আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রেস্টুরেন্টের দিনগুলি-৫

ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....

কথা প্রসঙ্গে হাবিব নামে অন্য এক রেস্টুরেন্টের কর্মচারী বেশ গর্ব করেই বলছিলেন, একবার তিনি রাজশাহীর এক লোকের জন্য অনেক গণ্ডগোল করেছিলেন। রাজশাহীর সেই লোকের ভিসা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও দেশে ফিরে যাননি। বৃটেনের এক রেস্টুরেন্টে অবৈধভাবে কাজ করতেন তিনি। অবৈধরা বিদেশে কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। একজন মানুষের দুর্বলতার সুযোগ পেলে অন্যরা তার উপর আরো ভালোভাবে চেপে ধরে তা অতি স্বাভাবিক বিষয়।

রেস্টুরেন্টের অন্য কর্মচারীরাও তার ওপর বেশ অত্যাচার করতেন। সারা দিনরাত তাকে দিয়ে কাজ করানো হতো। বেতন দেয়া হতো অতি সামান্য। কিন্তু এতেই কাহিনীর শেষ নয়। রেস্টুরেন্টের মালিক একবার তার ওপর খুব বিরক্ত হয়েছিলেন।

বিরক্ত হয়ে তিনি তাকে ছুরি দিয়ে খোচা দিয়েছিলেন। ধারালো ছুরিতে তার হাত বেশ ভালোভাবে কেটে গিয়েছিলো। এর পরেও সেই কর্মচারী কারো কাছে অভিযোগ করেননি। কারণ, পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে ওনার অভিযোগ হয়তো শুনবে, ব্যবস্থাও নিবে। কিন্তু তার পরই ভিসা না থাকার কারণে পুলিশ ওনাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিবে।

আর মালিক যদি তাকে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেয় তাহলে নতুন একটা চাকরি যোগাড় করা তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। কারণ অবৈধ শ্রমিকদের চাকরি যোগাড় করা খুব কঠিন ব্যাপার। এসব দিক মিলিয়ে মালিক ছুরি মারার পরেও আহত সেই কর্মচারীর মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। একমাত্র হাবিব সেই ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি রেস্টুরেন্টের মালিককে বলেছিলেন, “আমার ভাই আজকে পেটের দায়ে অবৈধভাবে এদেশে আছে।

তাই বলে আপনি তাকে ছুরি মারতে পারেন না। ” তিনি এ ঘটনা দেখে পরদিন অন্য কর্মচারীদের নিয়ে মালিকের বিরুদ্ধে সংগঠিত হন। মালিককে তিনি মাপ চাইতে বাধ্য করেন, সেই আহত শ্রমিকের চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন। বৃটেনের বাংলাদেশী মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেলে অদ্ভূত এক বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যেতো। বিজ্ঞাপনে এক রেস্টুরেন্টের ভেতরে শেফ ধারালো একটা চাপাতি বাগিয়ে খুব বিপজ্জনকভাবে অন্য একজনকে তাড়া করতো।

সাধারণ কোনো মানুষের পক্ষে এ বিজ্ঞাপণ দেখে অবাস্তব বলেই মনে হবে। যদিও আমি বাস্তবেই এমন ঘটনার প্রমাণ পেলাম। এ ঘটনা শুধু একটা নয়। অবৈধ শ্রমিকদের এমন বহু ঘটনা এখানকার রেস্টুরেন্টগুলোতে নিয়মিত হয়। তবে তাদের দুঃখ দুর্দশাতে এভাবে এগিয়ে আসার এমন ঘটনা খুবই কম।

অবৈধদের পক্ষে এসব বিষয়ে আইন-আদালতের সাহায্য নেয়া কোনোক্রমেই সম্ভব হয় না। বৃটেনের নিয়ম অনুযায়ী কেউ ১৪ বছর এ দেশে অবৈধভাবে অবস্থান করতে সক্ষম হলে তাকে বৃটিশ নাগরিকত্ব দেয়া হয়। এ কারণে রেস্টুরেন্টের অনেক অবৈধ শ্রমিকেরা নিজেদের জীবন-যৌবন শেষ করে অপেক্ষায় থাকে এক যুগ পূর্তির জন্য। অনেকে তার আগেই পুলিশের কাছে ধরা পড়ে বৃটিশ লাল পাসপোর্টের স্বপ্ন ধূলিস্যাত করে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। সবচেয়ে হৃদয় বিদারক হয় যাদের ১০ বা ১১ বছর কষ্ট করে থাকার পরে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

কয়েকদিন আগে এ এলাকা থেকে এমন কয়েকজন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠানো হলো যাদের এ দেশে ১৪ বছর পূর্ণ হতে আর কয়েক মাস বাকি ছিলো। জীবনের বড় একটা অংশ অবৈধভাবে লুকিয়ে, অল্প বেতনে, লোকজনের লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করে থাকার পর এ হলো তাদের পরিণাম। রেস্টুরেন্টে জয়েন করার পর কিছুদিন হলো শোনা যাচ্ছিলো অবৈধ শ্রমিকদের জন্য বৃটেনের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। এ নিয়ে রেস্টুরেন্ট মালিকেরও ব্যাপক চিন্তা ছিলো। শ্রমিকদের ভাগ্যের চেয়ে তার চিন্তাটা মালিককে নিয়েই বেশী ছিল।

