আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিজ্ঞানের জয়, মানবতার পরাজয়



বিজ্ঞানের জয়, মানবতার পরাজয় ফকির ইলিয়াস ======================================== বুজ অলড্রিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা স্থাপন করলেন চাঁদের বুকে। রচিত হয়ে গেলো নতুন এক ইতিহাস। দিনটি ছিল ২০ জুলাই ১৯৬৯। পেরিয়ে গেছে চল্লিশ বছর। তিন মার্কিন নাগরিক পা রেখেছিলেন চাঁদের পাথরে।

এরা হলেন নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও বুজ অলড্রিন। তিনজনই জীবিত আছেন। ঘটা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিত হলো চন্দ্রগমনের চল্লিশ বছর। এই তিন মহানায়ক আবার শিরোনাম হলেন মিডিয়ার। তারা বললেন তাদের ভালো লাগার কথা।

তাদের অভিজ্ঞতার কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ১৯৬৯ সালে চাঁদে এ্যাপোলো-১১ প্রেরণ করে তখন বিশ্বের প্রেক্ষপট ছিল ভিন্ন। রাশিয়া ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিপক্ষ। এ্যাস্ট্রোনোমি নিয়ে ছিল ব্যাপক প্রতিযোগিতা। সে অবস্থা এখন আর নেই।

সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। বিশ্বে সমাজতন্ত্রের অস্তিত্ব বেঁচে আছে নিভু নিভু প্রদীপের মতো। এ্যাপোলো-১১ প্রেরণে সে সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়ে ছিল সাড়ে তিনশ মিলিয়ন ডলার। সেই স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে নীল আর্মস্ট্রং (৭৮) বলেন, পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, আমরা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বিজ্ঞানের একটি নীরবতা ভাঙতে পেরেছিলাম। জ্যোতির্ময় আলো বিশ্লেষণের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

আটাত্তর বছর বয়সী মাইকেল কলিন্স বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, আমরা যে কাজটি শুরু করেছিলাম, তা শেষ হয়নি। মানব কল্যাণের প্রয়োজনে সকল ইতিবাচক সমীক্ষা অব্যাহত থাকা দরকার। ঊনআশি বছর বয়সের অন্য নভোচারী বুজ অলড্রিন বলেছেন, চাঁদ পৃষ্ঠে নেমে আমাকে খুব বোরিং ফিল করতে হয়েছিল। সেখান থেকে আকাশকে কালো মনে হয়।

আর পেছনের অবজেক্ট ছিল সূর্য। তিনি বলেন, নতুন কিছু স্পর্শ করার আনন্দই আলাদা। ‘ম্যান অন দ্য মুন’ ইতিহাসটি ছিল বিশ্ব কাঁপানো। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে হাজার হাজার দর্শক সেদিন তিনটি বড় বড় টিভিতে অবলোকন করেছিলেন তিনটি টিভি চ্যানেলের প্রচারা পর্ব। ১৬ জুলাই ১৯৬৯, এ্যাপোলো-১১ যখন পৃথিবী ছেড়ে যায় তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট স্পিরো এগনো দৃশ্যটি অবলোকন করেছিলেন ফ্লোরিডার স্পেস সেন্টার থেকে।

‘নাসা’র জন্ম হয় ২৯ জুলাই ১৯৫৮ সালে। প্রতিযোগিতায় রাশিয়া ছিল এগিয়ে। তারা ১২ এপ্রিল ১৯৬১ সালে মহাশূন্যে প্রেরণ করে ইউরি গেগারিনকে। তারপর ‘নাসা’ চন্দ্রে মানব প্রেরণকে মুখ্য বিষয় করে ব্যাপক গবেষণা চালাতে থাকে। ২০ ফেব্র“য়ারি ১৯৬২ সালে জন গ্লেন নামক প্রথম কোনো আমেরিকান মহাশূন্যে গমন করেন।

২৭ জানুয়ারি ১৯৬৭ সালে তিনজন নভোচারী কেপ কার্নিভালে অগ্নি দুর্ঘটনায় মারা যান। এই দুর্ঘটনা ‘নাসা’ কে শঙ্কিত করে তুললেও গবেষণা থেমে থাকেনি। এরপর আসে সেই প্রতীক্ষিত দিন ২০ জুলাই ১৯৬৯। যেদিন চাঁদে অবতরণ করে মানব সন্তান। মহাকাশ নিয়ে মানুষের গবেষণা এবং নিরীক্ষণ চলছেই।

এই যে সকল আয়োজন, এই যে সকল প্রচেষ্টা এর মূল উদ্দেশ্য কী? মূল উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, মানবজাতি, মানবগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধন। পরিবর্তিত বিশ্বে তা কতোটুকু সফল হয়েছে? কতোটুকু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে মানুষ? এই প্রশ্নটি আমি বিশিষ্টজনকে করি সুযোগ পেলেই। আজ আমার মনে পড়ছে তেমন একটি দিনের কথা। আশির দশকে একটি বিকেলে তেমনি একটি ঘরোয়া আড্ডায় এই প্রশ্নটি করেছিলাম নারীনেত্রী, প্রজ্ঞাবতী, সমাজসেবিকা শ্রীমতি হেনা দাসকে। আজ তাঁকে মনে পড়ছে, সেই প্রাসঙ্গিক বিষয়টি আসায়।

