আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছাত্র ইউনিয়ন কি ও কেন?

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

ছাত্র ইউনিয়ন কি ও কেন? ছাত্র ইউনিয়ন ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’ একটি স্বাধীন ছাত্র গণসংগঠনের নাম। ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিয়ে ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল এর জন্ম। ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রদের এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা ছাত্রস্বার্থ রক্ষা ও ছাত্রদের অধিকার আদায়কে অগ্রাধিকার দেয়। সকল শিক্ষার্থীর জন্য বৈষম্যহীন বিজ্ঞানভিত্তিক গণমুখী ও একই ধারার শিক্ষানীতি বাস-বায়নের জন্যে সে লড়ছে অবিরাম।

ছাত্র ইউনিয়ন মনে করে যে শিক্ষা জীবনের সমস্যা সমাধান ও শিক্ষার্থীর স্বার্থ-অধিকার সুপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সমাজ থেকে শোষণ-বৈষম্যের অবসান ঘটানো এবং তা নিশ্চিত করার জন্য সমাজতন্ত্রই সর্বোৎকৃষ্ট অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা ছাত্র ইউনিয়ন কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন বা সহযোগী সংগঠন নয়। ছাত্র ইউনিয়ন ব্যতীত অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন বা সহযোগী সংগঠন। সহযোগী সংগঠনের চরিত্রও এখন অঙ্গ সংগঠনের মতো। এরা সকলেই এদের নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ও নেতানেত্রীদের নির্দেশের গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এরা ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে ভাবনাকে কখনোই প্রাধান্য দেয় না।

উল্টো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এরা সন্ত্রাস, লুটপাট, ভর্তি বাণিজ্য, টেণ্ডারবাজী, দখলদারিত্ব, খুন, ধর্ষণসহ নানাবিদ অপকর্ম করে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট করে। এরা বিপুল অর্থ ব্যয় করে তথাকথিত ‘ক্যাডার বাহিনী’ লালন করে আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় বড় মিছিল বের করে ওমুক নেতা ওমুক নেত্রী জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ বলে শ্লোগান দেয় এবং হাতে তালি দেয়। জন্ম কথা ৫২’র মহান ভাষা আন্দোলনের সঠিক নেতৃত্ব দেয়ার মতো কোন ছাত্র সংগঠন সেসময় দেশে ছিল না। মুসলিম ছাত্রলীগ নামের যে সংগঠনটি তখন ছিল, সেটা ছিল নামে ও প্রবনতায় সামপ্রদায়িক এবং বহুলাংশে আপোসকামী। তারা ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল।

ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব তাই স্বাভাবিক ভাবেই চলে এসেছিল সচেতন ও প্রগতিবাদী ছাত্রদের হাতে। এই আন্দোলন শুধু ছাত্র সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, দেশের আপামর জনতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক ও জব্বারের তাঁজা রক্তের বিনিময়ে আমরা পে্যেছিলাম আমাদের প্রাণপ্রিয় বর্ণমালার মর্যাদা ও রক্তঝড়া ২১ ফেব্রুয়ারী ‘শহীদ দিবস’। ভাষা সংগ্রামের সফল উত্তরণের পরে ভাষা সৈনিকরা উপলব্ধি করেছিলেন, রক্তেগড়া ঐতিহাসিক এই সংগ্রামকে যথাযোগ্য পরিণতিতে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিবাদী রাজনৈতিক চৈতন্যে উদ্বুদ্ধ একটি গণ ছাত্র সংগঠন। তাই ভাষা সংগ্রামের সামনের কাতারের প্রগতিশীল চিন-া-চেতনায় উজ্জীবিত প্রধান ছাত্র নেতৃবৃন্দ, যারা অনেকেই ছিলেন দেশভাগ পূর্ব ছাত্র ফেডারেশনের উত্তরসূরী, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-জেন্ডার রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থিকে প্রগতিশীল কর্মসূচীর ভিত্তিতে একতাবদ্ধ করতে পারে এমন একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার জন্য সিদ্ধান- গ্রহণ করেন।

১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ঐক্য, শিক্ষা, শানি- ও প্রগতি- এ চার মূলনীতিকে ভিত্তি করে পূর্ব পাকিস-ান ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। জন্মলগ্নে এই প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন কাজী আনোয়ারুল আজিম ও সৈয়দ আবদুস সাত্তার। এরপর ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে মোহাম্মদ সুলতান সভাপতি এবং মোহাম্মদ ইলিয়াস সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনেই সংগঠনের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। ছাত্র-ছাত্রত্ব-ছাত্র ইউনিয়ন শিক্ষা জীবনে একজন ছাত্রের মৌলিক কাজ হচ্ছে তার ছাত্রত্ব অর্থবহ ও পরিপূর্ণ করা।

