আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উচ্চ মাধ্যমিক ফলাফল ও ইংরেজি ভীতি

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

উচ্চ মাধ্যমিক ফলাফল ও ইংরেজি ভীতি রেকর্ড পরিমাণ জিপিএ-৫ এবং পাসের হার নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলেছে কৃতীমানদের উল্লাস। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিশ সহস্রাধিক জিপিএ-৫ চাট্টিখালি কথা নয়। আনন্দ তো তারা করবেই। তা করুক।

তাতে কেউ বাদ সাধবে না। "সুখে আছে যারা সুখে থাক তারা"। আজ আমি ভগ্নদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাই। দিতে চাই তাদের খবর যারা ফেল করেছে। দাপ্তরিক ভাষায় অকৃতকার্য হয়েছে কিংবা কথ্য ভাষায় ডাব্বা মেরেছে।

দেশের দশটি শিক্ষা বোর্ডে এদের গড় অনুপাত ৭০.৭৩। বাকীরা আপাতত পাস করতে পারেনি। আমাদের ভালো লাগতো এদের সবাই পাস করলে। কারণ যারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে টেস্ট পরীক্ষায় পাশের পর ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছে- তাদের সাফল্য প্রত্যাশা কি যুক্তিহীন দুরাশা? শতভাগ স্বাক্ষরতার স্বপ্ন যেমন আমরা বয়ে বেড়াই, তেমনি স্বপ্ন দেখা যায় শতভাগ পাসের। এবং সেটাই আমাদের জাতীয় দায় হওয়া উচিত।

অথচ আমরা মুষ্টিমেয় নগরকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে সীমাহীন আত্মপ্রসাদ লাভ করছি এবং শিক্ষার্থীদের মেধা তালিকার পাশাপাশি স্কুল-কলেজেরও মেধা তালিকা প্রকাশ করছি। মেধা তালিকাভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা কপট গাম্ভীর্যের সাথে বিশেষজ্ঞের মতামত দিচ্ছেন মিডিয়ার সামনে। তাঁরা একবারও বলছেন না যে, ভর্তির সময় মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫-এর নিচের কাউকে তারা তাদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেননি। নিম্ন মেধার কথা না হয় বাদই দিলাম, একজন মাঝারি মেধার ছাত্র/ছাত্রীকে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমে শীর্ষ মেধায় উন্নীত করে দেখাতে পারলে তাদের ক্যারিশমা বিনা বিতর্কে মেনে নেয়া যেতো। কিন্তু বিষয়টি কি সেরকম? যে সকল শিক্ষার্থী নিজগুণেই মেধা রেলের যাত্রী তাদের কাঙিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া কি খুবই প্রশংসার? বড় কিছুকে ছোট করে দেখানোর কোনো বাতিক আমাকে পায়নি।

আমার অভিযোগ শুধু অন্যায্য অতিপ্রশংসার বিষয়গুলো নিয়ে। মাধ্যমিক পর্যায়ের জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের মেধামান বহাল রাখার প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখার অবকাশ হয়তো নেই। কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরী মেধামান বৃদ্ধির প্রচেষ্টা এবং একশত ভাগ পাসের নিশ্চয়তা বিধানের প্রচেষ্টা। এই দ্বিবিধ উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে যারা এগুচ্ছে, তারাই ঠিক কাজটি করছে। ফেলের হার কমাতে গেলে শনাক্ত করতে হবে ফেলের কারণগুলো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন ফেল করা ৩০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীর প্রায় ৮০ শতাংশই ফেল করেছে ইংরেজিতে। বলা চলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাস-ফেলের প্রধান নিয়ামক এই ইংরেজী বিষয়। স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে প্রায় অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রই ইংলিশ ফিয়ার সিনড্রোম (EFS)-এ আক্রান্ত। এই আক্রমণের হার আবার পল্লী এলাকার শিক্ষার্থীদের বেলায় ভয়াবহ রকমের বেশি। বস্তুত এর শেকড় আরো গভীরে।

একেবারে নিম্ন-মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। ইংরেজির বিভীষিকা একেবারে শৈশবকাল থেকেই আমাদের পল্লী অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের তাড়া করে ফেরে। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলের শিক্ষকেরা Spare the rod and spoil the Child নীতি মেনে চলতেন বলে মারের ভয়ে হলেও আমাদের পিতা-পিতামহের প্রজন্মের ইংরেজি বিদ্যা মোটামুটি পর্যাপ্ত ছিলো। এখন সে প্রক্রিয়া নিরুৎসাহিত। তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি।

বরং দক্ষ মোটিভেশন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর গভীরতর প্রভাব ফেলে। সেই প্রভাব প্রহার-প্রযুক্তির চাইতে নিশ্চয়ই অধিক কার্যকর। কিন্তু কোথায় আছে সেই দক্ষ মোটিভেশন? ইংরেজি শিক্ষার বুনিয়াদী পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ শিক্ষক নেই বললেই চলে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে এই ইংরেজি জ্ঞানের বহর নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হচ্ছে গ্রামের কোনো টেনেটুনে এমপিওভুক্ত কলেজে। রাজধানীর টপ টেন কিংবা বোর্ডের টপটেনে ভর্তি তো তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন।