মানুষের কল্যাণে বুর্জোয়া দেশগুলোর ভূমিকা কী হতে পারেÑ প্রশ্নটি করার সঙ্গে সঙ্গেই হেসে দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন ‘তারা চন্দ্র বিজয়ের কৃতিত্ব দাবি করছে অথচ মানুষের মন জয় করার চেষ্টাটুকুন পর্যন্ত করছে না’। তিনি বলেছিলেন, এগুলো নেহায়েত লোক দেখানো বাণিজ্য ছাড়া কিছু নয়। কারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করতে হলে মানুষের সুখ-দুঃখ বুঝতে হবে। লেফাফা দুরস্ত হয়ে বিশ্বে শান্তির পতাকা উড়ানো সম্ভব নয়।

আগে ভণ্ডামি বাদ দিতে হবে। শ্রীমতি হেনা দাস সম্প্রতি প্রয়াত হলেন। তাঁর সেই বাণীগুলো আমার কানে বাজছে। সিলেটের সেই আড্ডাটির স্মৃতি স্মরণ করে তাঁর আত্মার পরম শান্তি কামনা করছি। শুধু হেনা দাসই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের তৃণমূল পর্যায়ে এমন অনেক নেতাই আছেন যারা জানেন এবং বুঝেন বিশ্বে গণমানুষের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায় কী।

ধরা যাক আফ্রিকার মহান পুরুষ নেলসন ম্যান্ডেলার কথাই। নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন গোয়েন্দাদের তালিকায় ‘ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী’ বলেই তালিকাভুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি যে বিশ্বের গণমানুষের মুক্তি আন্দোলনে অবিসংবাদিত নেতা- তা সময়ই প্রমাণ করেছে সুদৃঢ়ভাবে। বিশ্বে, পরাশক্তিগুলোর চক্ষুশূল বিবেচিত অনেক নেতা এখনো আছেন, যারা তাদের সৃজনশীল মননশক্তি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কাজে লাগাতে পারছেন না। বিশ্বে আজ যারা ‘শান্তিবাদী’ বলে নিজেদের পরিচয় দেয় তারা আসলে কতোটা শান্তিকামী? এই প্রশ্নটি বারবার উত্থাপন করা যায়।

বিভিন্নভাবে উত্থাপন করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি অন্যতম প্রভাবশালী টিভি মিডিয়া এনবিসি। এদের মালিকরা প্রধান ব্যবসায়ী হিসেবে অস্ত্র প্রস্তুতকারী। মিডিয়া তাদের কাছে একটি ঢাল মাত্র। আমার খুব হাসি পায়, যখন দেখি সেই এনবিসি চ্যানেলেই শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে মার্কিনি বুদ্ধিজীবীরা কথামালার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন।

যারা অস্ত্র ব্যবসাকেই মুখ্য হিসেবে ধারণ করে, তারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আসলে কতোটা আন্তরিক? যুদ্ধ না চললে অস্ত্র বিক্রি হবে কিভাবে? এমনি একটি গোলকধাঁধায় চলছে আমাদের গোলাকার পৃথিবী। আমরা দেখছি অনেক কিছুই। কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। কোনো প্রতিবাদ করতে পারছি না। অন্যদিকে মৌলবাদী জঙ্গিদের প্রসার আরো অশান্ত করে তুলছে বিশ্বের নানা রাষ্ট্রভূমি।

অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এমনি একটি শঙ্কা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই আলোচনার বিষয় ‘হিজব-উত তাহরীর’ নামের একটি জঙ্গিবাদী জিহাদি সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তালিকায়, হিজব-উত-তাহরীর নামের সংগঠনটি সন্দেহভাজন টেরর তালিকায় নেই। সম্প্রতি এই সংগঠনটি শিকাগোর একটি বিলাসবহুল হোটেলে ‘দ্যা ফল অব ক্যাপিটেলিজম এন্ড রাইজ অব ইসলাম’ নামে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। এই সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী বক্তব্য গোয়েন্দাদের নজরে পড়ে।

এরপর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর জানা যায় হিজব-উত-তাহরীর জিহাদিজম প্রতিষ্ঠার একটি পুরোনো ও শক্তিশালী সংগঠন। যারা যুক্তরাষ্ট্রে মূলত তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করে কাজ করছে। তারা মুসলিম প্রজন্মকে জিহাদি দীক্ষায় দীক্ষিত করছে। জানা যাচ্ছে, এরা মূলত আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন হিসেবেই বিশ্বে কাজ করছে। মানুষ চন্দ্র বিজয় করেছে।

কিন্তু বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় খুব একটা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পেরেছে- তা বলা যাবে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিশ্বে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাপট। এই দাপট দেখাতে গিয়ে চরম স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে বৃহৎ শক্তিগুলো। মনে পড়ছে বুশ প্রশাসন ইরাক আক্রমণ করার আগে নিউইয়র্ক টাইমস-এ জুডিথ মিলার নামের একজন সাংবাদিক ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেন। সে প্রতিবেদনে তিনি বারবার বলার চেষ্টা করেন ইরাকে মারাত্মক পরমাণু অস্ত্র রয়েছে।

সে যুদ্ধ এখনো চলছে। কিন্তু ইরাকের কোথাও মারাত্মক পরমাণু অস্ত্রের কোনো অস্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছে কি? না, পায়নি। তা হলে এই যুদ্ধ কি খুব অপরিহার্য ছিল? বিশ্বে বিজ্ঞানের জয় হচ্ছে। আর পরাজিত হচ্ছে মানবতা। অথচ বিজ্ঞান আবিষ্কৃত হয়েছিল মানুষের জন্য, মানুষের দ্বারা।

মানবতা, শান্তি ও সৌহার্দ্যরে বিজয় সুনিশ্চিত করা না গেলে, কিছুই মানুষের উপকারে আসবে না। নিউইয়র্ক/২২ জুলাই ২০০৯ --------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। ২৫ জুলাই ২২০৯ শনিবার প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.