ছাত্রত্ব হলো- শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরী করা। যেন মানুষটি তার সমগ্র জীবনে সৎ, দেশপ্রেমিক, মানবিক গুনাবলীর অধিকারী, প্রগতিশীল, আদর্শবান, যুক্তিনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় বহন করার সক্ষমতা অর্জন করে। কোনো সংকীর্ণতা, সীমাবদ্ধতা যেন তাকে স্পর্শ করতে না পারে। সময়ের কাজ যেন সময়ে করতে শেখে। বুঝে শুনে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করে।

যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতার নিরিখে পথ চলতে সক্ষম হয়। ছাত্র জীবনে একজন ছাত্রের মৌলিক কাজ হলো শিক্ষা অর্জন করা। শিক্ষা ও জ্ঞানের মাধ্যমে সমাজ, মানুষ, পৃথিবী, রাজনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করা। শুধু জ্ঞান অর্জন করলেই হবে না, প্রয়োগের মাধ্যমে এ অর্জিত জ্ঞানের সাথে সমাজ, দেশ, দেশবাসী ও বিশ্ব সভ্যতা-বিশ্ব মানবতার যোগসূত্র তৈরী করতে হবে। একজন ছাত্রকে অবশ্যই অন্যান্য ছাত্রদের সাথে যুক্ত হয়েই তার প্রকৃত শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা ও অধিকার আদায় করতে হবে।

এজন্য সকলের মধ্যে সচেতনতা এবং একতা গড়ে তোলা অপরিহার্য। কিন' সেই সাথে নিজেকে উপযুক্তভাবে জ্ঞানসমৃদ্ধ ও সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। অন্যকে যুক্তিবান ও বিজ্ঞানমনস্ক করতে হলে প্রথমে নিজেকে যুক্তিবান ও বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সমাজটাকে পরিবর্তন করতে চাইলে নিজেকেও পরিবর্তন করতে হবে। বিপ্লব করতে চাইলে নিজেকেও বিপ্লবী হিসেবে তৈরী করতে হবে।

আমি বা আমরা যা-ই করতে চাই না কেন তার জন্য মানুষের কাছে যেতে হবে। তাদেরকে বুঝাতে হবে এবং তাদেও কাছ থেকে শিখতেও হবে। কিন' নিজে না বুঝলে অন্যকে সে কি বুঝাবে। ছাত্র ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে এই কাজগুলো যথার্থভাবে মেনে চলতে হয়। এই ধারায় উদ্বুদ্ধ একজন ছাত্রই কেবল ছাত্র ইউনিয়ন করার যোগ্যতা রাখে।

ছাত্র ইউনিয়ন নিছক খাতায় নাম লেখানো মার্কার সংগঠন নয়। এই সংগঠন করতে হলে প্রথমত তাকে তার ছাত্রত্ব রক্ষা করতে হয়। তারপর সংগঠন সম্পর্কে বুঝতে হয়, জানতে হয়। ক্রমাগত সচেতনতা বাড়াতে হয়। শুধু তত্ত্ব চর্চা নয়, বাস-ব প্রয়োগ, সত্যিকার আন্দোলন সংগ্রাম, ছাত্র সমাজ ও জনগণের মাঝে প্রত্যক্ষ কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে উন্নত জীবন দর্শন ও সামাজিক কর্মযজ্ঞের নিবেদিত প্রাণ কর্মী হয়ে ওঠার নিরন-ও প্রয়াস চালাতে হয়।

