আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিউইয়র্কে এবিসি কনভেনশন ও সাহিত্য-সংস্কৃতির অভিবাস



নিউইয়র্কে এবিসি কনভেনশন ও সাহিত্য-সংস্কৃতির অভিবাস ফকির ইলিয়াস ======================================== নিউইয়র্কে আমেরিকা বাংলাদেশ কানাডা (এবিসি) সম্মেলন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গেই সম্পন্ন হলো। ১১ ও ১২ জুলাই নিউইয়র্কের মেরি লুইস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলন। সম্মেলনটির প্রধান বার্তা ছিল, ‘ভালোবাসার আবাস হৃদয়ে বাংলাদেশ’। সম্মেলনে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে ছুটে এসেছিলেন শত শত অভিবাসী। এসেছিলেন গুণীজনরা বাংলাদেশ ও ভারত থেকেও।

মানুষ পরিবর্তন চায়। প্রজন্ম চায় নতুন সূর্যের আলো। এরই বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে এবারের এই সম্মেলনটি নতুনের দিকনির্দেশনা দিতে সমর্থ হয়েছে, সন্দেহ নেই। সম্মেলনে সেমিনারগুলো ছিল বেশ আকর্ষণীয়। দুদিনে মোট সাতটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

এগুলোর বিষয় ছিল- ১. অভিবাসীদের ব্যবসা, সংকট ও সম্ভাবনা, ২. অভিবাসী সমাজ গঠনে সংগঠনের ভূমিকা ও নেতৃত্বের দায় ৩. দ্যা নিউ জেনারেশন এন্ড ফিউচার লিডারশিপ (নতুন প্রজন্মের জন্য ইংরেজিতে) ৪. প্রবাসে রাজনীতি : স্বদেশের না মূলধারার ৫. পারিবারিক মূল্যবোধ : সংকট ও উত্তরণের উপায় ৬. কম্যুনিটি বিকাশে গণমাধ্যমের ভূমিকা ৭. অভিবাসে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ধারা। একটি আগুয়ান সমাজে বহুভাষিক, বহুজাতিক মানুষের বিচরণ সর্বকালেই ছিল। এই বসবাসের ব্যাপ্তি ঘটছে ক্রমশ। বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকায় কোনো বাঙালি প্রজন্ম শুদ্ধ করে বাংলা বলতে-পড়তে পারলেই বেশি গর্ববোধ করে। গর্বিত হন সেই সন্তানের মা-বাবাও।

আর বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, সে তো মূলত শিকড়েরই সন্ধান। ‘অভিবাসে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ধারা’ এই প্রাণবন্ত সেমিনারটি সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। সেমিনারে সম্মানিত অতিথি ছিলেন- বাংলা সাহিত্যের বেশ কজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। সুনীল গঙ্গোপাথ্যায় কিংবা সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে এর আগে সাহিত্য আড্ডা যদিও বেশ কবার দিয়েছি- কিন্তু তাদেরকে কোনো সেমিনারে মুখ্য অতিথি করার আনন্দ ছিল আমার জীবনের বাড়তি পাওনা। সেমিনারটিতে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত আরো তিনজন লেখক-লেখিকা।

অধ্যাপক আলী আনোয়ার, দিলারা হাশেম ও মোজাম্মেল হোসেন মিন্টু। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করলেন, যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী একজন ধ্যানী ঔপন্যাসিক-গল্পকার ফেরদৌস সাজেদীন। তারপর শুরু হলো আলোচনা। প্রথম পর্বে আলোচনায় অংশ নিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী খুরশীদ আলম সেলিম, রস সাহিত্যিক আবু লিয়াকত হোসেন। কবি তমিজ উদ্দীন লোদী তার সারগর্ভ আলোচনায় তুলে আনলেন ষাটের দশকে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাস জীবনের কথা।

বললেন এই অভিবাস থেকেই নির্মিত হবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সৃজনকর্ম কোনো একদিন। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান পরিচালক গৌতম ঘোষ দুই বাংলার উদ্যোগে বৃহৎ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালাবার প্রচেষ্টার কথা বললেন। বললেন, এ জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রজন্মকে জানাতে হবে, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা। আলোচকের বক্তব্যে বাংলাদেশ থেকে আগত কবি ড. মোহাম্মদ সামাদ জানালেন বাংলা কবিতা নিয়ে তার প্রত্যয়ের কথা।

