আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রমজানের সিসিফাসায়ান

কাগু ক্যান স্টার্ট অ্যা ফায়ার ইউজিং জাস্ট টু আইস কিউবস

তারপর একদিন আমাদের মহল্লাতেও বস্তাবন্দী মেয়ের লাশ পাওয়া যায় । চৌধুরি বাড়ীর সামনের বিশ কাঠার বিশাল খোলা মাঠে ইট আর সুড়কির চিপায় মূলত স্যুটকেসের ভিতরে সেই লাশ পাওয়া গেলেও আমরা লো-কালচার্ড পোলাপান সেটাকে বস্তাবন্দী মাইয়ার লাশই বলি । হয়ত আমরা সেইসব শৌখিন ব্যাগ কখনো নিজেরা ব্যবহার করিনাই বলে যেকোন কিছু রাখার থলেকেই আমরা বস্তা বলি, অথবা মেয়ের লাশের মত এমন তুচ্ছ জিনিস মোড়াতে বস্তার চাইতে দামী কিছু ব্যবহার করার ব্যাপারটি আমাদের মাথায় ভালোমত ঢুকেনা বলে । আমাদের বিকালিক চা সিগারেটের আড্ডায় এটা অবশ্য তেমন ঝড়তোলা ঘটনা হয়ে উঠে না । মাঝে মাঝে কেউ একজন হয়ত দেশের গড়পড়তা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিন লক্ষণ হিসাবে অথবা মহল্লাটির দিনদিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা নিয়ে কথাবার্তাতেই বিষয়টি তুলে আনে ।

তবে সেসব তেমন স্থায়ী হয় নাই । কেবল চারকোনা মাথার রমজানের সেই বিষয়ে জড়িয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত । রমজানের মাথাটিকে ঠিক চারকোনা বলা যায় না, আবার আমাদের মত ঠিক মোটামুটি গোলও বলা চলে না । সে যেহেতু আজাদ প্রোডাক্টের শ্রমিক এবং যেহেতু তার টেম্পু ড্রাইভার বাপ তাদের মা আর চার ছেলেকে ফেলে ভেগে গেছে আমাদের স্মৃতি শুরু হওয়ারও আগে, সেহেতু তার কনফিউজিং মাথাটিকে চারকোনা বলে সর্বসম্মত হতে আমাদের তেমন কষ্ট হয়নি । মহল্লার মৌসুমি ক্রিকেট এবং ফুটবল দলের পিছনে প্রচুর শ্রম দেয়ার ফলস্বরুপ কখনো কখনো আমরা থাকে চাইরকোণা রমজান না বলে ম্যানেজার রমজান বলে ডাকলেও তাতে তাচ্ছিল্যের ভাবটাই বেশি থাকতো , যদিও স্নেহেরও তেমন ঘাটতি থাকতো না ।

আমাদের চাইতে বয়সে সে ঠিক কতটা বড় তা না বুঝা গেলেও, আমাদের উপরে নীচে কয়েক প্রজন্মের সবাই তাকে বন্ধু বা ভাঁড়ের মত বলে ভাবতো, এবং হয়তো দারিদ্রের কারণে অথবা কেবল বিশুদ্ধ অমায়িক চরিত্রের কারণেই এই নিয়ে তাকে কখনো মনঃক্ষুন্ন মনে হয় নি । লিখতে না জানলেও বেহায়ার মত অনেক উপহাস সহ্য করে রমজান পত্রিকা পড়তে শিখেছিলো এবং প্রায়ই অসময়ে আমাদের ঘরে পত্রিকা পড়ার জন্য হাজির হয়ে সে বিরক্তির উৎপাদ করতো নিয়মিতই । আমাদের ভিতরে ইশকুল কলেজে গিয়ে অর্জন করা জ্ঞান কচকচ করতো বলে পত্রিকার পাতায় আমরা চোখ বুলাতাম কেবল , পড়তাম না । কখনো সখনো আন্না কুর্নিকোভা বা মার্টিনা হিঙ্গিস কোন টুর্নামেন্ট জিতলো কিনা অথবা এইবারের অ্যাশেজ সিরিজ কে জিতলো এইসব দুয়েকটি খবর আমার সচিত্র হলে পড়তাম । তখনো আমরা মারিয়া শারাপোভা বা সানিয়া মির্জার আপস্কার্ট যুগে প্রবেশ করি নাই ।

