আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"প্রধানমন্ত্রীর সৌদি সফর : পর্বতের মূষিক প্রসব ছাড়া আর কিছু নয়"

ইট মারলে পাটকেল খেতে প্রস্তুত থাকুন .....

(আমার এ লেখাটি বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকে গত মে মাসে প্রকাশিত হয়েছে) দীর্ঘ্য ৩/৪ বছরে নানাবিধ সমস্যার অবসানে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রাণের দাবী ছিল, বাংলাদেশ সরকারের প্রধান বা উচ্চ পর্যায়ের কোন প্রতিনিধি সৌদি সফর করে তাদের সমস্যাগুলোর আশু সমাধানের কার্য্যকর পদক্ষেপ নিন। বিগত দু’বছরের অতিবিপ্লবী তত্বাবধায়ক সরকার এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়নি বা নেয়ার সুযোগ পায়নি; স্বভাবতই নির্বাচিত সরকারের কাছে এটি জনগুরুত্বপূর্ন বলে বিবেচিত হয়। সে হিসেবে গত 21 এপ্রিল হয়ে গেল বহু প্রতিক্ষিত সে সফর, প্রধানমন্ত্রী তার ৩৯ জন সফরসঙ্গীর বিশাল বহর নিয়ে ৫ দিন ব্যাপি সাড়ম্বরে সৌদি সফর করলেন; তবে বাদশার সাথে বৈঠক হলো মাত্র ৫৫ মিনিটের। এই রাষ্ট্রিয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে শেখ রেহানা ও জয় যোগ দিলেন। একটি রাষ্ট্রিয় সফরে এসে অন্য একটি রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে বৈঠকে বোন, বেয়াই আর ছেলেকে নিয়ে অংশগ্রহনের মাযেজা কি, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ন রাষ্ট্রিয় বৈঠকে পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে অংশগ্রহনের কোন রেওয়াজ আছে কিনা, এতে বৈঠকটি নিছক গুরুত্বহীন পারিবারিক বৈঠকে পরিনত হলো কিনা, সৌদি সরকারও এটাকে কিভাবে নিয়েছে এ সব নিয়ে বারংবার ভাববার অবকাশ আছে।

পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের (অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দেন) প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্যে কোন রাজকীয় রিসিপশন কিংবা ভোজসভা না থাকা সত্বেও এই সাদামাটা অভ্যর্থনাতেই বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অতি উষ্ণতা অনুভব করেছেন সফরের যত্রতত্র; হতে পারে এটা তার মহত্ব ও মহাত্মের লক্ষন। আবার বাদশার সাথে আলোচনায় কি কি অগ্রগতি হলো তা ছাপিয়ে বাদশা আব্দুল্লাহ প্রধানমন্ত্রীকে বোন ডাকার বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠা এবং তা স্বকন্ঠে মিডিয়াতে ক্যানভাস নিছক তার বালিকাসুলভ বালখিল্যতা প্রকাশ পেয়েছে। প্রবাসীদের মধ্যে সে সফর নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে, সাফল্য নিয়ে দ্বিধা-শংকা আছে, কে কাকে বোন ডাকলো আর কি ডাকলো তাতে প্রবাসীরা বিন্দুমাত্র বিচলিত কিংবা পুলকিত নয়, প্রবাসীরা চায় দৃশ্যমান সমাধান, অস্পষ্ট আশ্বাস নয়। এই সফর সংক্রান্ত সব বক্তব্যই অস্পষ্ট, অসম্পূর্ন, অজ্ঞতাপ্রসূত ও মিথ্যাচারে ভরা। মন্ত্রি আর কিছু মিডিয়ার বক্তব্য শুনে মনে হয় সমস্যার সমাধান হলো কি হলো না তার চেয়ে জরুরী হলো ঢোল পিটানো, সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন।

