'বেগম' উপাধি নেয়া অনর্থক। মহারাণী ভিক্টরিয়া ব্যাপারটির গুরুত্ব উপলদ্ধি করে স্থির করেন যে, বৃটিশ ভারতের এ নিভৃত পল্লীর এই বিদূষী রমণী'র যথার্থ উপাধি হবে 'নওয়াব'। তারই ফলশ্রুতিতে ১৮৮৯ সালে মহারাণী ভিক্টরিয়ার নির্দেশক্রমে ফয়জুন্নেসাকে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে 'নওয়াব' উপাধি দেয়া হয়। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব। এই নারী জাগরণের পথিকৃত রমণী ১৮৩৪ সালে বর্তমান কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানার অর্ন্তগত পশ্চিমগাঁও নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।

ফয়জুন্নেসা ছিলেন তৎকালিন বৃটিশ ভারতের জনপ্রিয় জমিদার,জমিদার আহমদ আলী চৌধুরী এবং আরাফান্নেসা চৌধুরীণী'র কন্যা। মোগল রাজত্বের উত্তরসূরী এই মহীয়সী নারীর ছিল দুই ভাই, এয়াকুব আলী চৌধুরী এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী। তাঁর দু'জন বোনও ছিল। তাঁদের নাম লতিফুন্নেসা চৌধুরাণী এবং আমিরুন্নেসা চৌধুরাণী। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার সাধারণ রীতি অনুযায়ী ফয়জুন্নেসা তাঁর অন্যান্য ভাই-বোনদের মতই রক্ষণশীল পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেন।

যেখানে পর্দাপ্রথা ছিল নারীর জন্য বাধ্যতামূলক সেখানে এমন চারদেয়ালের মাঝে থেকেও ফয়জুন্নেসা ছিলেন স্বাধীনচেতা। এধরনের প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি এগিয়ে গেছেন আপন লক্ষ্যে। ফয়জুন্নেসা তাঁর চিন্তা ও কর্মে ছিলেন পুরোপুরি আধুনিক । সেকালের সমাজ ব্যবস্থার সকল বাঁধা পেরিয়ে তিনি ছিলেন মন মানসিকায় সম্পূর্ণ কুসংস্কারমূক্ত।

তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম অন্ধকার দিক মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ের দোরগাড়া পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতো না। তারা বাড়ীর চারদেয়ালের মধ্যেই বন্দী থাকতো। কিন্তু শিক্ষার প্রতি ফয়জুন্নেসার অদম্য আগ্রহ দেখে তাঁর পিতা তাঁর জন্য বাড়ীতে গৃহশিক্ষক রাখার ব্যবস্থা করেন। ফয়জুন্নেসা খুবই দ্রুত আরবি, ফার্সি'র পাশাপাশি বাংলা ও সংস্কৃতি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৮৬০ সালে আরেক স্বনাম জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজী'র সাথে তাঁর বিয়ে হয়।

কিন্তু, সংসারের কঠিন দায়িত্বও তাঁকে জ্ঞান আহরণের তীব্র আগ্রহ থেকে টলাতে পারেনি। তাঁর দুই কন্যা আরশাদুন্নেসা এবং বদরুন্নেসাসহ পরিবার সামলেও তিনি হ'ন বৃটিশ ভারতের প্রথম মহিলা কবি। ১৮৭৬ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'রুপজালাল' প্রকাশিত হয়। অবশ্য তাঁর দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। তিনি ছিলেন মোহাম্মদ গাজী'র দ্বিতীয় স্ত্রী।

এক পর্যায়ে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। ১৮৭৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারি লাভ করেন এবং ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর মাতুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। নারীমুক্তি ও নারী অগ্রজাগরণের পথিকৃত এই মহীয়সী ১৮৭৩ সালে আরেক বিদূষী 'বেগম রোকেয়া'র জন্মের সাত বছর পূর্বে নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটি উপমহাদেশের বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীন স্কুলগুলোর অন্যতম। কালক্রমে এটি একটি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং এর নাম হয় নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ।

