আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আশরাফুলের ফিউচার

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

(লেখাটা শুরু করেছিলাম বাংলাদেশের হোয়াইটওয়াশ সিরিজের পরপরই, আজকে শেষ করতে পারলাম। ) সাবাশ বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের মান যেমনই হোক, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়টি হয়েছে বেশ রাজকীয়, মানে চুনোপুঁটি কোন জয় নয়, একেবারে নিখাঁদ "হোয়াইট ওয়াশ" যাকে বলে। তার ওপর খেয়াল করলে দেখা যাবে যে সিরিজের প্রত্যেকটি ম্যাচই (দুটো বললে কেমন কম কম শোনায়) বৃষ্টি দ্বারা বিঘ্নিত হবার পরও বাংলাদেশ সবগুলো ম্যাচ থেকেই জয় বের করে এনেছে। সেজন্য হলেও প্রতিপক্ষ যেমনই হোক, হোয়াইট ওয়াশের জন্য একটা কড়া গরম সাধুবাদ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে দিতেই হচ্ছে! সাবাশ বাঘের বাচ্চারা!! তবে এবারের প্রতিপক্ষটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বি টিম মতান্তরে সি টিম বলে একটা পরিচিতি পাওয়ায় এই জয়ের আনন্দেই সবকিছু ভরে ফেলাটা আমাদের আম-সমর্থকদের জন্য ঠিক ততটা জুতসই হচ্ছেনা, আরেকটু প্লাস আলফা কিছু একটার প্রয়োজন পড়ছে। আমাদের ভাগ্য ভালো যে সিরিজ শুরু হবার আগেই সমালোচনার হটকেকে পরিণত হওয়া বর্তমান দলের সবচেয়ে বড়সড় কালো ভেড়া মানে ব্ল্যাকশীপটির, ওরফে মোহাম্মদ আশরাফুলের পিন্ডি চটকানোর উপকরণও সিরিজের পরতে পরতে পাওয়া গেছে হরদম।

হোয়াইটওয়াশে জেতা সব খেলোয়াড়ের মতো নিশ্চয়ই মন খুলে আনন্দ করতে পারছেননা এই তথাকথিত "মেধাবী" খেলোয়াড়। আশরাফুলের অবস্থা হোয়াইট ওয়াশ সিরিজে তো বটেই, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সি টিমের মতো দলের সাথেও নিজের একমাত্র স্পেশালাইজড ডিপার্টমেন্ট "ব্যাটিং"য়ের চার ইনিংসে মাত্র ২৪ রান তোলা, ৮০ বল খেলা এবং সর্বোচ্চ মাত্র ২৯ রানের পার্টনারশীপে ব্যাট করতে পারা -- সবগুলো উপাত্তই বলছে যে এটা কিছুতেই একজনের স্পেশালাইজড ডিপার্টমেন্ট হতে পারেনা! আশরাফুলের এই দূরবস্থা আজ প্রথম নয়, দিনের পর দিন এটা হয়ে আসছিলো। হঠাৎ হঠাৎ একদিন দৈবক্রমে তার ব্যাটে-বলে হয়, মানে টাইমিংটা খুব ভালো হয়; স্ট্রোক তার বরাবরই ভালো, যোগে বিয়োগে চোখ ধাঁধানো একটা ইনিংস খেলে সবাইকে চমকে দেয় সে। এর একটিমাত্র ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে যেটা হলো আশরাফুলের ভিজ্যুয়াল পারসেপশনের ডিলে টাইমটা পিরিওডিক এবং সেই পিরিওডও মাশাল্লাহ ভালোই লম্বা -- দুতিনবৎসর ঘুরে একবার শূণ্যতে আসে। সেজন্যই হয়তো এমন লম্বা সময়ের গ্যাপে গ্যাপে তার টাইমিংটা হঠাৎ একদিন পারফেক্ট হয়ে চার-ছয়ের ফুলঝুরি ছোটে।

