আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ন্যায়বিচারের পক্ষে রাষ্ট্রের অবস্থান



ন্যায়বিচারের পক্ষে রাষ্ট্রের অবস্থান ফকির ইলিয়াস ======================================== বাংলাদেশ পালন করল আরেকটি শোক দিবস। এই দিনটি এলে মনটা খুবই ভারাক্রান্ত থাকে। পঁচাত্তর সালে জাতির জনক যখন সপরিবারে নিহত হন, আমি তখন স্কুলছাত্র। ভোরবেলা জেগেই রেডিওতে শুনেছিলাম, 'আমি মেজর ডালিম বলছি, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে (?) শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। ' সে এক মর্মান্তিক শ্রবণ অভিজ্ঞতা।

'জাতির বৃহত্তর স্বার্থে' কথাটি যুক্ত করে ঘাতকরা সেদিন কি বোঝাতে চেয়েছিল? কি ছিল সেই বৃহত্তর স্বার্থ? কার ছিল সেই স্বার্থভোগী? এসব প্রশ্নের জবাব জাতি অনুধাবন করছে এখনও। চৌত্রিশ বছর পরও। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান দেখছিলাম। চ্যানেল আইতে 'তৃতীয় মাত্রা' অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন। তিনি তার বক্তব্যে যে লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তা শুনে আমি আতঙ্কিত হয়েছি আবারও।

মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন ছিলেন তখন ডিজিএফআই বিভাগে কর্মরত। তাই সে সুবাদে অন্যদের সঙ্গে তিনি পনরোই আগস্ট ভোরে যান ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে। তাদের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুসহ অন্যদের ছবি তোলা। সেখানে যাওয়ার পরে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন জিয়াউদ্দিন অনেকটা এভাবে। তিনি বলেন,'' সেখানে যাওয়ার পর দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে ওঠার সময়ই দেখলাম সিঁড়িতে পড়ে আছে জাতির জনকের মরদেহ।

তার বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে বুলেটে। সাতই মার্চ যে শানিত আঙুলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল ঘাতকের বুলেটে উড়ে গেছে সেই আঙুলটি। আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্ত যাতে স্পর্শিত না হয় সে খেয়াল রেখে দোতলায় গেলাম। গিয়ে দেখলাম সেখানে দায়িত্বে রয়েছে সামরিক অফিসার পাশা। পাশা আমাকে বলল, অন্যরুমে বেগম মুজিবের মরদেহ।

আমরা যেন দেখে আসি। আমি বললাম, একজন নিরীহ মহিলাকে তোমরা হত্যা করছো। আমি সেই নারীর শবদেহ দেখতে আগ্রহী নই। এ সময় দেখলাম এক পাশে পড়ে আছে শিশু রাসেলের লাশ। আমি পাশাকে জিজ্ঞাসা করলাম, একজন শিশুকে কেন হত্যা করা হলো? পাশা আমাকে ইংরেজিতে বললো, আমরা শেখ মুজিবকে নির্বংশ করেতে চেয়েছি।

এরপরে পাশা আমাকে জানাল, শেখ রাসেল খুব চেঁচামেচি করছিল। আমাকে আব্বুর কাছে নিয়ে যাও। আমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে যাও। এরপর তাকে বেয়নেট চার্জ করা হয়। বেয়নেটের সঙ্গে শিশু রাসেলের কলিজার একটি টুকরোও বেরিয়ে আসে।

যা প্রত্যক্ষ করে আমি নিজেকে সামলে নিলাম খুব কষ্টে। এরপর ছবি তোলা শেষ হলে নিচে নেমে এলাম। সেখানে দেখলাম, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তায় যারা এ রাতে দায়িত্বে ছিল, তাদের একজন আমার বেশ পরিচিত। সে আমাকে জানালো, চৌদ্দ আগস্ট সন্ধ্যায় সামরিক অফিসার ওয়াহাব (যে এখন ফাঁসির দ-প্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছে) এসে সব নিরাপত্তা কর্মীর গুলি নিয়ে যায়। ওয়াহাব বলে, গুলিগুলো পুরনো হয়ে গেছে।