প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোর সীমাবদ্ধ জ্ঞান অর্জন করলেই যেমন জ্ঞান অর্জন করা যায় না তেমনি শুধু মাত্র ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিলে বা নাম লেখালেই প্রকৃত অর্থে ছাত্র ইউনিয়ন করা হয়না। জাতীয় রাজনীতি ও ছাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ক্ষমতার অপব্যবহারের রাজনীতি অথবা কোন রাজনৈতিক দল বা তাদের উপদলের লেজুড়বৃত্তি করে না। কিন' বাস-ব জীবনের কঠোর অভিজ্ঞতায় ছাত্রসমাজ দেখতে পায় যে, তারা যে গণতান্ত্রিক, অসামপ্রদায়িক, প্রগতিশীল, অবারিত ও সমৃদ্ধশালী শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা জীবন চায়, তার পথে পদে পদে অন-রায় সৃষ্টি করে রাখছে দেশের প্রচলিত সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর লুটপাটতন্ত্রের অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা। আর সেই প্রতিক্রিয়াশীল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে লালন-পালন করে চলেছে দেশের বর্তমান শাসক-শোষক শ্রেণী। সামপ্রদায়িকতা, স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা, মুক্তবাজারের নামে লুটপাটতন্ত্র, বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-আগ্রাসন ইত্যাদির ফলে ছাত্রসমাজের প্রত্যাশা ও সুন্দর স্বপ্নগুলো প্রতিনিয়ত নানাভাবে বিনষ্ট হচ্ছে।

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এই শিক্ষাই দিচ্ছে যে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার আমূল রূপান-র ও বর্তমান শাসক-শোষক শ্রেণীকে পরাভূত না করতে পারলে ছাত্র সমাজ তার বহু আকাঙ্খিত শিক্ষা জীবন নিশ্চিত করতে পারবে না। অন্যদিকে, দেশবাসীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ছাত্র সমাজ জাতীয় সমস্যাবলী থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখতে পারে না। ছাত্র সমাজ সমগ্র জনগণেরই একটি সচেতন অংশ; তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার, অসামপ্রদায়িকতা, সমাজ ও অর্থনীতির প্রগতিশীল বিকাশ, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের আগ্রাসী আধিপত্য থেকে মুক্তি, বৈষম্য ও শোষণের অবসান, প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয় রোধ, বিশ্ব শানি--জাতীয় মুক্তির স্বপক্ষে আন-র্জাতিক সংহতি- এসব কোনো বিষয়ই ছাত্র সমাজের বিবেচনা বর্হিভূত বিষয় হতে পারে না। অনেকের মধ্যে এরকম ভুল ধারণা হতে পারে যে ছাত্ররা শুধু লেখাপড়া করবে। দেশ দুনিয়া নিয়ে ভাবার কোন প্রয়োজন তাদেও নেই, কেননা এগুলো তাদেও শিক্ষা জীবনের সাথে জড়িত নয়।

কিন' এরকম ধারণা সঠিক নয়। একটা ছোট উদাহরণ দেয়া যাক। ধরা যাক, পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এর প্রতিবাদ করা এবং প্রতিবাদে প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট করা ছাত্র হিসেবে অসি-ত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই যুক্তিসংগত হয়ে ওঠে। যেসব ছাত্রের পরিবার পাটকলের উপর নির্ভরশীল তাদের শিক্ষাজীবন তখন এর ফলে হুমকীর মধ্যে পড়ে।

এভাবেই অর্থনীতি-রাজনীতিসহ জাতীয় আন-র্জাতিক ঘটনাবলী অবিচ্ছেদ্য ভাবে ছাত্রসমাজের সামগ্রীক স্বার্থ ও মননে জায়গা করে নেয়। এজন্যই আপনাকে আমাকে ও সমগ্র ছাত্র সমাজকে জাতীয়-আন-র্জাতিক নানা মৌলিক ও ছোট-বড় বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়াটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কিন' এটা হলো ‘রাজনীতি’। এটা ‘দলবাজি’ বা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি নয়। ছাত্র সমাজের কোন ধরণের রাজনীতি করা উচিৎ সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমরা অনেক রকম রাজনীতি দেখতে পাই। লুটপাটের রাজনীতি, খুন-ধর্ষণের রাজনীতি, অস্ত্রবাজী-টেণ্ডারবাজী-চাঁদাবাজীর রাজনীতি, নেতা-নেত্রীর নামে স্লোগানের রাজনীতি, ধর্মান্ধ-মৌলবাদী রাজনীতি ইত্যাদি। ছাত্র ইউনিয়ন রাজনীতির নামে চলতি হাওয়ার এই অপরাজনীতির সাথে মোটেই সমপৃক্ত নয়। এসবকে সে ঘৃণা করে, প্রত্যাখ্যান করে। আরেক ধরণের রাজনীতি হলো আদর্শ, দেশপ্রেম, ত্যাগের রাজনীতি।