তাছাড়া ক্রিজে দাঁড়িয়ে বারবার উপরদিকে তাকানো আর সাথে সাথে বিড়বিড় করে দোয়াদুরূদ পড়ার যে অভ্যাস তার দেখেছি (জানিনা এখনও এ অভ্যাস তার আছে কিনা), তাতে তার স্রষ্টাভক্তি নিয়ে যতটা নিঃসন্দেহ হওয়া যায় ততটাই সন্দিহান হতে হয় তার আত্মবিশ্বাস নিয়ে । খোদ ইসলাম ধর্মের শিক্ষক বা মাদ্রাসার মাওলানাও ক্লাশে পড়াতে ঢোকার আগে এত দোয়াদুরূদ পড়েননা, কারণ সম্ভবতঃ স্রষ্টাবিশ্বাসের পাশাপাশি তাঁদের আত্মবিশ্বাসটাও থাকে, আমাদের আশরাফুলের যেন শুধু সেটাই নেই। আশরাফুলের বিকল্প সেদিক দিয়ে আশরাফুলকে খানিকটা গোবেচারাই মনে হয়; মনে হয় যে শুধু শুধুই আমরা এর উপর এত প্রত্যাশা করি। এরকম একজন খেলোয়াড় কোনভাবেই একটা দলের কান্ডারী হতে পারেনা। সেখান থেকেই আশরাফুলের বিকল্প কে হতে পারে সেটা ভাবতে গিয়ে বুঝলাম দলের কান্ডারী নয়, বরং মোটামুটি ভালো খেলে বাকীদেরকে সাপোর্ট দেবে এমন একজন ব্যাটসম্যান হলেই তো আশরাফুলের বিকল্প হওয়া যায়।

মেহরাব জুনিয়র কি এখন ইনজুরিতে? সে কেন দলে নেই জানিনা! এই ছেলেটি আর রাকিবুলের ব্যাটিংয়ে টেস্ট মেজাজ আছে, বল বেছে খেলার একটা ভালো প্রবণতা এদের দেখেছি যেটা নান্নু, বুলবুল, গুল্লুর পর হয়তো আর তেমন কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের মধ্যে দেখিনি। বাংলাদেশে কি আসলেই আর ব্যাটসম্যান নেই? শামসুর রহমান নামে একজন এবার লীগ কাঁপিয়ে ফেলছে শুনলাম। আরো অনেকেই থাকার কথা, কিছু কিছু নাম শুনি হঠাৎ হঠাৎ, যেমন নাদিফ চৌধুরী, জুনায়েদ ইমরোজ, ইমতিয়াজ -- এরা আসে, জ্বলে ওঠে, আবার মুহুর্তেই হারিয়েও যায় -- ভিনি, ভিডি, ভিসি, ভি-উধাও! এটাও মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো আশরাফুলকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে দলে ঢুকালেই সমস্যার সমাধান হবেনা; মানে বদলি খেলোয়াড়টিও আশরাফুলের-কাছে-সবার -যে-প্রত্যাশা (যেমন আমার ছিলো, সিরিজে অন্ততঃ ৩৫ এ্যাভারেজে একটা হাফ বা ফুল সেঞ্চুরী করা) সেটা পূরণ করতে পারবেনা। তারপরও এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে ৪ বা ৫ নং পজিশন আটকে রাখার মতো যোগ্যতা আশরাফুলের আর কোনভাবেই নেই। বাংলাদেশ দলের লাইনআপ যেমন হওয়া উচিত এখন একটু বাংলাদেশ দলের লাইনআপ কেমন হওয়া উচিত দেখি -- রকিবুল, মেহরাব আর সাকিবকে দিয়ে ৩, ৪, ৫ এ নিয়মিত খেলানোর চিন্তা শুরু করা উচিত এখনই, সাকিবের মেজাজ যদিও এখনও পরিণত না, তাও নিজেকে গড়ে তোলার লম্বা সুযোগ পাবার দাবী সে রাখে।