তা বদলে দেয়া হবে। '' মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিনের এই বক্তব্যটি শোনার পর আমি আর সংযত থাকতে পারলাম না। টিভি'র চ্যানেলটি ঘুরিয়ে দিলাম। কি মর্মান্তিক বর্ণনা! ইতিহাসের কি জঘন্যতম, বর্বরতম ঘটনা! সপরিবারে কোন রাষ্ট্রপ্রধান নিহত হওয়ার এমন দুঃসহ ঘটনা কি বিশ্বের আর কোথাও কখনও ঘটেছে? দুই পনরোই আগস্টের বেনিফিশিয়ারি কারা? সে প্রশ্নের জবাব এখন আর বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়। সেই বেনিফিশিয়ারিদের একজন ফ.কা. চৌধুরীর পুত্র সা.কা. চৌধুরী।

তিনি আবারও দাম্ভিক উচ্চারণের সঙ্গে বলেছেন 'শেখ মুজিব হত্যা অপরিহার্য ছিল। ' রাজাকার পুত্রের এই দাম্ভিকতা কাঁপিয়ে তুলেছে গোটা বাংলাদেশের ভিত। ধিক্কার উঠেছে দেশজুড়ে। ভাবতে অবাক লাগে এই যুদ্ধাপারাধীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কেন নেয়নি? সে প্রশ্নটির জবাব অনেকেই খুঁজেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিবেচনা করছে। 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়'- গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে অনেক আগে। তারপরও সাকা কিংবা সাঈদীর অতীত সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছে, তা মানা বড় কঠিন কাজ। সাকা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, জাতিসত্তা এগুলোকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেই যাচ্ছেন। তিনি সম্প্রতি এটাও বলছেন, একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলাম।

এখন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য সব 'স্বাধীনতার' পক্ষে অবস্থান নিয়ে অতীতকে পুষিয়ে নেব। কি ধৃষ্ঠতাপূর্ণ কথাবার্তা। এর প্রকৃত অর্থ কি হতে পারে? '৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অত্যন্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করেছিল। এরপর জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এসে তা থামিয়ে দেয় কৌশলে। চলে গেছে প্রায় সাত বছর সময়।

এখন মহাজোট আবার ক্ষমতায় এসেছে। এবারের শোক দিবসে জাতির দাবি একটিই ছিল, পনরো আগস্ট হত্যার দ্রুত বিচার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দ্রুততম সময়ে এই কাজটি সম্পন্ন করার সব প্রস্তুতি নেবেন বলেই জাতি প্রত্যাশা করছে। একটি কথা আমরা জানি, সময় কারও জন্য বসে থাকে না। সময় আসতে পারে অনুকূল কিংবা প্রতিকূল হয়েও।

বাংলাদেশ নবম জাতীয় সংসদ ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানা হত্যাকান্ডের এই নগ্ন পরিকল্পনাও ছিল তেমনি একটি প্রতিকূল ঘটনা। যে বর্বরতম হত্যাকা-টিরও দ্রুত বিচার দরকার জাতির স্বার্থে। টিভিতে দেখলাম পিলখানা হত্যাকান্ডের পর গেল ১৭ আগস্ট বিডিআর'র দরবার সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে বিডিআর প্রধান জেনারেল মইনুল ইসলাম বলেছেন, পিলখানা হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বহিঃশক্তি লাভবান হয়েছে। তার এই বক্তব্যকে পুঁজি করে একটি মহল বলতে চাইছে এটা বাইরের কারও ষড়যন্ত্র।

কিন্তু কথা হচ্ছে, শক্তি ভেতরের হোক আর বাইরের হোক, কাজটি যারা করেছে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত নায়কদের মুখোশ। আর তাতেই জাতি জানতে পারবে, কারা ছিল এর নেপথ্যে। আবারও বলি, সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। কিছু কাজ প্রথম জরুরি বিবেচনায় করতে হয়। বর্তমান সরকারকে তা বিবেচনায় রাখতে হবে।

পনরোই আগস্ট হত্যাকান্ড, ঘাতক দালালদের বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ড, ২১ আগস্ট হত্যাকান্ড এবং পিলখানা হত্যাকান্ডের বিচার দ্রুত সম্পন্ন না হলে জাতি গ্লানি মুক্তির প্রথম ধাপটি পেরুতে পারবে না। নিউইয়র্ক ১৯ আগস্ট ২০০৯ ------------------------------------------------------------------ দৈনিক সংবাদ। ২১ আগস্ট ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- ফ্রাংকো কেইনি

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.