আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কর্নেল তাহেরঃ ভয়শূন্য এক বিপ্লবীর নাম



(গত ২১ জুলাই বাসদ নোয়াখালী জেলা শাখা আয়োজিত কর্নেল তাহের স্মরণসভায় কমরেড খালেকুজ্জামান প্রদত্ত ভাষণটি সম্পাদনা করে এখানে প্রকাশ করা হল । ) কর্নেল তাহের এক অকুতোভয় দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম। তাহের শোষক বুর্জোয়াশ্রেণীর ক্ষমতার দুর্গে আঘাত হানা ভয়শূন্য এক বিপ্লবীর নাম। তাহের শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্য উৎসর্গীকৃত এক শহীদের নাম। তাহের বাংলাদেশের বিপ্লবীদের সামনে ত্যাগে, দ্রোহে, শৌর্যের প্রেরণাদায়ক এক প্রতীক।

দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার সংগ্রামে তিনি তার শরীরের একটা অঙ্গ বিসর্জন দিয়েছিলেন। আর দেশকে পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির জন্যে জীবন বিলিয়ে গেলেন। রাজনৈতিক ভ্রান্তি ও শোষকশ্রেণীর নির্মমতার শিকার জাসদের অঘোষিত নেতা, সৈনিকদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব এই মহাপ্রাণ বিপ্লবীকে১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন সামরিক জান্তা বিচার প্রহসন চালিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল। আজ তাঁর ৩৩তম মৃত্যুদিবসে আমি তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। একই সাথে যারা কর্নেল তাহেরকে স্মরণ করতে, শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁর জীবন ও সংগ্রামের শিক্ষা নিয়ে সাহসী সৈনিক হিসাবে আগামীর সংগ্রামে নিবেদিত হতে চাইছেন তাঁদের সবাইকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে জানাই অন্তহীন শুভেচ্ছা ও সংগ্রামী অভিনন্দন।

কর্নেল তাহের জেলখানার ভিতর লুকানো প্রহসনের ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আপনার সামনে দন্ডয়মান এই মানুষটি, যে মানুষটি আদালতে অভিযুক্ত সেই একই মানুষ এই দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য রক্ত দিয়েছিল, শরীরের ঘাম ঝরিয়েছিল। এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত পণ করেছিল। এটা আজ ইতিহাসের অধ্যায়। একদিন সেই মানুষটির কর্মকান্ডের আর কীর্তির মূল্যায়ন ইতিহাস অতি অবশ্যই করবে। ” এই মূল্যায়ন তাদের জন্য জরুরি যারা আগামী দিনে শোষক বুর্জোয়াশ্রেণীর আধিপত্য-কর্তৃত্ব ভেঙে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের সংগ্রামে এগিয়ে যাবে।

বাসদ সেই সংগ্রামের পতাকা বহন করে দৃপ্ত শপথে অবিরাম অবিচল চলমান বিধায় আমাদের দায়িত্ব, অবমূল্যায়ণ-অতিমূল্যায়ণ ও অনুষ্ঠান সর্বস্বতার হাত থেকে রক্ষা করে ৭ নভেম্বর ও কর্নেল তাহেরের প্রকৃত মূল্যায়ন দেশবাসীর সামনে হাজির করা। যাতে জনগণ অভিজ্ঞ হয়ে ওঠতে পারে, অতীত সংগ্রামের ভ্রান্তি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার শিক্ষা ও সাহস সঞ্চয় করতে পারে। কর্নেল তাহের যে বুর্জোয়াশ্রেণীকে উৎখাত করে সর্বহারাশ্রেণীর রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিলেন, সেই বুর্জোয়াশ্রেণীর কোনো অংশের সাথে হাত মিলিয়ে চলা দলের পক্ষে তাহেরের প্রকৃত মূল্যায়ন এবং সঠিক পথ নির্দেশনা দেয়া সম্ভব নয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সামরিক অসামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এবং ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি রক্ষা, শিক্ষা-গণতন্ত্র মানবাধিকার সংরক্ষণ-সম্প্রসারণ, নর-নারী বৈষম্য বিলোপ, আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সমাজ-সভ্যতা ও জীবনের দাবি পূরণের বহু বিচিত্র সমৃদ্ধ সংগ্রামের গৌরব গাথা রয়েছে যা জগত জুড়েই বিরল। বাংলাদেশের এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি পরদেশী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বদেশী শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত জনতার রক্ত, ঘাম ঝরেনি, আন্দোলনের ঢেউ এর দোলা কোনো কুটিরে লাগেনি।