এ তিনজনের কেউ ব্যর্থ হলে মুশফিককে উপরে উঠিয়ে আনা যায়। ওপেনার পজিশনে তামিম থাকবে, "তাউড়া বাড়ি"র খেলোয়াড় হলেও সব ম্যাচেই মোটামুটি ২০এর কাছাকাছি বা এর উপরে একটা স্কোর করে তবেই সে আউট হয়, যেটাকে এখনকার দলের পরিস্থিতিতে "ভালোই" বলতে হবে। তামিমের সাথে "ফি সাবিলিল্লাহ" হিসেবে জুনায়েদ/শাহরিয়ার নাফিস/ইমরুলকে রাখতে হবে হয়তো, যদিও এদের কাউকেই কখনই টেস্ট ব্যাটসম্যান মনে হয়না। ৬,৭ এ অবধারিতভাবে আসে মুশফিক (ঠান্ডা মেজাজ প্রমাণিত) আর মাহমুদুল্লাহ -- এই ছেলে ব্যাটিংয়েও ভালো করবে, ফার্স্ট ক্লাস এ্যাভারেজ অন্যদের তুলনায় বেশ ভালো। ৮/৯ এও অবধারিতভাবেই নাঈম/মাশরাফি; স্পেশালিস্ট বোলার বেশী দরকার হলে হয়তো নাঈমকে বসিয়ে বাড়তি বোলার নেয়া যেতে পারে।

১০/১১ তে দুজন স্পেশালিস্ট বোলার থাকবে -- বর্তমানের শাহাদাৎ/রাসেল/রুবেল/এনামুল/রাজ্জাককে যথেষ্ট পরিণত মনে হয়, তবে এর চেয়েও ভালো কেউ আসলে "সারভাইভল অভ দ্য ফিটেস্ট" থিওরী কাজ করবে। স্পিনার বা পেসারের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী এই ব্যাংক থেকে ১০/১১ তে প্লেয়ার নেয়া যাবে। আশরাফুলের সম্ভাবনা বা ফিউচার: কাজেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, দলে থাকতে হলে আশরাফুলের স্পেশালিস্ট বোলার হিসাবে নিজেকে গড়েপিটে তোলা ছাড়া আর কোন গতি নেই। স্পিনে সে সেটা হতে পারে নাই আজ দশ-বারো বছর, তাই বেচারার শেষ ভরসা ফাস্ট বোলিং প্র্যাকটিস। এতে অবশ্য তার অধুনা স্ফীতিপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক পরিশোধন হবে বলা আশা করা যায়।

অবশ্য এবারের উইন্ডিজ সিরিজের পরিসংখ্যানে দেখা গেলো যে আশরাফুলের নাম উপরের দিকে আছে মাত্র দুটো জায়গায়। একটি হলো বোলিং স্ট্রাইক রেটে (অর্থাৎ, গড়ে উইকেট প্রতি কত বল করতে হয়েছে বোলারকে) আর আরেকটি হলো ক্যাচে -- দূ' দুটো ক্যাচ ধরেছে সে। বোলিং স্ট্রাইক রেট ভালো হবার অবশ্য অন্য কারণ আছে। আশরাফুল রেগুলার বোলার না, ব্রেক থ্রুর জন্য অল্প কয়েক ওভার কাজে লাগানো হয়েছে তাকে, সেই অল্প কয়েক ওভারেই একটি করে উইকেট পেয়ে পরিসংখ্যানের বিচারে উপরে চলে এসেছে সে। এটা কিছুদিন আগে প্রচলিত হয়ে আবার বাতিল হয়ে যাওয়া নিয়ম, মানে সেই দ্বাদশ খেলোয়াড়ের (ব্যাটিং লাইনআপ থেকে একজনকে বদলায়ে বোলার নেয়া যাবে) ক্যাটেগরীতে খুব ভালো ম্যাচ করতো।

আশরাফুলের কপাল খারাপ, সেই নিয়ম বাতিল হওয়ায় এই ক্যাটেগরীতেও তার দলে থাকার আর সুযোগ থাকলোনা। বাকী থাকে ফিল্ডার পজিশন, সে উদ্দেশ্যে দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে আশরাফুলকে দলে রেখে "ঝিকে মেরে বউকে শেখানো"র কাজে ব্যবহার করা যায়। কিভাবে সেটা হয়তো ব্যাখ্যা করার দরকার নেই, তাও বলি, ভাবতে চেষ্টা করুন যে প্যাভিলিয়নে শুকনা মুখে ব্যাটসম্যানদেরকে প্যাড-গ্লাভস-গার্ড এগিয়ে দেয়া আশরাফুলকে দেখে বাকীরা বুঝে নিবে যে "পারফর্ম না করলে আশুর মতো প্লেয়ারের যখন এই দশা হইতারে, তখন আমগোর ...." আরো কিছু উপায় অবশ্য আছে আশরাফুলের। যেমন, আমাদের বর্তমান উইকেট কীপারটির গলায় বেশ জোর থাকলেও উইকেটের পেছনের কাজের পটুতা নিয়ে তার গলার জোরের সমানুপাতেই বদনাম আছে। ধীমান ঘোষ আইসিএল কলঙ্কে কলঙ্কিনী(!) না হলে হয়তো আশরাফুলের এই সুযোগটাও যেতো -- তাও যেহেতু সুযোগটা আছেই তাই সে উইকেট কীপিং শেখাতেও মনোযোগ দিতে পারে।