১৮৯৩ সালে পর্দানশীন , বিশেষত দরিদ্র মহিলাদের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজ গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। নাম ছিল 'ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল'। তিনি ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এতিমখানা সড়ক নিমার্ণ করে তাঁর মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হাজ্বব্রত পালন করার প্রাক্কালে তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি 'মুসাফিরখানা' এবং মদিনায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর সোনিয়া নিশাত আমিন তাঁর 'The World of Muslim Women in Colonial Bengal,1876-1903 গ্রন্থে বলেন, "At the time when sporadic efforts were taking place to develop the condition of education in this part of the world , a Muslim woman came forward with a daring plan to set up a school for PURDANASIN girls in comilla." পশ্চিমগাঁওয়ের নওয়াব বাড়ী'র সন্নিকটে ডাকাতিয়া নদীর পাড় ঘেষে ফয়জুন্নেসা বালকদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

যা কালক্রমে 'নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানেও কলেজটি স্বীয় ঐতিহ্য আর সম্মান নিয়ে ডাকাতিয়া'র পাড়ে স্বীয় দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফয়জু্ন্নেসা'র ধর্মপরায়নতার উদহরণও ছিল অনন্য। জাতভেদ তিনি অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। তাঁরই সাহায্য আর সহযোগিতায় লাকসামে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য মন্দির,উপাসনালয়।

তিনি নওয়াব বাড়ীর সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মহৎ শিক্ষানুরাগী 'কুমিল্লা ভিক্টরিয়া কলেজ' প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সেই সময়কার ১০ হাজার টাকা কলেজ নির্মানে দান করেন। নওয়াব ফয়জুন্নেসা তাঁর নওয়াব বাড়ীর অদূরে একটি ফ্রি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কালক্রমে যেটি বিস্তৃত হয়ে বর্তমানে 'গাজীমুড়া আলিয়া মাদ্রাসা' হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাঁর কন্যা বদরুন্নেসার সহযোগিতায় পশ্চিমগাঁওয়ে "নওয়াব ফয়জুন্নেসা ও বদরুন্নেসা উচ্চবিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেন।

যে বিদ্যালয় হতে অদ্যবধি অসংখ্য মেধাবী ছাত্র/ছাত্রী উল্লেখযোগ্য ফলাফল করে 'কুমিল্লা বোর্ডে' বিশেষ স্থান দখল করে আসছে। ফয়জুন্নেসা বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বান্ধব,ঢাকা প্রকাশ, মুসলমান বন্ধু, সুধাকর, ইসলাম প্রচারক প্রভৃতি বাংলা পত্রপত্রিকা তাঁর আর্থিক সহায়তা লাভ করেন। সঙ্গীতসার ও সঙ্গীতলহরী নামে তাঁর দুখানি কাব্যের কথাও জানা যায়। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী এমন এক সময়ে বাংলা ভাষ ও সাহিত্য চর্চা করেন যখন অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে এই ভাষা ব্যবহার হতো না।

নারী জাতিকে শিক্ষা-দীক্ষায় আর আধুনিকতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে সে যুগে যা ছিল অকল্পনীয়! এই মহীয়সী রমনী ১৯০৩ সালে নিজ বাড়ীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ২০০৪ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। বর্তমানে নওয়াব ফয়জুন্নেসার স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগের অভাবে ধ্বংষপ্রায় হয়ে পড়েছে। নওয়াব বাড়ীর সেই জৌলুসও এখন আর আগের মতন নেই।

ফয়জুন্নেসার বংশধরগণও আর তেমন নওয়াব বাড়ীতে তেমন একটা থাকেনা। নওয়াব বাড়ী'র পাশে যে ফয়জুন্নেসা স্মৃতি পাঠাগারটি আছে বর্তমানে সেটিও জীর্ণপ্রায় । তথ্যসূত্র: ১.বাংলা উইকিপিডিয়া ২. ফয়জুন্নেসা স্মৃতি পাঠাগার ৩.বিভিন্ন ওয়েবসাইট ৪.স্টার ম্যাগাজিন ৫.সোনিয়া নিশাত আমিন-'The World of Muslim Women in Colonial Bengal,1876-1903 //স্বরণীয়: লেখাটি তৈরী করতে অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইংরেজি সূ্ত্রের অনুবাদ তুলে দেয়া হয়েছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।