পল্লী অঞ্চলের এই কলেজগুলোতে বিশেষ করে বেসরকারী কলেজগুলোতে ইংরেজি শিক্ষার অবস্থা তথৈবচ। মোটা টাকা ডোনেশন দিয়ে চাকরি পাওয়া এই সকল কলেজের ইংরেজি শিক্ষকে পেশাগত দক্ষতার প্রশ্ন তোলাই অবান্তর। তবুও যতোটুকু উপযোগ তাঁদের আছে তার প্রায় সবটুকুই খরচ হয় প্রাইভেট টিউশনের কাজে। ফলে এদের হাতে-পড়া ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি জ্ঞানের মাত্রা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্জিত মাত্রাসীমার একইঞ্চি উপরেও উঠতে পারে না। ঘটনাক্রমে এরাই বাড়িয়ে চলে ফেলের হার।

এদের গ্রেড পয়েন্ট বাড়াতে পারে কিংবা এদের পাস করাতে পারে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাই সত্যিকার আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর এদের সত্যিকার উন্নয়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে যে শিক্ষা ব্যবস্থা তাই যথার্থ শিক্ষা ব্যবস্থা। গ্রেড পয়েন্ট বাড়াতে কিংবা পাসের হার বাড়াতে যা সর্বাগ্রে করণীয় তা হলো ছাত্রছাত্রীদের মন থেকে ইংরেজির জুজু তাড়ানো। কেবল আদু ভাইয়ের অদম্য ইচ্ছা কিংবা শ্রীকান্তের মেজদা'র কর্তব্যনিষ্ঠার সবক দিয়ে পাসের হার বাড়ানো যাবে না। এর জন্যে প্রয়োজন সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দশভুজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়- কিন্তু দেশের সামগ্রিক শিক্ষার উন্নয়নে কাংখিত ফলোৎপাদন করতে পারছে না। এই সুবিশাল ব্যবস্থাপনায় নানা মুনির নানা মতের সমন্বয় সাধন সম্ভব হচ্ছে না এবং অনেক ক্ষেত্রে "অধিক সন্যাসী গাজন নষ্ট" করে ফেলছে। অথচ একই লক্ষ্যবস্তুতে দশদিক থেকে আঘাত হানলে শিকার অব্যর্থ হওয়ারই কথা। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাহুগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা, আন্তঃশৃংখলা, সমন্বয়, যোগাযোগ প্রভৃতির অপর্যাপ্ততার কারণে সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাড়ি কাড়ি অর্থ গচ্ছা যাচ্ছে।

এদিকে দাতাদের মনোরঞ্জনের জন্য অধিকতর ভালো ফলাফল প্রদর্শনের প্রয়োজনে কূট কৌশলের আশ্রয় নেয়ার কথাও অনেক শোনা যাচ্ছে। এই প্রবণতার সুদূর প্রসারী ফল ভালো নয়। সঠিক পদক্ষেপ নিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পাশ-রেখা ঊর্ধ্বগামী এবং ফেল রেখা নিম্নগামী হতে থাকবে। সঠিক পদক্ষেপের মধ্যে নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার বুনিয়াদ শক্ত করে তুলতে হবে। হঠাৎ করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব নয়।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ ইংরেজির শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে একমুখী করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো। একই দেশে বহুধাবিভক্ত শিক্ষাকার্যক্রম বিদ্যমান থাকায় নির্দিষ্ট বিষয়ে মান নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় অসুবিধাজনক হয়। বেসরকারী কলেজের ইংরেজির শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। ইংরেজি বিষয়ে একটি শ্রেণীতে ভিন্ন ভিন্ন বোর্ডে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন হওয়ায় সকলের প্রতি সমবিচার করাও সম্ভব হচ্ছে না।

একই প্রশ্নপত্রের ব্যবস্থা থাকলে শুধু ইংরেজি কেন, সকল বিষয়েই একটি সামগ্রিক মূল্যায়ন ও মাননিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। সবচেয়ে বড় কথা প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট, কার্যকর জাতীয় শিক্ষা নীতি থাকা বাঞ্ছনীয়। আমরা আশাবাদী, অচিরেই এর সফল বাস্তবায়ন দেখবো। শুধুমাত্র পাসের হার বাড়ানোর জন্য নয়, যে কোনো বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার অন্যতম প্রধান মাধ্যম ইংরেজি। বাঙালির মনন শক্তিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত ইংরেজি জ্ঞানের।

যথার্থই বলা হয়েছেঃ English is the window on the world. ঘরে বসে যদি উঁকি দিয়ে বিশ্ব দেখতে হয়, তবে জানালাটি হতে হবে ইংরেজির। যুগ যুগ ধরে আমাদের সেই জানালা বন্ধ করে রেখেছে এক জুজু বুড়ি- যার নাম ইংরেজি ভীতি। সেই কিংবদন্তীর জুজু বুড়িকে আমরা তাড়াতেই হবে। তানাহলে আমরা জাতি হিসেবে আর বেশী দূর এগুতে পারবোনা।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.