জাতে উঠার চেষ্টায় রমজান এইসবে মাঝে মাঝে আগ্রহ দেখালেও, তার মূল আকর্ষণ আমরা অনেক দিন ধরেই খেয়াল করেছিলাম আমাদের মহল্লা বা থানা নিয়ে কোন খবর আছে কিনা সেইসবে । যদিও আমাদের চারপাশে অঘটন ছাড়া তেমন বড় কিছু কখনোই ঘটতো না এবং আমাদের মহল্লার বড় বড় রংবাজদের লাশ কোন এক অদ্ভূত কারণে সবসময়ই পাওয়া যেত নারায়নগন্জ বা শীতলক্ষ্যার পাড়ে, তবু সেইখানে কালেভদ্রে আমাদের মহল্লার নামের উল্লেখ থাকতো । আর সেইসব খবর রমজান ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে ধমক খাওয়ার আগ পর্যন্ত বানান করে করে আমাদের শোনাতো । অন্যসব সোর্স থেকে আমরা সেইসব খবর আগেই জানতাম বলে বিরক্ত হলেও রমজানের উৎসাহে ভাটা কমই দেখা যেতো, এবং বিভিন্ন বাড়ির ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকা থেকে সে কেবল ঘটনাগুলির উপরেই চোখ রাখতো না বরং সেইগুলির ফলোআপও নিয়মিতই চেক করতো । কিন্তু এইসব ঘটনা একদিন দুদিনেই চাপা পড়ে যেতো এবং রমজান মাঝে মাঝে সেইসব নিয়ে কথা তুলে আমাদের ধমক খেতো ।

এইসবের বাইরে রমজানের আরেকটি বিকৃত রুচি ছিলো । বিভিন্ন পত্রিকা ঘেঁটে দেশ জুড়ে ধর্ষণের পর খুন হওয়া যুবতী/শিশু/নারীদের লাশ আবিষ্কারের ঘটনাগুলি সে পড়তো এবং মাসের পর মাস জুড়ে সেসব ঘটনার ফলোআপের জন্য অপেক্ষা করতো । দেশের বিস্তীর্ন ভূগোলে এইসব ঘটনা নিয়মিতই ঘটতো, কিন্তু লাশ আবিষ্কারের পর তার বেশি কিছুর কথা পত্রিকাতে না পেয়ে সে হতাশ হলেও, সবার কাছে সেইসব বলার সাহস তার ছিলো না । সে আজাদ প্রোডাক্টসের কামলা ছিলো এবং তার টেম্পুচালক বাপ তাদের মা আর চার ছেলেকে রেখে আমাদের স্মৃতি শুরু হওয়ার আগেই পালিয়ে গিয়েছিলো বলে দুনিয়ার বিচারের উপর সামান্য ভরসা ফিরে পাবার আশাতে বা নিতান্ত নিষ্ঠুরতায় প্রাণ হারানো হতভাগীদের জীবনের মূল্য কতটুকু এইসব গভীর ভাবনা তার থাকার কোন কারণ থাকতে পারে বলে আমাদের কখনো মনে হয়নি । অবশেষে আমাদের মহল্লায় এমন একটি ঘটনা ঘটলে বস্তাবন্দী মেয়েটির নাম পরিচয় জানার আমাদের নিস্পৃহতায় হতাশ না হয়ে রমজান একটি অপরিচিত পত্রিকা থেকে ঠিকই খবরটি বের করে আনে এবং আমাদের দেখায় ।

