আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কন্সপিরেসি অব সাইলেন্সের মধ্যে জাতীয় সম্পদ রক্ষায় একটি মরিয়া হরতাল

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

জানা ছিল, ঈদের আগে যখন সব ব্যস্ত তখনই তড়িঘড়ি করে গ্যাস-বন্দর-ট্রানজিট দেওয়া হবে। এবং এও জানি যে, ঢাকা শহরের সঙ্গে ফুলবাড়ী কি কানসাটের অনেক দূরত্ব।

বরং মুম্বাই-লন্ডন-নিউইয়র্ক অনেক কাছে। জানি, বিদেশি সাবানের মতো বিদেশি পুঁজির রস গায়ে মাখলে গতর নাদুসনুদুস হয়। জানি, নিজের দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে উচ্চবিত্তদের লজ্জার সীমা নাই। তাই তারা তাদের লজ্জাস্থান আরো বিদেশি কোম্পানির কাছে জিম্মা দিয়ে বাঁচেন। উভয়ের লজ্জা আর তা ঢাকবার কৌশল এক হবার নয়।

এও জানি, যে কৃষক সারের অভাবে জমিতে রুইতে পারে না, সে এখনো ভাল করে জানে না তারই গ্যাস সার না হয়ে বিদেশি কোনো কারখানার কাঁচামাল হবে। আমি জানি, পেট ও মালিকের ঠেলায় ঠিকই রিকশা নিয়ে বের হবে মঙ্গাদেশের কোনো রিকশাচালক। গার্মেন্টসের মেয়েটি ঠিকই যাবে কারখানায়। বড়লোকি কারগুলিও লা লা রি রি করে চলবে, যেমন দাপটে চলে প্রতিদিন। আর দালাল-বেনিয়ারা তাদের অশ্লীল ভেংচানি দেখাতেই থাকবে গণপ্রতারণামাধ্যমগুলোতে।

আমি জানি শহরগুলো প্রতিক্রিয়াশীলদের দুর্গ, তা ঢাকাই হোক আর নিউইয়র্ক হোক। জানি যে, ঢাকায় খুটি না পুতে দিল্লি-ওয়াশিংটন-প্যারিস নিরাপদ বোধ করবে না। জানি সত্য, জনভিত্তিক দলগুলোর রুপার কাঠির সঙ্গে জনগণের দুঃখ-শোক ঠেকানিয়া জেদের সোনার কাঠির মিল যতদিন না হচ্ছে, ততদিন এই শহরে বিপ্লবীদের মিছিল আর গরিবের হাহাকার, পরস্পরকে ডেকে ডেকে হয়রান হবে। মাথা খুঁড়বে কর্পোরেটের পাথুরে দেয়াল আর রাজপথের কালো পিচে। তাদের প্রতিবাদসভা লুন্ঠিত দেশের শোকসভা হয়ে থাকবে, তাদের প্রেস রিলিজের অক্ষরগুলো কর্পুরের মতো উবে যাবে।

কিন্তু কাল তাদের দেখাদেখি হবে, কাল হরতাল। মগজ-অবশ মানুষেরা দূর থেকে আজম বিদ্রোহীদের দেখে বিব্রত হবে। কিন্তু স্বেচ্ছায় নিজেদের বন্ধ না করে কে কবে বন্ধ করতে পেরেছে ফেরাউনি অনাচার? আমার ঘরে আর মনেই তো উপনিবেশিক সংসার। এক বৃদ্ধ প্রকৌশলী তাঁর জমি বিক্রি করে বিবিয়ানার গ্যাস রপ্তানী ঠেকাতে লংমার্চের খরচ যোগাড় করেন। আশি বছর বয়সেও পথ হাঁটেন।

এক অধ্যাপক জাতীয় স্বার্থের প্রবক্তা হওয়ার অপরাধে পা-ভাঙ্গা মার খেয়ে পড়ে থাকেন রাজপথে। বয়সে তরুণ কিন্তু জাতীয় স্বার্থরক্ষার দায় বিষয়ে নাড়ির জ্ঞান টনটনা এমন একদল ছাত্রছাত্রী-মজুর আর পেশাজীবীরা প্রতিদিনের কঠিন জীবন আরো কঠিন হয়ে যাওয়ার হুমকি নিয়েও লড়াইয়ের ময়দানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। কারণ, তাদের চোখে-মনে দেশের প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। দেশ তাদের কাছে সিভিকো-মিলিটারি-কর্পোরেট ফোঁড়ার পুঁজ মোছার সংবিধান আর পতাকা নয় কেবল। দেশ মানে মানুষ ও তার স্বার্থের যোগফল।

সেই মানুষ মাটির ওপর দাঁড়িয়ে। সেই মাটি চারদিক থেকে ঘেরাও। সেই ঘেরাওয়ের মধ্যে জীবন-জীবিকা-সম্পদ আর স্বাধীনচেতা মন আহত ও জ্বলন্ত। সার্বভৌম শব্দের মহিমা আর জ্বালা তারা একাত্তরের মতোই রক্তের ছলক আর বেইমানির বিষে জেনেছে। তাই হরতাল হবে।