বিশেষ করে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ৭ নভেম্বর সিপাহী অভ্যুত্থান, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এর শিক্ষা খুবই জরুরি। কারণ আগামী দিনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষমতা দখলের রূপ হবে গণঅভ্যুত্থানমূলক। এটা অতীতের গণঅভ্যুত্থানসমূহের প্রকৃতি, পরিধি, সাংগঠনিক ও গণপ্রস্তুতি, নেতৃত্ব, নীতি-কৌশল, উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ইত্যাদির সাথে যেমন হুবহু মিলবে না - তেমনি এগুলোর মধ্যে থাকা ছোট ভ্রান্তি-বিচ্যুতি-সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে তা অতিক্রমণের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করা ছাড়া আগামীর সাফল্যও নিয়ে আসা যাবে না। যেমন রাশিয়াতে ১৯০৫ সালের ব্যর্থ বিপ্লবের যথার্থ শিক্ষা ১৯১৭ সালে বিপস্নবের সফলতা এনে দিয়েছিল। এটা এক বিশাল অধ্যায়।

একদিনের আলোচনায় তা নিরূপণ করা বা সামগ্রীকতায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। কর্নেল তাহের ব্রিটিশ ভারতের শেষ প্রহরে ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তারা ১১ ভাই বোনের মধ্যে ৮ জনই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ৪ জন যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে গোটা বাংলাদেশকে ১১টি সামরিক সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। কর্নেল তাহের ১১ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন।

তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এই সেক্টরে যে গেরিলা সেনাদল গড়ে উঠেছিল, তাহের পরিবারের সদস্যদের প্রাধান্যের জন্য অনেকে একে ব্রাদার্স প্লটুন বলতেন। এখান থেকেও কর্নেল তাহেরের চরিত্রের একটি বড় দিকের সন্ধান মেলে। এই গোটা পরিবারকে স্বাধীনতার বেদীমূলে উৎসর্গীকৃত হতে তিনি প্রাণশক্তি যুগিয়েছিলেন। তাঁর অপার দেশপ্রেম, ইস্পাতদৃঢ় বিপ্লবী সংকল্প ও নিষ্ঠা তাঁকে পরিবারের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড় করিয়েছিল।

তার প্রমাণ মেলে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে ঘিরে তাঁর পরিবারের গণমুখী অবস্থান থেকে। আজ তাহের নেই, পরিবারের সদস্যদের গণমুখী বিপ্লবী অবস্থানও আর নেই। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। কর্নেল তাহের যদি আওয়ামী লীগের শাসনামলে বুর্জোয়াদের দূর্গে আঘাত হানতেন তাহলে সিরাজ সিকদারের পরিণতি বরণ করতে হতো। আর সিরাজ সিকদার যদি বিএনপি আমলে রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতেন তাহলে তাঁকে তাহেরের পরিণতি বরণ করতে হতো।

কিন্তু আজ তাদের দল কিংবা পরিবারের সদস্যদের আচরণ ও কর্মকান্ড দেখে মনে করা কঠিন যে এই শহীদেরা এক বুর্জোয়া শিবিরের পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়ে অন্য বুর্জোয়াগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বদলে গোটা বুর্জোয়াশ্রেণীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রাম করেই জীবন দিয়েছিলেন। তাদের তৎকালীন রণনীতি-রণকৌশল, সাংগঠনিক পদক্ষেপ ইত্যাদি নিয়ে নানা মত, ব্যাখ্যা বিশেস্নষণ থাকতে পারে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক; কিন্তু তারা যে শোষকশ্রেণী এবং শোষণমূলক ব্যবস্থা উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন এবং এক্ষেত্রে কোনো আপোষ ছিল না তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। কর্নেল তাহের ১৯৭১ সালে প্রচলিত সেনাবাহিনীর সদস্য হিসাবে যুদ্ধ করেননি। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক ধাঁচের সেনাশৃঙ্খল ভেঙে জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে জনযুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর কোনো সংশয় ছিল না বলেই তিনি বলতে পেরেছিলেন, “আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম একজন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার হিসাবে নয় বরং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে, আমি এটাকে আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক বলে মনে করি।