রাহুল দ্রাবিড় পেরে গেছে, আশরাফুল তো কোন ছার্! আর সবশেষ উপায় হলো, তাবিজ-তুমার করে দুচারজন ব্যাটসম্যানের ইনজুরির অপেক্ষায় থাকা, দুধভাত হিসেবে যদি সুযোগ মেলে! নাহ, বেচারাকে আর নিচে নামাইনা। আসল কথা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সি টীমের সাথে জেতায় মন ভরেনি, তাই উপরে মূলতঃ মজা করেই এটা সেটা লিখলাম। আশরাফুলের খেলা দেখে একসময় মুগ্ধ হয়েছিলাম, কম্পিউটারের ওয়ালপেপারে "অন ষ্ট্রাইক আশু"কে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম বলেই হয়তো আজ এই মজা করার অধিকারটুকু নেয়া। মজা তো অনেক হলো, এখন বেচারা আশরাফুলকে নিয়ে একটু সিরিয়াসলি ভাবার চেষ্টা করি। আমার মতে এখন বড়জোর ৬ বা ৭ নম্বর পজিশনে কিছুদিন খেলতে দিয়ে নিজেকে প্রমাণের একটা সুযোগ আপাততঃ দেয়া যেতে পারে আশরাফুলকে।

যে খেলোয়াড়ের সারা ক্যারিয়ারের কোথাও কনসিস্টেন্সী বলে কিছু নেই তাকে দিয়ে ৪ নং পজিশনের কাফফারা আর কতকাল টানবে দল? এই পজিশনে দলের সবচেয়ে রিলায়েবল ব্যাটসম্যানটি খেলে থাকেন, যিনি টপ অর্ডারের ব্যর্থতার ধকল যেমন সামলাতে পারেন, তেমনি টপ অর্ডারের গড়ে দেয়া পাহাড়কে পর্বত বানিয়েও ছাড়তে পারেন। আশরাফুলের সেই গুণ কোনকালেই ছিলোনা। তার সব কীর্তিই দৈব, উপরদিকে তাকিয়ে ক্রমাগত দুরূদ পড়ার ফল বলা যেতে পারে বড়জোর। তবে তার স্ট্রোক এখনও বাংলাদেশ দলের আর যে কোন খেলোয়াড়ের চেয়ে ভালো, এটা স্বীকার করতে কোন আপত্তি আমার নেই। কিন্তু তার জন্য আরো বেশী দরকার হলো ধৈর্য্যের সাথে ক্রিজে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন, বল বাই বল দেখে খেলার যোগ্যতা অর্জন, যেটা সে কখনই আয়ত্ত করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে।

অন্ততঃ টেস্ট ক্রিকেটে এই গুণটি যে সুন্দর স্ট্রোকের চেয়ে অনেক বেশী প্রয়োজনীয় সেটা যে কেউ বোঝে। আশরাফুল নিজেও যে সেটা বুঝেছে তা প্রমাণের মাধ্যমেই কেবল টেস্ট ক্রিকেটে তার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। বেশী বেঁধে দিচ্ছিনা, আগামী পাঁচটা টেস্টের দশটি ইনিংসের অন্ততঃ পাঁচটিতে শতাধিক বলের ইনিংস (রান ১০০ বলে ১ রান হলেও অসুবিধা নেই) যদি সে খেলতে পারে তাহলেই হয়তো কেবল সে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে পারে বলে মনে করবো। তা না হলে আইপিএলে বাংলাদেশী দর্শক টানার "টুলকিট"হিসেবে ব্যবহার হওয়াই হয়তো তার সর্বশেষ নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.