আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ছোটভাই......

...

আমার ছোট ভাই, আতিক, অনেক ক্ষেত্রেই আমার চেয়ে বেশী দক্ষ। সে আমার চেয়ে ভালো গেম খেলে, আমার চেয়ে জোরে দৌড়ায়। ছোটবেলায় অন্যদের সাথে মারামারি করতে গেলে সে আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। আমার চেয়ে ভালো ফুটবল খেলে ( বাস্তবে এবং কম্পিউটারে)। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় পরিচয়- সে আমার চেয়ে ভালো মানুষ।

একটা উদাহরন দেই। গরীবের ঘোড়া রোগের মতই আমার একদা একটি PDA কেনার শখ চাপল। পেপারে খুব সস্তা চাইনিজ পিডিএ এর বিজ্ঞাপন দেখে হাজার সাতেক টাকা নিয়ে গেলাম কিনতে একটা। দোকানে সামান্য সময় নাড়াচাড়া করেই বুঝলাম এইটা আসল “মাল” না। এতে হবে না।

কিছুদিন ঘুরলাম সেকেন্ড হ্যান্ড কিছু পাওয়া যায় কিনা তার আশায়। আতিক বিসিএস কম্পিউটার সিটিতে গিয়ে পিডিএ এর খোজ নিয়ে আসল। HTC ব্র্যান্ড এর। দাম বাইশ হাজারের মত। দাম শুনেই বুঝলাম- এই জিনিস কেনা আমাদের সাধ্যের বাইরে।

পরের কিছুদিন নেটে সেকেন্ডহ্যান্ড কিছু সেট খুজছি। হাজার দশেকে ভিতর সেকেন্ডহ্যান্ড পাওয়া যেতে পারে এমন সব সেটের প্রোফাইল সেভ করে রাখছি। আতিক একদিন পিসিতে দেখলো সেইসব ফাইল। পরদিন বিকালে আমি চুল কাটিয়ে বাসায় এসে দেখি আমার জন্য অপেক্ষা করছে HTC এর একটা টাচ স্ক্রীন পিডিএ। -টাকা পাইলি কই? -টাকা ছিল না, কিস্তিতে কিনে আনলাম তোর জন্য।

ছয় মাসের ভিতর শোধ হয়ে যাবে। সেই HTC এর সেট, গরীবের একমাত্র ঘোড়া – খুব গর্বের সাথেই আমি ব্যবহার করতে লাগলাম। কিন্তু ছয় মাস পার হবার আগেই, কিস্তির টাকা শোধ হবার আগেই- সেটটার স্ক্রীনটা ফাটিয়ে ফেললাম। জানা গেল সেটটা ঠিক করতে বার হাজার টাকা লাগবে। আমি বুঝলাম আমার ঘোড়ার চারপা-ই ভেঙ্গে গেছে।

দুই তিন মাস পরের কথা। আমার হাতে কিছু টাকা জমেছিল -ঈদের বোনাস আর বেতন থেকে জমানো টাকা। আতিককে একদিন হাজার বিশেক টাকা দিয়ে বললাম, আমাকে HTC কিনে দিয়েছিলি। তোকে দিলাম এই টাকা। এইবার তুই কিন।

দুইভাই মিলে কয়েকটা সেট দেখে আসছি। পছন্দ হলো না। আমি ঢাকার বাইরে চাকরি করি। প্রতি সপ্তাহে অবশ্য আসা যাওয়া করি। তাই বলে গেলাম, তুই কিছু একটা কিনে নিস।

পরের সপ্তাহে এসে দেখব কি কিনলি। পরের সপ্তাহে এসে দেখি আতিক নিজের জন্য না কিনে , আমার জন্য আরেকটা মোবাইল কিনে নিয়ে আসছে। তার চোখে পড়েছে, আমার HTC নষ্ট হবার পর- অন্য মোবাইল ব্যবহার করতে সমস্যা হচ্ছে। অথচ সে তার নিজের মোবাইলের সুইচ খুলে যাওয়ায় সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া দিয়ে ব্যবহার করে। পিঠাপিঠি ভাই বোন থাকায় ছোটবেলা থেকেই আমাকে আলাদা খাটে থাকতে হয়।

যতদূর মনে পড়ে ক্লাস ওয়ানে পড়ার আগে থেকেই আমি একলা খাটে থাকি। আমার মা আমার সাহসের কিছু গল্প করেন। আমি নাকি কিছুতেই একলা থাকতে ভয় পেতাম না। পরবর্তীতে আমার ভাই এসে আমার সাথে যোগ দেয়। আমরা দুইজন আলাদা খাটে থাকতাম।

বাবা মায়ের সাথে আমার ছোটবোনটা থাকত। আতিক মাঝে মাঝে রাতে ভয় পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ত। সে নাকি কিছু দুঃস্বপ্ন দেখত। সেইসব স্বপ্নের খুব পরিস্কার ব্যাখ্যা দিতে পারত না। খালি একটা ফিতা আর সেটা প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে সে আটকা পড়ে যাচ্ছে- এমন কিছু দেখত।

আমিও ছোটরা সচরাচর দেখে এমন কিছু দুঃস্বপ্ন দেখতাম। ঘুম থেকে উঠে আমারো খুব ভয় লাগত। কাদতে ইচ্ছে করত। কিন্তু একটু অদ্ভুদ ব্যাপার ছিল কাউকে স্পর্শ করে থাকলেই আমার ভয় কেটে যেত। ছোটভাইটা কাছে থাকায়, আমি রাতের দুঃস্বপ্নের শেষে তার হাতটা শুধু স্পর্শ করে রাখতাম।

এতেই আমার ভয় কেটে যেত। খাটের নিচের অশরীরীরির ভয় কেটে যেত শুধু রক্ত মাংসের জীবন্ত মানুষের স্পর্শেই। এইকারনে আমি খুব সাহস দেখাতে পারতাম। মায়ের ধারনা ছিল তার বড় ছেলেটা ছোটটার মত এত ভীতু নয়। আমি এখনো রাতের বেলা দুঃস্বপ্ন দেখি।

বুয়েটের হলে থাকার সময়ও দেখতাম। তখনো দুই ভাই এক রূমে থাকি। প্রচন্ড ভয় পেয়ে জেগে উঠতাম। আমার বেড থেকে উঠে তার পাশে গিয়ে বসে থাকতাম কয়েকমিনিট। আমার সমস্ত ভয় চলে যেত।

ইদানীং ভয় পেয়ে জেগে উঠলেও আতিককে আশে পাশে কোথাও পাই না। কঠিন দুনিয়ায় টিকে থাকার চেষ্টায় দুইজন দুইদিকে ছুটে যাচ্ছি। এখনো ভয় পেয়ে রাতে ঘুম ভাঙ্গে। এখনো আমি মনে মনে ভাবি, আমার ছোট ভাইটা আমার পাশেই আছে। তার হাতটা ধরতে বড় ইচ্ছে হয়।

======================= আজ আতিকের জন্মদিন। রাতে ভয় পেয়ে তাকে স্পর্শ করে থাকার কথাটা এতদিন বলিনি, আজকে বললাম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।