আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রবাসে দৈবের বশেঃ মৃত্যুপথযাত্রীদের নিয়ে

এ রকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই/উত্তরপুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হব

বহুবছর আগে ভারতীয় পরিচালক গৌতম ঘোষের একটি ছবি দেখেছিলাম। নাম ‘অন্তôর্জলি যাত্রা’। সেসময় ছবিটির কাহিনী আমাকে বেশ আলোড়িত করেছিলো। আমার অবচেতন মনে সে থেকে একটি অনুসন্ধিৎসা নিয়ত তাড়িয়ে বেড়াতো মৃত্যু পরবর্তী জীবন বা মৃত্যুর মুহূর্তে একজন মানুষের অনভূতি কি হয় সে সম্পর্কে জানতে। এ জাতীয় অনুভূতি বা এ নিয়ে কোন লেখা বাংলা সাহিত্যে বিরল।

তবে ইংরেজি সাহিত্যে এ ধরনের প্রচুর গবেষণামূলক লেখা আছে। আমি চেষ্টা করেছি সেসব লেখা থেকে পড়ে এ বিষয়ে আমার জানার অভিজ্ঞতাকে পূর্ণ করতে। ২০০৬ সালে সাপ্তাহিক ২০০০-এর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো একটি গল্প নাম ‘অন্তôর্জলি যাত্রা’। লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুণ। গল্পটির আমি প্রিন্টেড কপি পড়তে পারিনি।

সাপ্তাহিক ২০০০-এর ওই ঈদ সংখ্যাটির অনলাইন সংষ্করণে গল্পটি আমি প্রথম দেখি ২০০৭ সালের জুনে। প্রথমেই শিরোনাম দেখে চোখ আটকে যায়। এক নিঃশ্বাসে গল্পটি পড়ে আমি অভিভূত। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একজন মানুষ কতটা সার্বজনীন হয়ে যায় এ গল্পটি পড়লে তা বোঝা যায়। কাহিনীতে লেখকের নিজের সম্পৃক্ততা ও লেখার মুন্সিয়ানায় গল্পটি হয়ে গেছে এক অসাধারণ জীবনধর্মী এপিটাফ।

ভাবলাম যেভাবেই হোক লেখকের সাথে পরিচিত হতে হবে। একদিন লেখকের কাছে একটি মেইল পাঠালাম। সাথে সাথেই জবাব এলো। এভাবেই শুরু। প্রতিদিনই তাঁর সাথে আমার মেইল আদান-প্রদান হতে থাকে।

আমি তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক খবরের অন্তôরালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুণকে বললাম আমাদের পত্রিকায় লিখতে। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। শুরু হলো খবরের অন্তôরালে ‘জার্মানির পথে পথে’ শিরোনামে তাঁর ধারাবাহিক লেখা। দুটো সংখ্যা বের হবার পর অনিবার্য কারণে খবরের অন্তôরালের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু হারুণ ভাই’র সাথে আমার যোগাযোগ হতে থাকে নিয়মিত। আস্তেô আস্তেô আবিষ্কার করি এক অসাধারণ লেখককে। এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি পড়েননি বা লেখেননি। আমার কাছে লেখা তাঁর প্রতিটি মেইলকে মনে হতো এক একটি মাস্টার পিস। এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে আমরা আলোচনা করিনি।

যা এখনও অব্যাহত আছে। ৩০ বছরের প্রবাস জীবনের ইতিবৃত্ত, প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্বের দ্বন্দ্বের বলি হয়ে বোহেমিয়ান জীবনধারা বেছে নেয়া, দেশের জন্য তাঁর আকুতি, একজন পিতার মমত্ববোধ, লেখার অসাধারণ গভীরতা সর্বোপরি একজন দুঃখি মানুষের বিমূর্ত প্রতীক হারুণ ভাই আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। বয়সের ব্যবধান থাকা সত্বেও আমরা দুজন পরষ্পরের বন্ধু হয়ে যাই। ৭৭ সাল থেকে এক দৈবের বশে প্রবাসী হয়ে আজ পর্যন্তô দেশমুখো হননি। প্রথমে যান গ্রীস, তারপর ৭৮ সালে জার্মানি।

সেখানেই থিতু হন। বর্তমানে সেদেশের নাগরিক। আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে মৃত্যু বিষয়ক তাঁর গবেষণাধর্মী কিছু লেখায়। মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষ সময়ে সঙ্গ দেয়ার জন্য জার্মানীর স্বীকৃত সংগঠন ‘হজপিস’র তিনি সক্রিয় সদস্য। আমি কোনদিন এ জাতীয় সংগঠনের নাম শুনিনি।