কারণ অবৈধ শ্রমিক ধরা পড়লে নিয়োগকর্তার প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য ১০ হাজার পাউন্ড জরিমানা হয়। একদিন তিনি আমাকে কতোদিনের ভিসা আছে, কতো দিনের ডিগ্রি নিচ্ছি ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে নিলেন। আমার পকেটে থাকা ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের কার্ড, আর ইউনিভার্সিটির আইডি কার্ড দেখিয়ে তাকে নিশ্চিন্ত করলাম। তার রেস্টুরেন্টে আমরা কেউ অবৈধ ছিলাম না। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই বৃটেনের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টগুলোতে অবৈধদের সন্ধানে পুলিশের রেইড করার খবর আসছিল।

প্রচুর বাংলাদেশী অবৈধ শ্রমিক ধরা্ও পড়ছিলেন। শুনলাম এক রেস্টুরেন্টে রেইড করার সময় বৃটিশ পুলিশদের সঙ্গে এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অফিসার ছিলেন। আইডি চেক করার সময় তিনি কৌশলে এক অবৈধ বাংলাদেশীকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। দেশীদের মহানুভবতার এমন কাহিনী রেস্টুরেন্টের স্টাফদের মুখে মুখে ফিরছিলো। যদিও লোকমুখে শোনা এসব কাহিনী সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

বাস্তবে অবৈধ শ্রমিকদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসে না। বার্মিংহামে আমার বাসার কাছেই সপরিবারে থাকেন সদালাপি এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। আমরা ওনাকে আঙ্কেল বলে ডাকি। প্রায়ই ঈদ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি আমাদের দাওয়াত করে খাওয়ান। এই আঙ্কেল বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআরের প্রথম শ্রেণীর একজন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন।

কিন্তু বিডিআরদের ওপর অত্যাচার ও নিপিড়ন মূলক আচরণ, চাকরিতে উন্নতি না হওয়ার অনড় নিয়ম ইত্যাদি দেখে তিনি হতাশ হয়েছিলেন। তার পরও তিনি বিদ্রোহ করেন নি। বিডিআর বিদ্রোহের অনেক আগেই হতাশ হয়ে দেশ ছেড়েছেন। তিনি সামরিক বাহিনীর চাকরির বিধিমালা ভেঙ্গে বৃটেনের একটা টুরিস্ট ভিসা জোগাড় করে সপরিবারে পালিয়ে এসেছেন। এখন তিনি অবৈধভাবে এ দেশে আছেন প্রায় সাত বছর।

কাজ করেন একটা রেস্টুরেন্টে। মধ্যরাত পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম করেন সামান্য কয়টা পাউন্ডের জন্য। অবৈধভাবে এদেশে বসবাস করায় অন্য কোনো চাকরি পাওয়া সম্ভব না ওনার পক্ষে। আবার দেশে ফেরত গেলে সামরিক বাহিনীর আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবেন। যতোবার এদেশে রেস্টুরেন্টগুলোতে পুলিশের রেইড করার খবর পাই ততোবারই আমার ওনার কথা মনে পড়ে।

ওনার মানসিক অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে বছর গুনি। তিনি এদেশে আছেন সাত বছর। চৌদ্দ বছর অবস্থান করে বৃটিশ পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরো সাত বছর। এর মধ্যে কখনো কোনো প্রয়োজনে সরকারি লোকজন ও পুলিশের কাছে যাওয়া যাবে না।

দেশে যাওয়ার কথা ভাবাই যাবে না। বাবার কথা যতোই মনে পড়ুক। মা যতোই অসুস্থ হোক তার কাছে যা্ওয়ার কথা চিন্তা্ও করা যাবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয়জন মারা গেলেও তাকে শেষবারের মতো দেখা যাবে না। অবৈধভাবে অবস্থানকালীন এক যুগেরও বেশী সময়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রচণ্ড ভয় আছে প্রত্যেকের।

অসময়ের এক মিনিটই কতো লম্বা মনে হয়। আর দীর্ঘ ১৪টি বছরকে না-জানি কতোই না দীর্ঘ ও কষ্টকর সময় হিসেবে পার করতে হয়। ওনার মতো এমন বহু অবৈধ শ্রমিক ভিসার অভাবে বিদেশের মাটিতে জীবনের দীর্ঘ ভীতিময় সময় পার করেন। কবে শেষ হবে চৌদ্দ বছর, সে আশায় দিন গুনেন। সুদূর প্রবাসে অমানসিক পরিশ্রম করে বিসর্জন দেন তাদের জীবন-যৌবন সবকিছু।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.