যুদ্ধ যখন চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন লড়াই কোনো পাত্রী-বাছাই অপশন নয়। সেটা হচ্ছে, সেটা চলছে, সেটা চলবে। ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জিকে ঘেরাও করে তাড়ানো হয়েছে। জয় এসেছে। ঢাকাতেও হরতাল হবে, জয়ের পথে এক ধাপ এগতে।

জয় তৈরি জিনিস নয়, জয় দিনে দিনে তিলে তিলে আসে। এই হরতালে তাদের জানাজানি হবে, তারপরের মিছিলে ওঠাপড়া ঘটবে, এভাবেই চলবে আরো কয়েক বছর। এই চলার মধ্যে দিয়ে শক্তি সংগ্রহ করা, এক পা এগিয়ে দু পা পিছিয়ে, আবার লাফ দিয়ে এগনোর পথেই আন্দোলন সংগ্রাম হবে, সংগ্রাম শক্তি হবে, শক্তি নিজেকে আত্মপ্রকাশ করবে। সেই আত্মপ্রকাশ জাতীয় ভাবে বৈধ হবে। হাসিনার কিছুই করবার নেই।

এদেশের লুটেরা বড়লোক-আমলা-মিলিটারি-এনজিও বলয়েরও কিছুই করবার নেই। তারা বিশ্বপুঁজির ফোরম্যান_চৌকিদার। লুটের মালের ভাগ তাদের মাংসে-মজ্জায়, শিক্ষায় আর দীক্ষায়। বিশ্বব্যাংকীয় ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট (দেশে ধনী বাড়লে তার ছিঁটেফোঁটা পেতে পেতে গরিবও স্বচ্ছল হবে) অনুসারে জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের অংশ তারাও পায় ঠিকাদারি, বিজ্ঞাপন, স্পন্সর, চাকরি ইত্যাদির রকমে। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকা মধ্যবিত্তরা সিপাহি বিদ্রোহে ভীত হয়, ব্রিটিশ চলে গেলে সভ্যতা চলে যাবে বলে টাই আর গাউন ভিজিয়ে কাঁদে।

এরা কাশিমবাজার কুঠির সন্তান। এদের বোঝাবার কিছুই নাই সোনা। তবুও জানাই, সেনা-তত্ত্বাবধায়কি জরুরি আমলে দালাল ম তামিমের করা পিএসসি অনুসারে, তাল্লো-কনকোরা উৎপাদন খরচ বাবদ নেবে ৫৫ ভাগ, তারপর লাভ বাবদ নেবে বাকি ৪৫%-এর আশি ভাগ। শুভঙ্করি গণিতের ফাঁকিতে আমার গ্যাস মজুদের মাত্র সাড়ে আট ভাগ আমার। তাও আবার সেটা গভীর সমুদ্র থেকে আনতে হবে আমাদেরই।

সেটা যেহেতু আনা সম্ভব না, সেহেতু আমাদের সাড়ে আট শতাংশসহ মোট ১০০ ভাগই তারা রপ্তানি করবে। নেবে কে? নেবে জ্বালানী ক্ষুধার্ত ভারত। আন্দোলন-লংমার্চ করে বিবিয়ানার পাইপলাইনে রপ্তানি ঠেকালেও এখন সমুদ্রসীমা দখলের হুমকি দিয়ে এলএনজি করে জাহাজে করে নেবার খায়েশ তাদেরই। তাদের করুণাধন্য মুক্তিযুদ্ধের দলের নব্য-রাজাকার হওয়া এভাবেই পাকা হলো। দশচক্রে ভগবান এভাবেই ভূত হলেন।

সেই ভূতের সতকার এখন জাতীয় কর্তব্য। প্রথম বিএনপি আমলে ২৩টা ব্লকে দেশটা ভাগ করে প্রায় সবগুলোই তুলে দেওয়া হলো শেল-কেয়ার্ন-অক্সিডেন্ডালের কাছে। মাগুরছড়া-টেংরাটিলা ব্লো আউট, উৎপাদনের ৮৫ ভাগ নিয়ে নেওয়া। টেন্ডারের একশ কোটি টাকার খনন হয়ে যায় তিন হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত। ইচ্ছামতো তোলা বা না তোলা দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখা।