ছাত্র ইউনিয়ন সেই রাজনীতির সাথে যুক্ত- যেখানে বৃহত্তর ছাত্র সমাজের মৌলিক স্বার্থের পাশাপাশি এদেশের গরীব দুঃখী-মেহনতী মানুষের সার্বিক অধিকার ও মুক্তির পথনির্দেশ রয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন যেমন অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন, গণমূখী ও একই ধারার শিক্ষানীতির বাস-বায়ন চায় তেমনি জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থায় শোষণ-বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা হল ঐক্যবদ্ধ সচেতন লড়াই-সংগ্রাম ছাড়া কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এ লড়াই সমগ্র ছাত্র সমাজের, আপনার আমার সকলের। সুন্দর সমাজের জন্য, মানুষ-মানবতা-মনুষ্যত্বের জন্য ও সাম্যের পৃথিবী গড়ার জন্য।

এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব-কর্তব্য এড়ানো কোনো সচেতন-যুক্তিবাদী ছাত্র-ছাত্রীর, কোন মানুষের কাজ নয়। ছাত্র ইউনিয়নের মূলনীতি ১। ঐক্য ২। শিক্ষা ৩। শানি- ৪।

প্রগতি ১। ঐক্য: বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আন-রিকভাবেই বিশ্বাস করে যে ছাত্র সমাজের মধ্যে ঐক্যই সবচাইতে বড় শক্তি এবং একটি ন্যুনতম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল কর্মসূচীর ভিত্তিতে ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য এবং একটি মাত্র সংগঠন গড়ে তোলা সম্ভব। ব্যপক ঐক্যের স্বার্থে কাজ করে যাওয়া ছাত্র ইউনিয়নের মূল লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য অসামপ্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল একটি কর্মসূচীর ভিত্তিতে বাংলাদেশের সব ছাত্র-ছাত্রীর একটি মাত্র গণ ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সকল সময়ে প্রস'ত এবং সেই লক্ষ্যে উদ্যেগী ও প্রয়াসী। ২। শিক্ষা: শিক্ষা জীবনের সমস্যা সংকটগুলো দূর করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে একটি গতিশীল আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলাই ছাত্র ইউনিয়নের মূল লক্ষ্য।

ছাত্র ইউনিয়ন এমন শিক্ষা ব্যবস্থায় চায় যেখানে শিশুকাল হতে একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মানবতাবোধ, জাতীয় ঐতিহ্য, উন্নত জ্ঞান ও ধী শক্তি, প্রগতিবাদী ও বিশ্ব-মানবতাবাদী মানসিকতায় জাগৃত হতে পারে। শিক্ষা পণ্য নয়, সুযোগ নয়, ‘অধিকার’, এই মৌলিক স্লোগান নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সংগ্রাম। ৩। শানি-: ভারসাম্যহীন পৃথিবী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্টীর হিংস্র থাবায় আক্রান-। পৃথিবীর দেশে দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে চলছে শোষণ, চলছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।

প্রতিদিন অগণিত মানুষ হচ্ছে শোষিত, হচ্ছে হত্যাযজ্ঞের শিকার। আমরা কেউই নিরাপদ নই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজ বাংলাদেশের উপরেও তার আগ্রাসন-শোষণ বৃদ্ধির পাঁয়তারা করে চলেছে। দেশের অর্থনীতি-রাজনীতির উপর তাদের নিয়ন্ত্রন আর নগ্ন হস্তক্ষেপ বেড়েই চলেছে। এই লুন্ঠনকারী, হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং সমগ্র মানব জাতির অসি-ত্ব রক্ষার প্রশ্নে বিশ্ব শান্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তাঁর আপোষহীন লড়াই-সংগ্রাম অব্যহত রেখেছে।

৪। প্রগতি : সমাজ সভ্যতার সম্মুখমুখী অগ্রযাত্রাই হলো প্রগতি। মধ্যযুগীয় অন্ধকার ও কূপমণ্ডুকতায় ফিরে যাওয়া তো নয়ই, এমনকি চলতি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার দৃষ্টিভঙ্গি হলো প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষনশীল দৃষ্টিভঙ্গি। এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ হলো প্রগতি বিরোধী। ক্রমাগতভাবে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়া ও এগিয়ে নেয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করে চলেছে ছাত্র ইউনিয়ন।