তিনি বললেন, যে দেশের রাজনীতি যতো পরিশুদ্ধ সে দেশের সাহিত্য ততোই বলিষ্ঠ। আর নির্মল সাহিত্য চর্চার জন্য চাই বিশুদ্ধ মনন। এই সেমিনারটি এতোই নন্দিত হয়েছিল যে, প্রায় সবাইকে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দিতে পারলে আমার ভালোই লাগতো মডারেটর হিসেবে। কিন্তু সময়ের তাড়া ছিল। ফলে সংক্ষিপ্ত করার দিকেই এগুতে হয় আমাকে।

উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্ক বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল শামসুল হক। তাকে সবিনয়ে প্রশ্ন করলাম- প্রবাসে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট কী ভূমিকা রাখছে? তিনি বেশ আশার বাণী শোনালেন। বললেন, যুক্তরাষ্ট্রে যৌথ উদ্যোগে ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ নামে কালচারাল নাইট উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দূতাবাস। কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে তারা তা করবেন। বিদেশে সরকারি উদ্যোগে এমন আয়োজন আশাব্যঞ্জক তো বটেই।

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন, মহান মুক্তিযোদ্ধা অন্যতম সংগঠক সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আজিজুর রহমান। তার কাছে সবিনয়ে প্রশ্ন রাখলাম, প্রবাসে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে পরামর্শ কী? তিনি বললেন, সেই বাহাত্তরের সংবিধানের কথা। যে সংবিধান দলমত নির্বিশেষে, জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালি মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করেছিল। প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে সকলকেই সঠিক ইতিহাস চর্চার অনুরোধ করেন তিনি। সেমিনারে সাপ্তাহিক ঠিকানার সাহিত্য সম্পাদক আলহাজ শামসুল হক প্রবাসী লেখকদের লেখায় স্বদেশ প্রেমের প্রশংসা করেন।

লেখক মোজাম্মেল হোসেন মিন্টু লেখকের প্রতিকূলতা ও পথচলা বিষয়ে তুলে ধরেন তার অভিজ্ঞতা। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন জার্মানি প্রবাসী লেখিকা নাজমুন নেসা পিয়ারী। তিনি বলেন প্রবাসী লেখকরা ভালো অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারেন। এরপর আলোচনার শেষ পর্বে অংশ নেন অধ্যাপক আলী আনোয়ার, দিলারা হাশেম, সমরেশ মজুমদার ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অধ্যাপক আলী আনোয়ার বলেন, রাজনীতিকরা মিথ্যা অঙ্গীকার করে মানুষকে কাবু করার চেষ্টা করেন।

লেখকরা তা পারেন না। কারণ তারা যা করেন তা কাগজে কলমে। তাই প্রমাণ থেকে যায়। কোনো ভ্রান্তি হলেও তা ধরা পড়ার সুযোগ থাকে মানুষের কাছে। ‘ঘর-মন-জানালা’ উপন্যাস খ্যাত দিলারা হাশেম তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন প্রবাসে সাহিত্য চর্চার আলোকে।

তিনি বলেন, প্রচুর অধ্যাবসায় করলে এখানে ভালো লেখা ও ভালো লেখকের অনেক উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বিশিষ্ট কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার বলেন, রাজনীতি ছাড়া সাহিত্য হয় না। প্রবাসের গদ্য ও উপন্যাস এখনো একটা লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছতে পারেনি। কিছু ভালো কবি কবিতা লিখছেন। তবে প্রবাসী লেখকদেরকে পেশাধার লেখক হিসেবে দাঁড়াতে হবে।

একজন পত্রিকা মালিক অন্যান্য সবক্ষেত্রে অর্থ খরচ করবেন আর লেখককে সম্মানী দেবেন না তা মানা যায় না। এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। সমরেশ মজুমদার বলেন, প্রবাসী লেখকরা যদি অর্থমূল্য পেয়ে লেখেন তবে তাদের লেখার মানও বেড়ে যাবে। কারণ তখন প্রতিযোগিতা বাড়বে। লেখকরা বিভিন্ন নতুন নতুন উপাত্ত নিয়ে লেখার সুযোগ খুঁজবেন।