” সেজন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেভাবে অনেকটা ঔপনিবেশিক গণবিচ্ছিন্ন ধাঁচের সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছিল, তাহের তার সাথে একমত পোষণ করতে পারেন নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে তার পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছিলেন, “আমি চিন্তা করেছিলাম বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবজনক সেনাবাহিনী গড়ে তুলব। আমি ছাউনিতে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীতে কাজ করেছি এবং আমি বুঝতে পারি একটি অনুন্নত দেশের জন্য এই ব্যারাক আর্মি কতটুকু বিপজ্জনক হতে পারে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের কোন ধরনের সম্পর্ক নেই বলেই এমন স্বেচ্ছাচারী ধরনের শাসনের ফলে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এবং সর্বশেষ তারা দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলে। আমি উৎপাদনশীল গণমুখী সেনাবাহিনী যা দেশের প্রগতির জন্য অত্যন্ত কার্যকরী মাধ্যম হিসাবে কাজ করবে, সে ধরনের একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলার ধারণা নিয়ে কাজ করতে শুরু করি।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ও আরো কিছু উচ্চপদস্থ অফিসার আমার এই ধারণার ব্যাপারে কোন ধরনের উৎসাহ ও সহযোগিতা দান করেননি। এই মৌলিক বিষয়ে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফের সঙ্গে আমি মতৈক্যে পৌঁছাতে পারিনি। ··· জনগণের স্বার্থই আমার কাছে সর্বোচ্চ। আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের কাছ ফিরে যেতে চাই; যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার চারিদিকে জড়ো হয়েছিল আমি তাদের বলবো কি ধরনের বিপদ তাদের দিকে আসছে। ” তার এই ভবিষ্যদ্বাণী কি মর্মান্তিকভাবে আমাদের জাতীয় জীবনে ফলেছিল তা ২৫ বছরের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন এবং ১৮ থেকে ২৮ বার সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, ব্যর্থ অভ্যুত্থান, দুই প্রেসিডেন্ট হত্যা, জেল হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে।

শাসকশ্রেণীর শ্রেণী-চরিত্রের বাইরে গিয়ে ভিন্ন ধাঁচের শাসন-প্রশাসন বেসামরিক-সামরিক আমলাতন্ত্র কোনোটাই যে দাঁড়াতে পারে না এর সম্যক ধারণাও তাহের নিজের মধ্যে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের দেশে ৫২’র ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত সকল ছোট বড় রাজনৈতিক সংগ্রাম বামপন্থি শক্তিই মূলত গড়ে তুলেছিল। তাঁদের সীমাহীন আত্মত্যাগ সকল সংগ্রামে শক্তি যুগিয়েছিল। কিন্তু মার্কসীয় মূল দৃষ্টিভঙ্গী ও বিচারধারা আয়ত্ত করার ব্যর্থতাজনিত কারণে তাদের কোনো অংশই সমাজের মূল দ্বন্দ্বের নিরিখে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা জনগণের সামনে হাজির করতে পারে নি। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ মূল দ্বন্দ্ব একভাবে নিরূপণ করতে সক্ষম হলেও সামগ্রীকতায় তার আলোকে রাজনৈতিক গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে পারে নি।

বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আপোষহীন ধারার প্রতিভূ মাওলানা ভাসানী বামপন্থি শক্তির ওপর ভর করে এগোতে চেয়েছিলেন। ’৫৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ যা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা তুলে ধরলেও তিনি একদিকে উঠতি বাঙালি ধনিকশ্রেণী ও তার আন্তর্জাতিক সহযোগীদের আশীর্বাদ বঞ্চিত ছিলেন, অন্যদিকে ছত্রখান বাম শিবিরও তাঁকে পরিত্যাগ করায় একাই তিনি একটা প্রতিষ্ঠানরূপে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আর এরই সুযোগে গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বুর্জোয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। এই নেতৃত্ব যে জনগণকে জনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে পারে না এবং আপোষ-মীমাংসার পথ ছাড়তে পারে না যতক্ষণ না তারা ভিন্ন পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় নিক্ষিপ্ত হয় - বুর্জোয়াশ্রেণীর এই ঐতিহাসিক ও শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতার কথা তাহের জানতেন। যে কারণে আজকের দিনে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে শোষিত জনগণ এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী বুর্জোয়াদের মধ্যে আন্দোলনের নীতি-কৌশল, উদ্দেশ্য-আদর্শ নিয়ে দ্বন্দ্ব বিরোধ তৈরি হয় এবং শোষিতশ্রেণীর সত্যিকারের নেতৃত্ব ও দল সঠিকভাবে সংগ্রাম পরিচালনা করতে পারলে জনগণ তাদের পেছনে কাতারবন্দি হয় এবং স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্ন বাস্তôবে রূপ লাভ করে।

যেমন করে চীনে ১৯৪৯ সালে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্র দুটোই অর্জিত হয়েছিল। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনী থেকে তাঁর পদত্যাগপত্রে বলছেন, “১৯৭১ সালের আগস্টের গোড়ার দিকে যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি, আমি দেখতে পাই মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রকম অসুবিধার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গণপ্রতিনিধিরা যেমন এমএনএ এবং এমপিএ-রা মুক্তিযুদ্ধ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছে এবং কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধকে তারা বিস্তৃত করার ব্যাপারে সাহায্য করেনি। এমনকি তারা এও বলাবলি করে যে তারা কেবল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল, স্বাধীনতা চায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট এ ধরনের বহু প্রতিনিধি ঘৃণার বস্তুতে পর্যবসিত হয় এবং আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সব সময়ই উপদেশ দিতাম এমএনএ এবং এমপিএ-দের প্রতি রূঢ় না হওয়ার জন্য।

এই জন্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর এই ধরনের গণপ্রতিনিধিরা জনগণকে নেতৃত্ব দেবার সুযোগ পাবে না। “সম্ভবত এই ভয়েই মুজিব নগরে অবস্থিত অস্থায়ী সরকার ভারতের সঙ্গে একটি অপমানজনক গোপন চুক্তিতে প্রবেশ করে এবং স্বাধীনতা শেষে তাদের ক্ষমতায় বসবার জন্য ভারতের সশস্ত্র সাহায্য এবং সহযোগিতা লাভ করে। যখন মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা সমগ্র ক্ষেত্রেই প্রস্তুত তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং সম্পদ লুটে নিয়ে যায়। অস্থায়ী সরকার এইভাবেই মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। ” যে কারণে অসীম আত্মত্যাগের পরও জনগণের প্রকৃত মুক্তি এলো না।

১৬ ডিসেম্বরকে ‘স্বাভাবিক বিজয়ের ফলশ্রুতি’ হিসাবে পাওয়া গেল না। ‘জয়ী হয়েও মুক্তিযোদ্ধারা হেরে’ গেল। জনগণের যুদ্ধকালীন চেতনা যা মূর্তরূপ লাভ করেছিল প্রকৃত গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন জাতীয় বিকাশের আকাঙ্খায়, একে শাসকশ্রেণী অস্বীকার করতে না পারলেও বাস্তবে তার বিপরীত পথে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু হলো। কর্নেল তাহের বলেন, “আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম এই ভেবে যে এবারে সব শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি ঘটবে। কিন্তু যুদ্ধের পর দেশের কি অবস্থা হলো?” “··· পরিকল্পনা বিভাগের যে কর্মীকে শোষণের পরিকল্পনা করা শেখানো হয়েছে বছরের পর বছর ধরে, তিনিই এখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরি করেন।

যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানিদের হয়ে প্রচারণায় মত্ত ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর তারাই ভোল পাল্টিয়ে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন। ” “··· এক অশুভ শক্তি, মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারের প্রভেদ রেখাকে মুছে দিতে শুরু করলো। ”কর্ণেল তাহের বলেন, “··· জনগণের ম্যান্ডেট লাভকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ছিল এক বিরাট দায়িত্ব ও কর্তব্য। দুর্ভাগ্যবশত সম্পূর্ণ অস্ত্রবলহীন একটি নিরস্ত্র জাতির ভবিষ্যত নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনরকম চিন্তাই করেনি। সম্ভাব্য ভয়াবহতা মোকাবেলা করার জন্য আগে থেকে তারা জনগণকে কোনভাবেই প্রস্তুত করেনি।

