আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরীতি শিখাইছে....................................



বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম গতকাল সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে সিলেট শহরের নূরজাহান হাসপাতালে ইহলীলা সংবরণ করলেন। জন্মেছিলেন ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগন্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে। বাবা ইব্রাহীম আলী আর মা নাওরজান বিবি। গ্রামের পাশের কালনী নদী আর হাওরের আবহে বড় হয়েছেন, বিকশিত হয়েছেন। আর দশটা লোকত্তোর প্রতিভার মতো তিনিও প্রকৃতির পাঠশালায় জীবন শিখেছেন।

আবহমান বাংলার লোকায়ত ধারার এই বাউল সম্রাট অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ ছিলেন। ছিলেন চিরসংগ্রামী-লড়েছেন জীবনের সাথে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুন্দরের জন্য লড়েছেন তিনি। গানপাগল আবদুল করিম বাউলগানের দীক্ষা নেন বাউল কামালউদ্দিনের কাছে। এরপর সাধক রশিদ উদ্দিন ও শাহ ইব্রাহীম মস্তান বক্সের কাছেও দীক্ষা নেন। এরপর গাইতে শুরু করেন, লিখতে ও সুর দিতে শুরু করেন তিনি।

ধীরে ধীরে নিজ এলাকা ছাড়িয়ে সিলেট অঞ্চলে পরিচিতি পান। এখনতো সকল বাংলাভাষী মানুষের কাছে পরম প্রিয়ভাজন তিনি। তাঁকে আমি জেনেছি অনেক পরে। ভার্জিনের স্পন্সরশিপে ইটিভির প্রথম যুগে একটা মিউজিকাল প্রোগ্রাম হতো(নাম ভুলে গেছি)। উপস্থাপনায় আলিফ আলাউদ্দিন আর সজল।

সে অনুষ্ঠানে একদিন দেখি আমার সহপাঠী/বন্ধু সন্জীব চৌধুরী আর বাপ্পা ''দলছুট'' ব্যানারে একটা গান গাইলো- গাড়ী চলেনা চলেনা চলেনা রে। শুনে খুব ভালো লাগলো। মনে হলো এইবার দোস্ত হিট করবে। বৃহত্তর আঙ্গিকে জনপ্রিয়তার পথে দলছুটের সেখান থেকেই শুভযাত্রা । ওদের দ্বিতীয় এ্যালবাম ''আকাশচুরি'' বের হলে দেখি গানের লিরিকের নীচে লেখা কথা ও সুর শাহ আবদুল করিম।

তখনো তিনি আমার কাছে একটা নামই শুধু। তাঁর সাথে প্রকৃত পরিচয় হয় কর্মসুত্রে যখন ভাটি এলাকা সংলগ্ন হবিগন্জে গেলাম। দেখি সব অনুষ্ঠানে সুন্দর সুন্দর লোকগান হচ্ছে। দেখি বেশির ভাগের লেখক শাহ আবদুল করিম। একেকটি গান কথার সৌন্দর্যে,সুরের মিষ্টতায় অনন্য।

যেমন-বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরীতি শিখাইছে, আমি কূল হারা কলঙ্কিণী, গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, গাড়ী চলেনা চলেনা চলেনা রে,আইলায় নায় আইলায় নায়রে বন্ধু,আমার বন্ধুয়া বিহনে গো সয়ে না পরাণে গো,বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে,কোন মিস্ত্রি নাও বানাইছে,মানুষ হয়ে তালাশ করলে মানুষ পাওয়া যায়,সখী কুন্জ সাজাও গো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে,গাই গাই আমার মনরে বুঝাই,কেমনে ভুলিব আমি,রঙের দুনিয়া তোরে চাইনা ইত্যাদি গান। গান লিখেছেন প্রায় ১৫০০। প্রকাশিত ৭টি বইতে ৬০০র মতো সংরক্ষিত আছে। ভাটি এলাকায় গিয়ে দেখি বাউলের সোনার খনি। হাছন রাজার (দেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী) কথা তো সুধিসমাজ রবীন্দ্রনাথের কল্যানেই জেনেছেন।