আমার বিশ্বাস এদেশের হাতে গোণা মাত্র গুটিকয়েকজন হয়ত এ জাতীয় এক বৈচিত্র্যময় সংগঠনের নাম শুনেছেন। সংগত কারণে বিষয়টি আমাকে কৌতুহলী করে তোলে। আমার কাছে হারুণ ভাইর বিভিন্ন লেখায় আমি এ সম্পর্কে বিস্তôারিত অবগত হই। এছাড়া তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত কয়েকটি বাংলা পত্রিকা বিশেষ করে জার্মানির নিঃস্বন, অরিত্র, সুইডেনের পরিক্রমায় লেখেন নিয়মিত। ব্যক্তি হারুণ অথবা লেখক হারুণের প্রতি আমার দুর্বলতার কারণেই হোক অথবা তাঁর অসাধারণ লেখাগুলো বাংগালি পাঠক যাতে পড়তে পারেন সে বিবেচনা থেকেই হোক আমি সিদ্ধান্তô নিলাম তাঁর সমস্তô লেখা সংকলিত করে একটি বই বের করবো।

আমার সিদ্ধান্তôটি হারুণ ভাইকে বলাতে প্রথমে তিনি বিস্মিত হলেন এবং বললেন বই বের করাতো চাট্টিখানি কথা নয়। সময়টা সম্ভবত ২০০৭ সালের আগস্ট সেপ্টেম্বর হবে। আমিও জানি এ ধরনের একটি বই বের করা সোজা কথা নয়। কিন্তু আমার টার্গেট ছিলো ২০০৮ সালের বইমেলাকে কেন্দ্র করে বইটি বের করা। হিসেব করে দেখলাম আমি যদি এখন থেকেই কাজ শুরু করি তাহলে হয়ত সম্ভব হবে।

হারুণ ভাই তারপরেও আমাকে ভেবে সিদ্ধান্তô নিতে বললেন। কারণ তিনি আমাকে শুধু লেখাগুলো পাঠানো ছাড়া আর কোনই সাহায্য করতে পারবেন না বলে জানালেন। এই অক্ষমতার জন্যই হয়ত তিনি বারবার আমাকে নিরুৎসাহিত করছিলেন। আমিও জানি এতদূর থেকে তাঁর কিছুই করার নেই। যা করার আমাকেই করতে হবে।

এছাড়া হারুণ ভাইর হয়ত ভয়ও ছিলো একজন অজানা-অচেনা আসিফ- যার সাথে শুধু মেইলের মাধ্যমে পরিচয় তাকে আমার মূলব্যান লেখাগুলো দেয়ার বিষয়ে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়। খুবই যৌক্তিক দোলাচল। তবু আমার বার বার পীড়াপীড়িতে তিনি রাজি হলেন এবং একদিন সত্যিসত্যি তার বেশ কিছু লেখা আমাকে মেইলে পাঠালেন। আমি মহা উৎসাহে কাজে নেমে পড়লাম। শুরু হলো একটি নতুন বই প্রকাশের ‘গর্ভযন্ত্রণা’।

একদিন হারুণ ভাই জার্মানি থেকে কয়েকটি পত্রিকা আমাকে পোস্ট করে পাঠালেন। এরমধ্যে ছিলো জার্মানি থেকে প্রকাশিত নিঃস্বন আর সুইডেন থেকে প্রকাশিত পরিক্রমা। নিঃস্বন পত্রিকায় দেখলাম বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক ইমদাদুল হক মিলনকে নিয়ে হারুণ ভাইর একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা। সে লেখায় জানলাম মিলন ভাই ৮০’র দশকে যখন পেশাগত কারণে জার্মানিতে ছিলেন তখন সিনডেলফিনগেনে বেশ কিছুদিন হারুণ ভাইর সাথে একরুমেই ছিলেন। মিলনকে নিয়ে হারুণ ভাইর বেশকিছু আবেগীয় স্মৃতির বর্ণনা আছে এই লেখায়।

হারুণ ভাই আমাকে অনুরোধ করলেন একটি কপি যেন আমি নিজহাতে মিলন ভাইকে দিয়ে আসি। আমি একদিন মিলন ভাইর বাসায় একটি কপি দেয়ার সময় দেখলাম মিলন ভাইও বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে হারুণ ভাই সম্পর্কে অনেক স্মৃতির কথা বললেন। এও বললেন, ‘হারুণ ভাই যদি সেদিন তাঁর রুমে আমাকে আশ্রয় না দিতেন তাহলে জার্মানি থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিলো। ’ সেদিনই আমি সিদ্ধান্তô নিলাম হারুণ ভাইর বইর মুখবন্ধটি আমি মিলন ভাইকে দিয়েই লেখাবো। মিলন ভাইকে সে কথা বলাতেই তিনি সানন্দে রাজি হলেন।

তিনি এও বললেন বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রচ্ছদ আঁকিয়ে ধ্রুব এষকে দিয়ে বইর প্রচ্ছদ করিয়ে দেবেন। মিলন ভাইর আশ্বাসে আমি আরো উৎসাহ পেলাম। এরমধ্যে শুরু হলো প্রকাশক খোঁজার পালা। কারণ অনুমোদিত প্রকাশক না হলে বইমেলায় এই বই’র স্থান হবে না। এগিয়ে এলেন আমার এক বন্ধু সংাবাদিক এস এম এস দোহা।