··· ফলে যে যুদ্ধের বেশীর ভাগই হয়েছিল স্বদেশের মাটির বাইরে, সে যুদ্ধ আমাদের জনগণকে কি সুফল উপহার দিতে পারে?” একইভাবে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জনকারী ভারতের সমর্থন ও সাহায্যের প্রশ্নে তাহের বলেন, “ভারত খুব খুশী মনেই আমাদের শিশুদের, সাধারণ মানুষকে আর সেনাদের প্রতি খাবার আর আশ্রয়ের নিরপত্তা দিতে প্রস্তুত ছিল। কারণ ভারত জানতো এতে করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর কূটনীতির অঙ্গনে তাদের সম্মান ও ভাবমূর্তি বেড়ে যাবে। আর উপমহাদেশে তার আধিপত্য বিস্তারের নীতিও আরও সুদৃঢ় হবে। আসলে বাংলাদেশের ঘটনায় ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থ ও সম্পদের দিক থেকে সবচাইতে বেশি লাভবান হয়েছিল ভারত। ” কর্নেল তাহের স্বাধীনতাত্তোরকালে যে দুঃশাসন জনগণের ওপর চেপে বসেছিল তার বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের লাইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের পথে ক্ষমতা দখল কিংবা ক্ষমতা বদলের নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না।

একই সাথে ব্যক্তির ভাল-মন্দ চরিত্র শাসন-প্রশাসনে প্রভাব ফেলে, কিন্তু তা শ্রেণীস্বার্থের সীমা অতিক্রম করতে পারে না এবং শ্রেণী স্বার্থ যে ব্যক্তি চরিত্রের গঠন ও পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে সে বিষয়টিও লক্ষ্য করছেন। তিনি বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার কি ভূমিকা পালন করেছে তা দেশবাসী সবারই জানা। কিভাবে একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল ও জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছিল এখন তা দলিলের বিষয়। এক কথায় বলা যায়, আমাদের লালিত সব স্বপ্ন, আদর্শ ও মূল্যবোধগুলো এক এক করে ধ্বংস করা হচ্ছিল। গণতন্ত্রের অসম্মানজনক কবরশয্যা রচিত হয়েছিল।

মানুষের অধিকার মাটি চাপা পড়েছিল। সারা জাতির ওপর চেপে বসেছিল এক ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র। ” “··· এটা খুবই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক যে এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের অন্যতম প্রধান পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান শেষ পর্যন্ত একনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। অথচ মুজিব তার সংঘাতময় রাজনৈতিক জীবনে কখনো স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে আপোষ করেননি। ··· আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ‘মুজিব’ নামটি ছিল রণহুঙ্কার।

মুজিব ছিলেন জনগণের নেতা। ··· তাই চূড়ান্ত বিশ্লেষণ তাঁর ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার শুধু জনগণেরই ছিল। যে মুজিব জনগণকে প্রতারিত করে একনায়ক হয়ে উঠেছিলেন তাঁকে জনগণের শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করাটাই হতো সব থেকে ভালো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জনতা মুজিবকে নেতার আসনে বসিয়েছিল, সেই জনতাই একদিন একনায়ক মুজিবকে উৎখাত করতো। ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত করার অধিকার জনতা কাউকে দেয়নি।

” চক্রান্তের সুফলভোগী জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বলেছেন, “জিয়া শুধু আমার সঙ্গেই নয়, বিপ্লবী সেনাদের সঙ্গে, সাত নভেম্বরের পবিত্র অঙ্গীকারের সঙ্গে, এক কথায় গোটা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে তুলনায় জিয়া মুদ্রার অন্য পিঠ বলেই প্রমাণিত হয়েছে। ” কর্নেল তাহেরের জাতীয় পুনর্গঠন ও উন্নয়ন সম্পর্কিত দৃষ্টিও ছিল সুদূর প্রসারিত। জনগণের মিলিত কর্মোদ্যোগ শক্তির উপর তার আস্থা ছিল প্রগাঢ়।

তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, “বৈপ্লবিক কর্মপ্রেরণার জোয়ার আমরা দেখেছিলাম বাংলার জনগণের মাঝে স্বাধীনতার পরপর। জনগণের কর্মচেতনার অভাব নেই। আজ প্রয়োজন একটি বৈপ্লবিক জাতীয় পরিকল্পনা। বৈদেশিক সাহায্য আনা টেন্ডারের ভিত্তিতে পরিকল্পনা নয়। এই জাতীয় পরিকল্পনা হবে আদর্শগত ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত।

” আজ আমরা আমাদের নদী ও পানিসম্পদ নিয়ে যে ব্যাকুল ভাবনায় পতিত হয়েছি, বহু পূর্বেই তাহেরের এ বিষয়ে সচেতন সজাগ দৃষ্টি ছিল। তিনি বলেছিলেন, “নদী আমাদের প্রাণ। বাংলার মানুষের সঙ্গে সে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নদীপ্রবাহ আমাদের ভূমিকে করেছে উর্বর। নদীকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও শিল্প, সভ্যতা বিকাশের মাধ্যমে এই নদীকে ক্রমাগত ব্যহত করে আমরা আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছি।

সোনার বাংলা ফিরে পেতে হলে আমাদের ফিরে পেতে হবে সুস্থ, সবল ও গতিশীল নদী। ” ··· ··· জাসদ রাজনীতি পেটি-বুর্জোয়া বিপ্লববাদের ধারা থেকে সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী ধারাতে উত্তীর্ণ হতে না পারার কারণে স্বাধীনতা-পূর্ব ‘মস্কো-পিকিং’ ধারার বামশক্তিগুলোর ব্যর্থতার শূন্যস্থান পূরণ করে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল তাকে এগিয়ে নিতে পারলো না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণ থেকে উঠে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-যুবক যারা তখনও উৎসর্গীকৃত জীবনের পূর্ণ আবেগে সজীব এবং টগবগে আর পাশাপাশি যুদ্ধে নবজাগ্রত একটা জাতি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর তাদের সামনে ‘ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর আবেদনকে প্রজ্ঞা ও দায়িত্বশীলতায় পূর্ণতা দিতে পারল না। যেমন, ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ মধ্যবিত্ত-যুবক নির্ভর দলকে সাধারণ জনগণের বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষকসহ শোষিত জনগণের মাঝে নিয়ে যাওয়ার যে তাত্ত্বিক রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছিল, তার সম্পূর্ণ বিপরীত আবেগ-উত্তেজনাময় একটা হঠকারী কর্মসূচি সম্পন্ন করতে গিয়ে জাসদ একদিকে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অন্যদিকে অপরিণত অবস্থায় রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণের মুখে বিধ্বস্ত ও ছত্রখান হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সঠিক পথে না চলে ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে করতে যে জায়গায় এসে জাসদ দাঁড়িয়েছিল সেটাই ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের বিরাট সাফল্যকে ব্যর্থতার গ্লানিতে ঢেকে দিয়েছিল।

শত সহস্র শহীদ আর তাহেরের অমূল্য জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছিল। এসব থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং বিপ্লবী রাজনীতির ঝান্ডাকে উত্থিত করার প্রাণপণ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে যে মতাদর্শগত সংগ্রাম ’৭৪ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল তার পরিণতিতেই আজ বাসদ তাহেরের আরব্ধ কাজ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শিখা জ্বালিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রদীপের এই আলো সূর্যের মতো সারাদেশকে আলোকময় করতে পারেনি তবে ঘোর অন্ধকারে বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে গন্তব্যের নিশানা হিসাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ··· ··· ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দিয়ে ৫৫ বছরের মধ্যেই ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে হয়েছিল। তাহেরের ফাঁসির পর এখনও ৫৫ বছর পার হয়নি।

আমরা আশা করবো, তার আগেই তাহেরের স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটবে। মুক্তিযুদ্ধের গণআকাঙ্ড়্গা ও মৌল চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে। কর্নেল তাহের লাল সালাম। জয় সর্বহারা, জয় সমাজতন্ত্র। Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.