সমরেশ মজুমদারের কথার সঙ্গে প্রায় কণ্ঠ মিলালেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। বললেন, প্রবাসে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সংকট থাকবেই। তা একদিনে সমাধান করা যাবে না। তিনি বলেন, ষাটের দশকে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাই তখনকার আমেরিকা আর আজকের আমেরিকা এক নয়। তখন অনেক খুঁজেও একজন বাঙালির দেখা পাওয়া যেতো না।

এখন শুধু নিউইয়র্কেই বাঙালির সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, প্রবাসে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পেছনে ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটির ভূমিকা অপরিসীম। এই স্বাধীন রাষ্ট্রটি জন্মলাভ করেছিল বলেই আজ বিশ্বে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালির ঐতিহ্য এতো ছড়িয়ে পড়েছে। জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপধ্যায় মূল প্রবন্ধ পাঠক ফেরদৌস সাজেদীনের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ভাষার সংকট কাটাতে হলে মনের সংকট কাটাতে হবে।

আমাদেরকে প্রকৃত সাহিত্য রসের বাঙালিয়ানা পৌঁছে দিতে হবে প্রজন্মের কাছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, প্রবাসে পেশাদার লেখকগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সকলের সম্মিলিত ঐক্য প্রয়োজন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যে বিদেশে বাংলা বইয়ের প্রকাশনী গড়ে উঠবে, আমি সেই স্বপ্ন দেখি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবিসি সম্মেলন আয়োজকদের প্রশংসা করে বলেন, এই যে মিলনমেলার উদ্যোগ, সেটাই সাংস্কৃতিক সংহতি সুদৃঢ় করে। এই সেমিনারে অন্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সহধমির্ণী স্বাথী গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা বইমেলার সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. আফসারুল কাদের, সাবেক রাষ্ট্রদূত রফিক আহমদ খান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশাহ, বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য সচিব শেখ আলতাফ আলীসহ প্রবাসের অনেক বিশিষ্টজনরা।

প্রায় পৌনে দুঘণ্টাব্যাপী সেমিনারটির শেষ পর্যায়ে এসে আমার বারবার মনে হয়েছে, যদি আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়া যেতো। কিন্তু সে সময় ছিল না। দর্শক শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে ছিলেন নাচ-গান উপভোগ করার জন্য। দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট শিল্পীরা নিচ্ছিলেন প্রস্তুতি। ভিন দেশে, ভিন আবহে বাংলা ভাষা, বাংলা কৃষ্টি লালনের প্রত্যয় খুব সহজ কথা নয়।

অভিবাসী অঙ্গনে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা আর শ্যামল মাটির ঐতিহ্য যারা আঁকড়ে রেখেছেন, তারা সত্যিই পালন করছেন গুরুদায়িত্ব। এই দায়িত্ব নির্মাণের। এই দায়িত্ব সমন্বয়ের। প্রথম এবিসি কনভেনশনের কনভেনরের দায়িত্বে ছিলেন প্রবাসের বিশিষ্ট সংগঠক লেখক, সাপ্তাহিক ঠিকানার প্রেসিডেন্ট সাঈদ-উর রব। তার দক্ষতার সঙ্গে সার্বিক পরিচালনা অভিবাসী সমাজ দীর্ঘদিন মনে রাখবে।

আর সেমিনারগুলোর চেয়ারপারসনের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম। তিনিও ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। রংবেরংয়ের পতাকা খচিত মেরি লুইস একাডেমি থেকে যখন বেরিয়ে আসছিলাম তখনো সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। যে ভালোবাসা কখনোই শেষ হওয়ার নয়। ১৬ জুলাই, ২০০৯ -------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ ।

ঢাকা। ১৮ জুলাই ২০০৯ শনিবার প্রকাশিত ছবিতে- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , মিথুন আহমেদ, মোহাম্মদ সামাদ, সমরেশ মজুমদার, ফকির ইলিয়াস ও ত্রিদিব চট্টপাধ্যায়

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.