ওর প্রকাশনীর নাম মেলা প্রকাশনী। নিজস্ব প্রেস আছে। সিদ্ধান্তô নিলাম ওর প্রেসেই প্রচ্ছদসহ যাবতীয় ছাপার কাজ করবো। দোহা নিজের কাজ বন্ধ রেখে ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ ছাপিয়ে আমাকে টেনশানমুক্ত করলেন। আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ।

এরমধ্যে আরেকজনকেও আমি খুবই কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। তিনি হচ্ছেন আমারই বন্ধু দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সিনিয়ার রিপোর্টার সাইফ ইসলাম দিলাল। ও বিভিন্নভাবে আমাকে পরামর্শ দিয়ে বইর প্রকাশানাকে করেছেন ঋদ্ধ। ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ বইর পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৩১। এতে পাঁচটি শিরোনামসহ মোট বাইশটি উপশিরোনামের কাহিনী আছে।

প্রতিটি কাহিনীই স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতিটি কাহিনীতেই আছে আলাদা আলাদা স্বাদ। যা পাঠকদের ভালো লাগবে। সর্বশেষ কাহিনীটির নাম প্রাচ্য-প্রতীচ্য। এই লেখাটি হারুণ ভাই শুধু আমাকেই লিখেছিলেন একান্তôভাবেই তাঁর নিজের কিছু কথা বলে।

আমি পড়ে এর গুরুত্ব বুঝলাম। কারণ এই লেখায় এমন কিছু মেসেজ আছে যা প্রতিটি পাঠকেরই জানা দরকার। লেখাটিতে ব্যক্তিগত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে আর কিছু সম্পাদনা করে হারুণ ভাইর অনুমতি নিয়ে বইর শেষে ‘প্রবাষে দৈবের বশে’ শীর্ষক শিরোনামের অধ্যায়ে গ্রন্থিত করেছি। মার্গারেট নামের এক মহিলার সাথে ১৮ বছর একত্রে থাকার পরেও কেন তার সাথে বিচ্ছেদ, যুগ যুগ ধরে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্তের দ্বন্দ্ব কেন চলে এসেছে, কেন এই দুই মহাদেশ সামাজিকভাবে এক হতে পারেনি তার একটি যৌক্তিক ব্যখ্যা একান্তô ব্যক্তিগত বর্ণনায় প্রতীকিভাবে এই লেখায় ফুটে ওঠেছে। পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন দুই মহাদেশের মানুষের মধ্যে শুধু নৃতাত্বিকভাবেই নয়; আর্থ-সামাজিক আর মানসিকতায় পার্থক্য কেন এত প্রকট আর এর কারণই বা কি? শুধুই কি অর্থনৈতিক? না অন্য কিছু? বলাবাহুল্য লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ এই মার্গারেটকে।

বইর আরেকটি অধ্যায় হচ্ছে শেষ যাত্রার সঙ্গি। লেখক এই অধ্যায়ে ব্র্যাকেটবন্দি আরেকটি শিরোনাম দিয়েছেন (যে যাত্রায় ফিরে আসা নেই, কারণ মৃৃত্যু খুলে দেয় পরবর্তী জীবনের দ্বার)। এই শিরোনামে মোট তিনটি কাহিনী আছে। নাম দেখেই পাঠক বুঝতে পারবেন মৃত্যু নিয়ে অসাধারণ অভিজ্ঞতাসম্বলিত কিছু কাহিনী এতে বিধৃত হয়েছে। তিনটি কাহিনীই লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা।

আমার বিশ্বাস বাংলা সাহিত্যে মৃত্যু নিয়ে এমন অসাধারন লেখা ইতোপুর্বে আর রচিত হয়নি। একজন মানুষ যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয় তখন তারমধ্যে যে সার্বজনীনতা প্রকাশিত হয় তা অবিশ্বাস্যভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তার লেখার মুন্সিয়ানায়। মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষের যে কোন দেশ-কাল-পাত্র থাকেনা, তার নিজস্ব কোন ভাষা থাকে না, সে তখন শুধুই একজন বিশ্ব মানব, যিনি পৃথিবীর পাট চুকিয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনন্তô অসীম এক মহা শক্তির কাছে সে কাহিনী লেখক প্রমাণসহ উপস্থাপন করেছেন এই তিনটি কাহিনীতে। এছাড়া ‘প্রবাসে আপনজন’, ‘নানা রঙ্গের দিনগুলি’ ও ‘কাছে থেকে দেখা’ শিরোনামের অন্তôর্গত বিভিন্ন কাহিনীতেও আছে এমন বৈচিত্র্যময় কিছু উপাখ্যান। প্রতিটি অধ্যায়ের সাথেই ব্যবহার করা হয়েছে প্রাসঙ্গিক ছবি।

এছাড়া গল্পের প্রয়োজনেও কিছু প্রাসঙ্গিক ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।