ঘটনাটি যেহেতু আমাদের মহল্লাতেই ঘটে এবং আমরা যেহেতু তখনো মারিয়া শারাপোভা বা সানিয়া মির্জার আপস্কার্ট যুগে প্রবেশ করিনাই সেহেতু মেয়েটির নাম পরিচয় জানার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ একেবারে শূণ্য থাকেনা । কিন্তু অপরিচিত পত্রিকাটি আসলে কোন সঠিক খবর দিতে পারেনা এবং কেবল পুলিশের ধারণার কথাই ছোট ছোট অক্ষরে একটি অগুরুত্বপূর্ণ পাতায় বর্ণনা করে । অবশ্য মেয়েটিকে কোথাও ধর্ষণের পরে শ্বাসরোধে হত্যা করে এখানে এনে ফেলে দেয়া হয়েছে এইটুকু ধারণা করার জন্য কারো যে পুলিশ হতে হয় না তা বুঝতে পেরে অযথা আমাদের সময় নষ্ট করার জন্য আমরা রমজানকে ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিই । ফলে সে যে জীবনে প্রথমবারের মত একটি পত্রিকা কিনে সেটি নিজের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলো এইকথা আমরা জানতে পারি না আরো কিছুদিন পর্যন্ত । আমরা সবাই তুচ্ছ ঘটনাটির কথা মোটামুটি ভুলে গেছি এমন সময়ে অর্থাৎ ঘটনাটির দিন তিনেক পরে একদিন সকালে রমজানের ক্ষীণদেহী যক্ষারোগী মাকে আমাদের বড়ভাইদের একটি জটলাতে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে ব্যাপার কি জানার জন্য এগিয়ে গেলে শুনতে পাই, গতরাতে রমজান অফিস থেকে বাড়ীতে ফিরে নাই এবং কোন খবরও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ।

বড় ভাইরা সে ফিরে আসবে , হয়তও কোন বন্ধুবান্ধবের বাড়ীতে গিয়েছে এইসব আশাবাদী ভবিষ্যৎবাণীতে আঃশ্বস্ত করতে চাইলেও সেইসবে রমজানের মায়ের আগ্রহ ছিলোনা । হয়ত সঙ্গত কারণেই অথবা মায়ের মন বলেই আমাদের ক্ষীণভাবে মনে হলেও মূলত আমি রমজানের একটি গোপন গতকদিনব্যাপী অস্থিরতার খবর জানতাম বলেই অন্যদের সাথে নিয়ে কি করা যায় এই ভাবনাতে নামি । অবশ্য আমাদের হাতে অতবেশী অপশন ছিলোনা । প্রথমেই যেটি মনে আসে , থানায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা, সেটি করতে গিয়ে অদ্ভূতভাবে প্রথম চেষ্টাতেই আমরা রমজানকে আবিষ্কার করি থানাহাজতে । যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের তদারকিতে বস্তাবন্দী মেয়েটির লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের হিমাগারে স্থানান্তর করা হলেও , প্রাথমিক তদন্ত চালাচ্ছে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশই এই খবরটি জীবনে একমাত্র কেনা পত্রিকা থেকে রমজান পেয়েছিলো এবং তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে খোঁজ খবর করতেই আজাদ প্রোডাক্টস থেকে ফেরার পথে সে থানায় ঢুঁ মেরেছিলো ।

থানার পুলিশের পক্ষে কেনো, কারো পক্ষেই তাকে সাংবাদিক ভাবা সম্ভব ছিলোনা বলে খুনী অথবা খুনীর সাহায্যকারী হিসাবে যৌক্তিকভাবে সন্দেহজনক মনে হওয়াতে একদফা চড় থাপ্পড় লাথির পরে তাকে হাজতে পুরে রাখা হয়েছিলো । আমাদের মধ্যেকার কয়েকজনের নেটওয়ার্ক এবং রমজানের মায়ের আঁচলের খুঁটে রাখা বাসাভাড়ার টাকায় পরদিন রমজানকে আমরা হাজত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসলেও ঠিক রাজনৈতিক নেতাদের মত মুক্তিপরবর্তী সংবর্ধনা সে পায় নাই । উল্টা অতিরিক্ত পাকনামী বা কাবিলাতির জন্য তিরষ্কার তাকে যথেষ্ঠ পরিমাণ করা হলেও অন্যসব উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটানোর পরে যেমন হত, দুয়েকটা চড় থাপড় দেয়ার মত শরীরের অবস্থা তার ছিলোনা । কেবল আমার ভিতরে রমজানের মানবিকতা বিষয়ক গোপন প্যারাডক্স জেঁকে ছিলো কয়েকদিন । সুস্থ্য হয়ে কামলাতে ফিরার পরেও কয়েকমাস ধরেই রমজান কেবল অপরিচিত বস্তাবন্দী লাশটির নাম পরিচয় জানায় কোন অগ্রগতি হয়েছে কিনা এই খবর জানার জন্য আমি ছাড়া অন্য সবার অগোচরে যাত্রাবাড়ী থানায় আসা যাওয়া করেছিলো, পুলিশের উপহাসের মুখে ।

বিচারের আশা করার সাহস ততদিনে তার নাও থাকতে পারে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।