বিজ্ঞানমনস্কতার নিরিখে জীবনের সকল কাজ পরিচালনা করা প্রগতির আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবনযাত্রার মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে তাদেরকে পশ্চাৎপদতা, কু-প্রথা, কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে বিজ্ঞান মনস্কতার দিকে, প্রগতির দিকে নিয়ে যেতে ছাত্র ইউনিয়ন নানা পন্থায় নানা প্রয়াস ও লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার সংগ্রামে ছাত্র ইউনিয়ন: পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত- যত সরকার এসেছে তারা যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে- তা সবই ছিল মূলত বৈষম্যমূলক শিক্ষা সংকোচনের এবং দক্ষিনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ধারার। একমাত্র ১৯৭৪ সালে কুদরত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্ট ছিল কিছুটা ব্যতিক্রমী। প্রতিটি প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন লড়াই করেছে।

১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল-তার নেতৃত্বে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। এই রিপোর্টে অত্যন্ত- নগ্নভাবে শিক্ষা সঙ্কোচনের কথা বলা হয়। সরকারি শিক্ষানীতি বাতিল ও সামরিক শাসন উচ্ছেদ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর আইয়ুব প্রদত্ত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে হরতাল ডাকা হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মোস-ফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ।

তারপরও ছাত্র ইউনিয়ন এ দেশের ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যায়। ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. আব্দুল মজিদ খান অত্যন- নগ্নভাবে সামপ্রদায়িক শিক্ষার প্রসার এবং সরকারি শিক্ষা সঙ্কোচন নীতি অবলম্বন করে শিক্ষানীতি ঘোষণা করে। প্রথম শ্রেণী থেকেই বাংলার সঙ্গে আরবি এবং দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজী অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনটি ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এসএসসি কোর্স ১২ বছর, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও শিক্ষার ব্যয়ভার যারা ৫০% বহন করতে পারবে তাদের রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়। ছাত্র ইউনিয়ন এই গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

ছাত্র সমাজকে আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ করে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী শিক্ষানীতি বাতিল ও সামরিক আইন প্রত্যাহার দাবিতে স্মরণকালের বৃহত্তম ছাত্র মিছিল হয়। সেদিন আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের উপর ট্রাক উঠিয়ে দেয় এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী। শহীদ হয় দিপালী, কাঞ্চন সহ আরো অনেকে। শুধু শিক্ষানীতির আন্দোলন নয়, শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন, ক্লাসরুম সংকট নিরসন, সেশন জ্যাম নিরসন, শিক্ষার্থিদের ইউনিফর্ম নিশ্চিতকরণ, ক্লাস শুরুর পূর্বে এসেম্বলি, শিক্ষকদের জীবনমান উন্নতকরণ, স্বল্পমূল্যে শিক্ষা উপকরণ নিশ্চিতকরণ, বিজ্ঞান গবেষণাগার- কম্পিউটার ল্যাব নিশ্চিতকরণ, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়াসহ শিক্ষা সংক্রান- বিভিন্ন স'ানীয় ও জাতীয় আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন নিরন-র সংগ্রাম করে চলেছে।

শিক্ষার অধিকার আদায়ে যে সংগঠনের ভূমিকা অগ্রগণ্য সেই ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নাম যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে থাকে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন এ ভূ-খণ্ডে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের ইন্ধনে। তাদের শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্যই তারা সামপ্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ ভূ-খণ্ডের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারের আন্দোলনকে বিভক্ত করা ও তাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এক সময় এ ভূ-খণ্ড থেকে হাত গুটিয়ে চলে গেলেও তার সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আমাদের দেশসহ এ উপমহাদেশে এক ভয়ংকর মরণব্যাধি হিসেবে এখনো উপসি'ত।

মৌলবাদ ফতোয়াবাজদের তান্ডবও সাম্প্রতিক কালে সাংঘাতিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এদেশের বিবেকবান, অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনের মানুষদেরকে দারুণ ভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জন্মলগ্ন থেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ধর্ম-ব্যবসায়ী, উগ্র জঙ্গীবাদ ও ফতোয়াবাজদের রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করে আসছে। ষাটের দশকে সামপ্রাদায়িক দাঙ্গা বিরোধী কর্মকান্ডে ছাত্র ইউনিয়ন ছিলো অগ্রগণ্য। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদের অসামপ্রদায়িক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছিলো, সারা বাংলায় নিষিদ্ধ করেছিল রবীন্দ্র সংগীত, ছাত্র ইউনিয়নই তখন শাসক গোষ্ঠীর চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্ম-শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানমালা আয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সামপ্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব ও উগ্র সামপ্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম এবং শত্রুকে চিরতরে উৎখাত করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