আওয়ামীমন্ত্রী ও তাদের প্রচারযন্ত্রীদের ভাষায় যেন ‘তিনি এলেন আর জয় করে চলে গেলেন’, নিমিষেই সব সমস্যার সমধান হয়ে গেছে। আবার কোন কোন পত্রিকা চাটুকারিতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে লিখল “বাদশার সাথে ফলপ্রসু আলোচনায় আক্বামা সমস্যার সমাধান হওয়াতে প্রবাসীদের উল্লাস”। লাখ লাখ প্রবাসী সৌদি বাংলাদেশীর অর্ধেকের বেশী লোক নানা সমস্যায় জর্জরিত, নানা বিধি নিষেধের মারপ্যাঁচে ইতোমধ্যে অনেকে অবৈধ হয়ে গেছেন আর কেউ হবার পথে, প্রধানমন্ত্রী সফরের পর এখনো সৌদি সরকার কোনে আনুষ্ঠানিক ঘোষনা দিলনা, বাংলাদেশ দূতাবাস এখনো প্রবাসীদের কোন সুসংবাদ দিতে পারলনা, সেখানে কোন হতভাগা প্রবাসী কিভাবে “উল্লাস” করল, কতিপয় মিডিয়া কোথা থেকে এই “উল্লাস” আবিস্কার করল, আমাদের বোধগম্য নয়। এ প্রসংগে রিয়াদ ও জেদ্দার বাংলাদেশ দূতাবাসস্থ লেবার উইং এ যোগাযোগ করলে তারা জানালেন, “আমরা কোন অগ্রগতির খবর এ মুহুর্ত পর্যন্ত জানিনা, বাংলাদেশী পত্রিকা ওয়ালারা কোথা থেকে কি লিখল তা তাদের জিজ্ঞেস করুন”। সফরের প্রথম দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো নিউজ করল, ইতোমধ্যে সৌদি মন্ত্রীসভা কর্তৃক পাশকৃত একটি আইনে প্রবাসীদের আক্বামা পরিবর্তন সংক্রান্ত জটিলতা কেটে গেছে, অথচ সৌদি জাতীয় ইংরেজী দৈনিক ‘আরব নিউজ’ পড়ে দেখা গেল, তা কেবল কন্ট্রাক্টিং কোম্পানীর হয়ে যারা এ দেশের সরকারী বিভিন্ন অফিস আদালত বা স্থাপনায় মেইনটেনেন্স, ক্লিনিং, ক্যাটারিং ইত্যাদিতে কাজ করে এটা জাতীয়তা ভেদে তাদের সবার জন্য।

এমনকি এদের ট্রান্সফার খরচও সরকার বহন করবে, তবে তাও কফিলের অনুমতি সাপেক্ষে, কফিল চাইলে যে কাউকে পাঠিয়েও দিতে পারে, তাহলে পরিবর্তনটা হলো কি? আর এ ধরনের কোম্পানীতে কতজন বাংলাদেশী কাজ করে? ২০ হাজার, কিংবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার। আর বাকি ২০/২১ লাখ প্রবাসী যারা ব্যাক্তি মালিকানাধীন বা প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করে তাদের কি হবে? পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে তারপর দিন মিডিয়াগুলো খবর দিল, বাদশার সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্থ করা হয়েছে যে, এখন থেকে আক্বামা অপরিবর্তিত রেখে বাংলাদেশীরা তাদের ইচ্ছামত যে কোন জায়গায় কাজ করতে পারবে, কর্মক্ষেত্র থেকে ছাটাই হলে তাদের আর আগের মত দেশে ফেরত আসতে হবেনা; তার মানে কি? আক্বামা অপরিবর্তিত রেখে এখনো অনেকে (কফিলের অনুমতি নিয়ে বা না নিয়ে) ভিন্ন জায়গায় কাজ করছে যাকে ফ্রি ভিসা বলে, চাকুরীচ্যুত হলে এখনো ঢালাও ভাবে সবাইকে দেশে ফিরে আসতে হয়না, (আবার কফিল পাঠিয়ে দিলে ধরে রাখার ক্ষমতাও কারো নাই) তাহলে পরিবর্তনটা হলো কোথায়? সেই আক্বামা নবায়ন, ছুটির জন্য এক্সিট-রিএন্ট্রি, লাইসেন্স, মিউনিসিপ্যালটির কার্ড, ব্যাংক একাউন্ট, মেডিক্যাল ইন্সুরেন্সসহ সব প্রয়োজনেই তো আবার কফিলের কাছে যেতে হবে তার সত্যায়িত অনুমোদনের জন্য আর তার জন্য গুনতে হবে হাজার হাজার রিয়াল, মূল সমস্যা তো এখানেই। ধরে নিলাম, আক্বামা অপরিবর্তিত রেখে কাজ করতে এখন থেকে আইনগত কোন বাধা নেই, তবে কফিল যদি অনুমতি না দেয়? কফিল বলছে এতদিনের মধ্যে ট্রান্সফার হও নতুবা তোমার দেশে ফেরত যাও, ট্রান্সফার বন্দ্ব না খোলা তা আমার দেখার বিষয় নয়, সে ক্ষেত্রে প্রবাসীরা কি করবে, কার কাছে প্রতিকার চাইবে? এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। মধ্যপ্রাচ্যের কফিল প্রথায় শ্রমিকদের স্বাধীনতা কতটুকু তা কি অবগত নন আমাদের মন্ত্রী মহোদয় কিংবা মিডিয়ার কর্তা ব্যাক্তিরা? আর আক্বামা বা মালিকানা পরিবর্তন ছাড়া কোন নতুন নিয়োগকর্তা বাংলাদেশী কোন শ্রমিক নিয়োগ দেবে কোন ভরসায়? কেন ভাসমান লোক নিয়োগ দিয়ে তারা ঝুঁকি নিতে যাবে? যেখানে অন্যদেশীয় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে, যাদের এ ধরনের কোন সমস্যাই নেই। তা হলে এ ধরনের বায়বীয় সাফল্য প্রচারের অর্থ কি? প্রচারিত সাফল্যটা কি কেবলই নিরাকার অশ্ব ডিম্ব? মন্ত্রীমহোদয়রা কি আসলেই জানেন প্রবাসীদের সমস্যাগুলো কি আর তার সমাধান কোন পথে? আর বিগত দিনে সৌদি প্রবাসীদের সমস্যাটা নিয়ে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় ধারাবহিক নানান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, প্রবাসীরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ তাদের কাছে।