যেখানে সমতলের গ্যাস পূর্ণদমে তুললেই বর্তমান চাহিদার প্রায় সবটাই মেটে, সেখানে সমুদদ্রের গ্যাস হরিলুট করে দেওয়ার এত উত্তেজনা কেন সরকারের? কারণ, এটাই তার জরুরি অবস্থা পাড়ি দিয়ে ক্ষমতায় বসবার কাফফারা। এই কাফফারা বিএনপি-জামাত যেমন দিয়েছে আজ আমলীগকেও তেমন দিতে হবে। কিন্তু জনগণ কেন যক্ষের ধন ভক্ষকেরে দেবে? বাপেক্স-পেট্রবাংলাকে ধ্বংস করা হয়েছে, যেমন ধ্বংস করা হয়েছে আদমজীকে। কৃত্রিম ভাবে দশকের পর দশক বিদ্যুৎ সংকট জারি রেখে মানুষকে বাধ্য করা হবে গ্যাস-কয়লা বিদেশিদের দিতে হাঁ বলাতে। অথচ বাপেক্সের রেকর্ড বিশ্বমানের।

আশি বছরের অভিজ্ঞতা, সেভিয়েত কারিগরি সহায়তা সব হাওয়ায় মিলালো কেবল সরকারের মীরজাফরিতে। অথচ দেশী প্রকৌশলীরাই ভাড়া খাটে দেশদখলের বহুজাতিকে। দেশের বিজ্ঞানীরা বিদেশে পাড়ি জমায় টিকতে না পেরে। জ্বালানী মোশাররফকে একটা গাড়ি দিলেই গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া যায়, শেখ হাসিনাকে তাহলে তারা কি দিয়েছে তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। টিপাই নিয়ে মাতম তোলা বিএনপি-জামাত কেন নিশ্চুপ তা জানতেও ভেতো বাঙালির গবেষণার প্রয়োজন নাই।

তাই শিক্ষিত-উপনিবেশিক মধ্যবিত্তকে শিখাবার-বোঝাবার কিছু নাই। যেতে হবে জনতার কাছে। যদিও মিডিয়া কুৎসা দেবে, খবর ছাপবে না, অর্ধবুঝমানদের ব্রেনওয়াশ করবে বর্ণচোরা পাতিবুদ্ধিজীবীরা। ভয় বা ঘুষের মারণাস্ত্রে কিনে নেবে। সংগ্রাম জিনিসটাকে এরা অভিধান ও জনজীবন থেকে বাতিল করে দিয়েছে।

এরা পা চাটবে, তাতেও না হলে আত্মবিক্রয় করবে, কিন্তু এদের মরা মাজা আর সোজা হবার নয়। আজ বিশ্বায়িত, ভোগবাদী, কৃষি ও খনিজ বিনাশী মধ্যবিত্ত বিত্তবাসনাই পরাশক্তির বড় সহায়। এদের শহর আর এদের বিলাস মেটাবার জন্য এরা কৃষি জমি, নদী, বন, খনি আর নারী, শিশু, ভাষা সব বিকাতে আর পোড়াতে রাজি। এরা আর জাতির অংশ নয়, এরা বিজাতীয় পুঁজির রক্তস্রাব। সেই পুঁজির মূত্রফেনায় এরা ঢেকুর তুলতে বিন্দুমাত্র মর্মযাতনায় ভোগে না।

তবুও আনু মুহাম্মদের মার খাওয়ার দৃশ্য কিংবা জাতীয় কমিটির ডাকা হরতাল অনেকের চিত্তে দ্বিধার জন্ম দিয়েছে। এটা ভাল। সুবিধাভোগীরা লড়াইয়ের বেগের সামনে পড়ে দুলতে থাকে, ছদ্ম প্রগতিশীলতার যুক্তিতে পাশ কাটাতে চায়। সেই দৃশ্য ভাসতে শুরু করেছে, ইনানো-বিনানো কান্না আর কোন্দল তারা গাইতে লেগেছে। লাগুক, জড়তা ভাংবার প্রথম মুহূর্তে এরকম দেখা যায়।

দুনিয়ায় কীসে থেকে কী হয়, দুয়ে দুয়ে কারা ঘর শূণ্য করে দেয় সেটা মানুষ বোঝে। কিন্তু কোন লড়াই তার লড়াই, সেটা প্রমাণের আছে দেশপ্রেমিক নাগরিক সংগঠনগুলোর। পরীক্ষা ছাড়া সীতাও পার পান নাই, আমরা তো কোন ছার! পরীক্ষা আমরা দেব, সেটা জনগণের কাছে। বুর্জোয়াদের তোষক-বালিশে মজমা বসানো ছারপোকাদের কাছে নয়। যত ছোটোই জাতীয় সম্পদ রক্ষার এই হরতাল নতুন এক তরঙ্গ।

আর আন্দোলন তো ব্যবসা নয় যে লাভ দেখে শেয়ার কিনব। কাল হারব জেনেও আত্মনিয়োগ প্রয়োজন, নইলে পরশু দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না। আর পরশু যদি দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, তার পরদিন মুখোমুখি টক্কর দেওয়ার তাকদ জনগণই যুগিয়ে দেবে। আমরা আশাবাদী। আমাদের অতীত লোপাট, বর্তমান বেদখল, একমাত্র ভবিষ্যতই আমাদের।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।