কিন' শাসক গোষ্টীর দূর্বলতা-ব্যর্থতা ও পরবর্তীতে ’৭৫-এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকারানে- এই প্রতিক্রিয়াশীল সামপ্রদায়িক ধারার প্রতিভূ শক্তিই রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসে। তারপর থেকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ মদদে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি এদেশে তাদের শক্তি সামর্থ আরো বৃদ্ধি করে চলছে। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো প্রচার করে যে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তারা ধর্মীয় আইন ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন' এদের বাস্তব জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের কোনো স'ান নাই। কারণ এ সকল ধান্ধাবাজ সামপ্রদায়িক-মৌলবাদী রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থলিপ্সায় ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে।

তারা ভাষা আন্দোলনের বিরোধীতা করেছে। ‘৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে তারা লড়েছে। এসবই তারা করেছে ‘ইসলাম রক্ষার’ মিথ্যা দুরভিসন্ধিমূলক অজুহাত তুলে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী সহ সম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মের নামে বিভিন্ন ফতোয়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কাফের আখ্যা দিয়ে সমগ্র বাঙ্গালী জাতিকে জারজ হিসাবে চিহ্নিত করে মুক্তিকামী ৩০ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ভূমিকা রেখেছিল।

ঐ বর্বর রাজনৈতিক শক্তি ৭১ এ বাঙ্গালী মা-বোনকে গণিমতের মাল আখ্যা দিয়ে নিজেরা ধর্ষণ করেছে এবং পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধর্ষণের জন্য তুলে দিয়েছে । জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির (৭১-এর আগে পর্যন- ইসলামী ছাত্র সংঘ) তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের কথা বলে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীকে একের পর এক হত্যা করছে এবং মধ্যযুগীয় বর্বরতার মাধ্যমে এ পর্যন- শত শত ছাত্রের হাত, পায়ের রগ কেটে দিয়েছে, দিচ্ছে। ওরা আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধু শাহাদাৎকে রাতে ঘুমন- অবস্থায় জবাই করে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে ছাত্র ইউনিয়নের স্কুল ছাত্রনেতা নতুনকে, হত্যা করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা তপনকে, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঞ্জয় তলাপাত্রকে। এভাবেই ওরা ধর্মের নামে বহু প্রগতিশীল ছাত্রের জীবনকে অকালে কেড়ে নিয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এসকল ঘৃন্য সাম্প্রদায়িক অন্ধকারের বর্বর শক্তিকে কিভাবে চিরতরে প্রতিহত করা যায়। ছাত্র ইউনিয়ন মনে করে, ব্যপক জনগণের বিশেষত শ্রমজীবী জনগণের সচেতন ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ থেকে এসব অপশক্তিকে দূর করে দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল বাম শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এদের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি ও ক্ষমতা কাঠামোকে উৎপাটন করা সম্ভব। সে লক্ষ্যে ছাত্র সমাজকে সচেতন ও জাগরিত করে ছাত্র-জনতার সমবেত সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ ছাত্র-ইউনিয়ন নিরলস ভাবে কাজ করে চলছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশে প্রথম যে ছাত্র সংগঠনটি পাকিস্তানের সামপ্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে এবং বাঙ্গালির স্বাধীকারের দাবিতে আওয়াজ তোলে তা হলো ছাত্র ইউনিয়ন। প্রতিষ্ঠার পর প্রায় এক দশক কাল ধরে তাকে অনেকটা এককভাবেই এ ইস্যুতে সংগ্রাম করতে হয়েছে।

ষাট এর দশকে ছাত্রলীগ এ ইস্যুতে তার দোদুল্যমনতা অনেকটা পরিত্যাগ করে এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আদর্শ নিয়ে অগ্রসর হয়। ছাত্র ইউনিয়ন বাঙ্গালী জাতির স্বাধীকারের ইস্যুকে সত্যিকারভাবেই অর্থবহ করার জন্য তাকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ধারায় অগ্রসর করতে ভূমিকা রাখে। ’৬৬ পরবর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন সারা বাংলার মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে বাংলার মানুষের জাগরণেরও অন্যতম রুপকার ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিশ্চিত করে তোলে আইয়ুব-মোনায়েমী শাষণের চুড়ান- পরাজয়।