তবে দু’একটি বাদে সব মিডিয়ার প্রতিবেদনই আংশিক ও অস্পষ্ট; অনেকটা অন্দ্বের হাতি দেখার মত। তারা মূল সমস্যাগুলো অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে অন্ততঃ তাদের রিপোর্ট দেখে মনে হয়না। যেখানে ২০/২২ লাখ বাংলাদেশী সৌদিতে থাকে, দেশের প্রতি ঘরে ঘরে সৌদি প্রবাসীরা আছেন, সেখানে সমস্যা ও সমাধানের উপায় সম্পর্কে সম্যক ধারনা নেয়াটা একজন রিপোর্টারের পক্ষে মোটেও অসম্ভব ছিলনা, তাতে সফর মহাসফল হয়েছে বলে যারা কীর্ত্তন গাইছে তাদেরও দাবী যে কতটা অসার, তাও ধরা পড়ত। তবে, আমরাও মনে করিনা প্রধানমন্ত্রীর সফরের সাথে সাথে মুহুর্তেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, কিন্তু যে কোন মূল্যে কূটনৈতিক পন্থায় প্রবাসীদের সমস্যাগুলো সমাধান হতে হবে, সে জন্য সরকার কে ধারাবাহিক ভাবে সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, আমাদের দাবী এটাই। বিশ্বমন্দার প্রভাব সৌদি অর্থনীতিতে তেমন বিরূপ প্রভাব ফেলবেনা তা তাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা দেখলে বুঝা যায়।

এ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের আরো ৫০ লক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হবে, প্রতিহিংসাপরায়ন প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্র আমাদের বিরুদ্বে অবিরাম নেতিবাচক প্রচারনা চালাচ্ছে নতুন শ্রম চাহিদার একচ্ছত্র দখল নেয়ার জন্য, যেন আমাদের নতুন কোন শ্রমিক আর এখানে নিয়োগ না পায়, আর আমাদের দূতাবাস কর্মকর্তাদের অদক্ষতা-অপেশাদারিত্বের কারনে আমরা তাদের সাথে পেরে উঠছিনা, ফলে আমরা আমাদের প্রধান শ্রমবাজারটা হারাতে বসেছি। বিদ্যমান শ্রমবাজার ঠিক রাখতে ও নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে আমাদের শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে, কোন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ আর নেশাখোর যেন মামলা / শাস্তির ভয়ে বিদেশে পালিয়ে আসতে না পারে এ জন্য পুলিশ ভ্যারিফিকেশন আরো কঠোর করতে হবে; কারন এসব চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা দেশে যেমন পরিবারের কলংক তেমনি বিদেশে গোটা জাতীর জন্য অভিশাপ। এ সকল পাপিষ্ঠদের কারনেই আজ সৌদিতে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ইমেজ সংকটে। আমাদের দূতাবাস সমূহে দক্ষ জনবল নিয়োগ করে সেবার মান বাড়াতে হবে, যারা বিদেশী বহুমাত্রিক প্রপাগান্ড়ার বিরুদ্বে বুদ্বিবৃত্তিক-কুটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে পারে, দুর্নীতি আর দলবাজির উর্দ্ধে উঠে দেশের স্বার্থে কাজ করতে পারে, তবেই সুসংহত হবে শ্রমবাজার, নিশ্চিত হবে অবিরাম রেমিট্যান্স প্রবাহ। লেখকঃ সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশী


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.