(লালন শাহকে নিয়েও সুধিসমাজে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। অবশ্য কাঙাল হরিনাথ তাঁর আগেই লিখেছিলেন তাঁর কথা, কিন্তু সেটা বহুল পরিচিতি পায়নি)। এরসাথে পেলাম রাধারমণ,দুরবীণ শাহ,আরকুম শাহ,শীতলং শাহ, সৈয়দ শাহনূর,সেকেন শাহ, দীনহীন(আজ পাশা খেলবো রে শাম খ্যাত) শেখ ভানু(নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে ভোমরা রে গানটি তাঁর লেখা। আমরা যেটা শুনি সেটা পল্লীকবি জসীম উদদীনের লেখা ও শচীনদেব বর্মনের গাওয়া। শেখ ভানু এর প্রায় একশ বছর আগে গানটি লিখেছেন।

দুইগানে প্রথম পার্থক্য অন্তরাতে-জসীম উদদীন লিখেছেন জ্বালাইয়া চান্দেরও বাতি আমি জেগে রব সারা রাতি গো,শেখ ভানু লিখেছেন-জ্বালাইয়া দিলেরও বাতি আমি জেগে রব দিবসরাতি গো। অর্থ বিবেচনায় জসীম রোমান্টিক, শেখ ভানু আধ্যাত্মিক) প্রমুখ। এখনো ভাটি এলাকায় এঁরা প্রচন্ড জনপ্রিয়। মজার বিষয় যে সন্জীবের মাধ্যমে আমি বাউল সম্রাটকে প্রথম জেনেছি সেই সন্জীবও ভাটির দেশেরই লোক(বানিয়াচং,হবিগন্জ/এ উপজেলার আরেক গুণী সুবীর নন্দী)। শাহ আবদুল করিমের গান অনেকে গেয়েছেন,গাইছেন।

সন্জীব চৌধুরী,বাপ্পা মজুমদার,মাকসুদুল হক,ফেরদৌস ওয়াহিদ,হ্যারল্ড রশীদ,দিলরুবা খান,রুহী ঠাকুর,মমতাজ,হাবীব,আনুশেহ,কায়া, জামালউদ্দিন হাসান বান্না(আমার অন্তরায় আমার কলিজায় এ জনপ্রিয় গানটির গায়ক), হিমাদ্রি,প্রদীপ কুমার ও বিভিন্ন ব্যান্ড। এসব লোক গানের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো গণমানুষের জন্য লেখা বলে কোন না কোন আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়। তাই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের শিল্পী ছাড়া অন্যরা ঐ গানের প্রকৃত উচ্চারণ ও একসেন্ট আনতে পারেন না। লালন শাহ,হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম এঁদের সবার ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেকে গাইছেন বটে উচ্চারণ ও সুরবিকৃতি তার সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। আবদুল করিমের দুই শিষ্য মোহিত শাহ ও প্রাণকেষ্টর কণ্ঠে বাউল সম্রাটের গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।

টিভিতে যেমন শুনি বাউলের কণ্ঠে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন লাগে। তাঁরা বলেছেন,গুরুর কাছে যেমন শিখেছি তেমন করেই আমরা গাই। বাউল সম্রাট ২০০০ সালে রাগিব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার, ২০০১ সালে একুশে পদক, ২০০৩ সালে লেবাক এওয়ার্ড,২০০৪ সালে মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা,২০০৫ সালে চ্যানেল আই মিউজিক এওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা,২০০৬ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা,২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা ও খানবাহাদুর এহিয়া পদক, ২০০৯ সালে এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা ও হাতিল এওয়ার্ডে ভূষিত হন। হবিগন্জের তোফাজ্জল সোহেল এবং সিলেটের শাকুর মজিদ বাউল সম্রাটের ওপর দুটি ডকুমেন্টারী তৈরি করেছেন। তাঁর স্ত্রী আফতাবুন্নেসা(সরলা) তাঁর অনেক আগেই মারা গেছেন।

লোকশ্রুতি আছে স্ত্রীর মৃতদেহের সামনে বসে ''আমি কূলহারা কলঙ্কিণী'' গানটি তিনি লিখেছিলেন। অসংখ্য গান,গুনগ্রাহী আর একমাত্র ছেলে শাহ নূর জালাল একমাত্র নাতি শাহ নূর ঝলককে রেখে গেছেন তিনি। অমিত প্রতিভাধর প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নির্লোভ এই গুণীকে জানাই অন্তরের শ্রদ্ধা। দোয়া করি পরপারে তিনি লাভ করুন অনন্ত শান্তি।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.