তার পর থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক প্রস'তির কাজ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নেয়। ’৭১ এর ফেব্রুয়ারিতে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার সহ বাঙ্গালী জাতির পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারের দাবী ছাত্র ইউনিয়নের ঘোষণাপত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে অন-র্ভূক্ত করা হয়। মার্চে ছাত্র ইউনিয়ন শুরু করে দেয় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রত্যক্ষ প্রস'তি। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা বিগ্রেড রাইফেল কাঁধে ঢাকার রাস্তায় মহড়া দেয়। মহড়া শুরু হয় হাতে তৈরি গ্রেনেড দিয়ে।

২৫ মার্চ পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা গ্রামে গ্রামে অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প প্রস'ত করে। এছাড়া হানাদার বাহিনীর আক্রমনের সাথে সাথে দেশের সর্বত্র রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে নীল পতাকার অভিযাত্রীরা। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন তার সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে অংশগ্রহন করে। সর্বত্র অসীম সাহস আর ত্যাগের পরিচয় বহন করে তারা। যুদ্ধে অসংখ্য নেতা-কর্মী শহীদ হয়।

বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মিলে গড়ে তোলে দেশের সর্ববৃহৎ গেরিলা বাহিনী। ২০ হাজার সদস্যের এ গেরিলা বাহিনী হাটে-মাঠে-ঘাটে অপদস- করে তোলে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী আর তার দোসর রাজাকার, শানি-বাহিনী, আলবদর আর আলশামসদের। এছাড়াও সারা দেশের ১১ টি সেক্টরের সাথে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহন করে অসংখ্য নেতা-কর্মী। ঢাকার দুর্ধর্ষ ‘ক্র্যাক প্লাটুন’, বিভিন্ন সেক্টরের এফ. এফ বাহিনী, মেরিন গেরিলা বাহিনী প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা সবচেয়ে সাহসী ও দক্ষ যোদ্ধার মর্যাদা অর্জন করে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় গেরিলাযুদ্ধে এবং সম্মুখ যুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন হয়ে ওঠে দুর্বার।

এমনি এক সোনালী সময়ে ১১ই নভেম্বর কুমিল্লার বেতিয়ারায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে হারিয়ে যান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রিয় নেতা নিজামউদ্দিন আজাদ, সিরাজুল মনির সহ ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর ৮ সদস্য। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীসহ সারা বাংলার অসংখ্য প্রাণ আর সাড়ে সাত কোটি দেশবাসীর ত্যাগের বিনিময়ে, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশের জন্ম হয় তা তার স্বপ্নসাধ বাস-বায়নের পথে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে নি। যে দুরন- স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো অল্প কিছুদিন পরেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে তৎকালীন শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পরিচালিত স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রানে-। তাই ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্র সমাজের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় নি, মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে এনে, স্বাধীনতার লাল সুর্যকে পরিপূর্ণতা দানের লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন এখনো পথ চলছে অবিরাম। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদীদের নগ্ন থাবা মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে আজও তৎপর।

এই জন্য তারা তথাকথিত ‘মুক্তবাজারের’ জালে আবদ্ধ করে, বহুজাতিক কোম্পানীর মাধ্যমে, বিশ্বব্যাংক-আই.এম.এফ-ডব্লিউ টি ও প্রভৃতি সংস্থাকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক শোষণ পরিচালনা করে। বৈষম্য ও নির্ভরতা বাড়িয়ে তোলে। মার্কিন নেতৃত্বে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের মত দেশকে পদানত রাখতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়, দেশে দেশে যুদ্ধ বাধায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্রষ্টা ছিলো এই সাম্রাজ্যবাদ যেখানে কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করা হয় । বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জন্মলগ্ন থেকেই এই ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও চক্রানে-র বিরোধিতা করে আসছে।

আমাদের দেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব দূর করার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন নিরন-র সংগ্রাম করে চলছে। দেশে দেশে পরিচালিত স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও জনগণের মুক্তি সংগ্রামের পাশে ছাত্র ইউনিয়ন সবসময়ই দাঁড়িয়েছে। সেই কর্তব্যবোধ থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন ভিয়েতনামের ওপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করে বাংলার মাটিতে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদ মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সামনে পৌছলে পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মীর্জা কাদের ও মতিউল ইসলাম শহীদ হন।

সেই থেকে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংহতি দিবস পালন করে আসছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। ২০০১ সালে ভিয়েতনাম সরকার শহীদ মতিউল-কাদেরকে সে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করেছে। প্যালেস্টাইন, কঙ্গো, দক্ষিন আফ্রিকা, মোজাম্বিক, এ্যাঙ্গোলা, কিউবা, নিকারাগুয়া, লাওস, কম্পুচিয়া, ইরাক, আফগানিস'ান সহ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশে দেশেসাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, দখলদারিত্ব ও যুদ্ধের সক্রিয় বিরোধীতা করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। ঐ সব দেশের সাধারণ মুক্তিকামী মানুষের প্রতি সব সময়ই সংহতি প্রকাশ করে আসছে ছাত্র ইউনিয়ন। যুদ্ধ নয়, বিশ্ব শানি-ই ছাত্র ইউনিয়নের কাম্য।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আর্শিবাদ নিয়ে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমান ও এরশাদ কয়েক দফা সামরিক শাসন জারি করেন। সকল সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন দুর্বার লড়াই করেছে, ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সামরিক স্বৈরাচারের নগ্ন হামলায় শহীদ হয়েছেন আমাদের অনেক বিপ্লবী বন্ধু। ১৯৮৬ সালের ৩০ মার্চ স্বৈরাচার এরশাদের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডারা আমাদের সংগঠনের নেতা আসলামকে হত্যা করে। তবুও থেমে থাকেনি ছাত্র ইউনিয়ন তথা ছাত্রসমাজের আন্দোলন।

১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সূচিত হয় আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে দূর্বার গণআন্দোলন। ’৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক শাসন জারি করলে ছাত্র ইউনিয়ন ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে ছাত্র ইউনিয়ন। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য জেল-জুলুম উপেক্ষা করে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।

১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। ঘোষিত হয় ছাত্র সমাজের ঐতিহাসিক ১০ দফা কর্মসূচি। শুরু হয় সরকার পতনের আন্দোলন। ছাত্র ইউনিয়ন এ সময় ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের জন্য উদ্যেগী হয়। ছাত্র-জনতার অব্যাহত আন্দোলনে পতন ঘটে স্বৈরাচার এরশাদের।

দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু' দু:খের বিষয় এখন পর্যন্ত- ছাত্র সমাজের ১০ দফা দাবি উপেক্ষিত। আওয়ামী লীগ-বি.এন.পি কোন সরকারই তাদের ওয়াদা রাখেনি। তারা ছাত্র সমাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন বৃহৎ অর্থে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণে ছাত্র ইউনিয়ন তার নিরলস সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।

ছাত্র ইউনিয়ন মনে করে একটি প্রগতিশীল সংস্কৃতি বিনির্মাণের কাজটি আমাদের কাঙ্খিত সমাজ ব্যবস'ায় উপনীত হওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো এজন্য সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার উপর সবসময় আঘাত হানে। পাকিস্তান আমলে সামরিক জান্তা যখন রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করে, তখন ছাত্র ইউনিয়ন তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এই নিষেধাজ্ঞা রুখে দাঁড়ায়। ছাত্র ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা। ছায়ানট, ঊদীচী প্রভৃতি সংগঠনের প্রতিষ্ঠায়, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বাংলা নববর্ষের উদযাপনের ঐতিহ্য ও ধারাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা প্রভৃতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

এছাড়াও পাকিস্তান আমলে ‘আমার সোনার বাংলা...’ গানটিকে জনপ্রিয় করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশে স্কুল-কলেজে জাতীয় সঙ্গীত প্রচার-প্রসারে ছাত্র ইউনিয়ন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। শহীদ মিনারের বর্তমান অঙ্গসজ্জার সূচনায়, ‘অপরাজেয় বাংলা’, ‘রাজু ভাস্কর্য’ এসব ছাত্র ইউনিয়নেরই ঐতিহাসিক কীর্তি। ভোগবাদী সংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহের বিপরীতে বাঙ্গালির এবং বাংলার শোষিত-বঞ্চিত সাধারণ মেহনতি মানুষের হাজার বছরের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখতে ছাত্র ইউনিয়নের সংগ্রাম আজো নিরন-র। সন্ত্রাস বিরোধী সংগ্রাম জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন নানা ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি “শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস বিরোধী” আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। যখনই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে তখনই ছাত্র ইউনিয়ন তা প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে।

এমনই এক গৌরবের সময় ১৯৯২ সাল। ১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল বন্দুক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ভীত-সন্ত্রস্ত্র- হয়ে পড়ে। সন্ত্রাস রুখে দাড়াতে ছাত্র ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.